চুপিসারে (৬) #রেহানা_পুতুল

0
547

#চুপিসারে (৬)
#রেহানা_পুতুল
শ্রাবণ চোখ রাঙিয়ে জোরে ধমকে উঠলো নদীকে।
নদী দাদীর ইশারা পেয়ে কম্পিত বক্ষে পা টিপে টিপে শ্রাবণের সঙ্গে একাকী একটি রুমে প্রবেশ করলো।সেটা আরুর রুম।

শ্রাবণ রুমের ভিতরে ত্রস্ত পায়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। নদীকে তার সামনে খাটের কিনারায় বসতে আদেশ দিলো। দরজা পুরোপুরি খোলাই রইলো। নদী জুবুথুবু হয়ে দুই হাঁটু ঝুলিয়ে বসলো শ্রাবণের সামনে।

সে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে আগেই, কি বলা হবে তাকে এখন। নদী শ্রাবণের মুখ হতে কোন উপদেশ,জ্ঞান শুনতে চাচ্ছে না। লাভটা কি হবে বলে। ছোট চাচীর মানসিক নির্যাতন থেকে কি কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে? পারবে না। শ্রাবণের অবাধ্য হওয়ারও দুঃসাহস তার নেই। সে শিশুকাল থেকেই মায়ের সাথে নানাবাড়ি বড় হয়েছে। নিজের বাড়িতে এসেছে উপলক্ষ হলেই। যতবার এসেছে ততবার সে শ্রাবণকে দেখেওনি। যতটুকু দেখেছে ভয়ে তটস্থ রয়েছে।

শ্রাবণ স্বল্পভাষী নয় আবার মিষ্টিভাষীও নয়। তার স্বরে কেমন যেন একটা রুক্ষতা মিশে থাকে সবসময় শীতের প্রকৃতির মতো। পরিবারের ছোটদের সাথে সে বরাবরই শাসনের সুরে কথা বলেছে। নদীর সাথেও কখনো তেমন ভালোবাসা দিয়ে কথা বলেনি।

শ্রাবণ বিচলিত অথচ কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো নদীকে,

নদী বলতো, এই পৃথিবীতে তোর সবচেয়ে আপন কে?

নদী উত্তর দিতে মুহূর্ত নিল না। মাটির দিকে চেয়ে একশব্দে বলল,
আমার আম্মা।

তোর আম্মার পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন কে?

আমি।

ভেরি গুড! তো এবার বলতো,তাহলে তুই তোর সেই আম্মাকে একলা করে কেন চলে যেতে চেয়েছিলি?

নদী নিরব রয়। শ্রাবণ বলে উঠে,

ওকে। এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। হয়তো তখন তুই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিস। এখন আমি তোকে বলতে চাই,

তুই একবার ভাব,এমন কিছু করলে তুই চলে যাবি। বেঁচে যাবি। কিন্তু তোকে সবকিছু বির্সজন দিয়ে যেই মানুষটা বুকে আগলে ধরে এত বড় করেছে। তার কি হবে? তাকে তো তুই জ্যান্ত মেরে ফেললি তাহলে। এই তোর মায়ের প্রতি ভালোবাসা নদী? এই তোর সবচেয়ে আপনজনের প্রতি কর্তব্য? আর তুই না ছোট বেলায় মাদ্রাসায় পড়েছিস? সেখানে কি এই শিখিয়েছে তোর ওস্তাদেরা? সুইসাইড করার মতো নিকৃষ্ট কাজ করতে? এটা যে কত বড় জঘন্য মহাপাপ এটা বলেনি তারা? একজন সন্তানের জীবনে একজন মা কতখানি অমুল্য রত্ন তা অনুধাবন করতে পারছিস তুই?

নদী মাথা হেঁট করে আগের মতই বসেই রইলো।

তুই কি এখন আমাকে কথা দিতে পারবি? যতকিছুই হোক। কিন্তু তুই এমন ভুল ও নিষ্ঠুর সিদ্বান্ত নিবি না?

নদী ভেবে পায় না কি বলবে। সে মৌন হয়ে রইলো।

শ্রাবণ রাগত স্বরে বলল,

আমার এই কথার জবাব নাই তোর কাছে? তুই কচি খুকি? তোর সাথেরগুলো কলেজে পড়ে। মাদ্রাসায় পড়ার জন্য তোর দুই বছর গ্যাপ গেলো। তুই পিছিয়ে গেলি। কিন্তু তোর বয়সতো পিছায়নি?

