উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-০৭||

0
419

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৭||

১১।
বাসের জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা এসে জমছে। আহি হাতটা বাইরে নিয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করতে যাবে তখনই রাদ তার হাত টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ বিরক্ত মুখে বলল,
“তোর কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে?”

আহি বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বললো,
“তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন?”

“তোর সাথে সুন্দর ভাবে কথা বলার মতো তো তুই কিছুই করছিস না। চলন্ত বাসে কেউ জানালার বাইরে বৃষ্টি ধরার জন্য হাত বের করে দেয়? এটা তো বোকামি।”

রাদ নিজের কপালে হালকা চাপড় মেরে বলল,
“কি যা-তা বলছি! বোকারাও এতো বোকা হয় না। কান্ড জ্ঞানহীনরাই এমন কাজ করে। যাদের হুশ জ্ঞান ভালো না, তারাই এমন ঢিলার মতো কাজ করে। আর তুই তো পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে যাওয়া পলস।”

আহি চোখ ছোট করে রাগী স্বরে বলল,
“বেশি বেশি বলছিস!”

“হ্যাঁ, আমি তো একটু বেশি বেশিই বলি। আর যারা বলে না, তারা নিঃশব্দে ধুয়ে দিয়ে যায়।”

“আমার অতীত নিয়ে কথা বলবি না।”

“আগে তুই নিজে সেই অতীত থেকে বের হয়ে আয়। তারপর আর কারো বাপের সাধ্য নেই তোকে খোঁচা দেওয়ার। আর শোন, এটা মেইন রোড। এখানে বাস ঘেষাঘেষি করে চলে। পেছন থেকে একটা বাস এসে তোর হাত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তখন হাত খুঁজতে থাকবি। পাবিও না আর। আর তুই কি এটা তোর বাসার জানালা ভেবেছিস যে মাথার উপর দিয়ে যাবে?”

“আমার বাসার উপর দিয়ে বাস চলাচল করে?”

“হেলিকপ্টার তো যায়। তোর বাবার সেই পারসোনাল হেলিকপ্টার তো ছাদেই ল্যান্ড করে। বড়লোকি হাবভাব।”

আহি রাদকে আর কিছু বললো না। সে যাই বলুক, আহির খারাপ সময়ে মানসিক শক্তি হয়ে তার পাশে ছিল। তাই সে রাদের কথায় মন খারাপ করে না।

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার জানালার বাইরে তাকালো। জানালার কাচ এবার পুরোপুরি ভিজে গেছে। কাচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার কোনো ঠিক নেই। একটু আগে সে গরমে হাসফাস করছিল, আর এখন বৃষ্টির ঝাপটায় পুরো বাতাবরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফোনে গুগল ম্যাপ দেখে বুঝলো তারা এখন যাত্রাবাড়ি পার করছে। হয়তো ঢাকা শহর আর যাত্রাবাড়ির আবহাওয়ায় পার্থক্য আছে, তাই এই হঠাৎ বৃষ্টির আবির্ভাব।

আহি জানালা খুলে দিতেই রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“অন্তত আমার সামনে মরতে যাবি না। আমি রক্তারক্তি সহ্য করতে পারি না।”

আহি হেসে বলল,
“প্রমিস, হাত বের করবো না। একটু বৃষ্টির ঝাপটা আসুক। এভাবে জানালা বন্ধ করে রাখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে।”

রাদ আহির দিকে সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আহি রাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে জানালার বাইরে চোখ রাখলো।

(***)

যাত্রাবাড়ীতে বোধহয় কয়েক ঘন্টা ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলো। আশেপাশে সব ভেজা। রাস্তায় কাঁদা জমে আছে। মাঝে মাঝে কাঁচা রাস্তা চোখে পড়ছে আহির। সেগুলো কাঁদায় পুরো ডুবে আছে। সেই কাঁদায় মাখামাখি হয়ে রাস্তাগুলো চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতেই আহির চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার জীবনের সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতাটির কথা।

…………………….

