গোলকধাঁধা
২.
তুহিনের সাথে আমার সম্পর্ক গভীরে যেতে লাগলো। মাঝেমধ্যে তার চিরকুট গুলো আমাকে অন্যভুবনে নিয়ে যেত। শব্দের বুননকৌশল বুঝি তার ঝুলিতেই লুটোপুটি খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধনুকের মতো বাঁকা নাকে তার রাগ ছিল ভরপুর৷ তবে তার রাগ ছিল অন্যরকম। ঠিক বোঝাতে পারবো না। আমার তো আর শব্দের ভাণ্ডার নেই তার মতো। তার রাগ একবারই আমাকে দেখিয়েছিল আর সেটাই ছিল শেষ।
আমাদের লুকোচুরি প্রেম চলতে লাগলো সরল গতিতে৷ আমার স্পর্শ জনিত যে সমস্যা আছে সেটা ওকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। মনে করুন, আমরা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছি। এক বা দুজন ছেলেও যদি পাশ দিয়ে যায়। সে আমাকে আড়াল করে দাঁড়াবে। তার কথা, তোমাকে অন্য কেউ কেন স্পর্শ করবে? সেও যে আমাকে স্পর্শ করেছে এমন না। মাঝেমধ্যে সে হাত ধরতে চাইত। কিন্তু আমি সন্তর্পণে কাটিয়ে যেতাম। আমার কারণ তার জানা ছিল না কিন্তু সে হয়তো ভাবতো, আমার আরেকটু সময় প্রয়োজন। আমার প্রায় ইচ্ছা হতো, তাকে ছুঁয়ে দেখতে। ইচ্ছা হতো তার ধনুকের মতো বাঁকা নাকের বাঁকা অংশটুকু ছুঁয়ে দিতে৷ যখন সে আমার জন্য ঘন গাছপালার মাঝে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত, তখন আমি পেছন থেকে গিয়ে তাকে চমকে দিতাম। প্রায় প্রতিদিনই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করতাম, আজকে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবো। কিন্তু কাছে গেলে আর সাহস হতো না। মনে হতো, তাকে স্পর্শ করার যে অনুভূতি সেটা যদি অপু স্যারের মতোন হয়। তখন? তখন আমি কীভাবে বিষয়টা মেনে নিব? তুহিনের চিরকুট ছাড়া কীভাবে আমার রাতের ঘুম ঠিক হবে?
*****
এদিকে ক্যাম্পাসে সে সেলিব্রেটি ধরনের হয়ে গেল। প্রায় প্রতিদিনই তার ডেস্কে মেয়েদের চিঠি পাওয়া যায়। তুহিন নিজ দায়িত্বে আমাকে পড়ে শুনায়৷ বিষয়টা আমার ভালো লাগতো না। আমি নিজেকে বুঝাতে চেষ্টা করতাম যে, আমার সাথে ওর ব্যক্তিগত বিষয়গুলো শেয়ার করতে ভালো লাগে।তাই সে করে। এখানে তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু পরোক্ষণেই মনে হতো, ও ওইসব মেয়েদের মতো আমাকে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার কথা বলতে চাচ্ছে। ওইসব মেয়েরা চিঠিতে তাকে আলিঙ্গন, চুমু খাওয়ার কথা প্রকাশ করে। আমারও তখন মনে হতো, তুহিন হয়তোবা আমার কাছে এমন কিছুই আশা করছে। আমি দোটানায় পড়ে যেতাম। প্রায়ই প্রতিদিনই আমার গল্পটা বলার প্রস্তুতি নিয়ে ক্যাম্পাসে যেতাম। কিন্তু তুহিন আর ক্লাসমেটদের সাথে দেখা হওয়ার পরে বলা হয়ে উঠত না। মনে হতো, আমার বিষয়টা জানার পরে ওরা আমাকেই দোষারোপ করবে। ওরা আমাকেই ঘৃণার বা করুণার চোখে দেখতে শুরু করবে!
