গোলকধাঁধা
৫.
কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরেও পেছন থেকে কেউ আসলো না। আয়াতুল কুরসি মনে মনে পড়ছি আর দ্রুত আগাচ্ছি। আর ভাবছি নতুন বাসার খোঁজ দ্রুত করতে হবে৷ সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে যাবো তখনই নিচতলার দরজা ক্যাচক্যাচ শব্দ করে পুরো খুলে গেল। আমি চিৎকার দিতে যাবো তখনই বৃদ্ধা বের হয়ে আসলেন। আমাকে দেখে বললেন, ” বাবা, বাসায় আজকে বিরিয়ানি রান্না করেছিলাম। তাই তুমি যদি আজকে আমাদের সাথে খেতে তাহলে ভালো হয়। তোমার দাদাও আমাকে রাগ করছিলেন। নতুন ছেলেটাকে একেবারে একঘর করে রেখেছ। ” বৃদ্ধা এখানেই থামলেন। আগের স্বভাবের সাথে এই স্বভাব মিলছে না। আমার কি উচিৎ ভেতরে গিয়ে খেতে বসা? এখানে আসার পরে থেকে খাবার নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে। বিরিয়ানিকে না করা যায়?
তার উপর বৃদ্ধার স্নেহময় আবেগ। কীভাবে না করি?
বিরিয়ানি খাওয়ার সময় একটা জিনিস বারবার মনে এসেছে৷ এই বাসায় তাদের ভাষ্যমতে মাত্র দু’জন থাকেন৷ কিন্তু আমার মনে হলো আরো একজন আছে। ডাইনিং টেবিল থেকে ভেতরের সবকিছু খুব একটা ভালোমতো দেখা যায়না। যতটুকু দেখা গেল তাতে আমি শিওর আরো একজন এই বাসায় আছে। যে সবার সামনে আসে না। আড়ালে তার দিন-রাত কাটায়। এ-ই মনে হয় সেই ছাদে নৃত্য প্রদর্শনকারী। আচ্ছা, একদিন এই নৃত্য প্রদর্শনকারীকে হাতে নাতে ধরতে হবে। তাহলে হয়তোবা তার জ্বালাতন কমবে।
আজকে রাতেই তাকে ধরে ফেলবো। আমার একটা সূক্ষ্ম আশা জেগে উঠেছে। রোকাইয়া কি এখানকার সেই নৃত্য প্রদর্শনকারী? ভাবতেও অবাক আর অদ্ভুত লাগে। যে মেয়ে হাসতে গেলেও হাজার বার ভাবতো সেই মেয়ে নাকি এভাবে নেচে বেড়াবে!
ওদের বাসার কাজের লোক যদিও বলেছিল,” আপার মাথা টাথা ঠিক নাই। আগে কথাই কইতো না আর এখন সারাক্ষণ একই কথা বলতে থাকে৷ কানডা তালা লাইগা যায়। সারাক্ষণ বিরবির করে গালাগাল করে। এতো গালাগালি শিখছে কই থেইক্কা আল্লাহ মাবুদ জানেন৷ এতো ভালা আপামনি আমার কী হয়া গেল! ”
এই ছিল ওর বাড়ির কাজের লোকের রিভিউ ওর সম্পর্কে। অনেক কষ্টে এই মহিলাকে আমি খুঁজে বের করেছিলাম। প্রায় দশ হাজার টাকা গেছে এই মহিলার কাছ থেকে এইটুকু বের করত৷ ও এখন কোথায়? জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, ” চাচায় ওরে কই যেন নিয়া গেছে। কাউরে কয়নাই। চাচীরেও কয় নাই। চাচী তো মাইয়ারে দ্যাখতেই পারে না৷ খালি দূর দূর ছাই ছাই করে। মাইয়ার সাথে খারাপ কিছু হইছে বইলাই তো মাথা খারাপ হইছে। তাছাড়া আপনিই কন, বিনা কারণে এতো ভালো মাইয়া এমন হইয়া যায়? নিশ্চয় কিছু হইছে। মনে হয় পীরিত কইরা ধরা খাইছে। ”
” মোটেও ধরা খায় নাই। উল্টো সেই ধরায় দিয়ে আসছে। ” এই কথা বলতে পারলে শান্তি পেতাম। কিন্তু সেটা করা যাবে না। এমনিতেই আমাকে ওর জন্য বহু ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। আল্লাহর রহমত যে কোনো মিথ্যা প্রমাণ কেউ পায় নাই। তাহলে আমার এডুকেশন লাইফ চাঙ্গে উঠতো।
