#মেঘের_শহর
#পর্ব_২৮
Saji Afroz
.
-কি ভাবছ?
.
হুরায়রার কথা শুনে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এল মেঘ। মেঘ বলল-
বুঝলাম না ওই ছেলেটা তোমাকে বিশ্রি কেনো বলল!
.
হুরায়রা হাসলে মেঘ খানিকটা অবাক হয়ে বলল-
তুমি হাসছ! অথচ যখন সাইয়ারা কে বলেছিল তখন সে অনেক রেগে যায়।
.
আবার একটু চিন্তিত স্বরে মেঘ বলল-
বুঝলাম না, আমার সাথে কেউ হাঁটলেই কি বিশ্রি দেখে মানুষ?
.
হুরায়রা হাসি থামিয়ে বলল-
এমন টা নয় মেঘ।
-তাহলে? অবশ্য তুমি কিভাবে জানবে।
-আমিই জানি এর কারণ। এবং শুধু তোমার সাথে হাঁটলেই বিশ্রি দেখে এমন টা নয়। আরো অনেকের কাছেই লাগে।
.
মেঘের মনে পড়ে যায় তার বন্ধুর কথা। সেও বলেছিল একটি বিশ্রি মেয়ে তার পেছনে ঘুরছে। মেঘ তাকে সাইয়ারা ভেবে নিয়েছিল। কিন্তু পরে সাইয়ারার সাথে মিশে বুঝলো, সে কোনো ছেলের পেছনে ঘোরার মেয়ে নয়। কিন্তু পুরো বিষয়টায় তার মাথা থেকে চলে গিয়েছিল। সাইয়ারা কে একবারো এই বিষয়ে আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি।
-কি ভাবছ?
-কিছুনা। তুমি বলো কেনো এটা হচ্ছে?
-আমি করেছি এমন টা।
-মানে?
-এই শহরে অনেক ছেলেই আছে যারা মেয়েদের দিকে কুনজরে তাকায়।
.
মেঘ হা করে হুরায়রার দিকে তাকিয়ে থাকলে সে মেঘের মুখ টা হাত দিয়ে বন্ধ করে বলল-
আগে তো বলে নিই! তারপর হা করো।
.
এরপর হুরায়রা আবার বলতে শুরু করলো-
বুঝিয়ে বলছি। আমি যখন এই শহরে আসি, সেই থেকে ছেলেরা আমার পেছনে পড়ে থাকতো। বেশিরভাগ ভার্সিটির ছেলেরা। কিন্তু আমার তো মানুষের সাথে প্রেম নিষিদ্ধ। তাই আমি জাদুর শক্তি তে ওদের মন থেকে নিজের নামটা মুছে ফেলতাম। যাতে করে আমাকে তাদের মনে না থাকে, আর পেছনে ঘুরে বিরক্ত না করে। নিজের সমস্যা সমাধান হলেও অনেক মেয়েকেই এই সমস্যায় পড়তে দেখেছি আমি। যেমন অনেক মেয়েদের দিকে ভালোবেসে তাকায় না। তাকায় লোভনীয় দৃষ্টিতে! এইরকম ই সাইয়ারার দিকে একজন তাকিয়ে ছিল। সে মনে মনে সাইয়ারা কে নিয়ে বাজে ভাবনা ভেবেছে। তাই আমার জাদুর শক্তি তে এমন ব্যবস্থা করলাম যে, ওই ছেলে এখন থেকে সাইয়ারা কে দেখলে বিশ্রিই দেখবে।
-এইরকম কি পুরো শহরে জাদুর কাজ চালিয়েছ তুমি?
-হ্যাঁ! এই যে একটু আগে যে ছেলেটা আমাকে বিশ্রি বলল সে আমাকে নদীর পাড়ে দেখে মনে মনে কি ভেবেছিল জানো?
-কি?
-এই মেয়েটার সাথে একটা রাত কাটাতে পারলেই শান্তি পেত।
-কি! আজ আমি ওকে মেরেই ফেলব।
.
মেঘ কে থামিয়ে হুরায়রা বলল-
শান্ত হও। এখন তো সে আমাকে চিনেই না।
-হুম। আচ্ছা আমার এক বন্ধু বলেছিল তার পেছনে এক বিশ্রি মেয়ে ঘুরছে। বিশ্রি মেয়ে কেনো ঘুরবে?