নদী মিনমিন কন্ঠে বলল,

চাচী মাঝে মাঝে এমন উপহাস করে কথা বলে, মেনে নেওয়া যায় না। মনে হয় আমি এই বাড়ি,এই পরিবারের মেয়ে নই। আশ্রিতা। সবার করুণায় এখানে আছি।

শ্রাবণ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নদীর মাথার উপরে নির্ভরতার হাত রাখলো। বড় ভাইসুলভ ভঙ্গিতে বলল,

আমি এই পরিবারের সন্তান হিসেবে সবার কাছে যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক তুইও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি এবং তুই এই দেওয়ান পরিবারে সমমর্যাদার অধিকারী। আমি রাজনীতি করি। চেয়ারম্যান হয়েছি। সেসব বাইরে। ঘরে নয়। ঘরের ভিতর তুই যা, আমিও তা।

সমস্যা আছে যেখানে, সেখানে সল্যুশানও আছে। মনে রাখিস। পৃথিবীতে কোন সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়। ক্ষণস্থায়ী। সাময়িক।

পরিক্ষা শেষ হলেতো দুই পরিবারেই থাকবি ছয়মাস করে। মাঝে তোর আম্মার কাছেও যাবি। ব্যাস, বছর শেষ হয়ে যাবে। কোন পাগলামি করবি না৷ খবরদার। তোকে আরো কিছু কথা বলব। তবে এখন নয়। তোর পরিক্ষা শেষ হলে। তবেই।

শুনে নদী ধরে নিলো শ্রাবণ হয়তো এমন আরো কিছু উপদেশ বাণী শুনাবে তখন। তার মতো দুই আনার সস্তা কড়ির সাথে একজন শিক্ষিত, স্মার্ট, সুদর্শন চেয়ারম্যানের আর কিইবা কথা থাকতে পারে।

শ্রাবণ বলল,

এই ভিতরে বেশী খারাপ লাগলে আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসিস আরু, নিরুকে নিয়ে। ভালোলাগবে। কেমন? মন দিয়ে পড়াশোনা কর। রেজাল্ট ভালো হলে যেটা চাইবি আমার কাছে সেটাই পাবি।

নদী মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো।

শ্রাবণ দাদীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। যেতে যেতে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলল, নদীকে কিছুটা হলেও মোটিভেটেড করতে পেরেছে বলে।

হাফসা বিবি নদীকে জিজ্ঞেস করলো,
শ্রাবণ এতসময় তাকে কি বলছে?

নদী সব বলল দাদীকে।

শুনে হাফসা বিবি আক্ষেপের ঝড় তুলল নদীর নিয়তির কথা মনে করে। এবং বলল,

তাইলেতো শাবন ম্যালা ভালা কথাই কইছে। তোর মঙ্গলের কথাই কইলো।

নাহার শহরে চাকরি করা স্বামী শফিকের সাথে ফোনে আরুর বিষয়ে কথা বলল। দুজন ঠিক করলো আরু কয়দিন পর দশম শ্রেণীতে উঠবে। তখন মুখোমুখি বিয়ের কথা ফাইনাল করবে দুই পরিবার মিলে। বিষয়টা আরু কিংবা নদী কেউই জানে না। সবাই আপাতত তাদের দুজন থেকে এই বিষয়টা আড়াল করেছে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে বলে।

নদীর এস এস সি পরিক্ষা সামনে। এই ভিতরে নাহার বেগম নদীর সাথে তেমন দুর্ব্যবহার করেনি। খাবারের সমবন্টন বা গৃহস্থালি কাজকর্ম নিয়ে গাইঁগুঁই করতে গিয়েও পারে না। আরু বাধ সাধে। মায়ের উপর অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে। তবে নদীকে মিষ্ট ভাষায় তুষ্ট করতে জুড়ি মেলা ভার তার।

আমগো নদী জজ ব্যারিস্টার হইবো। উকিল হইবো। ডাক্তার হইবো। পরের বাড়ির গিয়া গতর খাটা লাইগবো না। নদীর মায় সাধে কি আর বাপ মরা মাইয়ারে আমার কাছে পাঠাইছে। বাপ নাই কি হইছে। হে মাইয়ারে বড় কিছু বানাইবো। নদী কিছু হইলেতো আমাদেরও তো বড় মুখ। আমরাও তো ফুটানি মারতে পারুম। আমগো দেওয়ান পরিবারের মাইয়া কত বড় কিছু হইছে এহন।
দেহি নদী যদি একটা কিছু হয়, তাইলে তার পিছন দিয়া আরু নিরুকেও একটা কিছু বানামু।

নাহার বেগমের ফোঁড়ন কাটার কথার সারবস্তু বুঝতে নদীর কোন অসুবিধা হয় না। তবুও নদী নিরব থাকে।

ও নদীইই.. কলপাড়ে পইড়ে থাকা বাসনগুলো ধুইয়া আন।

ও নদীইই…উঠান থেইকা কাপড় গুলান নিয়া আয়।

নদীইই…ধর তোর দাদীরে ভাত গুলান নিয়া দে।

নদীইই..ঘরটা এট্টু ঝাড় দিয়া দেনা। পানির মগটা ভইরা আন।

ও নদীইই..রসুই ঘর থেইকা লাকড়ি গুলান আইনা উঠানে রইদে মেইলা দে।

বিছানা চাদরটা বিছায়া পালা। তোগো তিন বইনের জামাকাপড়গুলা আলনায় গুছাইয়া রাখ।

সবার অলক্ষেই নদীকে দিয়ে নাহার বেগম এমন ফুট ফরমায়েস খাটায়।

নদীও নত মাথায় মলিন মুখে যা পারে তা সব কাজই করে দেয় চাচীকে।

রজত সেই যে গেলো আর দেওয়ান বাড়িতে পা রাখেনি। সে নদীর পড়ালেখার তদারকি করে তার স্কুলে গিয়ে। একদিন স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে নদীকে নিয়ে ঝাল চটপটি খাচ্ছিলো রজত। প্রসঙ্গত নদীকে বলল,