এরইমধ্যে বিব্রতকর কয়েকটা ঘটনা ঘটলো।
প্রথম ঘটনা, অপু স্যার কোনোভাবে আমার আর তুহিনের বিষয়ে জানতে পেরেছেন৷ তিনি আমাকে লম্বাচওড়া কয়েকটা ম্যাসেজ পাঠালেন। ম্যাসেজে লেখা ছিল, ” মামনী, ক্যাম্পাসে আজকাল রোমান্টিক ক্লাস চলছে তোমার তাই না? কোথায় কোথায় ওই ছেলের সাথে যাও সবই কিন্তু জানি, মামনী। সে যে তোমায় ছেড়ে দেয় না। সেটাও বুঝি। তাছাড়া কি আর প্রেম হয়? শুধু আমি তোমাকে চাইলে দোষ! আমি একটু আদর করতে চাইলাম বলেই কামড় বসিয়ে পালালে। আর এখন যে, ওই ছেলে কতভাবে তোমাকে আদর করে! তাকে কি তখন কামড় বসিয়ে দাও? মামনী, এবার বাড়িতে আসলে আমার সাথে দেখা করবে৷ তা নাহলে… ” একটা আননোউন থেকে ম্যাসেজ করেছিলেন৷ এবং এই একই ম্যাসেজ উনি দুই তিন দিন পরপর আমাকে পাঠাতেন৷
উনি কীভাবে আর কার মাধ্যমে খবর পেয়েছিলেন তখন আমার জানা ছিল না। সেই ম্যাসেজ পড়ার পরে থেকে আবার সেই দুঃস্বপ্ন গুলো দেখতে শুরু করলাম। এবারের দুঃস্বপ্ন আগের তুলনায় ভয়াবহ রকমের ভীতিকর ছিল। স্বপ্নটা কিছু এরকম, ছোট্ট একটা মাকড়সা আমার বুকের উপর বসে আছে। তারপর দ্রুত বড় হচ্ছে। এতো বড় যে আমি ভার নিতে পারছিলাম না। তারপর সেই মাকড়সা আমাকে কামড়াতে শুরু করলো। তারপর হঠাৎ করে মাকড়সা উধাও হয়ে যেত। আর সেখানে অপু স্যার…
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল… স্যারের ম্যাসেজ পাওয়ার সাত বা আট দিন পরে। সেই ঘটনাই আমাকে পুরোপুরি ভাবে বিভীষিকাময় জীবনে ঠেলে দিয়েছিল।
ক্যাম্পাসে আসার পথে বাসে উঠার পরে সিট খালি না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন মধ্যবয়স্ক একজন লোক আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ ভীড়ের মধ্যে আমি কারো হাতের উপস্থিতি আমার শরীরে পেলাম। কিছু সময় পরে বুঝতে পারলাম আমার পাশে থাকাই লোকটার হাত। উনি আমার কোমড়ের আশেপাশের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিচ্ছিলেন। আমি সরে যেতেও পারছিলাম না।এতো বেশি যাত্রী ছিল সেদিন যে একটু সড়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। অনেক চেষ্টা করে কোনোমতে ধাক্কাধাক্কি করে মেয়েদের দিকে চলে এসেছিলাম। পুরোনো সেই ভয় আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেছিল । আমার তখন বারবার মনে হচ্ছিল, ওই লোক শকুনির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ আমার মস্তিষ্ক ক্রমেই শূন্য হয়ে গেছিল। আমি কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম জানি না। তবে আমার একটা ক্লাস সেদিন ছুটে গেছিল। আমার হুশ হলো বাস ড্রাইভারের প্রশ্নে।
” মামনী, নামবা না? সেই কোন সময় থেইকা বইসা আছ! ডেইলি তো আগেই নাইমা যাও। ”
উনার মামনী ডাকে আমার রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমি উনার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, উনিও কি স্যারের মতো কাজ করবেন? ভাবতে ভাবতেই নামার জন্য পা বাড়াবো তখন বুঝতে পারলাম, বাসে আমি, ড্রাইভার আর হেল্পার ছাড়া কেউ নেই। জানি না কী হলো! মুহুর্তের মধ্যে বাসের সিট, জানালা সবকিছু বদলে গেল। সবকিছু কীভাবে যেন সেই সিঁড়ি ঘরে রূপ নিল। মনে হলো আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নামছি আর স্যার তার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বের হচ্ছেন। বাস ড্রাইভার যেখানে বসে ছিলেন সেখানে অপু স্যার বসে আছেন। তারপর এমন ভাবে দৌড়ে নেমে এলাম যে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম ফুটপাতের ওপর। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে আবার দৌড়াতে শুরু করলাম। বাসের হেল্পার পেছনে পেছনে চিৎকার করে আমাকে ডাকছিল আর বলছিল, ” আপা, ভাড়া দিয়া গেলেন না? ”
