গোলকধাঁধা
৯.
আমি কোনোভাবেই বাবা – মাকে বোঝাতে পারিনি যে, অপু স্যার নির্দোষ নন। একদিন বিকালে মা স্যারকে ডেকে এনেছেন। যেন আমি তার নামে মিথ্যা অভিযোগ দেয়ার জন্য, ক্ষমা চাই। আমার তখন শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল রাগে। আমি তার কাছে ক্ষমা চাইব? আমি? কেন? উনার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ তুহিনের কাছে। তাহলে এমনটা কেন হলো না? এই সমাজ সবসময় ভিক্টিমকেই বলি দেয়। তাই বাধ্য হয়ে আমিই তার উপযুক্ত শাস্তি না দিতে পারলেও কাছাকাছি কিছু করতে পেরেছিলাম। যে হাত দিয়ে উনি আমাকে স্পর্শ করেছিলেন। যে হাত দিয়ে থ্রেট ম্যাসেজ লিখেছিলেন। সেই হাতের আঙুলই আমি তিনটা গায়েব করে দিলাম৷ সেদিন আমার নিজেকে মুক্ত, স্বাধীন মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার থেকে ভালো আর কেউ থাকতে পারে না৷
( তুহিন )
তিষার সাথে প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা হলো। সারমর্ম হচ্ছে, আমার বাবা-মা ওদের বাসায় গিয়েছিল। যদিও কথা ছিল, আগে আমি ওর বাবার সাথে দেখা করবো। তারপর আমার ফ্যামিলি। আমাকে দুই একদিনের মধ্যে বাসায় যেতে হবে। আমার আর তিষাদের বাড়ি কাছাকাছিই। আমারের বাড়ি থেকে দুই তিন মিনিটের হাঁটা পথেই ওদের বাড়ি পড়ে। একসময় আমি ওর হোম টিউটর ছিলাম৷ ওর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান পাঁচ ছয় বছরের হবে। পড়াশোনার জন্য ও খালার বাসায় থাকতো। আর আমার হোস্টেল থেকে ওর খালা বাসায় যেতে দশ মিনিটের বেশি সময় লাগতো না৷ মেয়ে হিসেবে, প্রেমিকা হিসেবে ওর তুলনা হয়না। এতো সুন্দর মেয়ে কীভাবে আমার মতো দেবদাসকে ভালোবাসল কে জানে!
আম্মার সাথে কথা হলো। আমি আসলেই কাবিন করে রাখবেন। তারপর সময় সুযোগ করে বউ উঠিয়ে আনবেন। এতো ভালো যোগ্য মেয়ে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না৷ কথা সত্য। এই মেয়ের জন্য সরকারি চাকুরিজীবী পাওয়া যাবে। তারপরও মেয়ের জেদের কারণে আমার মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ছেলের কাছে বিয়ে কেন দিচ্ছেন? এটা নিয়ে আমার মাথা কখনো চিন্তা করেনি। তিষার গভীর ভালোবাসার ফলাফল এমনই হবার কথা। তিষা আর যাই করুক কখনো আমাকে ছেড়ে যায়নি। যেমন রোকাইয়া গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, সেদিনের পরে হয়তো ও যোগাযোগ করা শুরু করবে৷ কিন্তু হলো তার ব্যতিক্রম। ও উল্টো গা ঢাকা দিল। এদিকে আমিও অফিস নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কাবিনের জন্য তিন দিনের কম ছুটি নেয়া অসম্ভব। তাই আগে থেকে আমার যত কাজ আছে সব ঠিকঠাক করে নিচ্ছি। আমার বিয়ের খবরটা জানানো প্রয়োজন ভেবেই একদিন রাত দশটার দিকে ওর বাসায় উপস্থিত হলাম। দরজা না খুলে পাশের জানালা দিয়ে কথা বলল। এতো রাতে একজন পুরুষকে সে বাসায় কেন ঢুকতে দিবে? যদি সে তাকে সেক্সুয়ালি… আমি কখনো ওই উদ্দেশ্যে তার কাছে আসবো না। তার প্রতি আমার প্রচণ্ড ভালোবাসা কাজ করে। তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় তাকে কিছু মুহুর্তের জন্য পেতে ইচ্ছা করে। আমি জানি সে-ও আমাকে বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে এই বিষয়ে তাকে আমি টানতে পারি না। আমি তার চালচলনে বলতে পারি, সে ভালো নেই। হয়তো আমিই তাকে ভালো রাখার ক্ষমতা রাখি। কিন্তু আমার পরিবার আমাকে সে কাজে আসতে দিবে না। আমার মা তো রোকাইয়াকে ঘৃণা করে। এতটা যে সে, মোনাজাতে, কারণে অকারণে অভিশাপ দেয়। বদদোয়া করে যেন, এই মেয়ে কখনো সুখী না হয়। আসলেই তো রুকু সুখী তো দূরে থাক সুখ বলতে ওর এখনকার জীবনে কিছু নেই। সেদিন খাবার খাওয়ার সময় খেয়াল করেছিলাম। ডান হাতের আঙুল কেটে যাওয়াতে খেতে পারছে না। চামচ দিয়ে খেতে বললাম। তাতেও বেশি ভাত তার মুখে ঢুকলো না। খাবারের প্রতি তার অনীহা স্পষ্ট ছিল। এমনকি তার আচরণেও বোঝা যায়, এই জীবনের প্রতি তার চাওয়া পাওয়া বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। হয়তো আমাকে দেখার একটা সূক্ষ্ম আশা ছিল। যেটা পূরণ হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” এতো রাতে?”
