#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৮||
১২।
কলিংবেলের শব্দ শুনে শশব্যস্ততা নিয়ে ছুটে এলেন মুনিয়া খালা। দরজা খুলতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো চার বছর আগের সেই প্রিয় মুখখানা। মুনিয়া খালা অতি আনন্দে খাবি খাওয়ার উপক্রম। আহি ব্যাগপত্র টেনে ঢুকাতে গেলে তিনি চেঁচিয়ে চুনিকে ডাকলেন।
“চুনি, ও চুনি। তাড়াতাড়ি আয়। দেখ, দেখ কে আইছে। আমাদের ছোড আফামণি আইছে।”
মুনিয়া খালা চুনিকে ডাকতে ডাকতেই নিজে এগিয়ে এসে আহির ব্যাগপত্র তার হাত থেকে টেনে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকাতে লাগলেন। আহি মুনিয়া খালার উৎকন্ঠা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। জগৎ সংসারে রাদ ব্যতীত তার জন্য উৎকন্ঠিত হওয়া মানুষ আরো একজন আছে দেখে তার মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। মুনিয়া খালা ব্যাগপত্র ঢুকাতে ঢুকাতেই দ্বিতীয় তলা থেকে নুপুরের রুনঝুন শব্দ ভেসে এলো। আহি ঘাড় কাত করে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির দিকে তাকাতেই মুনিয়া খালা এক গাল হেসে বললেন,
“চুনি আইতাছে আফা। মাইয়াডা বড্ড বেয়াদব। কোনহান থেইকা ঝুনঝুনি ঝুলানো কি যে ফইরা থাহে। সারাদিন ঘরে ঝুনঝুনি বাজে।”
আহি মুনিয়া খালার কথায় বিস্তর হাসলো। একটু পরই চুনি নেমে এলো। চুনিকে দেখে আহি মুগ্ধ হলো। মেয়েটাকে শেষবার যখন দেখেছিল, তখন তার বয়স চৌদ্দ ছুঁইছুঁই। আর এখন সদ্য তারুণ্যের স্পর্শ তার সর্বাঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে। কোমল মুখটা আরো উজ্জ্বল হয়ে গেছে। ঠোঁটে হাসির রেশ বেশ স্পষ্ট। কাপড়চোপড়েও সে যথেষ্ট যত্নবান মনে হচ্ছে। বেশ রুচিশীল পোশাক পরেছে চুনি।
আহি চুনিকে দেখে বলল, “কেমন আছো, চুনি?”
চুনি আহির কথা শুনে মুখটা কালো করে মায়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকালো। মুনিয়া খালা চোখ গরম করতেই চুনি মাথা নামিয়ে নিলো। আহি মুনিয়া খালার দিকে তাকাতেই তিনি আমতা-আমতা করে বললেন,
“ছোড আফা, কিছু মনে কইরো না। এই মাইয়া মেলা প্যাঁচাল করে। কি বলে চুনি ডাকলে তার কি জানি পাঞ্চার হইয়া যায়। কি কই এডারে?”
মুনিয়া খালা চুনির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ওই তুই ইংরাজিতে কি জানি কস?”
চুনি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “প্রেস্টিস।”
আহি চুনির কথায় মুখ চেপে হাসলো। মুনিয়া খালা বললেন,
“হ আফা, ওইডাই নাকি পাঞ্চার হইয়া যায়।”
চুনি লজ্জায় মাথাটা একেবারে নুইয়ে ফেলছিলো। আহি চুনির থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“তা প্রেস্টিজিয়াস তরুণীর কি নাম?”
চুনি ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে চোখ নামিয়ে বলল,
“আফা, আমার নাম চাঁদনি।”
“বাহ, কি সুন্দর নাম! একদম তোমার চেহারার মতো সুন্দর।”
চুনি বিষ্ময়ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আফা, আমি সুন্দর?”
“হ্যাঁ, ভীষণ সুন্দর।”
“আপনেও অনেক সুন্দর। এহন তো আগের থেইক্কা বেশি সুন্দর হইয়া গেছেন।”
আহি হাসলো। চুনি ব্যাগপত্র নিয়ে বলল,
“আফা, ব্যাগগুলা আমি আপনের রুমে রাইখা আসি।”
আহি মাথা নাড়লো। মুনিয়া খালা আহির হাত ছুঁয়ে দিয়ে বললেন,
“ছোড আফা, তুমি এহন আইছো ঘর আলো হইয়া গেছে। এতোদিন আঁধার ছিল।”
আহি মৃদু হেসে বলল,
“মোজাম্মেল চাচা কোথায়? উনাকে দেখলাম না!”
