উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||আংশিক পর্ব||

0
346

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||আংশিক পর্ব||

৪৭।
মিসেস লাবণি এবং রিজওয়ান কবির আজই দেশে ফিরেছেন। বাসায় ঢুকতেই আহিকে দেখে তারা দু’জনই অবাক হলেন। আহি বাগানে বসে চুনিকে ইংরেজি শিখাচ্ছে। রিজওয়ান কবির বললেন,
“নতুন কাজ নিয়েছো না-কি!”

“হ্যাঁ বাবা। ভাবছি এভাবেই সময় পার করবো।”

“ভালো। তাজওয়ারের অফিসে গিয়েও বসতে পারো। কাজ শিখতে পারো। আফটার অল বিয়ের পর তোমাকে সেই বিজনেসটা সামলাতে হবে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“সরি, আমি কারো বিজনেস সামলাতে পারবো না। যা করবো নিজের জন্য করবো।”

“ওটা তোমারই বিজনেস।”

আহি বিরক্তমুখে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকাতেই মিসেস লাবণি বলল,
“আহা, এসেছি একটু বিশ্রাম নেই। তোমাদের বাবা-মেয়ের বাগবিতণ্ডার জন্য অনেক সময় পরে আছে।”

মিসেস লাবণি আর রিজওয়ান কবির চলে যেতেই চুনি চাপা স্বরে বলল,
“আফা, একটা ইংরাজি কও তো।”

“কীসের?”

“একটা ডাইনি আইসা বুইড়া খাটাশের মাথা খাইছে। এহন বুইড়া খাটাশ খালি ঘ্যানরঘ্যানর করে।”

আহি চোখ ছোট করে বলল, “বুইড়া খাটাশটা কে?”

“বড় সাহেব।”

চুনি কথাটি বলেই দাঁত দিয়ে জিহ্বায় কামড় খেয়ে বলল,
“আফা, বইলা দিও না। আমারে আবার বিয়া দিবো না। আম্মা তো কইছে, বড় সাহেব বিয়া দিলে ধুমধামে আমার বিয়া হইবো। ওই যে টিভিতে দেহায়, বউ এত্তো লম্বা গহনা গলায় ঝুলাইয়া রাখে, চারপাশে বাত্তি জ্বলে, টুসটাস বাজি ফুটে, জামাই আসে ঘোড়ায় চইড়া। আহা কি সুন্দর বিয়া!”

“তুমিও সেভাবেই বিয়ে করবে না-কি?”

“হ, আফা। বহুত শখ আমার। কিন্তু আমার কি টাহা আছে? আম্মাও তো কই, ওভাবে আমাগো বিয়া অয় না।”

আহি চুনির থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“তোমার বিয়ে ওভাবেই হবে।”

“সত্যি আফা?”

“হুম, একদম সত্যি।”

“এহন কও তো ডাইনি ইংরাজি কি হইবো।”

“উইচ।”

“আজকে থেইকা কমু, উইচ কাম, ইট বুইড়া খাটাশ হেড।”

আহি শব্দ করে হাসলো। আর বলল,
“তোমার এই ইংরেজির ভাংচুরগুলো আমার শুধরে দিতে ইচ্ছে করে না। খুব ভালো লাগে শুনতে।”

“আরো দু’একটা কমু?”

“বলো।”

“মিস চাঁদনী শাদি ধুমধাম সাউন্ড। ভেরি বিউটিফুল ইদার ওদার।”

আহি মুখ চেপে হাসছে। চুনির সাথে গল্প করেই আহির ভালো সময় কাটছে। ডাক্তার নায়ীবের পরামর্শে কাজ দিচ্ছে ভালোই।

(***)

গোসল সেরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো পদ্ম। আফিফ বিছানায় বসে ফাইল দেখছে। পদ্ম তার ভেজা চুল ঝাঁকাতেই পানির ছিঁটে আফিফের মুখে এসে পড়লো। আফিফ পদ্মের দিকে তাকাতেই পদ্ম লাজুক হাসলো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হাসছো কেন?”

