গোলকধাঁধা -পর্ব ১

0
207

গল্পের নাম – গোলকধাঁধা..!

আমার তখন বয়স নয় কি দশ হবে। তখন প্রথম পুরুষের স্পর্শ পেলাম। খারাপ, জঘন্য সেই স্পর্শ। আমি সিড়ি ভেঙে নিচতলায় নামছিলাম স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঠিক তখন চারতলায় অপু স্যার দাঁড়িয়ে ছিলেন। খুব সম্ভব উনি কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলেন। আমাকে দেখে লম্বা চওড়া হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” মামনী, কেমন আছ? ”
” ভালো, আপনি ভালো আছেন?” বাবা আমাকে এভাবেই কথা বলতে শিখিয়েছেন বড়দের সাথে। অপু স্যার আমার দিকে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন, ” স্কুলে যাচ্ছ? ” মাথায় হাত রাখা খারাপ না। তিনি রাখতেই পারেন। কিন্তু সমস্যাটা অন্য কোথাও হলো। উনি আশেপাশে তাকাতাকি করে মাথা থেকে হাত সরাসরি আমার বুকে নামিয়ে আনলেন। তারপর… আমি শব্দ দিয়ে এই বিভীষিকাময় ঘটনার মূল অংশ ব্যাখ্যা করতে পারবো না। তার সেই শকুনি দৃষ্টিতে তাকানো আমাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছিল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, এমন কেন করছেন উনি? উনার সেই স্পর্শ পেয়ে আমি দূরে সরে যেতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না… ঘটনার আকস্মিকতায় আমি যন্ত্র হয়ে গিয়েছিলাম হয়তো। আমার ওই বয়সে জ্ঞান ছিল না যে, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ স্পর্শ। শুধু এটুকু বুঝেছিলাম, এই স্পর্শ আদরের না । আমার বাবা, মামা, চাচাও পুরুষ। তারাও আমাকে আদর করেন। কিন্তু তাদের কারোরই আদর এমন না।তারা তো ওইভাবে তাকান না। সেই ঘটনার পরে আমার মধ্যে ভয় কাজ করতে শুরু করলো। আমার ছোট্ট মন আর মস্তিষ্কে তখন ওই বিষয়ের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি। তখন থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আমার ভয় লাগতে শুরু হলো। প্রায় সময় চারতলায় আসলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসতো।মনে হতো এই বুঝি, উনি দরজা খুলে বের হয়ে আসবেন। আর আমাকে… তিনি একইকাজ আবার করলেন আমার ছোট ভাইয়ের আকিকার অনুষ্ঠানে। বাসায় সবাই ব্যস্ত অনুষ্ঠান নিয়ে। তখন স্যারের বাসায় আমাকে পাঠালেন, স্যারকে ডাকতে। আমাকে এক প্রকার জোর করে পাঠালেন। উনার স্ত্রী আর ছেলে বাসায় ছিলেন না। উনি সেবার শুধু বুকে হাত না আরো কিছু স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে আমি স্যারের হাতে কামড় দিয়ে সেবার পালিয়ে ছিলাম। তারপর থেকে উনি আমাকে হায়নার মতো খুঁজে ফিরতে লাগলেন।বাসায় কাউকে বলতে পারতাম না। দ্বিতীয় বারের পরে আমার ভয় আরো বেড়ে গেল। মনে হতো, এই মনে হয় অপু স্যার বের হয়ে এসে আমাকে আবার…
পড়াশোনায় মন বসত না।বারবার চোখের সামনে ওই দৃশ্যগুলো ভেসে উঠতো। হোম টিউটরের কাছে পড়তে বসেছি। তখন উনার জায়গায় অপু স্যারকে দেখতাম৷ আমার তখন কথা বলা বন্ধ হয়ে যেত। আমার এই অবস্থায় তিনি যত আদর করে বুঝাতে আসতেন, আমি তত দূরে সরে আসতাম। উনি আমার সাথে সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চাইতেন। চাইতেন যে, কেন আমার এই অবস্থা? এই বিষয় নিয়ে আমি যেন খোলাখুলি ভাবে বলি। কিন্তু আমিই সাহস পেতাম না৷ আমার অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণেই হয়তোবা!
প্রায় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙত। প্রায় প্রতি স্বপ্নে কোনো বড় মাকড়সা আমার বুকের উপর উঠে বসত। বা স্যারের বিশাল ধারালো হাত আমার দিকে আসছে এমন কিছু। ধীরে ধীরে আমার মানসিক অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। আমি আরো বেশি অন্তর্মুখী স্বভাবের হয়ে গেলাম। তার উপর স্যারকে বাসার সবাই অসম্ভব ভালো জানতেন। বাবার ইউনিভার্সিটির ব্যাচমেট ছিলেন। আম্মুর চাচাতো বোনের বর ছিলেন। সনামধন্য কলেজের জীববিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। এমন একজন মানুষের চরিত্র নিয়ে নয় দশ বছরের মেয়ের অভিযোগ কেউ কি কানে তুলবে? আর এই বিষয় নিয়ে ছড়াছড়ি হলেও তো দোষ আমার ঘাড়ে আসবে। আমার এক খালাতো বোনের বর তাকে খুব মারতো। আর এইজন্য নাকি আমার বোনেরই দোষ বা ভুল ছিল। তার বরের দোষ কখনো আমার পরিবারের লোকজন দেয়নি।আমার গ্রামের বাড়ির এক মেয়ের মুখে এসিড ছুড়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। সবাই তাকেই দোষ দিয়েছিল। কেন সে ওই ছেলের সাথে সাহস দেখাতে গিয়েছিল। এই ঘটনার পরে আমি আরো বেশি চুপসে যাই। সেই ঘটনা অনেক কষ্টে আমি চেপে রেখেছিলাম। সেইসময়ের মানসিক যন্ত্রণা আমি আমার মধ্যেই রেখেছিলাম।
তারপর সময়ের সাথে সাথে অতীতের সময়গুলো ঘোলা হতে লাগলো কিন্তু ভয় কখনো যায়নি। ভেতরে কোথাও লুকিয়ে ছিল।

