#শরতের_শিশির ( ৩ )
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
কানের কাছে মুঠোফোন ধরা। চাঁদনী ফের চমকাল। মুহূর্তে মুখশ্রী শক্ত হয়ে গেল। আবার এই ছেলে। মুখ কুঁচকে কিছু বলার জন্য উদ্বত হল। কিন্তু তার বাবার ব্যগ্র দৃষ্টি তার দিকে। ভাতের থালায় হাত তাকলেও মুখে শুধু একটাই বুলি আওড়াচ্ছে সেলিম।
‘কে’ রে চাঁদনী তোর মা’।
চাঁদনী ঘাবড়াল। কি বলবে এখন। একদিকে বাবা, অন্যদিকে এই ছেলে। মুখে রা’ নেই তার। তড়িৎ মাথায় বুদ্ধি এল। কিঞ্চিৎ দু’ঠোঁট ফাঁক করে হেসে উঠল। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা আনিসা।’
মুঠোফোনে থাকা ব্যক্তির উদ্দেশ্য বলে উঠল, “হ্যাঁ’রে আনি’ তোর মাথায় কি গোবর ঠাসা। তোকে তো আসার সময় বললাম। আমি বাড়ি যাচ্ছি। কাল টিউশন করব না। তাও কল দিতে হয়। তুই দিন দিন এত বলদ হয়ে যাচ্ছিস কেনো বলতো? পড়াশোনায় একটু মনোযোগ দেয় না ভাই। তা তো করবি না। সারাদিন খালি পড়া ফাঁকি দেয়ার ধান্ধায় থাকিস। এখন রাখ। আমি খেতে বসছি। আবার কল দিয়ে জ্বালাবি তো, তোর পা ভেঙে তোর গলায় ঝুলিয়ে দিব কিন্তু।”
তার কথার মাঝে ওপাশ থেকে একটাই বাক্যেই ভেসে এল। ‘প্লিজ কল’টা কেটো না। তোমাকে কিছু কথা বলব। তারপর আমি নিজেই কল কেটে দেব।’
চাঁদনী শুনল না। তড়িৎ কল কাটল। ফোন অফ করে বিছানায় ছুঁড়ে মারল। বাবার কাছে ধরা খেলে এখন মান সম্মান সব যাবে। সেলিম মেয়ের কান্ডে হতবাক। নিজের খাওয়া ছেড়ে মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলেন। আচম্বিত বলে উঠল,
“মেয়ে’টাকে এভাবে ঝাঁড়লি কেনো? না হয় তোর কাছে একটু সাহায্য চেয়েছে। তাই বলে এভাবে কঠিন ভাষায় কথা বলবি। মেয়ে’টা রাগ করবে না।”
চাঁদনী বাবার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার বাবা যদি সত্যি’টা জানত এখন তার অস্তিত্ব থাকত মাটির তলায়। নিশব্দে হতাশার সুর তুলল। বাবার কথার জবাবে বলল, “বাবা তুমি জানো না। আনি অনেক নাছোড়বান্দা। তাকে এর থেকে বেশি বললেও তার রাগ করবে না। পড়াশোনা একদমই করে না। তাই মাঝে মাঝে তাকে ঝাঁড়তে হয়।”
সেলিম মুচকি হাসলেন। মেয়েটা একদম তার মতই হয়েছে। তার ক্লাসের রকিবুলকে সে কত উত্তম মাধ্যম দিত। কত গালমন্দও। কিন্তু দিনশেষে ছেলেটা তার কাছে কুকুর ছানার মতই ঘুরঘুর করত। গা ঘেঁষে বসত। আচমকা নিজের স্কুলের কিছু স্মৃতি রোমন্থন করল। আহ্! সে দিনগুলো আর ফিরবে না। মেয়ের দিকে তাকালেই আজকাল নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান। বাইশ বছর বয়সে মেট্রিক পাশ করার পর আর পড়া হয়নি তার। