#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
৫০।
হোটেলে ঢুকতেই পদ্ম অবাক হয়ে গেলো। তার কাছে এটা প্রাসাদের মতোই সুন্দর। রুমগুলো বেশ বড়। জানালাগুলোও বিশাল। বারান্দা আছে সেটাও চমৎকার। বারান্দায় দাঁড়ালে সমুদ্র দেখা যায়। রুমের সাথে লাগানো লিভিং রুমও আছে। আর চারপাশে বিভিন্ন রঙের বাতি ঝুলছে। ওয়াশরুমে ঢুকেই পদ্ম বলল,
“জানেন, এই প্রথম আমি বাস্তবে এমন রুম দেখেছি।”
আফিফ পদ্মকে বলল,
“এক সপ্তাহে তো অনেক টাকা চলে আসবে।”
পদ্ম বলল,
“এটা আহির বাবার হোটেল। টাকা লাগবে না।”
আফিফ আর কিছু বললো না। কিন্তু তার মনটা ভারী হয়ে আছে। এতোগুলো টাকা আহিকে কীভাবে ফেরত দিবে সে? রুম দেখে মনে হচ্ছে এক রাতে দশ হাজার টাকার মতো আসবে। সাত দিনে আসবে সত্তর হাজার টাকা। এর চেয়ে বেশিও তো হতে পারে। এদিকে আফিফের মাসিক বেতন মাত্র পনেরো হাজার টাকা। তার এই টাকা শোধ করতেই তো দুই বছর লেগে যাবে।
(***)
রাদ আহির হাত ধরে তাকে সমুদ্রতীরে নিয়ে এলো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”
আহি বলল, “তুই আসলে কি?”
“মানুষ!”
“না, সাধারণ মানুষ না তুই।”
“তাহলে কি অসাধারণ?”
“ভাবতে দে।”
আহি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “প্রীতমানব।”
“মানে কি?”
“যে মানুষটা সবসময় হাসি-খুশি থাকে।”
রাদ আহির কথায় হাসলো। আর আহি সমুদ্রের ঢেউয়ে নিজের পা ভেজাতে ব্যস্ত। মিনিট খানিক নীরব থেকে আহি বলল,
“ভাবছি তোর বিয়ে হলে আমার কি হবে?”
রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “এভাবে বলছিস কেন?”
“তোর বউ তো আমাদের এভাবে একসাথে সহ্য করতে পারবে না।”
“কে বলেছে তোকে?”
“পৃথিবীতে সবকিছুর ভাগ হয়। কিন্তু ভালোবাসার ভাগ কেউ দিতে চায় না। অন্য কাউকে প্রিয় মানুষের পাশে কেউ সহ্য করতে পারে না। যেমন আমি পারছি না।”
“বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা দু’টি ভিন্ন, আহি।”
“কিন্তু ভালোবাসা বন্ধুত্বের কাছে হারতে বাধ্য।”
“আমি এটা মানি না। যদি এমনই হতো তাহলে তোর ভালোবাসা বন্ধুত্বের কাছে হারতো না।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ আবার বলল,
“তুই পদ্মের কারণেই তো আফিফকে ভুলে যেতে চাস।”
আহি মুচকি হেসে বলল,
“আফিফকে পাওয়ার চেষ্টা করলে হয়তো পাওয়া যেতো। কিন্তু তার জন্য ক্ষমতা লাগবে। আর এই ক্ষমতা বাবার কাছে আছে। আর বাবা চায়, আমি তাজওয়ারকে বিয়ে করি। আর আফিফ আমাকে কখনই ভালোবাসবে না। যার মনে অন্য কেউ, তাকে আমি জোর করে কীভাবে নিজের করে নেবো? আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমি মিসেস লাবণি হতে চাই না। মিসেস লাবণি আমার মায়ের জায়গাটা নিয়ে ফেলেছে। পদ্ম আর আফিফের তো সন্তান নেই। কিন্তু একটা সংসার তো আছে। আমি আমার ঘরের ইট-পাথরের ভাষাও বুঝি। তারা মাকে চায়। ওটা আমার মায়ের সংসার ছিল। আমার মা আমার অহংকার। আমি আমার মায়ের সন্তান। আমি বাবার মতো হয়ে নিজেকে রিজওয়ান কবিরের সন্তান বলে পরিচয় দিতে চাই না। বরং ওয়াসিকা নামের পাশ থেকে কবির শব্দটাই মুছে দিতে চাই। তাহলে বল, শুধুই কি বন্ধুত্ব? আমার আত্মসম্মানবোধও এখানে জড়িয়ে আছে।”
রাদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
“আফিফ কি পৃথিবীর একমাত্র ছেলে? কি এমন আছে ওর মধ্যে? আফিফের চেয়েও ভালো ছেলে আছে।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জানি না ওর মধ্যে কি আছে। কিন্তু আমি তো ভালোবেসে ফেলেছি রাদ। ডক্টর নায়ীব বলেছে এটা রোগ। কিন্তু আমার কাছে এই ভালোবাসা, রোগ না। আমার কাছে এটা অনুভূতি, আমার আবেগ, আমার স্বপ্ন।”
রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যদি ও তোর জীবনে না আসতো, তাহলে কি প্রেমে পড়তি না?”