দিনটি ছিল শরতের বৃষ্টিস্নাত দুপুর। প্রতিবারের মতো চারুশিল্পের ক্লাস শেষ হতেই আহি আফিফের পিছু নিয়েছে। প্রতি বৃহস্পতিবার আফিফ ক্লাস শেষে বাসে উঠে পড়ে, আর শুক্রবার মসজিদে ঢুকে যায়। আজ বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ আফিফ বাসে উঠবে। আহি ভাবলো সেও আজ আফিফের সাথে বাসে উঠবে। লোকাল বাসে কখনোই চড়া হয় নি তার। বাবার গাড়িতে করেই দীর্ঘ দূরত্বের পথ পাড়ি দিয়েছিল। তাই আজ নতুন অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্যই সে আফিফের পিছু পিছু বাসে উঠে পড়লো। বাসে যাত্রীদের ভীড়। মেয়েদের সিট সব ভর্তি। আহির বসার কোনো জায়গা নেই। তাই সে আফিফকেই অনুসরণ করলো। আফিফ ভীড় ঠেলে পেছনে গিয়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ালো। আহিও চুপচাপ পেছনে চলে গেলো। সবাই আহির দিকে একনজর তাকাচ্ছে। সবাই হয়তো ভাবছে, সে আফিফের সাথেই এসেছে। কারণ দু’জনই একসাথে উঠেছে, এখন দু’জনই এক জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের সিট যেহেতু সামনে, তাই তারা সামনেই দাঁড়ায়। এখন আহির এভাবে ছেলেদের ভীড় ঠেলে পেছনে এসে দাঁড়ানোটাই সবার বিষ্ময়ের কারণ। কিন্তু আহি তো এই নিয়ম সম্পর্কে কিছুই জানতো না। তাই সে আফিফের পাশে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু আফিফের দৃষ্টি একবারো আহির দিকে পড়লো না। সে আছে নিজের ঘোরে ব্যস্ত।

বাস চলছে ভাঙা পথ পাড়ি দিয়ে। বাসের ঝাঁকুনিতে আফিফের সাথে হালকা ধাক্কা লাগছে আহির। আহি চোখ বন্ধ করে আছে। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে তার। এভাবে অজান্তেই আফিফের স্পর্শ তার হাত-পা কাঁপাচ্ছে। ধীরে ধীরে তার গাল গরম হয়ে যাচ্ছে। হাতের উল্টো পিঠ কপালে ঠেকালো আহি। খুশিতে তার জ্বর উঠে গেছে কি-না দেখে নিলো। কিন্তু হাতটা বরফের ন্যায় জমে গেছে। আহি তার ঠান্ডা হাত দিয়ে নিজের গাল ছুঁয়ে দিলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে তার। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে লাগলো,
“শরীর জুড়ে এমন নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা ছড়াচ্ছে কেন? গাল গরম, হাত ঠান্ডা। শরীরের তাপমাত্রার এই অদ্ভুত কম্বিনেশন কখন হয়?”

আহি নিজের প্রশ্নে নিজেই হাসলো। মনে মনে উত্তর দিলো, “প্রেমে পড়লে হয়।”

আফিফ উলটো দিকে ফিরে দাঁড়ানো। আহি তার ঠিক পেছনে। আহির দৃষ্টি আফিফের চুলের দিকে। তার ঘন চুল। আহির ইচ্ছে করছে হাত ডুবিয়ে দিতে। সে নিজের ইচ্ছে পূরণ করার আশায় হাত বাড়াতেই থমকে গেলো। আফিফ বুঝতে পারলে তাকে মারাত্মক লজ্জায় পড়তে হবে। বাবাকে অভিযোগ করে বসলে তার চারুশিল্পে যাওয়া বন্ধ।
না, ধীরে ধীরে আগানো ভালো। কোনো সম্পর্ক শুরুর পূর্বে তাড়াহুড়ো ভালো না। বিশেষত ভালোবাসায় তাড়াহুড়ো না করাই ভালো। ভালোবাসা ধীরগতিতে জীবনে আসলে দীর্ঘস্থায়ী হয়। আহি চায় আফিফ তার জীবনের দীর্ঘস্থায়ী অংশ হোক। এতো সহজে সে আফিফকে হারাতে চায় না।

(***)