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে নিজের পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নেন তখন। তিন’টা ছোট বোন বিয়ের উপযুক্ত। তাই নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে নেন। কলেজে ভর্তি হয়েও আর কখনো যাওয়া হয়নি তার। নিশব্দে আক্ষেপের নিশ্বাস ছাড়ল। এজন্য নিজের মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করছেন। যাতে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত থাকে।
খাবার শেষে বই নিয়ে বসল চাঁদনী। ক্ষানিক পড়ে তারপর শুয়ে পড়বে। ঘড়ির কাটায় তখন রাত দশটার ঘরে। মুঠোফোন এখনো বন্ধ করে রেখেছে। অত্রের জ্বালায় অতিষ্ঠ সে। নাম্বারটাই চেইঞ্জ করবে। কিন্তু তা’ করতে গেলে সবাইকে আবার কৈফিয়ত দিতে হবে। বালিশের পাশে রাখা মুঠোফোন অন করল। মেসেজের টুংটাং শব্দ হতে লাগল ক্রমাগত। মেসেজের বহর দেখে চক্ষুদ্বয় কুঁচকে আছে। বাপরে! এই ছেলে এত ধৈর্য্য কৈ পায়? একটা মেসেজ পড়ে থমকাল বেশ।
“তুমি নিজেকে কি ভাবো ‘বিশ্ব সুন্দরী’? অথচ নিজের চেহারা দেখেছো। বাংলার পাঁচ মার্কা চেহারা নিয়ে আবার দেমাগ দেখাও। উহুহ, নিজেকে নায়িকা ভাবা বন্ধ কর। তোমার মত মেয়েদের আমি রোজ পকেটে নিয়ে ঘুরি। এত ভাব আমার সাথে দেখাবে না। গুড বাই।”
রাগে গজগজ করে উঠল চাঁদনী। কি হাস্যকর ব্যাপার স্যাপার। একে তো তাকে বিরক্ত করছে। আবার তাকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। ইচ্ছে করছে এই ছেলের কানের নিচে গিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে আসতে। মাথায় নির্ঘাত ব্যামো আছে এই ছেলের। রাতে বিছানায় গড়াগড়ি করল। সারারাত তার ঘুম ধরল না। বার বার সেই মেসেজ পীড়া দিচ্ছে তাকে। ভারী অদ্ভুত ঠেকল। মাত্র একদিনে এই ছেলের এত পরিবর্তন! কীভাবে সম্ভব!
_
তিনদিন পর কলেজ আসল চাঁদনী। কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আজ প্রথম আসল। ক্লাসে প্রবেশ করার পথে রেবেকার সাথে দেখা হল। রেবেকা তাকে দেখে কুশল বিনিময় করল। এতদিন কলেজ না আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে চাঁদনী তার জবাব দিল বেশ রয়েসয়ে। ধীর কদমে প্রবেশ করতে করতে জবাব দিল,
“নিজের বাড়ি গেছিলাম। মা’ নানুর বাড়ি ছিল। তার জন্য কলেজ আসা হয়নি।”
রেবেকা ছোট্ট করে বলল, ‘অহহ’ আচ্ছা।
তিন নম্বর সারির দ্বিতীয় টেবিলে বসল রেবেকা। তার পাশে চাঁদনীও বসল। সে বসল বেঞ্চের প্রথম প্রান্তে। তার চক্ষুজোড়া কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছে। যেন দেখা হলে তার অস্থির মন শীতল হবে। তবে দেখা হল না তার। ক্লাস শেষে ক্লান্ত পথিকের মতই বাসায় ফিরছিল। হঠাৎই চোখ পড়ল অদূরে থাকা রেষ্টুরেন্টের দিকে। হাসিমাখা মুখশ্রীর এক পুরুষ অবয়ব দেখে আবার অদ্ভুত লাগল। এই ছেলে কি’না বার বার ফিরে আসবে তার কাছে? কিন্তু এইভাবে? আসলে মানুষ পরিবর্তনশীল। দ্রুতই নিজেকে বদলাতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের গন্তব্যের দিকে কদম বাড়াল। পিছু তাকানোর সাধ্যি নেই তার।
