#শরতের_শিশির (৪)
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
নির্জন ক্লাসের এককোণে বসে আছে চাঁদনী। অন্তঃকরণ তার তিক্ততায় পূর্ণ। সকালে মা’ কল দিয়েছে। আজ না’কি পাত্রপক্ষ আসবে। কলেজ ফটকে দাঁড়াবে। তারা দূর থেকে তাকে একপলক দেখবে শুধু। পছন্দ হলে কথা আগাবে নয়ত এখানে শেষ হবে। মায়ের সাথে এই নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে তার। বিয়ে যে করবেনা তা তো নয়। কিন্তু তার যে কিছুদিন পর তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। এমন সময় হুটহাট বিয়ে নিয়ে কথা বললে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। তার যতবারই পরীক্ষা আসে ততবারই এমন উটকো ঝামেলা এসে পড়ে। অস্থিরতায় দু’পায়ের পাতা এখনো কাঁপছে। কেমন হাসফাস লাগছে নিজের কাছে। তার নিশ্চুপতায় সঙ্গ দিতে আচমকাই রেবেকার আগমন ঘটল। মুখের কোণে ঈষৎ সুপ্ত হাসি তার। চাঁদনীকে ক্লাস রুম থেকে হিড়হিড় করে টেনে আনল।
‘দেখ চাঁদনী’ তোর হিরো আসতেছে।’
চাঁদনীর বিস্মিত আঁখি জোড়া। কিছু বোঝার আগেই রেবেকার হাতে বাহুবন্ধি হল। করিডোর থেকে সোজা মাঠ দেখা যায়। মাঠের একপাশে ক্লাসে প্রবেশ করার পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তা। কলেজ মাঠ পেরুলেই মূল ভবনের গা ঘেঁষে শত বছরের তিনটে কড়ই বৃক্ষ। তাদের মেলে দেয়া ডালপালা খেলার মাঠ, পিচঢালা রাস্তা আর ভবনের অর্ধেক জুড়ে শীতল ছায়ার কাজ করে। গাছের ডালপালার জন্য প্রথমে কিছু ঠাউর করতে পারল না চাঁদনী। শেষে দৃশ্যমান হল খেলার মাঠ। পাশে দাঁড়ানো কালো শার্ট পরিহিত পুরুষ অবয়বকে দেখে তার শরীর শিরশির করে উঠল। বুঝতে পেরেই চোখমুখ শক্ত করল। রেবেকার দিকে তাক্ষণিক তার কোপিত স্বর ভেসে আসল।
‘মাথা খারাপ না’কি তোর? মানুষ খুঁজে পেলি না আর।’
তাদের মাঝের কোলাহল দেখে আনিশাও প্রবেশ করল। সেও রেবেকার সুরে সুর তুলল। দু’জন মিলে তার মজা উড়াল অনেকক্ষণ। চাঁদনী দু’জনের দিকেই চোখ পাকালো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। রেবেকা তার মত বলেই গেল।
‘তোর হিরো কতদিন পর কলেজ এল। কোথায় তাকে ওয়েলকাম করবি, তা’না। উল্টো আমাদের চোখ পাকাচ্ছিস। বুঝি’ বুঝি’ আমরা সব বুঝি।’
‘মাথা গরম করিস না’তো!’