বাস থেকে একজন নামতেই আহি সেই সিটে বসে পড়লো। একদম আফিফের পাশের সিট। আফিফ বসতে চেয়েছিল, কিন্তু পাশে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে সরে দাঁড়ালো। আফিফের এই ভদ্রতা দেখে আবার প্রেমে পড়ে গেলো আহি। দিনে ক’বার যে সে আফিফের প্রেমে পড়ে তার ইয়েত্তা নেই। আফিফের সামনে বসে বেশ ভালোই হয়েছে। তার দিকে তাকানোর ভালোই সুযোগ পাচ্ছে আহি। কিন্তু মাথা উপরে তুলে তাকানোটা অভদ্রতা। তাই আহি ব্যাগ ঘেঁটে তার ছোট আয়নাটা বের করলো। আফিফের শ্রান্ত মুখ দেখা যায় মতো আয়নাটা ধরলো।
এদিকে আফিফের চোখ ব্যস্ত রাস্তার দিকে। উদাস চাহনি তার। কারো উদাস চাহনি কি এতো চমৎকার হতে পারে? আহি যখন মন খারাপ করে থাকে, তখন তার নাক-মুখ ফুলে যায়। ভীষণ রকম বিশ্রী লাগে দেখতে। কিন্তু এই প্রথম কারো উদাস চাহনি দেখে আহির চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে স্ট্যাচু বলে সব থামিয়ে দিয়ে আফিফের মুখের উপর ঝুঁকে তাকিয়ে থাকতে। ডোরেমনের গেজেটটা পেলে ভালোই হতো। আফিফকে পাওয়ার জন্য এতোদিনে সে সব গেজেট ব্যবহার করে ফেলতো।

আফিফের কন্ঠে ঘোর কাটলো আহির।

“দাঁড়ান, এখানে নামবো।”

আহির কানে বাক্যটা কয়েকবার গুঞ্জন করে উঠলো। আহিও উঠে দাঁড়ালো। আহি উঠে দাঁড়াতেই আফিফের গায়ের গন্ধটা তার নাকে এসে ঠেকলো। অনেকটা কাছাকাছি ঘেঁষে পড়েছিল আহি। এদিকে আফিফ ব্যস্ত বাস থেকে নামায়। সে সেকেন্ডের মধ্যেই দূরত্ব রেখে সরে গেলো। আহি বুঝলো, সে বেশি হুড়োহুড়ি করে ফেলেছে। আফিফ যদি বুঝে যায়, আহি তার পিছু নিচ্ছে?

(***)

বাসের হেল্পারকে বারো টাকা দিয়ে নেমে গেলো আফিফ। আহিও একটা বিশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে নেমে হেলো। হেল্পার বলল,
“আপনের আট টাকা লইয়া যান।”

আহি তার কথাটা কানেই নিলো না। আট টাকা দিয়ে সে কি করবে যদি আফিফকেই হারিয়ে ফেলে?
আহি নিজেই জানে না কোথায় এসে বাস থেমেছে। আফিফ বাম পাশের একটা রাস্তায় ঢুকে পড়লো। আহিও তার পিছু পিছু যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হাঁটার পর আফিফ একটা গলির ভেতর ঢুকলো। গলিতে ঢুকতেই দেখলো রাস্তায় কাঁদা জমে আছে। হয়তো কাল রাতের বৃষ্টিতে ড্রেন উপচে ময়লা পানি রাস্তায় উঠে এসেছিল। এখন পানি নেমে সব ময়লা ভেসে উঠেছে। বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে লাগতেই আহির গা গুলিয়ে এলো। আফিফ এমন জায়গায় থাকে? আহি দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগছে। এই রাস্তায় পা রাখলে যদি পিছলে পড়ে? অনেক ভাবার পর আহি সন্তপর্ণে রাস্তায় পা রাখলো। আর যাই হোক, বিয়ের পর তো তাকে রোজ এই রাস্তায় আসতে হবে। এমন ভাবনা মনে আসতেই আহির মনে হিম সমীরণ বয়ে গেলো। আহি লাজুক হেসে মনে মনে বলল,
“তখন মিস্টার এআরকে বলবো কোলে করে রাস্তা পার করিয়ে দিতে।”

আহি অর্ধেক পথ যেতেই কাঁদায় তার স্যান্ডেল আটকে গেলো। কোনোভাবেই সে টেনেও বের করতে পারছে না। আহি এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখলো আফিফ একটা বাড়িতে ঢুকে গেছে। এক তলা সেমি পাকা বাড়ি। দেয়াল থেকে সিমেন্ট খসে পড়ছে। আহি উদাস চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। হুট করে তার মাথায় একটা প্রশ্নের উদয় হলো,
“বাবা কি এই জায়গায় তাকে বিয়ে দেবেন?”

