উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-২৬||

0
348

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৬||

৪৮।
জীবনের পাতা উল্টাতেই কেটে গেলো তিন সপ্তাহ। এরইমধ্যে প্রকৃতি ছেয়ে গেছে স্নিগ্ধ শীতল গন্ধবহে। শিউলিতলা ভরে গেছে শুভ্র পুষ্প মালায়। পথে পথে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কাশফুল। আর শুভ্র মেঘের ফাঁকে নীল আকাশের পানে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক ভাবুক মন।
আজ আহিদের পরীক্ষা শেষ। সে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখলো রাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি সন্তপর্ণে রাদের কাছে এসে তাকে ভয় দেখানোর জন্য জোরে বলে উঠলো, “ভাউ।”

রাদ বাঁকা চোখে আহির দিকে তাকালো। আহি মুখ ফুলিয়ে বলল, “একটু ভয় পাবি না?”

“তোর কি মনে হয় আমার হার্ট দুর্বল?”

আহি মুখ বাঁকালো। পরক্ষণেই ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আমরা তাহলে এই সপ্তাহে ট্যুরে যাচ্ছি।”

রাদ মাথা নাড়তেই তার সামনে আফিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। আহির মনোযোগ সেদিকে না যাওয়ার জন্য রাদ আহির হাত ধরে তাকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ঠিক করে আহিকে নিয়ে উঠে পড়লো। আহি বলল,
“এতো হুড়োহুড়ি করছিস কেন?”

“তোকে নিয়ে ভেলপুরি খেতে যাবো।”

আহি রাদের গাল টেনে দিয়ে বলল, “সো সুইট মাই ফ্রেন্ড।”

এদিকে আফিফ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আহির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

(***)

আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো আহি। ছোট একটা কালো টিপ পরলো কপালে। ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা একটা অলকানন্দা ফুল চুলের সাথে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিলো সে। এরপর ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ বক্সে ডাক্তার নায়ীবের শেষ মেসেজটির দিকে তাকালো। যেখানে লেখা আছে,
“আজ তুমি সেভাবেই নিজেকে সাজাবে, যেভাবে এতোদিন তুমি অলকানন্দের জন্য নিজেকে সাজাতে চেয়েছিল। আজ কোনো বাঁধা নেই। আজই যেন অলকানন্দের জন্য তোমার নিজেকে শেষ সাজানো হয়। এরপর আর কখনোই তুমি নিজেকে তার জন্য সাজাবে না।”

আহি মেসেজটি পড়ে আবার আয়নার দিকে তাকালো। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি। সাদা শাড়ি পরেছে সে। আহি আজ ঠিক সেভাবেই সেজেছে যেভাবে এক্সিভিশনের আগে আফিফের ছবির জন্য নিজেকে সাজিয়েছিলো। আলতা রাঙা হাতটি আয়নার সামনে এনে রাখলো আহি। হঠাৎ তার কানের কাছে ফিসফিস করে সেই পরিচিত কন্ঠস্বর বলে উঠলো,
“অলকানন্দা, ভীষণ সুন্দর লাগছে তোমাকে।”

আহি মিষ্টি হেসে বলল, “তোমার পদ্মফুল থেকেও?”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। আহি এবার পাশ ফিরে দেখলো কেউ নেই। আহির চোখ ভিজে গেলো। সে বুকে হাত রেখে বলল,
“আমি এই এক সপ্তাহ তোমাকে তোমার পদ্মফুলের সাথে কীভাবে দেখবো, আফিফ? এখনই ভাবতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ডাক্তার নায়ীব কেন এমন এক্সপেরিমেন্ট করতে বলেছে জানি না। কিন্তু তোমাকে আমার ভুলতে হবেই। নয়তো আমি পাগল হয়ে যাবো।”