চাঁদনী আর দাঁড়াল না। এদের দু’জনের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যা বলবে তার উল্টো বুঝবে এখন। নিজের রাগ চেপে ক্লাসে প্রবেশ করল। পিছন থেকে দু’জনের খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসছে। সে ধ্যানমগ্ন হল। এ দু’জন অত্রের কথা জানল কিভাবে? সে’তো এদের সাথে এসব নিয়ে কখন আলোচনা করেনি। তাহলে,, একটা কিন্তু থেকে যায়।
আনমনে গত তিন মাসের স্মৃতি রোমন্থন করল। সেই রাতে অত্র কল দিলেও সে রিসিভ করেনি। ইচ্ছে করেই যতবার কল দিয়েছে ততবারই সে কল কেটেছে। পুরো সপ্তাহ অনবরত অত্রের এভাবে কল আসল। কিন্তু সে পূর্বের ন্যায় নিজের ঠাঁট বজায় রাখল। তাকে বাংলার পাঁচ বলা, বিভিন্ন কুটুক্তি করা। এসবের প্রতিশোধ তুলল কল রিসিভ না করে। এর পরের একমাস অত্রের কল আসেনি। তবে মাঝে মাঝে ক্ষুদে বার্তা আসত। অদ্ভুতভাবে সে দেখত। রাগ হলেও কেনো যেন ভাল লাগত। একাকী বসে বসে পড়ত। আবার মাঝে মধ্যে কেন যেন প্রচন্ড ক্রোধান্বিত হত। এভাবেই চলছে গত তিনমাস ধরে। গত ছ’মাস ধরে অত্রকে চেনা-জানা হয়েছে তার। আগে অত্রকে চিনলেও এতটা কাছ থেকে দেখিনি কখনও। কিন্তু কেনো যেনো তার সাথে জমে না খুব একটা। প্রণয় তো বহুদূর, ঠিকভাবে কথাই হয় না।
ক্লাসে অনেক দিন পর অত্রের আগমন ঘটল। প্রথম সারির শেষের দিকে বসেছে সে। চাঁদনী দ্বিতীয় সারির প্রথম বেঞ্চিতে বসা। অত্রের সাথে চোখাচোখি হল আচমকাই। অত্র চোখ সরিয়ে নিল দ্রুতই। ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডোরের শেষ প্রান্তে দাঁড়াল। কড়ই গাছের ডালপালার সাথে হেলান দিয়ে আছে। তার বন্ধু ইফাজকে পাঠাল চাঁদনীকে ডাকতে। সে চাঁদনীর সামনে ত্রস্ত পায়ে এসে দাঁড়াল। মিনমিনে বলল,
“চাঁদনী’ তোমাকে অত্র ডাকছে।”
চাঁদনী সোজাসাপটা জবাব দিল, ‘কথা বলার হলে এখানে আসতে বল। আমি যেতে পারব না।’
ইফাজ আশাহত হল। সে আবার অত্রের কাছে দ্রুতই ছুটল। অত্র এবার যেন ধৈর্য্যর বাঁধ ভাঙল। তড়িৎ ছুটে এল চাঁদনীর কাছে। সামনা সামনি দাঁড়ানো। চোখমুখে রক্তিম আভা ছড়ানো। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। চাঁদনী মাথা নিচু করে বসা। ঘটনার রেশ বুঝতে পারল সে। সাহস করে অত্রের দিকে মুখ তুলে চাইল না। অত্র ভণিতা না করে বলে উঠল,
‘তোমার এত অহংকার কিসের? ছাত্রী হিসেবে মেধাবী বলে না’কি পড়াশোনায় তোমার মত নই বলে। কোনটা চাঁদনী?’
চাঁদনী উত্তর দিল না। আগের মতই চুপ করে আছে। ক্লাসের সবারই উৎসুক দৃষ্টি। অত্রের ব্যাপারে সবারই কমবেশি বিশেষ আগ্রহ আছে। তার উপর যদি হয় পড়াকু চাঁদনীর সাথে। তাহলে তো কথাই নেই। কেউ মিটমিট করে হাসছে তো আর কেউ ফিসফিস করছে। অত্র তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। ফের বলে উঠল,
‘আমি কি ছেলে হিসেবে খুব খারাপ না’কি তোমার কারো সাথে সম্পর্ক আছে। তাই আমাকে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন মনে করছো না। কোনটা চাঁদনী?’
চাঁদনী তব্দা খেয়ে গেল। দু’ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলে অত্রের দিকে চাইল। রাগে কন্ঠস্বর ভীষণ কাঁপছে। কঠিন স্বরে জবাব দিল,
‘আমার ইচ্ছে তাই! তোমাকে পাত্তা দেয়া কি আমার একান্তই প্রয়োজন। তা’তো আমার মনে হয় না। তুমি এতটাও বিশেষ কেউ নও আমার।’
‘তাই না’কি!’
‘হুমম।’
‘তাহলে তো বিশেষত্ব দেখাতেই হই। তৈরি থেকো মুনলাইট।’
অত্র হনহন করে বেরিয়ে গেল। চেপে রাখা নিশ্বাস ছাড়ল চাঁদনী। এতক্ষন তার জান বেরিয়েই যাচ্ছিল। ক্রমাগত অস্থিরতা বাড়ল তনুমনে। সকাল থেকেই হৃদকোণ বিষাদময় হয়ে আছে। আজকে কেন সবকিছু একসাথে হচ্ছে তার সাথে। অত্র কি করবে তার সাথে। ভয় চেপে ধরল তার অন্তঃকরণে। আচমকাই ক্লাসের ঘন্টা পড়ল। কিয়ৎক্ষন পরে টিচার আসবে। রেবেকা আর আনিসা তার দিকে এক ভ্রু উঁচিয়ে মুখ টিপে হাসছে। সে অবাক হল না। এখন সবারই দৃষ্টি তার দিকে।
_
ক্লাস শেষে বের হতেই মুঠোফোন কর্কশ ধ্বনি তুলল। চাঁদনী বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকাল। তার ভালই জানা আছে এখন তার মা’ কল দিয়েছে। কলেজ মাঠের পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তা ধরে হাঁটছে। মায়ের কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভারিক্কি আওয়াজ ভেসে এল,
‘চাঁদনী’ তুই কলেজ গ্রেইটের পাশের নার্সারির দোকানে যাবি। কিছু কিনার না থাকলেও কিছু চারাগাছ কিনবি। যাবি তো? না’কি আবার যাবি না। দেখ মান-সম্মানের ব্যাপার স্যাপার। একটা মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত থাকলে এরকম হরহামেশাই বিয়ের জন্য আসে। আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। তাই যেভাবে বলছি সেভাবে কাজ করবি কিন্তু।’
চাঁদনী উত্তর দিল না। মায়ের কথামতো নার্সারির দোকালে ঢুকল। আঁড়চোখে পুরো দোকান পরখ করল। দু’জন মধ্যবয়স্ক লোক ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ল না তার। এতসব ভাবল না। দু’টো চারাগাছ কিনল। পাশের একজন লোক বলে উঠল,
‘মা’ তোমার নাম কি?’
‘চাঁদনী।’
‘বাড়ি কোথায় মা’?’
‘শিবপুর মজুমদার বাড়ি।’
‘অহহ, আচ্ছা। ঠিক আছে যাও মা’।’
চাঁদনী চোয়াল শক্ত করে বেরিয়ে এল। পথিমধ্যে দেখল তার কলেজের কিছু ছাত্র-ছাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। সে তেমন কিছু ভাবল না। ছুটল নিজের গন্তব্যের দিকে। গাড়িতে বসার মিনিট পনের পরেই নিজের বাসায় পৌঁছাল। গাড়ি থেকে নামতেই তার চোখ পড়ল অদূরে দাঁড়ান এক পুরুষ অবয়বের দিকে। হৃদপিণ্ড দ্রুতই উঠানামা করল। পুরো শরীর কাঁপছে। এভাবে তার বাসার সামনে অত্রকে একদমই আশা করেনি। পায়ের কদম থমকে দাঁড়িয়ে আছে। আগানোর সাহস হল না। চারপাশে একবার চোখ বুলালো। কোনও ভাড়াটিয়া যদি এখন অত্রের সাথে তাকে দেখে। তাহলে পুরো মহল্লায় তার সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। শুকনো ঢোক গিলল। অত্র তার থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে। অত্র নিজের দূরত্ব আরও কমালো। সামান্য দূরত্ব আছে শুধু তাদের মধ্যে। তার মুখশ্রী ভাবলেশহীন।
‘আমার জবাব চাই। উত্তর হ্যাঁ’ পেলে চলে যাব। নয়ত আজ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব।’
‘মাথা খারাপ না’কি?’
‘উহুহ, তোমার জন্য খারাপ।’
‘এখন বাসায় যাও প্লিজ। কেউ দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।’
‘আমি তো তাই চাই। দু’জনকে একসাথে দেখে কাজি অফিস নিয়ে যাক। তারপর সাক্ষি সেজে বিয়ে পড়িয়ে দিক। ভালো না আইডিয়া।’
‘প্লিজ, বাসায় যাও।’
‘আগে আমার উত্তর দাও।’
‘আচ্ছা মোবাইলে দিব। এখন বাসায় যাও।’
অত্র উচ্ছ্বসিত হল। চোখ পিটপিট করে বলল, ‘সত্যিই, মোবাইলে জবাব দিবে!’
চাঁদনী নিজের রাগ সংবরণ করল। মুচকি হাসল। অত্রকে দ্রুত যেতে অনুরোধ করল। অত্র কিছুদূর যেতেই নিজের বাসার দিকে তড়িঘড়ি ছুটল। ভয়ে চুপসে আছে। তার বোন আবার কিছু দেখেনি’তো। আচমকাই তার মুঠোফোন কম্পিত হল। স্ক্রিনে অত্রের নাম্বার ভেসে উঠল। সে দোটানায় পড়ল। দ্রুতই কল রিসিভ করে বলল,
‘প্লিজ, আমাকে দু’দিন সময় দাও। এখন রাখছি।’
চলবে,,,,,