“কইয়ো না আফা, ম্যাডামরে নিয়া বাইরে গেছে। আর ম্যাডাম যে কি দৌঁড়ান দৌঁড়ায়। ঘরে বইয়াই থাহে না। কাল যে গেলো, এহনো আইলো না। রাত-বিরেতে বাইরে যায় গা। স্যার তো আন্ধা। তার দুনিয়ায় আছে খালি টাহা আর টাহা।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হঠাৎ আহির ফোন বেজে উঠতেই সে চকিত দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকালো। এরপর সে মুনিয়া খালার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“খালা, তুমি আজকে একটু ভালো কিছু রান্না করো। আমার এক ফ্রেন্ড আমার সাথে এসেছে। ও এখন একটা কাজে গেছে। রাতে আসবে।”
“ঠিক আছে আফা। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি এহন ম্যাডামের থেইক্কাও ভালো রাঁধি।”
(***)
আহির ফোনে আবার কল এলো। আহি গম্ভীরমুখে কলটা ধরলো। ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ ভেসে এলো।
“অদ্ভুত তো আহি! এতো বার কল দিচ্ছি, ধরছোই না।”
“মাত্র একবার দিয়েছেন। দ্বিতীয় বারেই ধরেছি।”
“ও, তাহলে তুমি আমার ফোনের হিসেব রাখছো?”
“এসব কথা বলার জন্য তো অবশ্যই আপনি কল দেন না। নিশ্চয় কোনো গুরুতর ব্যাপার আছে। যা বলার জন্য কল দিয়েছেন, তাই বলুন।”
নারী কণ্ঠটি তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো। আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি আমার সাথে যতোই বাজে ব্যবহার করবে, আমাকে তোমার সামনে ততোটাই ভয়ংকর রূপে দেখতে পাবে।”
আহি পাল্টা হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“আপনার যেই ভয়ংকর রূপ দেখেছি, তাতে আমার ধারণা হয়ে গেছে, আপনি কেমন। আরো কোনো রূপ দেখানো বাকি থাকলে দেখিয়ে দিন। আমি সহ্য করতে পারবো। আপনাকে সহ্য করতে আমি বাধ্য। বাধ্য না হলে আপনার স্থান আপনাকে দেখিয়ে দিতাম।”
“খুব শীঘ্রই তুমি তোমার স্থান দেখবে। ওয়েলকাম টু মাই ওয়ার্ল্ড, ডিয়ার ওয়াসিকা।”
(***)
চার বছর পর সেই চেনা-পরিচিত রুমে পা রাখলো আহি। ঘরটি ঠিক আগের মতোই আছে। দেয়ালে সেই রঙ, বিছানাটিও সেদিকেই বিছানো। পরিপাটি ঘরটির দেয়ালে বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটির দিকে চোখ পড়লো আহির। ছবিটির সামনে এসে দাঁড়াতেই চুনি বলল,
“আফা, তুমি যে ছবি আঁকছিলা, ওই ছবিগুলো ম্যাডাম ফেলাইয়া দিতে চাইছিলো। আম্মা ফেলাইতে দেয় নাই। তুমি যাওনের ফর, আম্মা ছবিগুলা দারোয়ান চাচারে দিয়া দিসে। চাচা ছবিগুলা গ্যারাজের পেছনে ছোড একখান ঘর আছে না,? ওইহানে রাখছে। তুমি কইলে, আমি এহনি সব নিয়া আসবো।”
আহি মৃদু হাসলো। চুনির দিকে তাকিয়ে বলল,
“থাকুক যেখানে আছে। ওসবে আমার আর কোনো অধিকার নেই।”
“কি কও আফা? তুমিই না ছবিগুলা আঁকছিলা?”
“চাঁদনি, তুমি এখন যাও। আমি ফ্রেশ হবো।”
চুনি দরজার কাছে এসে পেছন ফিরে বলল,
“আফা তুমি ইংরেজি দেশে ছিলা না?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “হুম।”
“আমারে ইংরেজি শিখাইবা? আমি এক আধখান বলতে পারি। হুনবা?”
