#চুপিসারে
#পর্ব ৭
#রেহানা_পুতুল
নদীর সুরেলা গায়কীতে পুরো হলরুমজুড়ে এক অদ্ভুত সম্মোহনী পরিবেশ বিরাজ করছে।
নদীর পরিক্ষা শেষ হলে শ্রাবণ ও রজত কি বলবে তাকে? নাকি পরিবর্তিত রূপ ধারণ করবে দুজনের কথাগুলো। বদলে যাবে দৃশ্যপট?
গান শেষ করে নদী নম্র হেসে নিজের সিটে গিয়ে বসল। তার ভিতরটা ধুকপুক করছে শ্রাবণ শুনতে পেলো বলে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার বুকের ভিতরে। ভাবছে,
বড় ভাইয়া কি,গান গাইলাম কেন এজন্যও বকা দিবে নাকি? উনিতো আবার আমাদের তিন পরিবারের কর্তাবাবু। রজত নদীর দিকে আড়চোখে চেয়ে হেসে উঠলো মিটমিটিয়ে।
অনুষ্ঠানের সমাপনী ঘোষণার আগেই অতিথির আসন ছেড়ে চলে যায় শ্রাবণ। নদী আরো ভয় পেয়ে গেলো এবার। তার উপর বিরক্ত হয়েই কি চলে গেলো শ্রাবণ।
সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো যার যার মতো করে। রজত নদীর সাথে পায়ে পায়ে নানাদের বাড়ির কাছ পর্যন্ত চলে গেলো। যেতে যেতে মুগ্ধ কন্ঠে নদীকে বলল,
গান গাইতে পারিস কিভাবে? শিখেছিস নাকি?
নাহ শিখিনি।
তো?
আমার মামাতো বোন গান শিখতো। সপ্তাহে দুইদিন ওর গানের টিচার বাড়ি এসে ওকে গান শেখাতো হারমোনিয়ামে। ওর পাশে আম্মা আমাকেও বসতে বলতো। তার গানের টিচারকে আম্মা রিকুয়েষ্ট করেছে যেন আমার দিকেও একটু খেয়াল রাখে।
মামি কি তোকে সিংগার বানাতো নাকি?
মনে হয়। আম্মার গান ভীষণ পছন্দ। ইচ্ছে ছিলো নিজেই গান শেখার। কিন্তু পরিবেশ অনুকূলে ছিল না তাদের পরিবারে। পরে আম্মার বিয়ে হলে আমি জন্মাবার পরই নাকি আম্মা স্বপ্ন দেখেছে আমাকে নিয়ে। গান শিখাবে। আমি অনেক বড় গায়িকা হবো। আবার আমি নাকি সুর শুনলেই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আয়ায়ায়া করতাম।
এইই হলো বিষয়। এভাবেই ওর সাথে বসে থেকে থেকে কিছুটা আয়ত্ত হয়েছে।
ওহ বুঝলাম। তো এখনতো সিচুয়েশন ভিন্ন। তোর ইচ্ছেটা কি? হবি নাকি গায়িকা?
নাহ।
কেনো?
ভালোলাগে না কিছুই। মরাকন্ঠে বলল নদী।
রজত আর ঘাটালো না নদীকে। বলল,
তবে সুন্দর গাইতে পারিস তুই। পরিক্ষা শেষ হলে আমাকে নিরালায় একটা গান শুনাবি। আগেই বুক করে রাখলাম।
নদী দেখলো রজতের চোখেজুড়ে অপার মুগ্ধতা তার জন্য। সে ঈষৎ হেসে বলল,
আচ্ছা শুনাব।
বাড়িতে যা। আমি গেলাম। বলল রজত।
নদী বিষম খেলো। পা থামিয়ে দিলো। চকিতে চাইলো রজতের দিকে। বলল,
যাবো মানে? আপনি যাবেন না রজত ভাই?
নাহ।
কারণ?
কারণ বলতে বারণ এখন। দুষ্টুমিষ্ট চোখে জবাব দিলো রজত।
কার বারণ?
অধিকারসুলভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো নদী।
এত কথা বলা যাবে না। সমস্যা আছে। তুই বাড়িতে যা। পরিক্ষার জন্য পিপারেশন নে ভালো করে।
রজত পিঠ ঘুরিয়ে নদীর সম্মুখ হতে প্রস্থান নেয়। নদী বেকুবের ন্যায় রজতের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো। রজত তার দৃষ্টির আড়াল হলে সেও বাড়িতে চলে গেলো।
নদী তার পরিক্ষার আগের দিন বড় চাচা রফিক দেওয়ানের নতুন বাড়িতে গেলো।বড়দের সালাম দিয়ে দোয়া নিলো। এটা তাকে তার মা রুবিনা শিখিয়ে দিয়েছে। যদিও রুবিনা না শিখিয়ে দিলেও নদী যেতো। রফিক দেওয়ান দেওয়ান নদীর হাতে সালামি গুঁজে দিলো। এবং বলল,
আঁচার ও তোর যা খেতে ইচ্ছে করে খাবি। এখন তোর বড়মার থেকে আঁচার চেয়ে নিস। তোর জন্য আঁচার রেখেছে।
আচ্ছা চাচ্চু। খাবো।
আলতো হেসে বলল নদী।
মোরশেদা ভেজা হাত শাড়ির আঁচলে মুছে নিলো। পিরিচে করে নদীকে ঝালনাড়ু খেতে দিলো। মমতার স্বরে আফসোস করে বলল,
এক আঁচারের জন্য হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড করলো আরুর মা। এই মা তুই কত আঁচার খাইতে পারিস খাইস পরিক্ষার পরে। এখন ধর এগুলো খা, বলে ছোট এক বাটি জলপাইয়ের টক ঝাল মিষ্টি চাটনির আঁচার খেতে দিলো নদীকে।
নদী আঙ্গুলের ডগায় তুলে তুলে বাটির সব চাটনি খেয়ে নিলো। ঝালনাড়ুতে কামড় বসিয়ে উঠে গেলো। চাচাতো বোন সারথিকে নিয়ে বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরলো। দুজনে রসুই ঘরের কোনায় অবস্থিত পেয়ারা গাছের নিচে গিয়ে থামলো।
সারথি বলল,
নদী আপা, ওই যে দেখো পাকা পেয়ারা। পাড়তে পারবা?
তুই এখানে দাঁড়া। আমি গাছের উপরে উঠছি। নে ধর আমার ওড়নাটা। এটার জন্য উঠতে অসুবিধা হবে।
নদীর গাছের উপরে উঠে গেলো। পেয়ারা দুই তিনটি টপাটপ নিচে ফেলে দিলো। সারথি মনের আনন্দে সেগুলো কুড়িয়ে নিলো।
শ্রাবণ বাইরে থেকে ঘরে এলো। তার মা বলল,
নদী আসছে পরিক্ষার সালাম দিতে। তোর আব্বা ওরে সালামি দিলো।
খুব ভালো হয়েছে। কই এখন নদী?
সারথিকে নিয়ে মনে হয় ঘরের পিছনে একটু ঘুরতে গেছে।
ওর এখন ঘোরার সময়? কথাটি বলেই নদীকে খোঁজার উদ্দেশ্যে শ্রাবণ ঘরের পিছনে গেলো। গিয়ে মাত্র পা রাখতেই তার মাথায় বড় একটি পেয়ারা টুপ করে পড়লো। ব্যথা পেলো শ্রাবণ। মাথায় হাত চেপে ধরলো। মুখ তুলে গাছের দিকে চাইলো ঝাঁঝালো চাহনিতে।
নদী ভীরু চোখে পাংশুটে মুখে শ্রাবণের দিকে চাইলো। লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে বুকে ওড়না নেই বলে। শ্রাবণের সামনে নামতেও পারছে না। পা ঝুলিয়ে বসে আছে গাছের উপরে মগডালের মাঝে। শ্রাবণ ছোটবোন সারথির দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে কাঠিন্যতা ভর করলো। দেখলো তার কাঁধের একপাশে পড়ে আছে নদীর ওড়না। শ্রাবণ আস্তে করে ওড়নাটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। ছোট বোন সারথীকে আদেশ দিলো রাগান্বিত কন্ঠে ,
নদীর ভাগের পেয়ারা রেখে তুই ঘরে যা।
সারথি ভয়ে চলে গেলো চেয়ারম্যান বড় ভাইয়ের সামনে হতে।
শ্রাবণ গলা তুলে নদীর দিকে দৃষ্টি তাক করলো। কন্ঠে শাসন ও অধিকার মিশিয়ে,
এই নদী নেমে আয় নিচে জলদি।
নদী গাছ থেকে নেমে আসার সময় অনিচ্ছাকৃত শ্রাবণের চোখ গেলো নদীর সুডৌল বুকের উপরে। শ্রাবণ চট করেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
নদী নিচু মাথায় গাছ থেকে নেমে একপাশে দাঁড়ালো বুক ঘুরিয়ে।
বলল,
ভাইয়া খুউব স্যরি। আমি লক্ষ্য করিনি আপনাকে।
শ্রাবণ পিছন হতে ওড়না দিয়ে নদীর বুক আবৃত করে দিলো। মুহূর্তেই নদী কেঁপে উঠলো। পরক্ষণেই শ্রাবণ কচকচে একটা পেয়ারা হাতে তুলে নিলো। সজোরে দু’কামড় বসিয়ে খেয়ে নিলো। সেই পেয়ারা নদীর হাতে দিয়ে গমগমে স্বরে বলল,
পেয়ারা খেয়ে দেখলাম মিষ্টি আছে৷ এটা খেয়ে ফেল। তারপর বাকিগুলো নিয়ে সোজা বাড়িতে চলে যা।
নদী পেয়ারা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি অবনত মাটির দিকে।
কিরে পেয়ারা খাচ্ছিস না কেন?
