হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৪) #Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

0
818

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৪)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১২৮)
তরু কুশলকে শান্ত করতে বললো….
—“কুশল…আপনি শান্ত হোন। আর আপনার পিছনের দিকে ঘুরে দেখুন দু’জন ৮-১০ বছর বয়সী বাচ্চা ছেলে-মেয়ে হারিকেন আর কলসী হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্কুল মাঠ থেকে বেড়োতে মূল দরজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমার মন কেনো জানি না বারংবার বলছে যে, এই মাঠের ঠিক কোন স্থানে আপনার মায়ের কবর আছে সেই সম্পর্কে ঐ বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জনের গার্জিয়ানরা অবগত হতে পারেন।”

তরুর মুখে এরূপ কথা শোনামাত্র কুশল তরুর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পিছন ঘুরতেই ঐ বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জনকে দেখতে পায়। পরক্ষণেই কুশল আর কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই ‘এই যে বাবুরা শুনছো! এদিকে একটু আসবে তোমরা?’ এই বাক্য উচ্চারণ করে গলা ছেড়ে ওদের ডাক দেয়। কুশলের ডাক বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জনের কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই ওরা সেখানেই থেমে গিয়ে কুশল আর তরুর দিকে একপলক দেখে একে-অপরের দিকে তাকায়। তরু হাত উঠিয়ে ইশারায় ওদের নিজেদের কাছে আসার জন্য ডাকছে। বাচ্চা মেয়েটি বাচ্চা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“ভাইয়া…ওনারা আমাদের ডাকছেন কেনো?”

বাচ্চা ছেলেটি তার বোনকে অভয় দিয়ে বললো….
—“চল তো গিয়ে দেখি কি বলেন।”

মেয়েটি ভীত স্বরে বললো….
—“না..না..আমি যাবো না। ওনারা যদি আমাকে আর তোমাকে বাবার মতো ধরে মা*রে*ন!”

ছেলেটি বললো….
—“ঝর্ণা…এভাবে বলতে হয় না বোন। হাজার হলেও উনি আমাদের বাবা হন।”

—“উনি যদি আমাদের বাবাই হতেন তাহলে মিঠুর বাবার মতো উনিও আমাদের নিজের কোলে বসিয়ে আদর করতেন। সবসময় চোখ রা*ঙি*য়ে কথা বলতেন না। আর কারণে-অকারণে আমাকে আর তোমাকে মা*র*তে*ন না। উনি অনেক পঁ*চা ভাইয়া। উনি আমাদের বাবা হতেই পারেন না।”

ছেলেটি রাগী স্বরে বললো…
—“চুপ করবি তুই! সবসময় বেশি বকবক করিস। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হতে শুরু করলে রেলগাড়ীর মতো তা চলতেই থাকে যেনো সঠিক সময়ে থামার কোনো নাম গন্ধ থাকে না।”

বড় ভাইয়ের রাগী স্বরে বলা কথাগুলো শুনে বাচ্চা মেয়ে ঝর্ণার মুখ ভার হয়ে যায়। ছেলেটি আবারও বললো….

—“এখন কি এভাবেই মুখ ভা*র করে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি আমার সাথে ওনাদের কাছে যাবি ওনারা কি বলেন তা শুনতে!”

ঝর্ণা মুখ ভার করা অবস্থাতেই মিনমিনিয়ে বললো…
—“হুম চলো!”

এই বলে ওরা দু’জন কুশল আর তরুর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিছুসময় পর ওরা দু’জন কুশল আর তরুর সামনে এসে দাঁড়াতেই ঝর্ণা ওর ভাইয়ের পিছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ায় আর ঘাড় বাঁকিয়ে ওদের দিকে লক্ষ্য করে। ছেলেটি কুশল আর তরুকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“কে আপনারা? আগে কখনও এই এলাকার আশেপাশেও দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না।”

বয়সের তুলনায় ছেলেটির কথার ধরণ অনেক বেশিই গোছালো দেখে তরু কিছুটা অবাক হয়ে বললো…

—“আমরা এইখানে আজই ১ম এসেছি। তোমাদের একটা প্রশ্ন করতে পারি!”