আহি ব্যাগ নিয়ে বাসের জন্য স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। এখানেই সবাই আসবে। আহি রাদকে ফোন দিতেই দেখলো একটা রিকশা স্টেশনের সামনে এসে থেমেছে। এদিকে রাদ ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে জানালো, রাস্তায় জ্যাম, তাই দেরী হচ্ছে। রাদের সাথে কথা বলে আহি তার ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো, যেই রিকশাটা থেমেছিল, সেটাতে আফিফ আর পদ্ম। আফিফ রিকশা থেকে নেমেই তাদের ব্যাগটাও নামালো। এরপর মানিব্যাগ বের করতেই তার চোখ পড়লো আহির দিকে। আহিকে দেখে সেকেন্ড খানিকের জন্য আফিফ থমকে গেলো। আহিও আফিফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আহির মনে পড়লো ডাক্তার নায়ীবের সেই কথাটি,
“তুমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালেই পদ্মের জীবনে ঝড় নেমে আসবে।”

আহি সাথে সাথেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। চোখ বন্ধ করতেই তার চোখ ভিজে উঠলো। তাই সে নিজেকে আড়াল করার জন্য দ্রুতপদে স্টেশনের ভেতরে ঢুকে গেলো। স্টেশন রুমটি কাচের গ্লাস দিয়ে ঘেরা। আহি বেঞ্চে বসে সেখান থেকে স্পষ্ট বাইরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। সে দেখলো আফিফ ভাড়া মিটিয়ে পদ্মের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পদ্ম সেই হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে রিকশা থেকে নেমে পড়লো। আফিফ সাদা পাঞ্জাবি পরেছে, আর পদ্ম পরেছে নীল রঙের সেলোয়ার-কামিজ। দু’জনের এমন অমিল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু আহির কাছে অস্বাভাবিক লাগছে।

(***)

পদ্ম স্টেশন রুমে ঢুকে আহিকে দেখে বলল,
“বাহ, কি সুন্দর লাগছে তোকে!”

আফিফ ব্যাগটা চেয়ারে রেখে আহির দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। আহি পদ্মকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোকেও ভীষণ সুন্দর লাগছে!”

“জানিস আহি। আমি তো আফিফকে অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছি। উনি তো আসতেই চাচ্ছেন না।”

“কেন?”

“এর আগেও আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম তো তাই।”

“ওহ, আচ্ছা। তাহলে না আসলেই হতো। শুধু আমার বান্ধবীটাকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিলেই চলতো।”

আফিফের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে পদ্মকে বলল,
“তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।”

আফিফ চলে যেতেই পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“আহি, এভাবে বললি কেন? উনি মন খারাপ করেছেন। আমি এখন বিবাহিতা। বিয়ের পর মেয়েরা বর ছাড়া কোথাও যায় না।”

“আহা, আমাদের আদর্শ পদ্মবিবি।”

পদ্ম মুখ ছোট করে বলল, “আফিফ রাগ করেছেন।”

আহি মনে মনে বলল,
“রাগ করলে করুক না। আমাকে তো অনেক কাঁদিয়েছে তোর বর। এখন সামান্য একটু রাগ নিতে পারবে না? আমি তো বছর ধরে তার দেওয়া আঘাত মনে জমিয়ে রেখেছি। তার শোধ তো সামান্য এই কথা দ্বারাও মিটবে না, পদ্ম।”

পদ্ম আহির হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“সত্যি উনি রাগ করেছেন। যা না। সরি বল না। আবার যদি যেতে না চান?”

আহি হেসে বলল,
“রাগ করলে আমার সাথেই করবে, তোর সাথে তো আর করবে না। তুই শান্ত হো। তোর বর তোকে কষ্ট দেবে না। দিলে আমাকেই দেবে।”

“কীভাবে?”

আহি মৃদু হেসে বলল,
“ভুলে গেলি না-কি। সে আমার ক্লাসমেট। নোট দিবে না। ক্লাসে না গেলে আমি তো তার কাছেই পড়া বুঝিয়ে নেয়। তখন আমাকে বুঝিয়েও দেবে না।”

“তাই? আমি উনাকে বলবো তোকে পড়ায় হ্যাল্প করার জন্য।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “না না। দরকার নেই।”

তখনই পুষ্প চলে এলো চেঁচাতে চেঁচাতে। পুষ্প স্টেশন রুমে ঢুকেই আহি আর পদ্মকে একসাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
“পলি আপুর গেট টুগেদার।”