“পড়তাম তো!”
“কার প্রেমে পড়তি?”
“তোর প্রেমে পড়তাম।”
রাদ আহির দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। আহি হেসে বলল,
“তোর মতো মানুষ ক’জন আছে? তবে অবশ্য তোকে চিনেছি আফিফের কারণেই। আফিফের জন্য রোগী হওয়ায়, তুই মেডিসিন হয়ে এসেছিস। আমার এমন পরিস্থিতিতে পাশে থেকেছিস, যেটা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। লিনাশার সাথেও এতো ভালো বন্ধুত্ব হয় নি আমার।”
“তুই না আমাকে মেডিসিন বলিস? মেডিসিন খেতে খেতে মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে। তুই যদি আসক্ত হয়ে পড়িস?”
“ভয় পাচ্ছিস না-কি?”
“না, আহি।”
“আমি আমাদের বন্ধুত্ব হারাতে চাই না। দেখ না ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি। তোকে হারালে আমি বেঁচেই থাকবো না। তুই একমাত্র মানুষ যার সাথে আমি এতো এতো কথা বলি। তখন কে শুনবে আমার কথা?”
আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। রাদ তা দেখে বলল,
“আমিও তোকে হারাতে চাই না।”
আহি মুচকি হাসলো। রাদকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো। রাদও আহিকে নিজের বুকে আবদ্ধ করে নিলো। তার মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আহিকে খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে,
“আমাকে ভালোবেসে দেখ, আহি। আমি তোকে কখনো ফিরিয়ে দেবো না। তুই দেখিস, আমি হারিয়ে যাবো না। আমি তোর গান, তোর চিত্র, তোর ভাস্কর্য, তোর ছন্দ সবকিছু হতে রাজী। শুধু আমার হাতটা ধরে একবার বল, ভালোবাসবি রাদ? দেখিস, আমি তোকে এতো ভালোবাসবো যে তোর সব দুঃখগুলো সুখ হয়ে যাবে।”
(***)
পদ্ম আফিফের হাত ধরে তাকে টেনে সমুদ্র পাড়ে নিয়ে এলো। সেখানে এসে দু’জনই অবাক। তারা দেখলো, আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্ম গলা খাঁকারি দিতেই আহি রাদকে ছেড়ে মাথা তুলে পেছনে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আমরা কিন্তু এখানেই আছি। শুধু আমরা না। অনেকেই আছে।”
আহি আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ আহির দিকে তাকালো না। সে পদ্মের হাত ধরে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাদকে বলল, “চল, সামনে হাঁটি!”
রাদ মুচকি হেসে বলল, “হুম।”
রাদ আর আহি সামনে এগুতেই পদ্ম আফিফের বাহুতে মাথা রেখে বলল,
“ওদের দু’জনকে বেশ মানিয়েছে, তাই না?”
