উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-০৬||

0
440

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৬||

১০।
কার্তিকের মাঝামাঝি দিনগুলো ভীষণ সুন্দর। শীতের আগমনে উত্তরের সমীকরণ প্রকৃতিতে ঊষ্ণ ও আরামপ্রদ বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। আকস্মিক বাদল ধারায় পথঘাট ভিজে না অনেকদিন। ধুলো জমা রাস্তা দেখলে মনে হবে মরুভূমিতে এই মাত্র ধূলিঝড় হলো। শরতের রেশ এখনো রাস্তার ধারে রয়ে গেছে। এখানে সেখানে এখনো কাশফুল দেখা যাচ্ছে। তবে কাশবনের শুভ্র রঙ ধূলি কণায় মলিন হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট তৃষাতুর কাক হয়ে বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটার অপেক্ষায় আছে। তবে জন সাধারণ বেশ সন্তুষ্ট। এমন আরামদায়ক বাতাবরণই সবার পছন্দের। আর আহির কাছে হেমন্তের এই রূপটা ভীষণ প্রিয়। প্রায়ই সে হেমন্তের দুপুরে ইজেল-ক্যানভাস নিয়ে নদীর ধারে চলে আসে।
নদীর পাড়ে ছবি আঁকাটা খুবই সাধারণ ঘটনা। যেকোনো চিত্রশিল্পী জীবনে একবার হলেও নদীর দৃশ্য এঁকেছে। কিন্তু আহি অনন্য। সে নদীর পাড়ে বসে সব বিষয়ের ছবি আঁকে, কিন্তু কখনো নদীর ছবি ক্যানভাসে উঠায় নি। কারণ আহি মনে করে এই নদীর ধীর বহমান স্রোত তাকে রঙ-তুলির ব্যবহার শিখিয়েছে। আর এই ক্ষুদ্র শিক্ষাটা সে কারো কাছেই উন্মুক্ত করতে চায় না৷ নদীর ছবি আঁকলে যদি তার অনুপ্রেরণার উৎসটা হালকা হয়ে যায়? কিছু সৌন্দর্য মনে গেঁথে যাওয়ায় ভালো। সৃষ্টিকর্মে প্রকাশিত হলে এর মাধুর্যতা হারিয়ে যায়। আর এতো চমৎকার দৃশ্য হয়তো আহি কখনোই আঁকতে পারবে না। তাই নদীর পাড়ে গিয়েও সে কখনো নদীর ছবি আঁকে নি। তবে সে হেমন্তের মধ্যাহ্ন দুপুরে নদীর বহমান স্রোতকে সাক্ষী রেখে তার গোপন প্রেমের গল্প করেছে।

(***)

আজ বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতি, শুক্র এই দু’দিন চারুশিল্পে ক্লাস থাকে। কিন্তু আজ নেই। দেশের দুই দলীয় রেষারেষির দরুন আজ হরতাল চলছে। আহির বাবা-মা দু’জনই বাসায় উপস্থিত। তারা একই ছাদের নিচে আছেন মানেই বাসায় ছোটখাটো একটা ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে। তাই আহি চুপচাপ নিজের ছবি আঁকার জিনিসপত্র গুছিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাসায় যা হওয়ার হোক, অন্তত তার হেমন্ত বিলাসে বাঁধা না আসুক।

রিজওয়ান কবিরের মন-মেজাজ সকাল থেকেই চড়াও হয়ে আছে। সালমা ফাওজিয়া যতোবারই তার সামনে পড়ছেন তার কপালে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠছে। যে-কোনো মুহূর্তে কবির সাহেব আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারেন। আহি বাবা-মার ঝগড়াঝাঁটিতে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকেই দেখছে মায়ের মতো শক্ত মহিলাটাও তার বাবার মার খেয়ে নীরবে তার সংসার গুছিয়ে সেই স্বামীর ঘরেই ঘুমোতে যায়। আহি মায়ের আত্মসম্মানবোধের অধঃপতনে মোটামুটি বিরক্ত। তবে বাবার বিশেষ ভালোবাসায় সিক্ত থাকায় বাবা-মার মারামারিতে আহি সবসময় নিরপেক্ষ থাকতো। যা হচ্ছে হোক, তাতে তার কি? মা মার খেতে না চাইলে চলে যাক। কি দরকার বাবার সাথে থাকার? তবে আহি আজ বুঝতে পারছে মা কেন এতো নির্যাতন সহ্য করেও সেই বাড়িতে পড়েছিল। সেই মুহূর্তে নিজের নিরপেক্ষতা আহিকে আজ ভাবতে বাধ্য করছে, সে ভীষণ স্বার্থপর ছিল। তার স্বার্থপর মানসিকতার ফলাফল আজ সে নিজেই ভোগ করছে।

(***)