****
ইন্টারে মহিলা কলেজে ভর্তি হলাম। স্যার সেই কলেজের শিক্ষক ছিলেন। আমি কলেজ টাইম ক্লাসে আর নাহয় লাইব্রেরিতে বসে কাটাতাম। তিনি বাবাকে অনেক বার বলেছিলেন, আমাকে যেন তার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আমি কখনোই ওই বিষয়ে রাজি হইনি। আমার মিথ্যা বলার অভ্যাস ছিল না। তারপরও তার কাছে না পড়ার জন্য বানিয়ে বলেছিলাম যে, তার পড়ানো আমি বুঝি না। বাবা আফসোস করে বলেছিলেন, ” এতো ভালো স্যার। এতো সুনাম আর তুমি নাকি তার পড়া বোঝো না। এটা কিছু হলো? স্যার কতবার বলেছেন, তোমাকে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু তুমি শুরু করেছ বাহানা দেয়া। তোমার জন্য তার রাইটার্স কপি গুলো অব্দি পাঠিয়ে দেন আর তুমি কিনা! ”
আমি বাবাকে কীভাবে বুঝাই উনি আসলে কী! ক্লাসে সবার সাথে এমন ব্যবহার করেন যেন, ছাত্রীদের মেয়ের চোখে দেখেন। আমাকে তার নিজের মেয়ের চোখে দেখেন। কিন্তু আমি তো বুঝি তার ওই শিয়ালের মতো ধূর্ত চোখের ভাষা! আমি বুঝি উনার মামনী বলে, কাছে বসতে বলার উদ্দেশ্যটা আসলে কী!
মাকে আমি বলার সাহস পাইনি। হয়তোবা কখনো হবেও না। আমার পুরুষদের প্রতি ভয় কাজ করতে শুরু করেছিল আগেই। এটার চরম রূপ নেয় যখন আমি প্রেমে ব্যর্থ হই।

ইউনিভার্সিটিতে পা দেবার পরে, আমি সসম্পর্কে জড়াই। তুহিনকে আমার প্রচণ্ড ভালো লেগেছিল। বিশেষ করে তার কথায় কথায় সাহিত্য ঝাড়ার বিষয়টা। খুবই আন্তরিক স্বভাবের এই ছেলে আমাকে বাধ্য করেছিল, অল্প পরিচিত কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে। সে ক্লাসের ফাঁকে একটা চিরকুট লিখে তার মনের কথা জানিয়েছিল। চিরকুটে লেখা ছিল – ” পথিক পথ হারিয়ে ফেলেছে। ”
আমি প্রথমে বুঝিনি। তাই চিরকুটের প্রতি উত্তরে কিছুই বলতে পারিনি। পরে অবশ্য সে-ই আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল। তুহিনের নাক ছিল ধনুকের মতো বাঁকা। শ্যামবর্ণ ছেলেটা আমাদের ক্যাম্পাসে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
আমার পুরুষ সম্পর্কিত পুরাতন ধারণা গুলো বদলে দিতে লাগলো সে। সে তার জাদুকরী শব্দের মায়ায় আমাকে জড়াতে লাগলো। আমার কথা বলার অভ্যাস বাসার বাহিরে একেবারেই কম ছিল। ভয় হতো, যদি ঘটনাটা কাউকে বলে দেই প্রসঙ্গক্রমে? কিন্তু তুহিনের বেলায় উল্টোটা হলো। আমার কথা বলার অভ্যাস হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে মনে হতো, বাচাল স্বভাবটা মনে হয় ছোঁয়াচে। এজন্যই হয়তোবা আমি সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছি।
আশেপাশে আমার চেয়েও ভালো মেয়ে ছিল। তারপরও তার আনাগোনা আমার আশেপাশেই। এই ব্যাপারটাও দারুণ লাগতো আমার।

চলবে…

( আর একটি পর্বেই এই গল্প শেষ হয়ে যাবে। ইনশা আল্লাহ আগামীকাল সেই পর্ব পোস্ট করে দিব। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here