আমি মূলত সিঁড়ি ভেবে দৌড়াচ্ছিলাম। তাই কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়েও গেছিলাম। দুই হাতের তালু, হাতের জায়গায় জায়গায় চামড়া উঠে সাদা চামড়া বের হয়ে গেছিল। পায়ের কনিষ্ট আঙুলের নখ উঠে গিয়েছিল। দুই পায়ের হাঁটুর চামড়া ছুলে গিয়েছিল। আমি তারপরও আমার গতি কমাতে পারছিলাম না।মনে হচ্ছিল, এই বুঝি স্যার আমাকে ধরে ফেলবেন৷ কখন যে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েছি খেয়াল ছিলো না। আমি বারবার পেছনে তাকাচ্ছিলাম আর দৌড়াচ্ছিলাম। ওইসময় আমার সামনে তুহিন পড়লো। ও আমাকে থামাতে চেষ্টা করলো। ওর চোখেমুখে বিস্ময়, ভয় ছিল। আমি কোনোমতে বললাম, ” তুহিন, স্যার আসছেন। আমাকে ধরে নিয়ে যাবেন। উনি আমাকে ছাড়বেন না। কামড় দেয়ার প্রতিশোধ নিবেন। ”
তুহিন আমার হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ” কোন স্যার? আর কীসের কামড়?” আমি তখন রাস্তার পাগলের মতো আচরণ করছিলাম। আশেপাশে মানুষ জন জড়ো হতে শুরু করছিল। আমি তখনও পেছনে তাকাচ্ছিলাম। দেখলাম দানবের আকৃতির মাকড়সা আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি তুহিনের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য অনুরোধ করে বললাম, ” তুহিন, বিশাল মাকড়সা আসছে। আমাকে ছাড়। আমাকে… ছাড়। ”
তুহিন আরো শক্ত করে হাত ধরে বলল, ” কীসব বলতেছ? কোথায় মাকড়সা? তোমার ব্যাগ রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। সেটাই উনি নিয়ে আসছেন। ” আমার ভেতর অস্থির হয়ে উঠছিল আগের থেকে হাজার গুণে বেশি। মনে হচ্ছিল সবার সামনে এবার আমার সত্য আমার গোপন আর লজ্জার কথা প্রকাশ হয়ে যাবে।
” তুহিন, তুমি জানো না৷ আমি সব বলবো। কিন্তু আমাকে এখন ছেড়ে দাও। সেই সিঁড়ি ঘর থেকে উনি আমাকে ফলো করছেন। ”
” কোন সিঁড়ি ঘর আর কে ফলো করছে?”
আমি কথা বলার জন্য তুহিনের দিকে তাকালাম। তুহিনের জায়গায় অপু স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। শকুনির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। এক হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সেই হাত ক্রমশও মাকড়সার পায়ের মতো হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। অপু স্যার দাঁতগুলো বের করে হেসে বললেন, ” এখন কোথায় যাবা? বলেছিলাম না, আমার কাছ থেকে পালাতে পারবা না। ”
তারপরের ঘটনা আমার মনে নেই। শুধু এটুকুই মনে আছে। আমি হাত ছাড়ানোর জন্য অপু স্যারের হাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। এতে উনি হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ তখন নাকি আমি চিৎকার করে আমার মস্তিষ্কের বিকৃত স্মৃতিগুলো উগড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবে সেখানে তুহিন ছিল। ক্যাম্পাসের শত শত শিক্ষার্থীদের সামনে তার ইমেজ এক পলকেই নেমে গেল অতল গহ্বরে।
যে ব্যক্তি আমার এলোমেলো জীবনের ছন্দ
ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছিল। সেই ব্যক্তির জীবন আমি নরক বানিয়ে দিয়েছিলাম। আমি এতটাই অভিশপ্ত ছিলাম যে, একজন মানুষকে মাত্র একজনকেও আমি আমার কৃষ্ণগহবর থেকে মুক্ত রাখতে পারিনি। শুনেছিলাম, আমার ওই ঘটনার পরে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এমনকি হল থেকে বের করে দেয়ারও কথা হয়েছিল। ডিপার্ট্মেন্টের শিক্ষকদের কাছেও তাকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল। সেই হাসিখুশি ছেলেটাও নাকি আমারই কারণে বিষন্নতায় ভুগছিল।
আমার শুধু মনে হতো, কীভাবে বুঝাই সেদিন তার জায়গায় আমি বর্বর নিকৃষ্ট পশুকে দেখেছিলাম। যার ভয়াল থাবায় এক পলকে আমার আর তার পৃথিবী উল্টো হয়ে গেছে সরলকোণের মাপে। যেটা সেই ব্যক্তি চেয়েছিল। আমার আর ওই ক্যাম্পাসে পা দেয়া হয়নি। রাতে একটা করে ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম আসে না। আগে তো তিন চার ঘণ্টার মতো ঘুম হতো। এখন সেটাও হয়না। তার তৈরি করা মাকড়সা ঠিকই আমার চারপাশে জাল বুনিয়ে ছিল। সেই জাল ডিঙিয়ে না আমি কখনো বের হয়ে আসতে পারবো। না তুহিনকে আসতে দিবে! মাকড়সা গুলো আকারে আর সংখ্যায় বাড়তে লাগলো। তাদের বোনা জালে দিন দিন আমি আটকে যেতে লাগলাম। অমাবস্যার অন্ধকার যেন আমার চক্ষু জুড়ে!
এই ঘটনার কয়েক মাস পরে আরেকটা অচেনা নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছিল। লেখা ছিল -” কামড়ের প্রতিশোধ। কেমন লাগলো? ”
আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিল, ” তুহিনের কী দোষ ছিল? ”
চলবে…
Maria Kabir