শরতের_শিশির ( ৬ ) #মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

0
326

#শরতের_শিশির ( ৬ )
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

নদীর স্রোতের মতই বহমান ঘড়ির কাটাও। পরীক্ষা শেষ হয়েছে দু’মাস থেকেও অনেক বেশি। আজ পরীক্ষার ফলাফল বের হবে। আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে চাঁদনী। শুধু দেখার অপেক্ষায় আছে সিজিপি কি হবে তার। তবে অত্রকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। নিজের হাতে বানানো খুব ছোট আকারের তৈরি সাজেশন দিয়েছে। যদি তা পড়ে অন্তত তার ন্যূনতম ৫০ করে আসবেই। কিন্তু আদৌ ছেলেটা পড়েছে কিনা কে জানে! পড়াশোনায় এত গড়িমসি করে। কি হয় আল্লাহ জানে। দুপুর একটার মাঝেই ফলাফল বের হল। সে ওয়েবসাইটে গিয়ে নিজের ফলাফল দেখল। আগের মতই তার ফলাফল ভালোই ছিল। সিজিপিএ 3.34। অত্রের রোল নাম্বার চাইল। অত্র রোল নাম্বার বলেনি। তবে নিজে যা বুঝার বুঝে গেল। এই ছেলে দু’বিষয়ে খারাপ করেছে। বাড়িতে তার বড় ভাই মসলা হিসেবে তাকে পিষে নিচ্ছে এখন। সাথে তার বাবাও যুক্ত। দু’জন মিলে তার মাংসের কি’মা বানাচ্ছে।

ভালো ফলাফল করেও মনটা বিষিয়ে আছে চাঁদনীর। অত্রের জন্য মনটা আকুপাকু করছে ভীষণ। কত অনুনয়-বিনয় ছিল তার প্রতি। প্লিজ পড়, ভালো ফলাফল হলে দিনশেষে তোমারই ভালো লাগবে। সাজেশনটা অনুসরণ কর। খুব ভালো ফলাফল না হোক অনন্ত পাসমার্ক তো আসবে। কিন্তু কি হল, অত্র তার একটা কথাও শুনল না। এখন সবার কুটুক্তি শুনছে। মন খারাপের সঙ্গী হিসেবে সে অত্রকে সান্ত্বনা দিল। পরেরবার যেন মন দিয়ে পড়ে। অত্র চুপ করে তার কথা শুনল। প্রতিত্তোর করল না।

অত্রের হৃদগগনে নিকষ কালো আঁধারের মেঘ জমেছে। নিস্তব্ধতা বিরাজমান। চাঁদনী সবই বুঝল। তাই তো অত্রের প্রিয় মানুষ হিসেবে পাশে দাঁড়াল। নিজের ঝুলিতে যত সান্ত্বনার বাণী ছিল সব আওড়াল। অন্তত অত্র ভালো থাকুক, প্রাণখুলে আবার হাসুক। হাসলে যে ছেলেটাকে দারুণ লাগে। কত প্রাণবন্ত সেই হাসি।

পরেরদিন চাঁদনী নিজ থেকে দেখা করল। প্রাণহীন এক অত্রকে দেখল। মাত্র একদিনে কেমন ভঙ্গুর হয়ে গেছে। দু’চোখের নিচে কালচে দাগ, ভাঙা চোয়াল আর শুকনো মুখ। নত মস্তকে বসে আছে। মুখ তুলে চাইল না। চাঁদনীর মনটা ভীষণ পুঁড়ছে। ইচ্ছে করছে একবার জড়িয়ে নিতে। বুকের বা-পাশে নিজের মাথা রেখে বলতে,
‘আমি আছি তো অত্র, একদম ভেবো না।’

কিন্তু সব ইচ্ছে তো আর প্রকাশ করা যায় না। তাই নিজের শান্তস্বর ব্যবহার করল।
‘অত্র ব্যর্থ হওয়া মানে সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। এখনো তোমার কাছে সময় আছে। শেষবর্ষে অন্তত পড়াশোনায় তোমার মনোযোগ বাড়াবে। পারবে না অত্র।’

অত্রের নির্লিপ্ত চাউনি। জবাব দিল না। শুকনো মুখে মাথা উপর নিচ করল শুধু। চাঁদনী নিশব্দে হাসল। এবার তার কাজ হচ্ছে অত্রকে আগের মত প্রাণবন্ত করা। সারাদিন অত্রের সাথে কাটাল। বিকেল গড়াতে দু’জন নিজেদের বাড়িতে ফিরল।
_
বন্ধ কলেজ খোলা হল। তাদের শেষবর্ষের ক্লাস চালু হল। চাঁদনী কলেজ আসল আগের মতই। অত্রকে নিজ মনে খুঁজলো। কিন্তু ডুমুরের ফুল অত্রকে পাওয়া গেল না। সে অত্রের মুঠোফোনে কল করল। কিন্তু কল ওয়েটিং দেখাল। প্রথমবার রিসিভ হল না। দ্বিতীয়বার সে আর নিজ থেকে কল দিল না। কিন্তু তার কিছু সময় বাদে অত্র নিজ থেকে কল দিল। চাঁদনী জিজ্ঞেস করল,
‘কলেজ আসবে না।’
অত্র প্রথমে ইস্ততঃবোধ করছিল। পরে বলে উঠল,
‘আসলে, নানা বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। আজকে কলেজ আসতে পারব না। তোমার সাথে রাতে কথা হবে।’

চাঁদনী মনঃক্ষুণ্ন হল। কিন্তু মুখে প্রকাশ করল না। নরম সুরে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
অত্রের কল কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। চাঁদনী এখনও মুঠোফোন হাতে ধরে বসে আছে। মনটা আচমকাই বিষন্ন হয়ে গেল তার। একাকি ক্লাস করতে আজকাল একদমই ভালো লাগে না। অত্রের সাথে বসে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করে। দু’জন একসাথে ক্লাস করবে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হবে সে লজ্জায় আড়ষ্ট হবে। অত্র তাকে উড়ন্ত চুমো ছুঁড়বে কিন্তু সে কৃত্রিম রাগ দেখাবে। মাঝে মাঝে তাকে চোখ টিপ্পনী মারবে আর সে ভেঙচি কাটবে। অত্র কিছু না বুঝলে তাকে খাতায় লিখে দেবে। দু’জন পাশাপাশি বেঞ্চিতে বসবে। কলম দিয়ে একে অপরকে খোঁচাবে। কত মজা হত তাই না! কিন্তু অত্র তো ক্লাসই করে না। খুব কদাচিৎ তার আগমন ঘটে ক্লাসের মাঝে। তার ইচ্ছেগুলো কি পূর্ণ হবে কখনো।

বাসায় ফিরল এক বিবর্ণমুখ নিয়ে। চাঁদনীর মনটা খচখচ করছে। ইচ্ছে করছে অত্রের কাছে ছুটে যেতে। শার্টের কলার চেপে ধরে বলতে, এত কষ্ট কেনো দাও? আমি যে তোমার প্রেমে মজে গেছি। আজকাল প্রেমের জ্বরে মরছি। আমাকে এভাবে মাঝদরিয়ায় ফেলে নিজে বেশ আয়েসে আছ। কত নিষ্টুর প্রেমিক তুমি! নিজের মুঠোফোন পড়ে আছে বিছানার এককোণে। মন তার তীব্র যাতনায় দগ্ধ হয়ে আছে। কবে তার অত্রের কল আসবে। সারাক্ষণই অত্র নামটাই তার মাথায় ঘুরে। রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসতেই অত্রের কল আসল। আজকাল অত্র রাতেই কল দেয়। দিনে তাকে খুব একটা পাওয়া যায় না।

চাঁদনীর বিষন্ন মন মূহুর্তে অদ্ভুত ভালো লাগায় চেয়ে গেল। তড়িঘড়ি কল রিসিভ করল। অত্র ফিসফিস করে কথা বলল,
‘কেমন আছো জান,। নানা বাড়িতে আছি এখনো। বাসায় মেহমান আছে তাই তোমাকে কল দিতে পারেনি। সর‍্যিই’।
চাঁদনীর মনটা মূহুর্তে মোমের মত গলে গেল। দু’ঠোঁটের মাঝে মুচকি হাসি ঝুলছে। নিশব্দে নিশ্বাস ছাড়ল। নিজেও ফিসফিস করল,
‘সমস্যা নেই। এখন কি করছো? রাতের খাবার খেয়েছো?’