” দরজা খোলো। ”
” এখান থেকেই বলো। ”
” তোমার কিছু ছিল আমার কাছে সেটাই ফেরত দিতে এসেছি। ”
” জানালা দিয়ে দাও। ”
বড়সড় একটা বাক্স দেখানোর পরে সে দরজা খুলতে বাধ্য হলো।
” এর মধ্যে কী? ”
” চিরকুট, গত পাঁচ বছর যাবত তোমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। এগুলো আর নিজের কাছে রাখতে পারবো না। ”
” ওহ ”
” কারণ জানতে চাইবে না?”
” তুমি বিয়ে করছ, তাই তো?”
” ফেসবুকে ফলো করো?”
” ঠিক তেমন না। হঠাৎ হঠাৎ তোমার খোঁজ নিতাম। তুমি ভালো আছ কিনা জানার জন্য৷ ”
” তোমার মতে আমি ভালো আছি?”
” হ্যাঁ, তিষা অন্যরকম সুন্দর। তোমার স্টুডেন্ট যখন ছিল তখন মনে হতো এতো সুন্দর মেয়ে রেখে আমার সাথেই বা কেন সম্পর্কে জড়ালে! ”
” তোমার মতে সৌন্দর্যই আমার ভালো থাকার উপায়?”
” সবার জন্যই ভালো থাকার উপায়। সবাই সুন্দরকে চায়। আমিও তো চেয়েছিলাম। তোমার মতো সুদর্শন যুবক আমি একটিও দেখিনি। ” রুকু হাসলো কথাটা বলে। ওর হাসি অসম্ভব সুন্দর। আমি তার হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার এখান থেকে যেতে ইচ্ছা করছে না৷ মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই। কিন্তু আমার মা আছেন, বাবা আছেন। রুকু হাসছে এখনো।
” you know you have a beautiful and pure soul. Maybe I’m… ”
ও যদি একবার বলে, যেও না। হয়তো এই ঘরের চৌকাঠ মাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার হবে না। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে জমে গেলাম। আমার ভেতরের এই চিন্তা আমাকে ধিক্কার জানালো। আমি এক মেয়েকে কথা দিয়ে এসেছি। সেই কথার মূল্য আমার কাছে নেই কেন?
( রোকাইয়া )
তিষাকে আমার আগে থেকেই পছন্দ ছিল না। মেয়েটাকে প্রায়ই তুহিন নিয়ে আসতো আমাদের কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া বা কোনো বিশেষ স্থানে যাওয়ার সময়। অপু স্যারের কাছে আমাদের যে ছবি গুলো ছিল। সবগুলোই কোনো রেস্টুরেন্টে বা সেসব স্থানের যেখানে আমরা তিনজনই উপস্থিত ছিলাম। অপু স্যারের কাছে কীভাবে যে সে ছবি পাঠিয়েছে তার একটা ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। যেহেতু অপু স্যার একজন সনামধন্য শিক্ষক কলেজের। উনি আবার ইন্টারের বইও লিখেন। কথায় কথায় তুহিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ” অপু স্যার না তোমার আত্মীয়? ”
” হ্যাঁ, একটু দূরের আত্মীয়। ”
” তুমি কতো লাকি! এমন একজনকে মেধাবী শিক্ষককে কাছাকাছি পেয়েছ। তুমি উনার কাছে পড়তে না?”
” না, উনার পড়ানো আমি বুঝতাম না। ” তুহিন আফসোস করে বলেছিল, ” আমি হলে উনার ঘরই ছাড়তাম না। ”
তখন ওইস্থানে তিষা উপস্থিত ছিল। স্যারের ফেসবুক আইডি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিল। তিষা উনার আইডি খুঁজে বের করে ছবি, ইনফরমেশন পাঠিয়েছিল। তাছাড়া স্যারের ওসব ছবি পাওয়ার কথা না। আমার ক্লাসমেটদের কেউই জানতো না। স্যার আমার আত্মীয় হন।
তিষা যা করেছে নিজের জন্য। আমার পরিবারের একটা বিষয় ও জানতো যে, আমার মা বাবা কোনোভাবে আমার সম্পর্কের খবর জানতে পারে। তাহলে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। তারা আমাকে বাসায় ফেরত নিয়ে যাবে। ওর উদ্দেশ্য ছিল, সম্পর্ক ভাঙা। কিন্তু শুধু সম্পর্ক ভাঙে নি সে। আমাকে আর তুহিনকেও ভেঙে দিয়ে গেছে।
তুহিন আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার অভিব্যক্তি আমি বুঝতে পারছি। আমি শুধু একবার বলবো, যেও না। ও যাবে না। এতো বছর পরেও ওর উপর আমার এই নিয়ন্ত্রণ টুকু আছে। যেদিন ওকে আমার বাসার সামনে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, তিষা ওর লোক দেখানো প্রেমিকা ছাড়া কিছু না। তা নাহলে এতকিছুর পরেও সে আমার খোঁজে এখানে ছুটে আসতো না। আমার সামনে থাকা এই মানুষটাকে আমার চাই, সারাজীবনের জন্য। আর তিষার করা কাজেরও একটা উত্তর আমার দেয়া উচিৎ। সে এতো সুন্দর একটা কাজ করেছে তার প্রতিদান না দিয়ে কি থাকা যায়?
আমি তুহিনের হাত ধরে কানের কাছে অস্ফুটস্বরে বললাম, ” যেও না। i want to be with you rest of my life. ”
তুহিন সাথে সাথে আমাকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো। যে স্বপ্ন সে এতদিন লালন করে এসেছে সেটা আজকে এই মুহুর্তে পূরণ হলো!
তিষা, ভালো থেকো।
সমাপ্তি।
Maria Kabir