পরক্ষণেই সে এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো যে বাবা না মানলে সে পালিয়ে চলে আসবে। তবুও সে আফিফকে ছাড়বে না।

(***)

আহিকে অনেকক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা লোক তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো। তিনি যত্নের সাথে কাঁদার ভেতর থেকে আহির পা উঠিয়ে আনলেন। কিন্তু স্যান্ডেলটা কাঁদায় তলিয়ে গেছে। সেটা নেওয়া সম্ভব না। আহি খালি পায়ে আবার পিছু ফিরে শুকনো রাস্তায় চলে এলো। ফর্সা পা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে আছে। ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করে বাবাকে কল করতে গিয়েও করলো না। সে কোথায় আছে নিজেও জানে না।
পাশের একটা দোকানের বাইরে বালতি ভর্তি পানি। হয়তো দোকানদার বৃষ্টির পানি জমিয়েছেন। আহি সেই পানি দিয়েই পা ধুয়ে নিলো। এরপর দারোয়ান চাচাকে ফোন করে বলল, সে এক বান্ধবীর সাথে তার বাসায় এসেছে। এখন পথ চিনছে না। পাশের দোকানদারকে ফোন এগিয়ে দিতেই তিনি মোজাম্মেল চাচাকে ঠিকানা বললেন। প্রায় একঘন্টা পর মোজাম্মেল চাচা আহিকে নিতে এলেন। এরপর তিনি রাস্তার ভ্যান থেকে আহিকে এক জোড়া চামড়ার স্যান্ডেল কিনে দিলেন। তারপর সিএনজি নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলেন। আহি ঘরে ঢোকার আগেই পেছন ফিরে চাচাকে বললো, বাবাকে যাতে আজকের ঘটনা না জানায়। দারোয়ান চাচা আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“সব কথা স্যারকে বলা যায় না, মা। আমি সেটা জানি।”

(***)

আহি নিজের ঘরে এসে গোসল সেরে ডায়েরী হাতে নিয়ে বসলো। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। কলম হাতে নিয়ে লিখলো,

“আজ আমি তোমার পিছু নিয়েছি। তোমার জন্য বাসে চড়েছি, কাঁদায় স্যান্ডেল হারিয়ে এসেছি। আর তুমি? একবারো আমার দিকে তাকাও নি। এআর, সত্যিই কি আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি? আমার না তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। তুমি পাশে থাকলে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। আজকে যতোক্ষণ তুমি আমার কাছে ছিলে, আমি ততোক্ষণ শুধু হেসেছি। এই হাসি মনের হাসি। আমার মনটা চমৎকার ভাবে হাসে, জানো? তোমাকে দেখলে আমার মন হাসে। তোমাকে কিন্তু সারাজীবন আমার মনকে হাসাতে হবে।”

আহি কলম তুলতেই সালমা ফাওজিয়া দরজায় কড়া নাড়লেন। দুপুরের খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। বিকেলও গড়িয়ে যাচ্ছে। আহি এখনো ঘর বন্ধ করে বসে আছে। সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে খেতে ডাকছেন। আহি মাথা ব্যথা করছে বলে কানে হেডফোন গুঁজে পেন্সিল হাতে নিলো। আজকের দিনটি স্কেচ করবেই সে। এই দিনটা তার জন্য বিশেষ একটা দিন।

বাসের ভেতরে অনেক যাত্রী। যাত্রীদের ভীড়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। তার পেছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্কেচ শেষ করেই আহি স্কেচটির নিচে লিখলো,

“প্রথম স্পর্শ পেয়েছি তোমার, আর এই স্পর্শ আমার আত্মাকে স্পর্শ করে ফেলেছে।”

…………………………

অতীত মনে পড়তেই আহির চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণা স্পর্শ করতেই রাদ তার দিকে ঝুঁকে তাকালো। আহি রাদের তাকানো দেখে তার দিকে ফিরে বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”

“কাঁদছিস?”