তোর ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হোক। আমার জরুরী কথা আছে তোর সাথে।

নদী পুলকিত অনুভব করলো। লাজুক হাসলো। মুখ ফুটে বলেই ফেলল,

আচ্ছা আমিও শুনব, কি এমন জরুরী কথা। আগে দোয়া করেন রজত ভাই। আমার পরিক্ষাটা যেনো ভালোর ভালো শেষ হয়ে যায়।

আমাদের পাগলীটা। তোর জন্য শুধু দোয়া? বুক ভরা ভালোবাসাও আছে আমার।

নদীর কোচিং শুরু হলে সে ক্লাসের ভিতরে চলে যায়। কিছু বলা হল না আর তার।

তার সপ্তাহ খানেক পরে এসএসসি পরিক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে স্কুলে মিলাদ মাহফিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ অতিথি নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান শ্রাবণ।
স্কুলের নিকটবর্তী রজতদের বাড়ি। সেই সুবাদে এই স্কুলে রজতসহ এলাকার কিছু শিক্ষিত যুবক ছেলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য রয়েছে। ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে তারাও ছাত্রছাত্রীদের সামনের সারিতে উপবিষ্ট রয়েছে।

একে একে শিক্ষকগণ সবাই বক্তৃতা দিলো বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। চেয়ারম্যানও তার মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করলো। জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হলো। সবাই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে কেউ গান,কেউ কবিতা,কেউ গল্প,কেউ কৌতুক,কেউ নাচ করলো। উপচে পড়া করতালিতে বিদ্যালয়ের হলরুম মুখরিত হয়ে উঠলো। আচমকা নাজমা নামে এক ম্যাডাম নদীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বলে উঠলেন,

এই নদী তুমি না গাইতে পারো। ছোট ভাইবোনদেরকে একটা গান শুনিয়ে দাও তোমার মিষ্টি গলায়।

শুনে রজত অবাক হলো। নদী গাইতে পারে?
শ্রাবণ চমকে উঠলো হঠাৎ এমন কিছু শুনে নদী সম্পর্কে। সে থম মেরে রইলো। তবে দৃষ্টি প্রসারিত নদীর মুখপানে।

নদী ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। কাঁচুমাচু শুরু করলো। ক্লাসের বন্ধুরা তাকে উৎসাহ দিতে লাগলো গাওয়ার জন্য।

নদী উঠে আসো? সমস্যা নেইতো।

ম্যাম প্রস্তুতি নেই যে?

লাগবে না। মিউজিশিয়ানরাতো আছেনই। কাবার হয়ে যাবে।

সাধারণ পোশাক পরিহিত নদী ধীর পায়ে উঠে যায়। হাতে নেয় মাইক্রোফোন। গেয়ে উঠে গান।

” আ..আ..আ..চঞ্চলা হাওয়ারে ধীরে ধীরে চলরে,
গুন গুন গুঞ্জনে ঘুম দিয়ে যারে।

পরদেশী মেঘ রে,আর কোথা যাসনে।

বন্ধু ঘুমিয়ে আছে, দে ছায়া তারে, বন্ধু ঘুমায় রে..
আয়রে মেঘ আয়রে..

ওগো ফুল তুমি আজ ঝরে যাও না..
এই মধুক্ষণে বাসর সাজাও না…”

রজত চোখ বন্ধ করে বিবশ হয়ে শুনছে। তলিয়ে যাচ্ছে নদীর গভীরে।

শ্রাবণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছে নদীর গান। এক আশ্চর্য চোখে চেয়ে আছে নদীর দিকে। এ কোন নদী আবিষ্কার হলো আজ তার সম্মুখপানে।

নদীর সুরেলা গায়কীতে পুরো হলরুমজুড়ে এক অদ্ভুত সম্মোহনী পরিবেশ বিরাজ করছে।

নদীর পরিক্ষা শেষ হলে শ্রাবণ ও রজত কি বলবে তাকে? নাকি পরিবর্তিত রূপ ধারণ করবে দুজনের কথাগুলো। বদলে যাবে দৃশ্যপট?

চলবে

অপেক্ষা করুন আগামী পর্বের জন্য, আর পেজে লাইক ফলো দিয়ে কমেন্ট করে রাখেন বাকি পর্ব পোস্ট করেই কমেন্ট বক্সে দিয়ে দেবো লিংক।

#চুপিসারে
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122113601558106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here