আহি পুষ্পের কথায় মলিন মুখে বললো,
“লিনু তো নেই।”

পুষ্প বলল,
“হ্যাঁ রে। আমি লিনুকে ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম আমরা ট্যুরে যাচ্ছি। আসতেও বলেছি। কিন্তু ও না-কি এখন খুলনায়।”

আহি মনে মনে বলল,
“মিথ্যে বললি কেন লিনু? জানি, আমি আছি তাই আসছিস না। আর কতো ঘৃণা করবি আমাকে? এক বিন্দু ভালোবাসা ভাগ্যে জুটছে না। উলটো প্রিয় মানুষের ঘৃণা ফিরে পাচ্ছি।”

পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“জানি না তোর আর লিনুর কি হয়েছে, আশা করি শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা কি এখন আর বাচ্চা আছি? এসব ছোটখাটো ঝামেলা কথা বলে মিটিয়ে ফেলা যায়।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার একটু পরই রাদ আর লাবীব স্টেশনে এসে ঢুকল। গাড়িও কিছুক্ষণ পর ছাড়বে। লাবীব সবার ব্যাগপত্র হ্যাল্পারকে দিচ্ছে। আর রাদ পাশের দোকান থেকে শুকনো খাবার কিনছে। পুষ্প আর পদ্ম বাসে উঠে নিজেদের সিটে বসে পড়েছে। আহি রাদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। রাদ ইশারায় আহিকে বলল উঠে বসতে। আহি মাথা নেড়ে বাসে উঠতে যাবে ওমনই তার পা পিছলে গেলো। আহি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নেবে আফিফ এসে আহির হাত ধরে ফেললো। আহি থতমত খেয়ে গেলো। আফিফ চাপা স্বরে বলল,
“শাড়ি সামলাতে না পারলে, পরেছো কেন?”

আহি আফিফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমার ইচ্ছে। আমার শাড়ি, আমি পরবো।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহিও বাসে উঠে পড়লো। রাদ বাসে উঠতেই পুষ্প লাবীবের পাশের সিটে এসে বসে পড়লো। আহি বলল,
“তুই বসবি না?”

পুষ্প বলল,
“আমার লাবীবের সাথে কিছু কথা আছে।”

এরপর রাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রাদ, তুমি আমার জায়গায় বসো আপতত।”

রাদ আহির পাশে বসতেই আহি রাদের দিকে তাকালো। তাদের পাশাপাশি সিটেই পদ্ম আর আফিফ বসেছে। রাদ আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর এআর এখানেই আছে। তুইও এখানে আছিস। মনের যতো জানালা আছে খুলে দে। নিজেকে আটকাবি না। তোকে কাঁধ দেওয়ার জন্য আমি আছি। তোর ভেজা চোখ মুছার জন্যও আমাকে পাবি। তোর কাঁপা হাতটা শক্ত করে ধরার মানুষটাও কিন্তু আমি।”

আহি রাদের হাত শক্ত করে ধরলো। রাদ আহির হাতে কপাল ঠেকালো। পদ্ম গলা খাঁকারি দিতেই আহি পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম মুচকি হেসে বলল,
“আমরা কিন্তু পাশেই আছি।”

আহি এবার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। রাদ আহির মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

(***)

বাস চলছে আপন গতিতে। পুষ্পের ফোনে মৃদু আওয়াজে গান বাজছে। আহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। আফিফও একই ভাবে হয়তো বাইরের দৃশ্য দেখছে, নয়তো অন্য কোনো ভাবনায় ব্যস্ত। পদ্ম আফিফের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। আর রাদ আহির দিকেই তাকিয়ে আছে। আর সবাই শুনছে সেই হৃদয়স্পর্শী গান।

তুমি যাকে ভালোবাসো,
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো,
তার জীবনে ঝড়।
তোমার কথার শব্দ দূষণ,
তোমার গলার স্বর।
আমার দরজায় খিল দিয়েছি,
আমার দারুণ জ্বর।
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর।
.
তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্যদল
বাঁচার লড়াই,
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে একটা চালের ভুল
কোথায় দাঁড়াই।
কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়
নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে অসহায়,
তুমি অন্য কারোর গল্পে নায়িকা।