আহি হালকা হেসে বলল,
“পরে শুনবো। সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনবো। তুমি এখন যাও।”
চুনি চলে যেতেই আহি দরজা আঁটকে দিলো। পেছন ফিরতেই আবার সেই ছবির দিকে চোখ পড়লো। বড় ফ্রেমে হাস্যোজ্জ্বল পদ্ম, লিনাশা, পুষ্প আর আহি। ছবিটির দিকে তাকাতেই তার চোখ ছলছল করে উঠলো। মনে পড়ে গেলো সেই দিনগুলোর কথা যেদিন তারা একসাথে ছিল। প্রতিদিন লিনাশার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, এক বেঞ্চে গাদাগাদি করে চারজনের বসা, ক্লাসে টিচারের উপস্থিতিতে তার চোখ ফাঁকি দিয়ে খাতায় লিখে গানের কলি খেলা, চারজনের সেই বৃষ্টি বিলাস, একজন বই না আনলে বাকিরা একসাথে শাস্তি ভাগ করে নেওয়া আর টিফিন ছুটিতে চারজনের ভাগাভাগি করে পদ্মের হাতে বানানো পিঠা খাওয়া। খুব চমৎকার সম্পর্ক ছিল তাদের। কিন্তু সব হুট করেই শেষ হয়ে গেলো।
আহি ছবিটা দেয়াল থেকে নামিয়ে একপাশে রেখে দিলো। ফেলা আসা মানুষগুলোকে সে আর তার জীবনে চায় না। তারা যেখানেই আছে, ভালোই আছে। শুধু ভালো নেই আহি।
(***)
ঘরের জানালাটা খুলে দিলো আহি। বিছানায় শুয়ে আগের মতোই চুলগুলো জানালা দিয়ে বের করে দিলো। ফ্যান ঘুরছে দ্রুত গতিতে। আহির দৃষ্টি সেদিকেই। পলকহীনভাবে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখের কোণে জল ভারী হলো। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে গিয়েও মুছলো না। থাক, কাঁদুক। তার কান্না করা উচিত। এই ঘরেই তো সে কান্নাকাটি করে স্বস্তি পায়। শেষবার এই ঘরের মেঝেতে বসে পাগলের মতো কেঁদেছিল সে। সবাই ভেবেছিল, সেটাই আহির প্রথম ও শেষ কান্না। কিন্তু সবাই ভুল ছিল। আহি এখনো কাঁদে। পার্থক্য শুধু এইটুকুই সেই অশ্রু এখন আর কেউ দেখে না। আহি তার ভেজা চোখ দু’টি বন্ধ করতেই তার চোখের সামনে ভেসে এলো কান্না ভেজা সেই প্রিয় মুখটি।
………………………..
মেঘলা আকাশ। মেঘেদের ঘর্ষণে গুড়ুম-গুড়ুম শব্দ হচ্ছে। আহি আকাশের দিকে তাকিয়ে চারুশিল্পের গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যদি গেট দিয়ে বের হতেই খুব জোরে বজ্রপাত হয় আর সেই বিদ্যুতের ঝলকানি তাকে ছাই করে দিয়ে যায়? সে শুনেছে বজ্রপাতের ফলে যেই পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়, তা দৈনন্দিন কাজের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুৎ শক্তির তুলনায় অনেক বেশি। বাসা-বাড়িতে সরবরাহ করা বৈদ্যুতিক খুঁটি ঠিক করতে গিয়ে কতো লোকের প্রাণ গেছে তার ইয়াত্তা নেই। আর বজ্রপাত তো তাকে ধরাশায়ী করে, একেবারে ছাই করে দেবে। সেই ভয়ে আহি গেট ধরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো মাঠের একপাশে বেঞ্চে বসে থাকা আফিফের দিকে। আফিফকে দেখে সে একটু অবাক হলো। সে ভেবেছিল, আফিফ চলে গেছে। কিন্তু সে তো মাঠের একপাশে বসে আছে। আহি মনে মনে ভাবলো,
“আজ বৃহস্পতিবার। আজ তো ওর বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু এভাবে এখানে বসে আছে কেন? বাসায় কি মায়ের বকা খেয়েছে নাকি?”