-তোমার সেই বন্ধু মেয়েটি কে ভালোবাসার কথা জানালেও তার মনে ছিল শয়তানি। সে মেয়ে তো এটা জানে না। তাই সে ওর পেছনে ঘুরছে। কিন্তু এখন তোমার বন্ধু ও কে চিনতেই পারছে না।
.
হা হা শব্দে হেসে উঠলো হুরায়রা। মেঘ তাকে নিজের কাছে টেনে কোমর চেপে বলল-
তোমাকে কেউ পছন্দ করলেই তুমি জাদুর শক্তি তে তার স্মৃতি থেকে তোমাকে মুছে দিতে। তাহলে আমার ক্ষেত্রে এমন কিছু হলো না কেনো?
-বুঝো না?
-তুমি বলো।
-কারণ প্রথম দেখাতেই তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল।
.
কথাটি বলে মেঘের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হুরায়রা ছুটতে লাগলো। তার পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে মেঘ বলল-
থামো হুরায়রা!
.
.
.
শহর আজ আনন্দ নগর শপিংমল এ এসেছে। তার কিছু কেনাকাটা করার প্রয়োজন। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সে জিকো কে দেখতে পায়।
জিকো ও মোখলেস একসাথে হাঁটছে। মোখলেসের একটা ফোন আসাতে সে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে। জিকো একা একা দাঁড়িয়ে ফোন টিপতে ব্যস্ত।
তার পাশে এসে শহর বলল-
বিয়ের শপিং করতে এসেছেন বুঝি?
.
জিকো একটু চমকে বলল-
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?
-শহর। শহর আহম্মেদ।
-আমার সম্পর্কে কিভাবে জানেন?
-আমি আরো অনেক কিছুই জানি। এই যেমন আগে আপনি ছেলে ছিলেন।
.
জিকো পেছনে তাকিয়ে দেখলো, মোখলেস ফোনে কথা বলতেই ব্যস্ত। সে বলেছিল জরুরি ফোন এসেছে।
জিকো শহর কে বলল-
আমার সাথে আসুন।
.
তারা মোখলেসের কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে এল। জিকো বলল-
আপনি এত কিছু কিভাবে জানলেন?
-আমি কিভাবে জানলাম সেটা বড় কথা নয়। আপনি যে মোখলেস কে ঠকাচ্ছেন এটা হলো বড় কথা।
-মানে?
-ছেলে থাকতেও আপনি অপকর্ম করে বেড়াতেন। মেয়ে হয়ে বদলাতে তো পারতেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে? আপনি বদলান নি। মানুষ কে ঠকানোর স্বভাব টা যায় নি আপনার।
.
জিকো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল-
আমি নিরুপায়! বিশ্বাস করুন আমি মোখলেস কে ঠকাতে চাই না। কিন্তু এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।
-জানতে চেষ্টা করেছেন কেনো আপনার সাথে এটা ঘটেছে?
-কিভাবে জানব? আমি তো ভেবেই পাই না কিভাবে কি হলো?
-আপনার কি উচিত নয় মোখলেস কে সব সত্যি টা জানানো? সে তো আপনাকে ভালোবাসে। হতে পারে সব সত্যি টা জেনেও আপনাকে গ্রহণ করতে রাজি সে।
-ঘৃণা করবে আমাকে।
-তাই বলে ছলনা করবেন তার সাথে? আপনাকে সে বিশ্বাস করে। সত্যি টা কখনো জানলে কি হবে ভেবেছেন?
.
জিকো ভাবনায় পড়ে গেল। শহর চলে যাওয়ার জন্য এক বাড়িয়ে আবারো থেমে গেল। সে বলল-
একটা ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করুন। হতে পারে এতে আপনি আগের রূপ ফিরে পাবেন এবং জীবনে সুখী হবেন।
.
শহর চলে যাওয়ার পরে মোখলেস এসে বলল-
হুট করে এখানে কেন চলে আসলে তুমি?
.
জিকো মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল-
আপনি ব্যস্ত ছিলেন তাই।
.
জিকোর হাত ধরে মোখলেস বলল-
এখন ফ্রি। চলো যাওয়া যাক। তোমার বিয়ের শাড়িটা এখনো কেনা বাকি।
.
জিকো হাঁটতে হাঁটতে আপন মনে ভাবছে-
কে এই শহর আহম্মেদ? কিভাবে সব জানলো!
.
.
.
রাত হলে ঘুমিয়ে পড়লো জিকো। গভীর রাতে এক স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল তার। এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসলো। এ কি স্বপ্ন দেখেছে সে !
এক মেয়ে কে সে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। মেয়েটি তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তিও হয়। একটু পরেই অন্য এক মেয়ে এসে তাকে জোরে ধাক্কা মারে। এরপরে আর কাউকে সে দেখতে পায়না। টলতে টলতে বাসায় ফিরে আসে। আর সকালে উঠেই সে মেয়ে হয়ে যায়।
তার মানে সেদিন রাতে কোনো মেয়ের সাথে এসব করার চেষ্টা করেছিল সে, যার কারণে তার আজ এই অবস্থা!
কিন্তু একটা মেয়ের সাথে এরূপ আচরণের ফলে তার এই অবস্থা হবে কেনো? এর কারণ কি মেয়েটিই জানবে?
হয়তো বা জানবে। জিকোর মেয়েটিকে খুঁজে নেওয়া প্রয়োজন। সে তার কাছে ক্ষমাও চাইবে। মেয়েটির ক্ষমা পেয়ে সে হয়তো বা আবার আগের রূপ ফিরে পাবে।
কিন্তু জিকো এই মেয়েটিকে পাবে কোথায়!
.
.
.
মেঘ ও হুরায়রা পাশাপাশি হাঁটছে। আজ তারা আনন্দ ঝর্ণা দেখতে এসেছে। হুরায়রার ইচ্ছে ছিল এখানে আসার। কিন্তু আসবে আসবে বলে আসা হয়নি। মেঘ কে নিয়েই আজ আসা হয়েছে এখানে।
গাড়ি থেকে নেমে তারা হাঁটতে শুরু করেছে।
মূল রাস্তা থেকে উত্তরে যেতেই ঝর্ণার কলকল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে তারা। উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে পায়ে হেঁটে যেতে যেতে তার দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে পাহাড়ী সবুজ আর জীবনধারায়।
মূল রাস্তা থেকে ঝর্ণাটি প্রায় অনেকটা ভেতরে। পুরোটাই পায়ে হাঁটাপথ। কিন্তু হাঁটা পথ যাত্রার আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অনেকখানি হাঁটার পর অবশেষে ঝর্ণার দেখা পেল তারা। মেঘ হেসে বলল-
এই হলো আনন্দ ঝর্ণা।
.
প্রাকৃতিক এই ঝর্ণাটি প্রায় ত্রিশ মিটার উঁচু থেকে আছড়ে পড়ছে নিচে। পুরোটাই পাথুরে পরিবেশ। পাহাড়ের প্রায় নব্বই ফুট উপর হতে ঝর্ণার পানি নিচে পড়ছে। নিচে পড়ার পর তা আবার পাথরের ওপর গড়িয়ে নেমে আসে সমতলে।
হুরায়রা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
অনেক সুন্দর!
-আমাদের আনন্দ নগরী তোমার মেঘের রাজ্য থেকেও সুন্দর।
-হুম।
.
হুরায়রা থেমে গেল। মেঘের দিকে তাকালো সে। মেঘের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে। মেঘ অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। তার কেনো যেন ভীষণ কান্না পাচ্ছে!
হুরায়রা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল-
কাল তোমার সিদ্ধান্ত জানাবে মেঘ। তবে একটা কথা মাথায় রেখো, আমি আমার পরিবার কে ভুলতে পারব না। তাই আমার জন্য এখানে থাকাটা কষ্টকর। কিন্তু তুমি? তুমি সব ভুলে যাবে। তাই তোমার কষ্ট পাওয়ার কথা আসে না। বরং তুমি আমার সাথে ভালো থাকবে।
.
নিশ্চুপ মেঘ কে দেখে হুরায়রা বলল-
কাল সকালে আমি তোমার জন্য নদীর পাড়ে অপেক্ষা করব। হতে পারে কাল থেকে আমাদের সুখের দিন শুরু অথবা দুঃখের!