এদিকে তিষা ফোন ধরছে না। কিছু একটা নিয়ে আবারও রাগ করেছে। কী নিয়ে? সেটাই মনে করতে পারতেছি না৷ আজকে সারাদিন তো তাকে টেক্সট, কল আর ইনবক্সে চুমু পাঠিয়েছি। তাহলে কী কারণে? এদিক থেকে রোকাইয়া খুব সহজ মেয়ে ছিল। সিরিয়াসলি কখনো রাগ করেছে কিনা মনে পড়ে না। আমি আরো চাইতাম যে সে রাগ করুক।
মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে নকল চিঠি নিয়ে যেতাম। যেখানে প্রেমিক প্রেমিকার গভীর আলিঙ্গনের কথা, ইচ্ছা লেখা থাকতো। আমি যখন ওই লাইনগুলো অনুভূতি মাখিয়ে পড়তাম তখন সে চোখ মুখ করল্লা খাওয়ার মতো করে রাখতো। বুঝলাম, অন্য মেয়ের বলা কথা সহ্য হচ্ছে না। তাহলে নিজেও তো সে সুযোগ দেয়না৷ এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম যখন ভাঙলো তখন দেখি আমার ঘরের মূল ফটক হা করে খোলা। আর সেই দরজার সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছাদে লাইট জ্বালানো ছিল আর আমার ঘরের ফটকও লাগানো ছিল। আমি এতটাও গাধা না যে হা করে খুলে ঘুমাবো। বিছানা থেকে দ্রুত নেমে দরজা টান দিতে যাবো তখন মনে হলো আমি অন্ধকারে কাউকে দেখলাম। একটা অবয়ব। অবয়বটা কীসের আর কী দেখলাম এসব মাথা থেকে সরিয়ে দরজা আটকানোর জন্য দরজা আবার টান দিলাম। কিন্তু লাভ হলো না। দরজা নাড়ানোই যাচ্ছে না। আর তখনই ঘটনাটা ঘটে গেল। ধবধবে সাদা কিছু আমার দিকে ছুটে আসতে লাগলো। আমার মনে হচ্ছে রোকাইয়া আসছে? শুনেছিলাম ওর নাকি মাথা ঠিক নেই। কিন্তু এইভাবে আসবে কেন? আর এই বাড়িতেই বা ও থাকবে কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই সাদা অবয়ব আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। এতো কুৎসিত চেহারা আমি কখনো দেখিনি। আসলে চেহারা বলবো না কী বলবো ভেবেও পাচ্ছি না। কোনো নাক, ঠোঁট নেই। মাথায় জুড়ে আছে বিরাট দুটো চোখ। তাও সাধারণ মানুষের বলে মনে হচ্ছে না। হবেও না কেন? এই জিনিস তো মানুষ না। আমি যন্ত্রের মতো তাকিয়ে ছিলাম। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার সামনের সেই অতিপ্রাকৃত জীব বিকট শব্দ করে হাসতে শুরু করলো। তারপর আর মনে নাই। যতদূর মনে পড়ে, এই চেহারা ছাড়া অবয়ব আমার রোকাইয়া না৷
*****
প্রিয় তুহিন,
তোমাকে আমি প্রায় রাতেই স্বপ্ন দেখি। তুমি কি জানো, স্বপ্নে তুমি আমার জন্য কাঠগোলাপ নিয়ে আসো? তুমি কাঠগোলাপ হাতে নিয়ে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলো, নিতু, তোমাকে ভালোবাসি!
আমার তখনই ঘুম ভেঙে যায়। আমার বলা হয়না, আমিও যে তোমাকে ভালোবাসি।
তুহিন, তুমি আমাকে এই কথাটা বলার সুযোগ করে দিবে?
আমি প্রায় তোমার বলিষ্ঠ বাহুতে নিজেকে কল্পনা করি। তোমার আঙুলের স্পর্শে আমি প্রতি সেকেন্ডে কেঁপে কেঁপে উঠি। তুমি তখন আমার চুলের সাথে নতুন খেলায় মেতে উঠো।
এইটুকু পড়ার পরে রোকাইয়া এমনভাবে তাকালো যেন, তাকে নীম ফলের জুস খাওয়ানো হয়েছে। আমি চিঠি পড়া বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”
” এসব সত্যি কোনো মেয়ে লিখেছে?”
” তোমার কি মনে হয়, কোনো ছেলে লিখেছে?”