পদ্ম আফিফের কথায় ঠোঁট ফুলিয়ে তার দিকে ফিরে বলল,
“আনরোমান্টিক বর একটা। আপনি কিছুই বুঝেন না।”

আফিফ মুচকি হেসে পদ্মের দিকে হাত এগিয়ে দিতেই পদ্ম আফিফের কোলে এসে বসে পড়লো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“বেশি রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছো মনে হচ্ছে।”

“হুম, একটা কথা বলি?”

“বলো।”

“বিয়ের পর আমরা তো হানিমুনে যাই নি।”

“গিয়েছিলাম তো।”

“কোথায়? কক্সবাজার গিয়েছিলাম। তাও আবার আপনার কাজে।”

“তখন চাকরি তো ছিলো না। এখন চাকরি হয়েছে। আমরা খুব শীঘ্রই আবার যাবো।”

পদ্ম অভিমানী সুরে বলল,
“চার বছর সংসার করেছি। শহর আর গ্রামের বাইরে আমি কোথাও পা রাখি নি।”

“তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে পারছি না, তাই সরি। একটু অপেক্ষা করো, পদ্মফুল।”

“অপেক্ষা কেন করবো? সুযোগ তো চলেই এসেছে।”

“কেমন সুযোগ?”

“পুষ্প ফোন করেছিলো। বলেছে একসাথে ঘুরতে যাবে।”

“কোথায়?”

“কক্সাবাজার।”

“তুমি তো গিয়েছিলে ওখানে!”

“আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি, পুষ্প, আহি, আমরা তো কখনো একসাথে যাই নি। আমার খুব ইচ্ছে ফ্রেন্ডদের সাথে কিছুদিন ঘুরবো। কিন্তু তখন বয়স কম ছিল, মা অনুমতি দেয় নি। এখন যদি আপনি সহ যান, তাহলে তো হলোই। আমাদের হানিমুনও হবে, ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরাও হবে।”

আফিফ কিছু বলতে যাবে তখনই পদ্ম অনুনয়ের সুরে বলল,
“প্লিজ। না করবেন না। আমি সত্যিই যেতে চাই। আমারও তো ইচ্ছে হয় ঘুরতে।”

আফিফ পদ্মের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে।”

“নিতে হবে না। আপনার কোম্পানিতে এমপ্লয়িদের শরৎকালীন ছুটি দেয়। ওটাতেই আমরা যাচ্ছি।”

“তোমাকে কে বলেছে শরৎকালীন ছুটি আছে?”

“আহি বললো।”

“ও কীভাবে জানে?”

“সেটা তো আমি জানি না। হয়তো খোঁজ নিয়েছে। আর ওর বাবা তো অনেক বড় ব্যবসায়ী। হয়তো সব কোম্পানিতেই দেয়।”

আফিফের মনে খটকা লাগলো। আহি কি ইচ্ছে করে এমন সময়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে যাতে আফিফও উপস্থিত থাকতে পারে? না-কি পদ্মের জন্যই সে খোঁজ নিয়েছিল?

(***)

বিকেলে রাদ আর আহি রিকশা নিয়ে ঘুরছিলো। হঠাৎ একটা গাড়ি তাদের রিকশার সামনে এসে থামলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে গাড়িটির দিকে তাকালো। তখনই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তাজওয়ার খান। সে রিকশার কাছে এসেই আহিকে টেনে নামালো। রাদ তেড়ে এসে বলল,
“এসব কেমন অসভ্যতা?”

তাজওয়ার শীতল কণ্ঠে বলল,
“অসভ্য লোকের প্রেমিকাকে নিয়ে সভ্য মানুষের উন্মুক্ত ঘোরাফেরা খুব একটা সভ্যতার লক্ষণও নয়।”

তাজওয়ার আহিকে টেনে নিজের কাছে এনে বলল,
“পাব্লিক প্লেসে তোমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করলে নিশ্চয় তুমি খুশি হবে না।”

তাজওয়ারের কথা শুনে রাদের হাত মুঠো হয়ে গেলো। আহি করুণ দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। তাজওয়ার বলল,
“সুইটহার্ট, গাড়িতে উঠো।”

রাদ আহির হাত ধরে বলল, “আহি, চল।”

তাজওয়ার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আহির হাত ছাড়ো, নয়তো পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে তোমার পরিচয় আর থাকবে না?”