আফিফ মুচকি হেসে বলল, “হুম, ঠিক বলেছো।”
আফিফ মনে মনে ভাবলো,
“আমি তো চাই, আহি অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যাক। তার জীবনে এমন কেউ আসুক, যেই মানুষটা তাকে অনেক ভালো রাখবে। আর যদি সেই মানুষটা রাদ হয়ে থাকে, তাহলে আহি ভাগ্যবতী।”
(***)
রাতে আহি লাল রঙের শর্ট গাউন পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর ঠোঁটে হালকা গোলাপী রঙের লিপস্টিক দিয়ে রুম থেকে বের হলো। তার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো রাতের আকাশে টিমটিমে বাতি ঘেরা আলোকিত ছাদে উঠে একটা ছবি উঠাবে। তার বাসার ছাদে এমন রংবেরঙের বাতি লাগানো নেই। আর হোটেলের ছাদটা অনেক সুন্দর। সুইমিংপুলও আছে। তাই আহি সন্ধ্যায় হোটেল ম্যানেজারকে দুই ঘন্টার জন্য ছাদটা খালি করতে বলেছিল। নোটিশ দেওয়ার পর আহিকে হোটেল বয় এসে জানিয়েছে ছাদ এখন খালি। আহিও তৈরী হয়ে বেরিয়ে এলো। পুষ্প তার ছবি উঠিয়ে দেবে। সে আবার ভালো ফটোগ্রাফার।
আহি রুম থেকে বেরুতেই কয়েক পা এগুতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ আপাদমস্তক আহিকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি আফিফকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবে তখনই আফিফ আহির পিছু এসে তার পথ আটকে দাঁড়ালো। আহি তো রীতিমতো অবাক। আফিফ তার পথ আটকে দাঁড়াবে, এটা অকল্পনীয় ব্যাপার। আহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ গম্ভীরমুখে বলল,
“এসব কি ড্রেস পরেছো?”
আহি উলটো প্রশ্ন করলো,
“আপনি আমার পথ আগলে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?”
“সেটা বিষয় না। তুমি কি এমন ড্রেস পরে বাইরে বের হচ্ছো?”
“আপনার কোনো সমস্যা?”
“না, আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি পদ্মের ফ্রেন্ড। তাই তোমার কথা ভেবে বলছি। কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“ছাদে যাচ্ছি।”
“আমি তোমাকে আটকাবো না। আমার কোনো অধিকারও নেই। কিন্তু একটা কথা জানানোর আছে।
আমি সন্ধ্যায় ছাদে গিয়েছিলাম, দেখলাম ওখানে অনেক ধরণের ছেলে উঠেছে। তুমি এমন ড্রেস পরে উপরে উঠলে বাজে কমেন্টের মুখোমুখি হবে।”
আহি আফিফকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আপনার পদ্মফুল নই। আমাকে আমার মতো চলতে দিন। যেখানে অধিকার নেই, সেখানে উদ্বিগ্ন হওয়া মানায় না।”
আফিফ আহির পথ থেকে সরে দাঁড়ালো। আহি দুই সিঁড়ি উপরে উঠে পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানুষ কথার কথা বলে, বাবার হোটেলে ইচ্ছেমতো চলা যায়। তবে আমার ক্ষেত্রে এটা সত্য হয়েছে। বাবার হোটেল, তাই ইচ্ছেমতো সময়ে পুরো ছাদ নিজের জন্য রিসার্ভ করে নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাবে না। আপনার মিথ্যে উদ্বেগ এবার কিছুটা হলেও কমেছে নিশ্চয়।”
আহি কথাটি বলেই উপরে উঠে গেলো। আর আফিফ এখনো তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তো আহির ভালোর জন্য তাকে বারণ করেছিল। কিন্তু আহি তো ডুবে আছে অতীতে। যেই রাগটা ঝাড়ছে আফিফের উপর। আজ যদি পুষ্পের বর আহিকে আটকাতো, তাহলে আহি এভাবে কখনোই উত্তরটা দিতো না।
৫১।
দ্বিতীয় দিন সকালে সবাই একসাথেই নাস্তার টেবিলে এসে বসলো। সবাই গালগল্পে মশগুল। আহি আছে তার কল্পনার জগতে। সে কখনোই ভাবে নি আফিফের সাথে তার এমন দীর্ঘ সময় কাটবে। তাও আবার সেই দীর্ঘ সময় জুড়ে তাদের মাঝখানে থাকবে অদৃশ্য দেয়াল। সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে আহির।
রাদ আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে-মুখে মলিনতা। রাদ ফোন বের করো গতদিনের রিপোর্ট দিলো নায়ীবকে। লিখলো,