আহি গেট ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মাঠের কাছাকাছি গেলো। খোলা মাঠে বজ্রপাত হলে আহি মুহূর্তেই অক্কা পাবে, তবুও তার ভীতি আফিফকে দেখেই কেটে গেলো। আফিফ উদাস মুখে বেঞ্চে একা একা বসে আছে। তার দৃষ্টি মাটির দিকে। এভাবে মানুষ কখন বসে থাকে? যখন তার মন ভীষণ খারাপ হয়। আহি আফিফের কাছে যেতেই থমকে গেলো। দেখলো আফিফ তার শার্টের হাতা দিয়ে তার চোখ আড়াল করে রেখেছে। কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থাকার পর আফিফ হাত সরালো। পকেট থেকে মলিন রঙের একটা রুমাল বের করে চোখ-নাক মুছলো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। ধীর পায়ে বেঞ্চ থেকে উঠে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। আহি স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আর আফিফ তাকে অতিক্রম করে চলে গেলো। সেদিন বাসায় ফিরে প্রতিদিনের মতো আবার সেই ডায়েরী বের করে আহি লিখলো,
“কেন কেঁদেছো তুমি? কি এমন কষ্ট তোমার? আমাকে দিয়ে দাও তোমার কষ্ট। আমি আমার সুখগুলো তোমার সাথে ভাগ করে নেবো।”
এই লেখাটির পাশেই একটি স্কেচ করলো আহি।
খোলা মাঠে একটি বেঞ্চ। বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে একটি ছেলে।
………………………..
আহি বিছানা ছেড়ে উঠে সেই ডায়েরীটা বের করলো। তারপর পৃষ্ঠা উলটে সেই স্কেচটি খুঁজে বের করলো। লেখাটিতে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। ঠোঁটে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল,
“স্বার্থপর মানুষ, কষ্ট দিয়ে গেছো, আবার সুখটাও কেঁড়ে নিয়েছো।”
১৩।
ঘর থেকে বের হয়ে নিচে নামতেই রাদের মুখোমুখি বসা মানুষটিকে দেখে চমকে উঠলো আহি। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “বাবা!”
রিজওয়ান কবির আহিকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“বসো, বসো। তোমার বন্ধু এসেছে। কথা বলো ওর সাথে।”
আহি রিজওয়ান কবিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি আহিকে পাশ কেটে উপরে চলে গেলেন। আহি এক ধ্যানে সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। রাদ আহির হাত ধরে তাকে পাশে বসালো। আহি শুকনো হেসে বলল,
“লাবীবকে নিয়ে আসিস নি কেন?”
রাদ হেসে বলল,
“ভুলে গেছিস আংকেলকে কি মিথ্যে কথা বলেছিস? লাবীব কি এখানে নাকি? লাবীব তো ঢাকায়। বেচারা দাদা একবার মারা গিয়েছেন, তুই উনাকে দ্বিতীয় বার মারলি।”
“যাহ, রাদ। এসব কথা রাখ। চল খাবি।”
“তোর বাবা তার গুরুগম্ভীর কথায় আমার পেট ভরিয়ে দিয়েছে। আমি এখন যাই।”
“কি বলছিস? খালাকে বলেছি তোর জন্য রান্না করতে।”
“আহি, আমরা কাল দেখা করবো। তখন না হয় একসাথে খাওয়া-দাওয়া হবে। আংকেলকে বলিস আমার কাজ আছে।”
“বাবা তোকে কি বলেছে, বল?”
“এমন কিছু না। প্লিজ আমি যাই।”
রাদ আহির কাছ থেকে জোরপূর্বক বিদায় নিয়ে চলে গেলো। কিছু একটা যে হয়েছে তা আহি বুঝতে পারলো।
(***)
রাতে খাবারের টেবিলে একসাথে বসে আছে রিজওয়ান কবির আর আহি। মুনিয়া খালা নিঃশব্দে তাদের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। চুনি রান্নাঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে তাদের খাওয়া দেখছে। রিজওয়ান কবির আর আহি উঠলেই তারা খাওয়া-দাওয়া করবে। এটাই এই বাড়ির নিয়ম।
রিজওয়ান কবির হাতের ইশারায় মুনিয়া খালাকে সরে যেতে বললেন। মুনিয়া খালা এক নজর আহির দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। খালা চলে যেতেই রিজওয়ান কবির গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“আশা করি সেই ছেলের সাথে তোমার কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয় নি।”
রিজওয়ান কবিরের কথা শুনে আহির গলায় খাবার আটকে গেলে। রাগী দৃষ্টিতে সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসব কি বলছেন আপনি?”