৪৯।

লাবীব পুষ্পের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মোবাইল নিয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কিছুক্ষণ পর পর তার মুখের ভাবভঙ্গি আঁকাবাঁকা হচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকে দেখে মনে হয় মুখে গ্রহণ লেগেছে, আবার কিছুক্ষণ পর তার মুখটা পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে যায়। লাবীব ভ্রূ কুঁচকে মাথা বাঁকিয়ে পুষ্পের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, পুষ্পের এমন গুরুগম্ভীর মুখভঙ্গির কারণ গেইমস। লাবীব ফুঁস করে একটা শব্দ করতেই পুষ্প বাঁকা চোখে তার দিকে তাকালো। লাবীব ঠাট্টার হাসি হেসে বলল,
“সাবওয়ে সার্ফারের যুগ শেষ হয়ে গেছে।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তো!”

“তোমার গেইমস নিয়ে কোনো আইডিয়ায় নেই।”

“থাকতে হবে না আইডিয়া।”

লাবীব মুখে আবার ফুঁস করে একটা শব্দ করতেই পুষ্প ফোন বন্ধ করে লাবীবের দিকে ঘুরে বলল,
“এই তুমি পুসপুস কেন করছো?”

পুষ্প অনেকটা জোরে কথাটা বলায় রাদ ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকালো। লাবীব চাপা স্বরে বলল,
“আস্তে, এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?”

“আমি তোমার পাশে এক সেকেন্ডও বসবো না।”

“বসতে হবে না। তুমি নিজেই তো আমার পাশে বসার জন্য মরে যাচ্ছিলে।”

পুষ্প দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ওহ, রিয়েলি? তুমিই আমাকে বলেছো রাদ আর আহিকে একসাথে বসতে দিতে।”

“তুমি যেমন চাও নি?”

“তুমি আমাকে বলেছিলে, তাই আমি চেয়েছি।”

“ওয়াও, তুমি এতো বাধ্যগত মানুষ তা তো আমি জানতাম না।”

পুষ্প সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাদ বলল,
“কি হয়েছে?”

পুষ্প চেঁচিয়ে বলল,
“এই ফাজিল ছেলেটার পাশে আমি বসবো না।”

রাদ উঠে পুষ্প আর লাবীবের সিটের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবীব পুষ্পকে বলল,
“আচ্ছা সরি। বসো না।”

পুষ্প চোখ ছোট করে বলল, “নো, নেভার।”

পুষ্প এবার আহির পাশের সিটে বসলো। আহি বলল,
“লাবীব একটু মজা করেছে হয়তো। ওর কথায় মাইন্ড করিস না।”

পুষ্প ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“আমি আর কখনোই সাবওয়ে সার্ফার খেলবো না।”

পদ্ম পুষ্পের কথায় হেসে উঠলো। পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুই হাসছিস কেন? একবার খেলে দেখিস, তারপর বুঝবি কেন এতো ভালোবাসতাম।”

পদ্ম বলল,
“না বাবা, আমার ওসব গেইমস খেলার সময় নেই। আমার সংসারেই অর্ধেক সময় যায়।”

“ব্যস্ত মানুষ।”

পদ্ম এবার আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি, তুই এখন আর ছবি আঁকিস না?”

পদ্মের কথায় আহি চমকে উঠলো। রাদও পদ্মের কথাটি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে আহির দিকে তাকালো। পুষ্প সাথে সাথেই বলে উঠলো,
“পদ্ম, তোর মনে আছে, আহি অনেক ছবি আঁকতো? স্পেশালি একটা ছেলের।”

পুষ্প কথাটি বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। এদিকে পুষ্পের কথা শুনে আফিফ শক্ত হয়ে বসে রইলো আর আহি জানালার বাইরে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আহি, কি হলো? রাগ করেছিস না-কি!”

আফিফ এবার আহির দিকে আঁড়চোখে তাকালো। আহিও সাথে সাথেই আফিফের দিকে তাকালো। দু’জনের চোখাচোখি হতেই আফিফ চোখ সরিয়ে নিলো। পদ্ম এবার বলল,
“তোর এআরের কি অবস্থা? তুই তো সেই স্কুল থেকেই তার জন্য পাগল ছিলি!”