_
সময় ফুরাল নিজের মতই। গত একমাসেও কোন কল, মেসেজ আসেনি অত্রের। সেদিনের পর তো আর নই। আজকাল তেমন কলেজেও দেখা যায় না। চাঁদনী যেনো খৈ হারাল। আগের মত পড়ায় মন বসে না তার। কিছু একটা খুব মনে পড়ে। নিজের মুঠোফোনে দিনে অজস্রবার চোখ বুলায়। তবে শেষের মেসেজ’টা পড়ে রাগে গজগজ করে উঠে মাঝেমধ্যে। ইচ্ছে করে দু’চারটা কথা শোনাতে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। সে তো আর নিজ থেকে কল দিবে না। আর অত্রও নিজ থেকে কল দিচ্ছে না। আশাহত হল। দিনগুলো এভাবে অসহনীয় কাটছিল তার।
কিছুদিন পর তাদের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শুরু হল। সেদিন অত্র উপস্থিত হল। পাশাপাশি বেঞ্চ না হলেও তার পাশের সারির তিন নাম্বার টেবিলে বসল। সে ছিল দ্বিতীয় সারির পাঁচ নাম্বার টেবিলে। অত্রের ব্যাকসাইড তার নজরে আসল। আনমনে বার বার সেদিকে তার নজর পড়ল। নিজেকে সংযত করে পরীক্ষা দিয়ে বের হল। অত্র জানালার পাশে ছিল। করিডোর পার হওয়ার মূহুর্তে ইচ্ছে করেই এক ঝলক অত্রের খাতার দিকে নজর দিল। এডাম স্মিথের পরম ব্যয় সুবিধা তত্ত্ব খাতায় লিখছে। তবে বার বার এদিক সেদিক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বেচারা! একটু পড়লেই তো লিখতে পারত। কি দরকার এদিক ওদিক তাকানোর। কিন্তু তার একটা বিষয় দেখে অবাক লাগল। আজ একবারের জন্যও অত্র তার দিকে তাকায়নি। ভীষণ অদ্ভুত লাগল !
বাসায় এসে নিজের মুঠোফোন হাতে নিতেই ভেসে উঠল একটা ক্ষুদে বার্তা। সে চমকাল। মুখ থমথমে। এক মাস পনের দিন পর অত্র তাকে মেসেজ দিয়েছে। দ্রুতই মেসেজ ওপেন করল।
‘আজ তো ফাটিয়ে দিয়েছো। এত লিখা কেমনে লিখ। কতগুলো কাগজ নিলে। আর আমি একটা খাতাই শেষ করতে পারি না। কি লিখ এত। ডানে বামেও তো একটু তাকাতে পার। একজন অসহায় ব্যক্তি তোমার পাশে ছিল। অথচ একটু তাকালেও না। যদি পার, তোমার মাথার মগজ একটু ধার দিবে আমাকে। নিজেকে তোমার মত পড়াকু বানাতাম। দিবে তো ‘মুনলাইট’।’
কাতর মুখশ্রী মূহুর্তে উচ্ছ্বসিত হল। অধরকোণে আচমকাই মুচকি হাসির আভাস ফুটে উঠল। বার কয়েক মেসেজ’টা পড়ল। ইচ্ছে করছিল উত্তর হিসেবে একটা বার্তা তারও পাঠাতে। কিন্তু মনের কোণে লুকায়িত সুপ্ত রাগের কারণে উত্তর দেয়া হল না। তবে অপেক্ষায় আছে অত্রের কলের। কল দিলে আজ সে কথা বলবেই। একদমই ছাড়বে না।
চলবে,,,,,