“ডক্টর, আহি সেই ছেলেটাকে দেখলে আগে অস্থির হয়ে যেতো। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অস্থিরতাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। অনেকক্ষণ একসাথে তার মুখোমুখি বসেও আহি শান্ত আছে।”
নায়ীবের উত্তর এলো,
“তাদের একসাথে রাখো। তবে এর মধ্যে আহির ফ্রেন্ডটি যেন অবশ্যই থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দেখে আহি যতো ট্রিগার হবে, ততোই নিজেকে শক্ত করতে পারবে। নুইয়ে পড়তে দিও না। তুমিই কিন্তু ওর মানসিক শক্তি।”
এদিকে নাস্তা আসার পর পদ্ম আফিফকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলো। আহির চোখ দু’টি না চাইতেও যেন একটু পর পর পদ্ম আর আফিফের দিকেই যাচ্ছে। আফিফ পড়েছে এক মহা বিপাকে। সে পদ্মকে থামাতে চায়লে পুষ্প বলল,
“থাক ভাইয়া, বারণ করছেন কেন? আমরা আপনাদের ভালোবাসা দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আফটার অল, আমরাও খুব শীঘ্রই এমন রোমান্টিক ব্রেকফাস্ট করবো যার যার স্পেশাল মানুষের সাথে।”
পুষ্প গালে হাত দিয়ে পদ্ম আর আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাবীব ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“লজ্জা করে না এভাবে তাকিয়ে থাকতে?”
“ওহ, হ্যালো। তুমি আমাকে লজ্জা শেখাতে এসো না। মাংকি একটা!”
“আমি মাংকি?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে তুমি কোথাকার ঘটকী? তোমাকে দেখে তো শিম্পাঞ্জি পালিয়ে যাবে। একদম সজারুর কপি পেস্ট।”
পুষ্প রাগী স্বরে বলল, “আমি সজারু?”
“ওতোটাও না। একটা পার্থক্য আছে। সজারুর গায়ে কাঁটা। আর তোমার মুখে।”
“মানে!”
“মানে, তোমার মুখ নির্গত বানী যেন মধু নয়, এক একটা বিষাক্ত কাঁটা।”
পুষ্প চেয়ার ছেড়ে উঠে চেঁচিয়ে বলল,
“আমি এই বানরের পাশে বসবো না।”
“ওকে, তাহলে আমি তোমার মাথায় উঠে বসি। বানর কিন্তু ভালোই বেয়ে উঠে, বসতে জানে।”
আহি উঁচু গলায় বলল,
“চুপ করবি তোরা? বাচ্চা না-কি, হ্যাঁ? এসব ঝগড়া করার বিষয় না।”
পুষ্প চুপচাপ বসে পড়লো। খাওয়া শেষ হতেই পুষ্প চেয়ার ছেড়ে উঠে হাত ধোয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলো। এদিকে লাবীবও খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়ালো। টেবিল থেকে বোতল নিয়ে মুখভর্তি পানি পুরে নিলো। তখনই পুষ্প ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সামনে পা বাড়াতেই লাবীবের সাথে ধাক্কা খেলো। আর সাথে সাথেই লাবীবের মুখের সব পানি বেরিয়ে পুষ্পের উপর ছিঁটকে পড়লো। পুষ্প থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। লাবীব দু’পা পিছিয়ে দৌঁড়ে ডায়নিং থেকে বের হয়ে গেলো। পুষ্প এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আহি কয়েকটা টিস্যু এনে পুষ্পের দিকে এগিয়ে দিতেই সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“লাবীবের বাচ্চা লাবীব, আমি তোকে গরম তেলে ফ্রাই করেই ক্ষান্ত হবো।”
আহি ধীর কন্ঠে বলল,
“ফ্রাই তো গরম তেলেই হয়। এতো এডভার্ব যোগ করছিস কেন?”
পুষ্প আহির কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে হনহন করে চলে গেলো।
(***)
নাস্তা সেরে হোটেল থেকে বেরিয়ে বিচের বালির উপর একা একা হাঁটছে আহি। তখনই পদ্ম তার হাত ধরে তার সাথে সাথে হাঁটতে লাগলো। আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর দু’জনই চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। নীরবতা ভেঙে পদ্ম জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, রাদের সাথে কি তোর কোনো সম্পর্ক আছে?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর এমন প্রশ্নের কারণ?”