খাব না এখন ভাইয়া। পরে খাবো। বাড়িতে গিয়ে।
চাপটে চামড়া খুলে ফেলবো তোর। পেয়ারা খাওয়ার জন্য গাছের উপরে চড়ে বসলি ছেলেদের মতো। কোনদিকে পেয়ারা ছুঁড়ে মেরেছিস সেই হুঁশটুকুও ছিল না। তাই বাড়িতে গিয়ে নয়। এখন আমাদের বাড়িতেই তোকে এই পেয়ারা খেতে হবে।
চাপা উত্তেজিত স্বরে বলল শ্রাবণ।
নদী অন্য একটি পেয়ারাতে কামড় দিতে যাচ্ছে, অমনি শ্রাবণ ফের ধমকে উঠলো। নদীর হাত থেকে সেই পেয়ারাটি কেড়ে নিলো। বলল,
অপচয় করা আমি একদম পছন্দ করি না। এটা খেতে যাচ্ছিস কেন? আমি যেটা থেকে খেয়েছি তুই এখন সেটা খাবি। পেয়ারা খাওয়ার শখ হয়েছে না তোর?
নদী শ্রাবণের দুই কামড় খাওয়া পেয়ারাটি খাওয়া শুরু করলো। চোখদুটো জলে টলমল করছে তার। শ্রাবণ সেটা দেখলো। পেয়ারার তিনভাগ খাওয়া হয়ে গেলে শ্রাবণ নদীর হাত থেকে পেয়ারার বাকি অংশ নিয়ে নিলো। বলল,
বুঝলাম আর খেতে পারছিস না। হয়েছে। এবার যা। পানিশমেন্ট খতম। পরিক্ষা ভালো করে দিস। কোন অসদুপায় অবলম্বন করিস না। আমি কেন্দ্রে আসব। আর রজত ত আছেই তোকে আনা নেওয়ার জন্য।
নদী মলিন মুখে শ্রাবণের সামনে হতে সরে গেলো। কারো কাছে না বলে বাড়িতে নিজেদের বাড়িতে চলে গেলো। তার দুঃখী দুঃখী অন্তরটা বেজায় খারাপ হয়ে গিয়েছে। মা কাছে নেই,বাবা প্রয়াত। আপন কোন ভাইবোন বলতে নেই। সবাই কেমন জানি তাকে বিষকাঁটার নজরে দেখে। নদী মনে মনে সিদ্বান্ত নিলো পরিক্ষা শেষ হলে মায়ের কাছে চলে যাবে নানার বাড়িতে। নিজের বাড়িতে ও বড় চাচার বাড়িতে থাকবে না। পরের বিষয় পরেই বিবেচনা করবে।
শ্রাবণ নদীর খাওয়া পেয়ারার অবশিষ্টটুকু তিন কামড়ে খেয়ে নিলো।
আজ নদীর পরিক্ষার শেষদিন। পরিক্ষা চলাকালীন শ্রাবণ দুই তিনদিন হলে গিয়ে নদীর পরিক্ষার খোঁজখবর নিয়ে এসেছে। আজও এসেছে কেন্দ্রে। ইচ্ছে ছিলো পরিক্ষা শেষ উপলক্ষে নদীকে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করাবে। পাশাপাশি কিছু কথা বলবে। কেননা বাড়িতে সেই পরিবেশ নেই।
এই কয়দিন নদীকে রিকসায় করে আনানেওয়া করেছে রজত। তাই বরাবরের মতো আজও রজত দাঁড়িয়ে আছে।
পরিক্ষা শেষ হয়ে গেলো। শ্রাবণ গেইটের সামনে বাইকে অপেক্ষমাণ নদীর জন্য। সব ছাত্রছাত্রী বের হয়ে গেলো। কিন্তু নদী আসছে না।মাঠ কিছুটা ফাঁকা। শ্রাবণ বাইক রেখে পায়ে হেঁটে মাঠের ভিতরে গেলো। এদিক সেদিক চেয়ে দেখলো নদী নেই। শ্রাবণ কেন্দ্রের পিছনের দিঘির পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো। দেখতে পেলো নদীকে। পাশে রজতকেও। শ্রাবণ পা ঘুরিয়ে চলে গেলো না। বরং লম্বা লম্বা কদম পেলে তাদের নিকটে চলে গেলো। নদী শ্রাবণকে দেখে হকচকিয়ে গেলো। শ্রাবণ নদীকে কিছু বলল না।
শুধু রজতকে বলল,
তোকে না আমি মানা করলাম? বললাম, আজ আমি নদীকে আনতে যাব। তুই যেতে হবে না।
রজতের টনটনে জবাব,
আমি তোকে কথা দিয়েছি নাকি আসব না বলে? সমস্যা কি? বাইক নিয়ে আসছিস না? একসঙ্গেই তিনজন যাবো।
শ্রাবণ কোন প্রতিউত্তর দিল না। ব্যক্তিত্বপূর্ণ ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে তাদের সামনে থেকে চলে গেলো। বাইক ছেড়ে দিলো ক্ষিপ্র গতিতে।
চলবে…
#চুপিসারে
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122113601558106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc