চুপিসারে (৫) #রেহানা_পুতুল

0
505

#চুপিসারে (৫)
#রেহানা_পুতুল
তারপর মা রুবিনার একান্ত ইচ্ছায় নদী একদিন বিকেলে তার সবকিছু নিয়ে চলে যায় নিজের বাড়ি। তাকে দেখামাত্রই মাথায় হাত পড়ে তার চাচী নাহার বেগমের। তার চারদিন পরেই এক শান্ত ভোরে নদী এক অশান্ত কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলল।

সেদিন নদী প্রভাতকালেই বিছানা ছেড়েছিলো। মুখ ঘুরিয়ে দেখলো তার দাদী হাফসা বিবি ঘুমিয়ে আছে। সে খালি পায়ে সন্তপর্ণে রুম থেকে বের হয়। আরুর রুমে যায়।গোটা রুম খালি। আরু তার নানাবাড়িতে গিয়েছে। নদী ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। টেবিলের সাথের চেয়ারটিকে এনে দাঁড় করায় সিলিং ফ্যান বরাবর নিচে। তার উপরে একটি মোড়া বসিয়ে নেয়। সেটার উপরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে নদী। নিজের বুকের ওড়নাকে সিলিং ফ্যানের ওপর দিয়ে ফেলে দেয়। পরে গলায় পেঁচিয়ে নেয়। এভাবেই সে আত্মহত্যা করার চূড়ান্ত চেষ্টা চালায়।

এর কারণ তার আগের দুপুরে নাহার বেগম তার গায়ে হাত তুলেছে। এবং অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করেছে। তার জন্য দাদীরও দশকথা হজম করতে হয়েছে চাচীর মুখে। নদীর অপরাধ ছিলো সামান্যই। সে বাড়িতে আসার পর হতেই ছোট্ট এক বয়াম তেঁতুলের আচার রোজ একটু একটু করে লুকিয়ে খেয়ে ফেলেছে। ধরা পড়েছে তার আগেরদিন দুপুরে।

ঠিক সেই মুহুর্তে দরজায় টোকা পড়ল। আরুর ছোটবোন নিরুর গলা শোনা যাচ্ছে। সে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। ভিতর থেকে দরজা খোলা হচ্ছে না দেখে অবুঝ নিরু গিয়ে মাকে ডাকল। তখন নাহার বেগম আসে। ভেতর থেকে বন্ধ দেখে নাহার বেগম ঠাস করে দরজা খুলে ফেলে। পুরোনো ঘুর। হার্ডবোর্ডের নড়বড়ে দরজা। মরচে পড়া ছিটকিনি। তাই পরিশ্রম ছাড়াই দরজা খুলে যায়।

তার আগেই নদী চাচীর উপস্থিতি টের পেয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠে। চট করেই পায়ের নিচের মোড়া ঠেলে মাটিতে ফেলে দেয়। অমনিই ঝুলে যায় নদী।

নাহার বেগম নদীকে ঝুলানো অবস্থায় দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠে। এবং নদীর পা দুটো ধরে ফেলে উপরে তুলে ধরে। হাফসা বিবি কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসে। বউকে মোড়া দেয় উঠে দাঁড়াবার জন্য। এভাবে নদীকে বাঁচিয়ে নেয়। নিকট বাজার থেকে ডাক্তার আনা হয়। দেখে জানালো কোন সমস্যা নেই। গলায় চাপ লেগেছে। একটু গরম পানি খেলেই সেরে যাবে।

নদীর লজ্জায় মাথাকাটা যায়। সেতো বাঁচতে চায়নি। এত অনাদর,অবজ্ঞা নিয়ে বেঁচে থাকা তার পক্ষে গ্লানিকর।
নাহার বেগম দেরী না করে ফোন দেওয়া শুরু করলো পরিবারের সবাইকে। নদীর ফুফু রাফিয়াকে ফোন দিয়ে বলতে লাগলো,

আমি আগেই ভাবছিলাম, এই মাইয়া একটা নয়, একটা অঘটন ঘটাবোই। আপনারা আসেন। ওরে কি করবেন করেন। আমার এত শখের আঁচার সব খেয়ে ফেলল রাক্ষুসীটায়। নিজেরে সামলাইতে না পাইরা একটু গায়ে হাত তুলছি। তাই মইরতে যাইবো। কন? মরলে তার মার কাছে গিয়া মরুক। আমার কাছে না। ওইতো আমগো সবাইরে জেলের ভাত খাওয়ানোর ধান্ধা করতাছে দেখছি। বইন আমার ডর লাগে। সে উলটাপালটা চইলবো। আমার মাথায় রাগ চড়বো। একটু বকাঝকা করুম। অমনি উনি এমন কাণ্ড করবো। নয়তো হাত পা কাইটা ফালাই বিপদে ফালাইবো আমগোরে। একটা কিছু করেন আপনারা।

তাই সেদিন বিকেলে সবাই আসে। নদীকে নিয়ে পারিবারিক বৈঠক বসে। নির্বাচনের অধিক ব্যস্ততায় শ্রাবণ আসতে পারেনি। রজত সিদ্ধান্ত দেয়,

দুই মামার বাড়িতেই থাকবে নদী। তাতে আর এক পরিবারে বেশি চাপ পড়বে না তাকে নিয়ে। উটকো ঝামেলাও ক্রিয়েট হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাবে। এক স্থানে থাকলে নদীও বিরক্ত হবে বকাঝকা শুনলে। ওর বয়সটাইতো বিগড়ানোর বয়স। আবেগের বয়স। মামীও ধৈর্য ধরে থাকতে পারবে না।
এতে নদীর ইচ্ছে আছে কিনা, তা জানার তোয়াক্কা কেউই করলো না।

__________

রজত ঘরে ঢুকেই নানীর রুমে গেলো। দেখলো নানীকে ঘিরে মা, খালা, মা,মামীসহ সবাই খোশগল্পে মেতে আছে। পরে মা রাফিয়াকে ডেকে নিলো উঠানের মাঝে।

কিরে কি হইছে?

কি শুনলাম এটা মা?

কি শুনছস?

তুমি নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছ?

হ। সমস্যা নাকি তোর?

আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না?

রাফিয়া গরম কড়াইতে তেল পড়ার মতো ছ্যাঁত করে উঠলো। বিরস মুখে বলল,

এভাবে কস ক্যান? আমি তোর সতাই মা? তোরে গাঙে ফেলে দিচ্ছি? আমার আপনা ভাইজির লগেইত ঠিক করছি। সমস্যার কিছুতো দেহি না সুবিধা ছাড়া। তোরে মান্য করে চলবে। যা কইবি তাই হুনবো। নিজের মতো কউরা চালাইতে পারবি।

আমার সুবিধা নয়। তোমার সুবিধা এসব। আসল কথা বলো। অন্য মেয়ে হলেতো তোমার খবরদারিত্ব গুঁড়িয়ে যাবে৷ তো কোন ভাইজির লগে ঠিক করছ শুনি?

ক্যান? কয়দিন আগে না তোরে কইলাম? তুইতো হাইসা দিলি তখন। মানাতো করসনাই।

আমিতো ভাবছি তুমি মজা করে বলছ। তাই গুরুত্ব না দিয়ে হেসে ফেলেছি। সিরিয়াসলি নিলে তো কথা বলতাম। বল পাত্রী কে?

কে আবার। আমাদের আরু।

শ্রাবণ যে বলল নদীর সাথে?

রাফিয়া তখন উঠানের এদিক ওদিক চাইলো। গলার স্বর নামিয়ে বলল,

শোন বাবা,শ্রাবণ পলিটিক্স করে। তাই নদীরে আমগো ঘাড়ে উঠায়া দিতে চায়। নয়তো কেউ যদি আবদার তোলে সে বিয়া করনের লাইগা। তাই সে আমাদের কথার মাঝে সাইকেল চালায়া দিলো। বোম ফাটার মতো কইরা কইলো,

রজতের লগে নদীর বিয়া দ্যান।

কি বদমাইশ পোলা। চিন্তা কইরতে পারিস। চেয়ারম্যান হইতে না হইতেই মাতব্বরি শুরু কইরা দিলো। ওর কথার খ্যাতা পুড়ি আমি। আমগো ভালোমন্দ আমরাই বুঝি। ওর কথায় কি আসে যায়। লাইফ আমগো। তাই সিদ্ধান্তও আমগো। তুই মাথা গরম করিস না। যা ঘরে যা। আবার ওরা কইবো মা পোলা মিলা কি ফুসরফাসুর করতাছে।

রাফিয়া থামলো এবার। রজত জিজ্ঞেস করলো,

বাকিরা কে কি বলল?

কার কন দিয়া আমাদের কি আসে যায়। তোর মাইজ্জা মামি রাজী। সকলেই রাজি। আরুর স্কুল লাইফ শ্যাষ হইলে কাবিন করুম। কলেজ পাস করলে বিয়া হইবো। বাকি পড়াশোনা আমগো বাড়িত থেইকা করতে পারবো।

রজত ক্ষেপে গেলো মায়ের উপরে। চনচন গলায় বলল,

বাহ বাহ বাহ! যার বিয়ে তার খবর নেই। পাড়া পড়শীর ঘুম নেই। আমি রাজি? আরু রাজি? নদী রাজী?
কারোই মত নেওয়া লাগবে না নাহ?

কি কইতে চাস তুই?

আমি কি কইতে চাই। সেটা পরে?
আগে আরু, নদী রাজী কিনা মত নাও।

ওই বজ্জাত পোলা। আরুতো ছোট। ওর সামনেতো আমরা এইসব আলাপ পাড়ি না। আর নদী? হ্যারেতো আমি বউ হিসেবে পছন্দই করি না।
ঘরে ল। মাথা ঠান্ডা কর বাপ।

তুমি ঘরে যাও। আমি বাড়িতে চলে যাচ্ছি।

আজিব তো। এই রাইতের কালে তুই বাড়িত যাবি ক্যান। আমার বাপের ঘরে কি তোর থাওনের জায়গার অভাব?