“মনে হলো।”
“না, আমরা শুধুই বন্ধু। একই সাথে অনার্স করেছি। স্কুলেও তো ও আমাদের ক্লাসমেট ছিল।”
“হুম, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে প্রেম-টেম চলছে। তোর খেয়াল রাখে। মনে হয় তোকে ভালোবাসে।”
“আরেহ না। কি যে বলিস! বন্ধু হিসেবেই ভালোবাসে। বন্ধুরা তো খেয়াল রাখবেই। তবে রাদ একটু বেশিই ভালো। তাই এতো খেয়াল রাখে।”
“হয়তো ভালোবাসে, কিন্তু তুই বুঝতে পারছিস না।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এমন কিছুই না।”
“তোদের দেখে মনে হয় না শুধু বন্ধু। কাল দেখলাম রাদকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলি।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“হয়তো আমরা চোখে যা দেখি, তা শুধুই আকাঙ্ক্ষা হয় না। কারো কাছে এই হৃদ স্পন্দন মানসিক শক্তি, ভরসার আশ্রয় আর কিছু বছর বেশি বেঁচে থাকার প্রেরণা।”
এবার পদ্ম বলল,
“আর যাই বলিস, আফিফের না এসব পছন্দ না। ছেলে বন্ধুর সাথে এতো জড়াজড়ি ভালো না।”
“কেন তোরা কি জড়াজড়ি ছাড়া প্রেম করেছিলি?”
“যাহ! কি বলছিস এসব? ভালোবাসার অর্থ এমন হয় না। আফিফ তো বিয়ের আগে আমার হাতটাও স্পর্শ করে নি।”
আহি পদ্মের কথা শুনে পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ খুব মনোযোগ দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। ছেলেটা এতো ভদ্র কেন সে বুঝতে পারে না। বেশি ভদ্র তাই হয়তো আহি এখনো তার মায়ায় বেঁধে আছে। আহি এবার পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাঝে মাঝে মানুষ মানসিক ভাবে দুর্বল থাকলে, পাশের জন ছেলে না-কি মেয়ে এই জ্ঞানটা থাকে না।”
(***)
দুপুরে রাদ আর আহি সাগর পাড়ে বসে পাল্লা দিয়ে চিংড়ি খাচ্ছে। আফিফ দূর থেকে আহিকে হাসতে দেখছে। রাদের সাথে থাকলে মেয়েটা হাসিখুশি থাকে। হাসলেই তো সুন্দর লাগে আহিকে। কিন্তু সেই হাসিটাই তো আফিফ কেঁড়ে নিয়েছিল। আফিফের মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে। যেখানে তাদের সম্পর্কই শুরু হয় নি, সেখানে আহি এখনো কেন তার স্মৃতিতে ডুবে আছে? তাকে এতো ভালোবাসার কারণ কি? আফিফ জানে না এসবের উত্তর। শুধু এতোটুকুই জানে, আহি কখনোই তার ভাগ্যে ছিল না।
বিকেলে তারা সবাই মিলে শপিং করতে গেলো। আফিফ পদ্মের জন্য তাঁতের শাড়ি দেখছে। আর পদ্ম ব্যস্ত কানের দুল দেখায়। আহি দূরে দাঁড়িয়ে আফিফকে দেখছে। রাদ আহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আফিফ শাড়িটা কার জন্য দেখছে?”