এবার রাদের হাত মুঠো হয়ে এলো। আহিও শক্ত হয়ে বসে আছে। হঠাৎ তার বুকে কাঁপুনি ধরলো। সে কিছুক্ষণ পর পর হাত ঘষছে। আফিফ আহির মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গেছে আহি। আফিফের সামনেই এমন প্রশ্ন করার মানে হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় পদ্ম আর পুষ্পের বোধজ্ঞানের অভাব আছে। লিনাশা হলে এমন প্রশ্ন কখনোই করতো না। এবার পুষ্প বলল,
“আর যাই বলিস পদ্ম, আহির ভালোবাসা যে পাবে সে ভীষণ ভাগ্যবান পুরুষ। এআরের প্রতি আহির ভালোবাসা দেখে আমিই অবাক হতাম। ছেলেটার পোড়াকপাল।”

আফিফ এবার ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। কথাগুলোতে আহির যে কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে, সেটা আফিফ বুঝতে পারছে। কিন্তু কীভাবে এই মেয়ে দু’টাকে থামাবে সে বুঝতে পারছে না। পদ্ম বলল,
“আহি চুপ করে আছিস কেন? আমাদের সাথে তুই আগের মতো সব কথা শেয়ার করিস না।”

রাদ এবার গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“শেয়ার করার বিষয় হলেই শেয়ার করবে। যে আহির জীবনে নেই, তাকে বার-বার টেনে আনার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।”

পুষ্প বলল,
“তুমি রেগে যাচ্ছো কেন? জেলাস না-কি?”

আফিফ পদ্মের হাত ধরে তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললো, পুষ্পকেও চুপ করাতে বলল। আফিফের কথামতো পদ্ম পুষ্পের হাত ধরে তাকে থামালো। অনেকক্ষণ বাস জুড়ে নিরবতা বিরাজ করছিলো। পুষ্প ঝুঁকে একনজর আহির দিকে তাকালো। আহি থম মেরে বসে আছে। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“সরি।”

আহি হঠাৎ সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর পুষ্পকে সরিয়ে রাদের সীটের কাছে গিয়ে বলল,
“বাসটা একটু থামাতে বলবি।”

রাদ সাথে সাথেই উঠে দাঁড়িয়ে সামনে চলে গেলো। আহিও রাদের পিছু পিছু সামনে চলে এলো। পদ্ম মাথা বের করে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মনে হয়ে আমরা একটু বেশিই বলে ফেলেছি। আমি বুঝতে পারি নি।”

পুষ্প মলিন মুখে বললো,
“হয়তো ছেলেটার সাথে ওর আর কোনো যোগাযোগ নেই। কিছু একটা হয়েছে হয়তো। কিউরিওসিটি থেকেই তো বার-বার জিজ্ঞেস করি।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। একটু পর বাস থামলো। লাবীব সীট থেকে উঠে সামনে এসে রাদকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? গাড়ি থামাতে বলেছিস কেন?”

“তুই সীটে বয়। আমরা আসছি।”

পুষ্পকে উঠে আসতে দেখে লাবীব বলল,
“বসো, বসো কিছু হয় নি।”

এদিকে আহি বাস থেকে নেমেই গলগল করে বমি করে দিলো। হাত ব্যাগটা রাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ওষুধটা বের করে দে।”

রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কীসের ওষুধ? আহি, ডক্টর নায়ীব কিন্তু ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে মানা করেছে। উনি এখনো তোকে কোনো ওষুধ লিখে দেন নি।”

“রাদ, এখান থেকে আমি একা যাবো।”

“তোকে ফেইস করতে হবে, আহি। উত্তর দিলি না কেন? বলতে পারিস নি, ছেলেটা তোর যোগ্য না?”

আহি ছলছল চোখের রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কীভাবে বলবো? আফিফের সামনে কীভাবে?”

“সমস্যা কি বললে?”

“ও যদি কষ্ট পায়?”