” হতেও তো পারে। কোনো মেয়ে এভাবে কেন লিখবে? ”
” তোমার আমাকে গে মনে হয়? রোকাইয়া?”
” না, তা কেন হবে। ”
” তাহলে আমাকে ছেলে কেন প্রেমপত্র দিবে?”
” প্রাংক না কী বলে! সেটাও তো হতে পারে। ”
” মোটেও না৷ যে মেয়ে এই পত্র দিয়েছে সে আমার হাতে দিয়েছে। তুমি দেখা করতে চাও?”
” মেয়েটা কষ্ট পাবে না? ”
” আজব! আমি আমার প্রেমিকাকে নিয়ে যেতেই পারি। তাতে কষ্ট পাবার কী আছে?”
” তুহিন? ”
রোকাইয়া এবার আমাকে চমকে দিল৷ আমার ঠোঁটে আলতো করে তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল, ” ওই মেয়েকে বলবা, অন্য কেউ আমাকে তার অধিকারে নিয়ে নিয়েছে। এতদিন শুধু দলিল করা ছিল। এখন সাক্ষর দিয়ে দিলাম। ”
রোকাইয়া মিটিমিটি হাসছে। মনে হচ্ছে এখনই সে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করবে। এবং হাসতে হাসতে আমার গায়ের উপর পড়ে যাবে। আমি তখন তাকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করবো। ততক্ষণে মনে পড়লো, রোকাইয়া কখনো এমন করবে না। সে তাহলে আমার স্বপ্নে এসেছে। এরপরে আবার অন্ধকারে তলিয়ে গেলাম।
ঘুম যখন ভাঙলো তখন বুঝতে পারলাম আমি হাসপাতালে ভর্তি। মোটামুটি ধারণা করতে পারছিলাম আমার সাথে আসলে কী হয়েছিল!
তারপরে মূল কাহিনী জানতে পারলাম। ওই বৃদ্ধার এক মেয়ে আছে। একসময় মেকাম আর্টিস্ট ছিলেন। তারপরে নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। যেহেতু সে মাথা খারাপ তাই ভাড়াটিয়াদের মেকাপের মাধ্যমে ভূত সেজে ভয় দেখান। এজন্যই তারা বাসায় ভাড়াটিয়া রাখতে চান না। আমাকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই রেখেছিলেন। এই ঘটনার পরে আমাকে অন্য বাসায় যেতে হলো। অফিস থেকে প্রায় আধা ঘণ্টার পথ। ওই বাসায় আমি আর যাইনি। উনারাই আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। তবে একটা প্রশ্ন হচ্ছে, দরজা খুলল কীভাবে?
এদিকে তিষার বাবার সাথে দেখা করার সময় এগিয়ে আসছে। দ্রুতই আমাদের বিয়ের তারিখও ঠিক হবে। আমার বাসা থেকে সবাই রাজি এই বিয়েতে। শুধুমাত্র তিষার বাবার সম্মতি বাকি।
নতুন বাসায় ওঠার পরে বাজার করা হয়নি। সেজন্য শুক্রবার ঘুম বাদ দিয়ে মাছ, মাংসের বাজারে আসলাম। অনেকদিন ডিম আর নিরামিষে আমার শরীর আর মুখ শেষ।
আম্মা এদিকে আমাকে বাসায় যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু এখানকার কাজটা না করে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না।
( তুহিন রূপচাঁদা মাছ দামাদামি করায় ব্যস্ত। মাছ গুলো দেখে তার এখন অন্য মাছ কেনার মন টানছিল না। তাই বিক্রেতার সাথে দর কষাকষি চলছেই৷ এরই মধ্যে তার পেছনে প্রায় গা ঘেঁষেই একজন নারী চলে গেলেন। তার হাতে বাজারের ব্যাগ৷ তিনিও মাছ কিনে বাসায় যাওয়ার জন্যই বের হচ্ছিলেন। এইসময় ভীড়ের মধ্যে ধাক্কা লেগে গেল। সেই নারী কিছুটা বিরক্ত হলেও মুখে কোনো শব্দ না করে চলে গেলেন৷ তুহিনের মন মাছে না থাকলে সেও ধাক্কা লাগার জন্য বিরক্ত হয়ে পেছনে তাকাত। কিন্তু তাকিয়ে তার বিরক্তি ভাব চলে যেত। সে বিস্ময়ে আবেগে ভেসে যেত। কারণ সেই নারীই ছিল তার প্রাক্তন রোকাইয়া৷ যাকে সে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে।)
চলবে…
~ Maria Kabir