রাদও দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কি করবি তুই?”

তাজওয়ার তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“তুই? হুহ। বেশি কিছু না, তোমাকে আত্মাদের জগতে পাঠিয়ে দেবো। ভূত হয়ে যাবে, ভূত।”

তাজওয়ার বিশ্রীভাবে হাসলো। আহি রাদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“রাদ তুই যা। আমাদের বন্ধুত্ব দেখে অনেকে মনে করে অন্যকিছু। সবাই তো আর বন্ধুত্বের সীমারেখা জানে না। একসাথে ঘুরলেই যে প্রেমিক-প্রেমিকা হয় না, এটা এমন কুৎসিত মনের মানুষকে বোঝাতে পারবো না আমি। তুই যা, রাদ। শুধু শুধু ঝামেলা করিস না।”

রাদ আহির কারণে যেতে বাধ্য হলো। রাদ চলে যেতেই আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এবার আমার হাতটা ছাড়ো।”

তাজওয়ার আহির হাত ছাড়তেই, আহি রাস্তার পাশ থেকে একটা ইট কুঁড়িয়ে এনে তাজওয়ারের গাড়ির গ্লাসে ছুঁড়ে দিলো। সাথে সাথেই পেছনের গ্লাসটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেলো। ড্রাইভারও তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে এলো। আহি বাঁকা হেসে আরেকটা ইট উঠিয়ে সামনের গ্লাসটিও ভেঙে দিলো। তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি তাজওয়ারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“ডিয়ার উড বি হাব্বি, আমি তোমার ভাঙা গাড়িতে উঠতে পারবো না। তবে তুমি যদি চাও আমরা একসাথে যেতে পারি।”

আহি একটা রিকশা দেখিয়ে বলল,
“ওই যে রিকশা দেখছো, ওটা করে। অনেক তো গাড়ি চালিয়ে আমাকে শহর ঘুরিয়ে দেখিয়েছো। এবার রিকশা চালিয়ে আমাকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসো।”

“আই হেইট দিস আহি।”

আহি গালে হাত দিয়ে বলল,
“ওপস, তাহলে ভ্যান গাড়ি চালাবে? আচ্ছা চলো, আমরা লোকাল বাসে উঠি। তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে, আর আমি বসে বসে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো। তুমি ধাক্কা খাবে, আর আমি সিনেমা দেখবো। সিনেমার নাম হবে বিজনেস টাইকুনের একদিনের লোকাল বাস।”

আহি কথাটি বলেই শব্দ করে হাসলো। তাজওয়ার তার ড্রাইভারকে বলল,
“এখনই আরেকটা গাড়ি নিয়ে আসতে বলো।”

আহি বলল,
“ওপস, আমি থাকতে তুমি গাড়িতে উঠতে পারবে না, মিস্টার খান। রাস্তায় ইট কিন্তু আরো আছে।”

তাজওয়ার বলল,
“যাও তুমি যেখানে যাওয়ার। আমি আটকাচ্ছি না।”

আহি হেসে বলল,
“তাজওয়ার খান দেখছি তার প্রেমিকার চেয়ে বিলাসিতাকেই বেশি ভালোবাসে। একদিন কি আমার আবদার রাখা যায় না?”

“ইয়েস আহি। আই লাভ মাই রেপুটেশন। আমি তোমার জন্য রিকশা চালাতে পারবো না। কিন্তু তুমি চাইলে লাখের বেশি রিকশা কিনে তোমার নামে লিখে দিতে পারবো।”

আহি এবার শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি সেই প্রেমিকের প্রেয়সী হতে চাই, যে আমার নামে টাকা নয়, হৃদয় লিখে দেবে।”

(আগামীকাল আরেকটা পর্ব দেবো)

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here