“পানির ঝাপটা লেগেছে।”

“চোখ লাল হয়ে গেছে তোর।”

আহি জানালা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“ঝাপটা চোখের ভেতরে লেগেছে তাই।”

রাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “মিথ্যুক।”

আহি মলিন মুখে রাদের দিকে তাকালো। রাদ মুখ ফিরিয়ে নিলো। আহি সিটে হেলান দিয়ে ধরা কন্ঠে বলল,
“সেই দিনও এমন বৃষ্টি ছিল। রাস্তায় কাঁদা ছিল। আমি সব উপেক্ষা করে তার পিছু পিছু অচেনা পথ ধরেছি। স্বপ্ন দেখেছি, সেই অচেনা পথ একদিন আমার পরিচিত পথ হবে। কিন্তু মানুষটা আমার দিকে তখনও ফিরে তাকায় নি, এখনো ফিরে তাকায় না। আমাকে একটুও অনুভব করতে পারে নি সে। আমি এক তরফা ভালোবেসেছি। আমি বোকা, আমি পাগল। তুই ঠিকই বলিস। আমার মাথায় কিছু নেই।”

রাদ আহির মাথাটা নিজের কাঁধে ফেলে দিয়ে বলল,
“তুই বোকা না। তুই একটা বোকা ছেলের প্রেমে পড়েছিস। তুই পাগল না, ছেলেটা পাগল ছিল বলেই তোকে অনুভব করতে পারে নি।”

“না রাদ, ওর কী দোষ? আমি ভালোবেসেছি বলে তারও যে আমাকে ভালোবাসতে হবে, এমন তো নয়। ভালোবাসায় জোর চলে না, রাদ। ভালোবাসা হুট করে হয়ে যায়। কিন্তু ভালোবেসে ফেলার পর অনেককেই দেখেছি সেই মানুষকে ভুলে যেতে। আর আমার সমস্যা কোথায় আমি নিজেও জানি না। আমি আজও তাকে ভুলতে পারি না। আমি আসক্ত হয়ে গেছি। নেশা যেমন কাটানো সহজ না, আমার এই আসক্তিও তেমন কাটছে না। শুনেছি আসক্ত মানুষকে সুস্থ করার জন্য তার প্রিয় নেশাদ্রব্য তাকে কিছুদিন খেতে দেওয়া হয়, আর আমি তো আমার আসক্তিটা ছুঁয়েও দেখতে পারলাম না। আমি কি তাহলে সারাজীবন এআর আসক্ত থেকে যাবো?”

রাদ চুপচাপ বসে আছে আর আহির কাঁপা কন্ঠের আক্ষেপ শুনছে। আফিফের প্রতি ক্ষোভ যেন রাদের বুকটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আহি রাদের হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমার ব্রেনটা খুলে আফিফের স্মৃতিগুলো মুছে দেওয়া যায় না? যতো টাকা খরচ হবে, আমি করবো। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, রাদ। আমার গলা কাঁপছে। আমি গত চার বছর ধরে ঠিকভাবে ঘুমোতে পারি না, খেতে পারি না। আমি প্রাণ খুলে হাসতেও পারি না। আমাকে একটু বাঁচা, রাদ। বাঁচা আমাকে।”

রাদ আহির হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“তুই যা বলছিস তা তো সম্ভব নয়। তবে একটা কাজ করা যায়। আফিফের সাথে দেখা করে তোর সমস্যার কথাটা খুলে বল। ও যদি তোকে বুঝে, তাহলে সমাধান পেয়ে যাবি।”

আহি রাদের হাত ছেড়ে দিলো। রাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি কখনোই এই কাজ করবে না তা রাদ ভালো করেই জানে। তাই ইচ্ছে করে আহিকে চুপ করানোর জন্য এই কথা বললো। নয়তো এই সমস্যার দ্বিতীয় কোনো সমাধান তার কাছে নেই।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here