‘মাত্রই খেয়ে আসলাম। আজকে নানার বাড়িতে মহাভোজ চলছে। ভাইয়া ইতালি যাবে সামনের সপ্তাহে। তাই এত বড় আয়োজন চলছে। তুমি কি করছো?’
‘আমিও মাত্র খেয়ে আসছি। এখন পড়তে বসছি। তুমি কাল কলেজ আসবে।
অত্র কিয়ৎক্ষন ভাবল। কিঞ্চিৎ হাসির শব্দ হল তার। ফিসফিস করেই বলল,
‘আসলে মামা বাড়ি থেকে যাওয়ার পর আমরা পরিবারের সবাই একটা ট্যুর দেব। আরও এক সপ্তাহ পর কলেজ যাব। তুমি তো আছই কলেজের সব বিষয় জানানোর জন্য। তাই আমি চিন্তামুক্ত ম্যাডাম।’

চাঁদনীর মনটা মূহুর্তে বিষন্নতার আদলে আবৃত হল। হৃদকোণ আবারও বিষাদে তিক্ত। তবু মুখ ফুটে দ্বিরুক্তি করল না। ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘অহহ।’
_

দু’দিন ধরে অত্রের কল আসল না। দিনগুলো কাটল অবসন্নতায়। যেনো কিছু একটা হারিয়ে গেছে তার। মুখশ্রী শুকনো হয়ে গেছে মাত্র দু’দিনে। আজকাল কাজকর্মে মন বসে না। তার গগনবক্ষে মেঘ জমেছে বেশ। কখন বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে তার ঠিক নেই। সর্বদা তার দৃষ্টি আকাশ পানে চেয়ে থাকে। সেই দৃষ্টিতে অত্রের মুখ ভেসে থাকে। আনমনে নিজ থেকেই কল দিল অত্রের মুঠোফোনে। কল তার ওয়েটিং দেখাল। আবারও অনেক কিছু ভাবল। কিন্তু উত্তর এল ‘জানি না’। সেদিন অত্রের কল আর আসল না। আলো আঁধারের লুকোচুরিতে এভাবে দিন কাটছিল তার।
_
কলেজ এসে নিভৃতে বসল ক্লাসে। আচমকাই হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামল ধরণীতলে। বৃষ্টির অঝোর ধারা দেখার জন্য করিডোরের একপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল চাঁদনী। সুপ্তমনে অত্রের ছবিই ভেসে উঠল। পাশে দাঁড়ানো রেবেকা হঠাৎই মজারচ্ছলে বলে উঠল,
‘অত্রের কথা ভাবছিস বুঝি। তোর হিরো আজকাল কলেজ আসে না। বড্ড কষ্ট হয়। বুঝি বুঝি সব বুঝি।’

রেবেকার আচম্বিত কথায় হতচকিত হয়ে গেল চাঁদনী। কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। কিন্তু নিজের লজ্জা সংবরণ করল দ্রুতই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে। রেবেকার কথায় ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘দূর, কিসব বলিস তুই।’
তাদের কথোপকথনের মাঝে পাশে দাঁড়ানো হামিদা তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল। অতর্কিত চাঁদনীর একবাহু টেনে ধরে কিছুটা জনসমাগম থেকে দূরে দাঁড়াল। চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
‘অত্র তোমাকে কল দেয়! তার সাথে কি কথা বল তুমি।’
চাঁদনীর দৃষ্টি জোড়ায় বিস্ময়। অকপটে জবাব দিল, ‘হুম, অত্র আমাকে কল দেয়। কিন্তু কেন?’

হামিদা কিঞ্চিৎ হাসল। সেই হাসি ছিল তাচ্ছিল্যেই পরিপূর্ণ। যেনো নিছক বিনোদন মাত্র। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,
‘অত্র আমাকেও কল দেই। রিসিভ না করলে ঘন্টার পর ঘন্টাও কল দিয়ে যেত। মোবাইলের স্ক্রিনে দেখি ৬১, ৩২, ৪১, ২৮, ৫০ এরকম প্রায় সময় মিসডকল উঠে থাকত। কিংবা কখনো মেসেজের বহর। আবার মাঝে মাঝে তার কল দেয়া বন্ধ থাকত মাসখানেক। তারপর আবার শুরু হত তার নিপীড়ন। আমি জানি না তোমার সাথে তার কেমন সম্পর্ক। তবে বলব সে হয়ত তোমার সাথে টাইম পাস করছে। যেমনটা আমার সাথে করেছে।
চাঁদনীর আরক্তিম আঁখিজোড়া। চোখ দুটো ছলছল। সে ‘কি কাঁদছে! তার কি খুব কষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘ ছয়মাস পর সে অত্রকে হ্যাঁ’ বলেছিল। আর এখন তাদের আটমাসের সম্পর্ক। সব কি মিথ্যে। নাহ! এটা হতে পারে না। হৃদকোণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বাইরের ঝুম বৃষ্টির অঝোর ধারা তার হৃদকাননে হচ্ছে। প্রচন্ড ঝড় বইছে। এ ঝড় যে থামার নয় আজ।

চলবে,,

আগামীকাল অন্তিম পর্ব আসবে। আপনাদের মতে, বলুন তো চাঁদনীর কি করা উচিৎ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here