অবাক চোখে বলল রাফিয়া।

আমি অভাব বলছি? আমাদের বাড়িতে কি এমন সময় আর যাইনাই? লাগোয়া গ্রাম। এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

প্রগাঢ় বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বলেই পা বাড়ালো রজত। লম্বা লম্বা পায়ে উঠান ডিঙিয়ে চলে গেলো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

রাফিয়া ঘরে ফিরে এসে মা,ভাবি, বোনকে রজতের সাথের আলাপ জানালো।

নাহার বেগম বলল,

ভাইগনা আমার শরম পাইছে। তাই তালবাহানা করে চলে গেলো। যাক। সমস্যা নাই। দুদিন বাদেই ঠিক হইয়া যাইব। দেইখেন।
সবাই হাসি তামাসায় গল্পগুজবে মশগুল হয়ে গেলো।

এদিকে চেয়ারম্যান ইশতিয়াকের ব্যস্ততা ক্রমাগতই বাড়ছে। সে আর পুরোনো বাড়িতে যেতে সময় পাচ্ছে না। সপ্তাহ খানেক পরে এক বিকেলে গেলো। হাফসা বিবির রুমে গিয়েই,

দাদী কি অবস্থা তোমার। ঘর ঠান্ডা কেন? চাচী কই?

তুইতো পদ পাইয়া দাদীর কথা ভুলে গেলি।হ্যার বাপের বাড়ি গ্যাছে।

নদীও গেলো নাকি?

নাহ। যায়নাই।

তোমার রুম অন্ধকার কেন?

কি হইছে? তোগো মতো আমার চাইর চোখ লাগে না। বাত্তি লাগেনা। চোখের বাত্তি দিয়াই সব ফকফকা দেহি।

আমরাতো তোমাদের মতো টাটকা খাবার পাই না। যা পাই তা খাই। সব ভেজাল আর ভেজাল। বলেই শ্রাবণ লাইট জ্বালিয়ে দিলো।

নদী পাশেই শুয়েছিলো। ওড়না দিয়ে পা থেকে মাথা অবধি ঢাকা তার। শ্রাবণের গলা শুনেই গুটিয়ে রইলো শোয়া থেকে। সরে যাওয়ার উপায় নেই।

এখানে কে বলেই শ্রাবণ নদীর পায়ের দিক হতে ওড়না টেনে কিছুটা নামিয়ে নিলো। অমনি নদীর মুখ দৃশ্যমান হলো। নদী চোখ বুঁজে রইলো।

কিরে নদী? মরার মত সোজা হয়ে মুখ ঢেকে আছিস কেন?

নদী কিছু বলছে না।

কিরে বোবা নাকি তুই?

হাফসা বিবি বকা দেওয়ার ঢংয়ে নদীকে বললেন,

খালি ত্যাড়ামি করে। এই তুই কথা কইতে পারস না? শরম পাস কেন শাবনরে? আমার হইছে যত জ্বালা এরে নিয়া। বাপ কব্বরে। মা বাপের বাড়ি। এর ভবিষ্যৎত পুরাই আন্ধার।

কিসের আন্ধার দাদী? ওইদিন না সেট করে দিলাম নদীর লাইফ।পুরাই সেটেল। বলল শ্রাবণ।

বাক্যগুলো শ্রবণ হতেই নদী পিটপিট চোখে তাকালো রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে।

শ্রাবণ বলল,

দেখলে দাদী। সব মতলবে চলে। ওই যে তোমার আহ্লাদী নাতনি এবার চোখ খুলছে। এই উঠে আয়। কথা আছে তোর সাথে।

নদী আস্তে করে বলল,
কি কথা বলেন ভাইয়া?

তুই উঠতে পারিস না? কি সমস্যা তোর?প্রাইভেট কথা। দাদীর সামনে বলা যাবে না। অন্যরুমে আয়।

নদী উঠে বসে আছে বিছানায়। নড়ছে না।

এই ফাজিল। চড় খাওয়ার আগে উঠে আমার সাথে অন্যরুমে আয় বলছি।

শ্রাবণ চোখ রাঙিয়ে জোরে ধমকে উঠলো নদীকে।

নদী দাদীর ইশারা পেয়ে কম্পিত বক্ষে পা টিপে টিপে শ্রাবণের সঙ্গে একাকী একটি রুমে প্রবেশ করলো।
চলবে

অপেক্ষা করুন আগামী পর্বের জন্য, আর পেজে লাইক ফলো দিয়ে কমেন্ট করে রাখেন বাকি পর্ব পোস্ট করেই কমেন্ট বক্সে দিয়ে দেবো লিংক।

#চুপিসারে
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122113601558106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here