আহি মৃদু হেসে বলল, “তার পদ্মফুলের জন্য।”
রাদ আহির উত্তর শুনে তার মুখের দিকে তাকালো। আহির চোখে মলিনতা। কিন্তু ঠোঁটে হাসি। রাদ এবার আহির হাতের দিকে তাকালো। না, আহির হাত কাঁপছে না। রাদের ইচ্ছে করছে এবার আফিফকে মিষ্টি খাওয়াতে। কারণ আহি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। দু’দিনেই এতোটা পরিবর্তন, ভাবা যায় না। কিন্তু পরিবর্তনটা আহির মাঝে লক্ষণীয়। যে কেউ এই পরিবর্তন বুঝবে না। শুধুই রাদই বুঝবে। কারণ সে আহিকে কাছ থেকে দেখেছে।
(***)
কেনাকাটা শেষে মার্কেট থেকে বের হতেই একটা ছেলে পদ্মের সামনে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটার অদ্ভুত চাহনি দেখে পদ্ম কয়েক পা সরে দাঁড়ালো। এদিকে লাবীব গাড়ি ঠিক করতে এক পাশে চলে গেছে। আফিফ অন্যদিকে। রাদ আহি আর পুষ্পের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। তারা খেয়ালই করে নি পদ্ম পিছনে পড়েছিল। এদিকে পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে ছেলেটিকে বলল,
“আমার পথ ছাড়ুন।”
ছেলেটা বুকে হাত দিয়ে বলল,
“আহা, কি চমৎকার কন্ঠ! আরেকবার বলো না।”
আহি কি মনে করে পেছনে ফিরে তাকালো। দেখলো একটা ছেলে পদ্মের হাত ধরতে চায়ছে, আর পদ্ম বার-বার এপাশ-ওপাশ হয়ে সরে আসার চেষ্টা করছে। আহির এটা দেখেই রাগ উঠলো। সে পদ্মের কাছে এসে বলল,
“চল, পদ্ম।”
ছেলেটি বলে উঠলো,
“একটার সাথে আরেকটা ফ্রি।”
তার সাথে এবার আরো দু’টো ছেলে যোগ হয়েছে। রাদ তাদের দেখে সামনে এগিয়ে আসতে যাবে তার আগেই যেই ছেলেটি এতোক্ষণ পদ্মকে বিরক্ত করছিলো, আহি সশব্দে সেই ছেলেটির গালে চড় বসিয়ে দিলো। ছেলেটি রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকাতেই রাদ এসে আহিকে আড়াল করে দাঁড়ালো। দূর থেকে আফিফ বিষয়টা খেয়াল করে তাড়াতাড়ি রাস্তা পার হয়ে চলে এলো। আফিফ পদ্মের কাছে আসতেই পদ্ম আফিফকে ঝাপটে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“ছেলেটা আমাকে বিরক্ত করছিলো।”
কথাটা শুনেই আফিফের মেজাজ বিগড়ে গেলো। কিন্তু তাকে কিছু করতে হলো না। আহি রাদকে তার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে তার ব্যাগ দিয়েই ছেলেগুলোকে জোরে জোরে মারতে লাগলো আর বলতে লাগলো,
“চোখ দেখাচ্ছিস কাকে? নিজেরা করবি নষ্টামি, আর চোখও দেখাবি? মেরে হাড্ডি গুঁড়ো করে ফেলবো। তোদের মতো ছেলেদের রাস্তায় ফেলে বেধড়ক পেটানো উচিত।”
রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য কেউ না বুঝলেও রাদ বুঝতে পারছে এই আঘাত আহির মনের আঘাত। আর ছেলেগুলো আহির কাছে তাজওয়ারের প্রতিরূপ। তাজওয়ারের উপর যতো ক্ষোভ জমে আছে, সেসব এই ছেলেগুলোর উপর ঝেড়ে তবেই আহি শান্ত হবে। আফিফ এবার রাদের কাছে এসে বলল,
“ওকে থামাও।”
রাদ বলল,
“মারুক না একটু। বল তো সব জায়গায় প্রয়োগ করা যায় না। যেখানে করা যায়, সেখানে করুক।”
আফিফ অবাক দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। রাদ আহিকে পেছন থেকে চেয়ার আপ করে বলতে লাগলো,
“মার আহি, আরো জোরে জোরে মার। পিঠে আরো কয়েকটা দে। তোর ব্যাগ ছিঁড়ে গেলে, আমি কিনে দেবো।”
মার খেতে খেতে দু’জন পালিয়ে গেছে। একজন রাস্তায় লুটোপুটি খাচ্ছে আর বলছে,
“আহ! বাপরে। মাফ করেন আপা আল্লাহর ওয়াস্তে।”
রাদ ছেলেটির আর্তনাদ শুনে বলল,
“আহা! আহা! কি শান্তি।”
চলবে-