.
.
.
পুরো শহর ঘুরেও মেয়েটি কে খুঁজে পেলো না জিকো।
এদিকে কাল তার মোখলেসের সাথে বিয়ে! শেষমেশ হতাশ হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় জিকো। এক মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগলে দূরে সরে দাঁড়ায় সে। মেয়েটির দিকে চোখ পড়তেই তার মুখে হাসি ফুটে। এ তো স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি, যাকে কি না জিকো ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল!
জিকো মেয়েটির পা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বলল-
আমাকে ক্ষমা করে দিন, অভিশাপ মুক্ত করুন।
.
মেয়েটি আশেপাশে তাকিয়ে জিকো কে উঠতে বলল। কিন্তু সে আরো জোরে তার পা চেপে ধরলো। মেয়েটি তাকে চিনতে না পেরে পরিচয় জানতে চায়। জিকো বসা অবস্থায় তার পরিচয় জানায়। মেয়েটি অবাক হয়ে বলল-
আপনি সে কি করে হতে পারেন! আপনি তো একজন মেয়ে।
.
জিকো দাঁড়িয়ে তাকে সবটা খুলে বলল এবং নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলো। মেয়েটি রেগেমেগে বলল-
সেদিন ওই আপুটা না থাকলে আপনি আমার কি হাল করতেন এটা ভাবলেই ভয় লাগে আমার।
.
জিকো তার কাছে ক্ষমা তাকে ভালো করে দেয়ার অনুরোধ জানায়। মেয়েটি প্রায় চেঁচিয়ে জানায়, সে জানেনা জিকোর এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে। কিন্তু যা হয়েছে তাতে সে খুশি। এসব ছেলের এই অবস্থায় হওয়া উচিত।
মেয়েটি হনহনিয়ে চলে যায়। জিকো মাথায় হাত দিয়ে বলল-
এই মেয়েও আমার সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারলো না। কালই বিয়ের তারিখ। এখন কি হবে! কি করা উচিত আমার!
.
.
.
শহরের রুমে বসে আছে হুরায়রা। শহর এখানে নেই। তারই অপেক্ষা করছে সে। চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে বসেছে হুরায়রা। সুন্দর ডায়েরি দেখলেই তার লিখতে ইচ্ছে করে। হুরায়রা লিখতে শুরু করলো-
আমি মেঘপরী
মেঘে আমার বসবাস,
দুঃখ পেলে কেঁদে ওঠে
আমার সারা আকাশ।
সেই কান্না বৃষ্টি হয়ে
পড়ে মাটির বুকে,
দেয় ভিজিয়ে সবুজ চাঁদর
সবুজ প্রকৃতিতে।
থাকি আমি মেঘের বাড়ি
হাঁটি যে মেঘের রাস্তাতে,
দোলা দিয়ে যাই শস্য শ্যামলায়
ঢেউ খেলে যাই নদীতে।
.
লিখেই হাসলো হুরায়রা। মাঝেমাঝে মনে যা আসে তাই লিখতে ভালো লাগে।
-কি লেখা হচ্ছে শুনি?
.
শহর কে দেখে বলল হুরায়রা-
ওসব বাদ দিন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
-আমার জন্য?
-পুনম আপনার নামে চিঠি পাঠিয়েছে।
.
শহর কে চিঠি দিয়ে হুরায়রা বেরিয়ে যাচ্ছে। তাকে থামিয়ে শহর বলল-
কাল মেঘ তার সিদ্ধান্ত জানাবে।
-হ্যাঁ।
-যদি রাজি না হয়?
.
হুরায়রা নিশ্চুপ হয়ে আছে দেখে শহর বলল-
মেঘের সিদ্ধান্ত কে সম্মান জানানো উচিত আপনার।
.
হুরায়রা জাদুর শক্তি প্রয়োগের কথা ভেবেছিল, এটা কি কোনোভাবে শহর জানতে পেরেছে?
শহর হেসে বলল-
পুনমের চিঠি টা পড়ি তবে…
.
চলবে
.
বি:দ্র: উল্লেখিতে কবিতা টি Afsana Chyte আপুর লেখা।