আহি হরতালের দিনে মধ্যাহ্ন দুপুরকেই বেছে নিয়েছে হেমন্ত বিলাসের জন্য। আঁকছে পাহাড়ের গায়ে জন্মানো কিছু ফুলের দৃশ্য। আহি নিজেও কখনো এই ফুল দেখেনি। এটা তার সৃষ্ট কাল্পনিক ফুল। ফুলের রঙ ধূসর-লাল। ছবি আঁকা শেষ হতেই আহি উঠে দাঁড়ালো। নদীর পাড়ে তরুণ-তরুণীদের প্রেমলীলা চলছে। কেউ চমৎকার ভাবে একে অপরের হাত ধরে রেখে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে, আবার কেউ কেউ ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। তারা একে-অপরের মাঝেই ডুবে যাচ্ছে। আশেপাশের মানুষেরা যে তাদের দেখছে, তাতে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আহি সেই প্রেম লীলায় মত্ত থাকা প্রেমিক-প্রেমিকাদের ছবি আঁকার সিদ্ধান্ত নিলো। ইজেল থেকে সদ্য আঁকা ছবিটি নামাতেই তার সাথে থাকা ড্রাইভারটি দৌঁড়ে এসে বলল, মিসেস সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আহি সব ফেলে ড্রাইভারের সাথে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। পুরো রাস্তায় সে ভেবে যাচ্ছিল, তার বাবা কি তার মাকে মেরে ফেলেছে? তার কি মাকে একা বাসায় রেখে বের হওয়া উচিত হয়েছিল?
হরতাল হলেও শহরের ভেতরে হালকা-পাতলা রিক্সা আর গাড়ি চলাচল করছে। আর রাস্তা অনেকটা ফাঁকা থাকায় গাড়ি দ্রুত হাসপাতালের সামনে পৌঁছে গেলো। সরকারি হাসপাতালে মাকে ভর্তি করানো হয়েছে। হাসপাতালে ঢুকতেই দেখলো মুনিয়া খালা অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। আহি তার কাছে আসতেই তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
“তোমার ভাইটারে বাঁচানো যায় নাই, ছোড আফা। স্যার যে লাথিটাই না মারলো ম্যাডাম রে!”

আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার কি ভাই-বোন আসার কথা ছিল? সে তো এই বিষয়ে কিছুই জানতো না। মায়ের সাথে কি অদ্ভুত সম্পর্ক তার? শুনেছে মায়ের সাতমাস শেষ হয়েছিল। এতোদিন ভেবেছে, মা বোধহয় মোটা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ সে এতো বড় সুসংবাদ পেলো তো পেলো, সেটা দুঃসংবাদে পরিণত হওয়ার পরই পেলো।

দারোয়ান চাচা ভালো মানুষ। নাম মোজাম্মেল। তিনিই সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। আর এখন রক্তের জন্য এদিক-ওদিক ছুটছেন। কিন্তু আহির বাবার কোনো হদিসই নেই। তিনি কি পালিয়েছেন না-কি? রিজওয়ান কবির পালানোর মতো মানুষ নন। তিনি দাপটের সাথে চলাফেরা করেন। দেশের নামকরা ব্যবসায়ী। ভালোই প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে তার। দেশের সব দলের নেতাদের সাথে তার সখ্যতা। যে-কোনো পরিস্থিতিতে তিনি নিরাপদ।

(***)

আহি সেদিনই প্রথম বাবার আসল রূপ দেখেছিল। বাবা যে প্রয়োজনে খুনীও হতে পারেন, সেদিনই প্রথম জেনেছিল সে। সেদিন সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পর বাবার কাছে প্রশ্ন করতে গিয়েছিল আহি। কেন তার ভাইকে মেরে ফেলেছে? সাত মাসের অস্তিত্বটাকে কেন মিটিয়ে দিয়েছে? কিন্তু আহি তার বাবার মুখশ্রী দেখে কিছুই জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। রিজওয়ান কবির এমন এক ভয়ংকর অপরাধ করেও নির্দ্বিধায় ফোনে কারো সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন। বাবার হাসিটা ছিল মারাত্মক কুৎসিত! তাকে দেখতে হিংস্র দানবের মতোই মনে হচ্ছিল। সেদিনের পর থেকেই আহি নীরবে বাবার সাথে সখ্যতা কমিয়ে দিয়েছে। সালমা ফাওজিয়াও সেই যাত্রায় বেঁচে ফিরেছিলেন। কিন্তু সন্তান হারিয়ে তিনি নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন। তার দেহটাই যেন অক্ষত ছিল, আত্মাটা তো সেই কবেই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছিল। এদিকে ডাক্তারও জানিয়ে দিয়েছে তিনি আর কোনোদিন মা হতে পারবেন না। এতো বড় দুঃসংবাদ যেন রিজওয়ান কবিরকে একটুও স্পর্শ করলো না। বরং তিনি এই দুঃসংবাদকে সুসংবাদ হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।

……………………..

রাদের কন্ঠে আহির ঘোর কাটলো। বাস ঢাকা ছেড়েছে অনেক আগে। জানালার বাইরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহি। মায়ের কান্না মাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বুকটা হুহু করে উঠলো তার। তখন যদি একটু সচেতন হতো, তার জীবনটা এমন এলোমেলো হতো না।

(পর্ব ছোট হয়েছে। যদি সুস্থ থাকি আগামীকাল আরেকটা পর্ব দেবো।)

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here