“তোমার বন্ধু রাদের কথা বলছি। একসাথেই তো ছিলে।”
আহি খাবারের প্লেট ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
“আমরা শুধু বন্ধু। এমন নোংরা সম্পর্ক আমার কারো সাথেই নেই। আর নিজের মেয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? চার বছরে একবারো আপনি আমার খবর নিয়েছেন? আজ এতো বছর পর দেখা হয়েছে, আর আপনার ব্যবহার দেখে আমি হতাশ।”
আহির চোখে অশ্রু টলমল করতে লাগলো। মুনিয়া খালা রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে রেখেছেন। চুনি চাপা স্বরে মাকে বলল,
“এই ফেরাউন কহন মরবো, আম্মা?”
মুনিয়া খালা চোখ বড় বড় করে তাকাতেই চুনি চুপ হয়ে গেলো। এদিকে আহি নীরবে অশ্রু ফেলছে। আর রিজওয়ান কবির নীরবে খেয়ে যাচ্ছেন। খাওয়া শেষ হতেই তিনি আহির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তোমার বাবা। আমার এমন প্রশ্নে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজকাল ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এসব সাধারণ ব্যাপার। তুমি সত্যটা স্বীকার করলেও আমি তোমাকে শাস্তি দিতাম না। যাই হোক, তুমি এসেছো আমি তাজওয়ারকে বলেছি। ভালো হবে তুমি সেই ছেলের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে তাজওয়ারের সাথে সময় কাটাও।”
আহি ধরা কন্ঠে বললো,
“আমি আর রাদ বন্ধু। আপনি ভালো করেই জানেন ও আমার স্কুল ফ্রেন্ড। আমরা একসাথে পড়েছি। এর আগেও ও অনেকবার এই বাসায় এসেছে। রাদ আপনার দৃষ্টিতে নতুন কেউ নয়। আরেকটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি, আমি তাজওয়ারের সাথে সময় কাটাতে চাই না। ছেলেটা ভালো না, আর আপনি সেটা ভালো করেই জানেন। আপনি আমাকে বাধ্য করলে আমি….”
রিজওয়ান কবির আহিকে থামিয়ে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,
“তোমার মায়ের কবর খোঁড়ার কাজে দু’একজনকে লাগিয়ে দেই। কালকের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।”
আহি ভীত চোখে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। এরপর অনুরোধের সুরে বলল,
“মায়ের ক্ষতি করবেন না, প্লিজ।”
“তাহলে তুমি তাজওয়ারের সাথে সময় কাটানো শুরু করো।”
রিজওয়ান কবির আহির দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন,
“মনে রেখো, আমি কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছি এই প্রজেক্টে। আমার লাস্ট ইনভেস্টমেন্ট তুমি। তুমি যদি কাজেই না লাগো, তাহলে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি কেন?”
আহি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
“মেরেই ফেলুন না হয়। আমি ভীষণ খুশি হবো।”
“প্রফিট হাতছাড়া করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
(গল্পটার অতীত ব্যাখ্যা নিয়ে যদি কারো প্রবলেম হয় দুঃখিত। কিন্তু গল্পের অতীত উল্লেখ করার পেছনে নিশ্চয় কারণ আছে। মাত্র গল্প শুরু হইছে। এখনই যদি বলেন অতীত তাড়াতাড়ি শেষ করতে তাহলে গল্পের সৌন্দর্য হারায় যাবে। কার সাথে কার মিল হবে, এ নিয়ে পূর্ব ধারণা করে লাভ নেই। কারণ গল্প যে লিখতেছে সে ছাড়া এই পরিণতি কেউ জানার কথা না। আজকের পর্ব পড়ে সবার ধারণা হওয়া উচিত গল্পের কাহিনী শুধু ভালোবাসা না। অনেক কিছু। এন্ড বিষয়টা খুব জটিল। আমাকে ধৈর্য দিয়ে লিখতে দিন। আপনারাও ধৈর্য নিয়ে পড়ুন।)
চলবে-