“রাখ তার কষ্ট। ও তোকে কি পরিমাণ সুখ দিয়েছে?”

“আমি তো ওর কাছে কিছুই আশা করি নি। করি না। কখনো করবোও না।”

রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“চল বাসে উঠ। আমার পাশে বসিস। লাবীবকে পেছনে বসাবো।”

আহি মুখে পানির ছিঁটে দিয়ে বাসে উঠে পড়লো। রাদ লাবীবকে বলল,
“তুই পুষ্পের পাশে গিয়ে বস তো।”

লাবীব আহির দিকে তাকিয়ে পেছনে গিয়ে বসলো। পুষ্পও কিছু না বলে লাবীবকে সীট ছেড়ে দিলো। লাবীব চাপা স্বরে ব্যাঙ্গ করে বলল,
“নো, নেভার।”

পুষ্প লাবীবকে ভেংচি দিয়ে বলল,
“তুমি এসেছো, আমি না।”

এদিকে আহি আসতেই পদ্ম বলল,
“আহি, তুই ঠিক আছিস তো!”

আহি হালকা হেসে বলল,
“এখন অনেক ভালো লাগছে। মেডিসিন তো আমার কাছেই আছে।”

আহি কথাটি বলেই রাদের দিকে তাকালো। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“বাসা থেকে উল্টোপাল্টা খেয়ে এসে বমি করেছে। তাই এমন চুপচাপ ছিল।”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোদের কথায় আমি রাগ করি নি।”

আহি একনজর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি যেই ছেলেটার ছবি আঁকতাম, সে হঠাৎ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই বলতে চাই নি তোদের।”

পুষ্প গালে হাত দিয়ে বলল,
“কীভাবে অন্ধ হয়েছিল?”

“মাথায় সমস্যা হয়েছিল তো, তাই হয়তো।”

রাদ আহির কথায় সীটে বসে মুখ চেপে হাসছে। এদিকে আফিফ চোখমুখ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি নিজের সীটে উঠে উল্টো দিক হয়ে সীটের উপর দুই হাঁটু উঠিয়ে পুষ্প আর পদ্মের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো আর বলল,
“জানিস ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছিলো একবার। ইশ বেচারা! আমিও বা কি করবো? সে তো আমাকে আর দেখতেই পায় নি।”

পদ্ম আর পুষ্প বলল, “তারপর!”

“তারপর আর কি! আমি বললাম, আমি তাকে পছন্দ করি। কিন্তু সে তো হাবলার মতো চলে গেলো। চোখে দেখে নি তাই।”

পুষ্প বলল, “কানেও শুনতো না না-কি!”

“হালকা-পাতলা সমস্যা ছিল হয়তো। মাথায় আঘাত লেগেছে। বুঝিস তো স্নায়ুবিক ত্রুটি। একটু পাগল পাগল ভাব ছিল।”

আহি এবার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি এবার বলল,
“এরপর একদিন শুনলাম তার বিয়ে হয়ে গেছে। আর পরে জানলাম মেয়েটারও মাথায় সমস্যা আছে।”

পুষ্প বলল, “ওয়াও, পাগল-পাগলীর সংসার!”

পদ্ম বলল,
“শুনেই খুব হাসি পাচ্ছে, তাই না আফিফ?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“এখন তোরাই বল, বাবা কি পাগল ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতো? তবুও ভালোবাসতাম দেখে, তাকে সম্মান করেছি। সে কি আর শখ করে পাগল হয়েছে? মাথায় আঘাত লেগেছিল তাই।”

রাদ আহির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“তোর পাগলের গল্প বন্ধ করে এদিকে এসে বস।”

আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মুখটাতে গ্রহণ লেগেছে। আহি এবার রাদের পাশে বসে চাপা স্বরে বলল,
“ওর মুখটা তো অন্ধকার।”

রাদ বলল,
“তোকে সমাজসেবী হয়ে আলো জ্বালাতে হবে না।”

“খারাপ লাগছে তো।”

“আমার তো বেশ মজা লাগছে। একটা ছবি তুলে ক্যাপশন দিতে ইচ্ছে করছে, ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে যাওয়া মুখ।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here