ছেলেটি তাড়া দিয়ে বললো…
—“তাড়াতাড়ি করুন। বাড়িতে আমাদের অসুস্থ দাদু আছেন। আর মায়েরও ঘুম ভে*ঙে যেতে পারে যখন-তখন। একটু পর বাবাও বাড়িতে ফিরবেন। আমাদের বাড়িতে দেখতে না পেলে আমাকে আর বোনকে মা*র*তে মা*র*তে আমাদের দুজনেরই পিঠের ছা*ল তুলে ফেলবেন।”

ছেলেটির এমন কথা শুনে কুশল আর তরু দু’জনেই অনেক বেশিই অবাক হয়ে যায়। সেইসময় তরু লক্ষ্য করে ছেলেটির পিছন থেকে ঝর্ণা একটু পর পর তরুর দিকে তাকাচ্ছে। চাঁদের আলোয় বাচ্চা মেয়েটির ফর্সা মুখশ্রী চকচক করছে। এতো মিষ্টি একটা বাচ্চা মেয়েকে কেও কি করে মা*র*তে পারে! তরু সেসব চিন্তা মাথার আরেক পার্শে রেখে বললো….

—“এতো রাতে তোমরা দু’জন এই ফাঁকা মাঠে এসেছো কেনো? আর ঐ বটগাছের গোড়ায় বা পানি দিলে কেনো? মাঠজুড়ে তো ফল-মূলের গাছের অভাব নেই। তোমাদের তো উচিত ছিলো সেইসব গাছগুলোর গোড়ায় পানি দেওয়া।”

ছেলেটি বললো….
—“বোঝার বয়স হয়েছে পর থেকেই আমাদের দাদুভাইকে দেখে এসেছি তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে ঐ বটগাছের গোড়ায় এক কলসী করে দিতেন। কেনো দিতেন তা আমি জানি না। কিছুদিন ধরে আমাদের দাদুভাই অ*সুস্থ হয়ে পড়েছেন। এর পর থেকে মায়ের চোখ ফাঁ*কি দিয়ে দাদুর কথানুযায়ী আমি আর বোন প্রতিদিন সময় করে এই স্কুল মাঠে আসি আর ঐ বটগাছের গোড়ায় এক কলসী করে পানি ঢেলে দিয়ে যাই।”

ছেলেটির এরূপ কথা শুনে কুশল আর তরু একে-অপরের দিকে তাকায়। কুশল কিছু বলতে নিবে সেইসময় ওদের সামনে থেকে একজন মধ্যবয়সের পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসে…..

—“ঝর্ণাআআআ….রাসেললল….এই ব*দ*মা*শ পোলা-মাইয়া….এতো রাইতে এইনে কি করতে আইছোস তোরা? এতো অল্প বয়সেই আমাগো পরিবারের মুখ পু*ড়া*ই*তে উইঠা পইড়া লাগছোস তোরা তাই না! মাইয়া মানুষ হইয়া তোর এই রাইতের বেলা ঘরের বাহিরে ঘোরাঘুরি করা আইজ বাইর কইরা ছাড়মু আমি। আজ যদি তোদের দুইটার পিঠের ছাল আমি তুইলা না ফেলছি তয় আমার নাম ও মফিজুর নয়।”

পুরুষালী কন্ঠে বলা এরূপ কথাগুলো শোনামাত্র ঝর্ণার শরীর ভ*য়ে শিউরে উঠে। তৎক্ষনাৎ সে কোনো কিছু না ভেবেই নিজের ভাইয়ের পিছন থেকে সরে তরুর পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পরে। কুশল, তরু আর ছেলেটি মফিজুরের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে মফিজুর একহাতে নিজের লুঙ্গি আঁটো করে ধরে বড় বড় কদম ফেলে ওদের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। ছেলেটি কুশল আর তরুর দিকে তাকিয়ে ভী*ত কন্ঠে বললো….

—“আপনাদের জন্য আজ আবারও আমাদের বাবার হাতে মা*র খেতে হবে। আপনারা যদি আমাদের না ডাকতেন তাহলে বাবা বাড়িতে ফেরার আগেই আমরা বাড়িতে চলে যেতে পারতাম।”

ছেলেটির কথাগুলো শুনে কুশলের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মুফিজুর ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছেলেটির হাত শক্ত করে ধরে রাগী স্বরে বললো….

—“কোথায় লুকাইলো রে ঐ ব*দ*মা*ই*শ মাইয়াটা! আজ ওর একদিন কি আমার যতোদিন লাগে। বড্ড বার বাইরা গ….।”

মফিজুরের রাগী স্বরে বলা কথাগুলো বলতে নিয়ে নিজের সামনে তরু আর কুশলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়। তরুর পিছনে দাঁড়িয়ে ঝর্ণা মফিজুরের বলা কথাগুলো শুনে ভ*য়ে তরুর শাড়ির পিছনের অংশ খাঁ*ম*ছে ধরে রেখেছে। তরু তা অনুভব করতে পারছে। মুফিজুর তরু আর কুশলের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো…

—“আপনেরা কেডা? এই গাঁয়ে এর আগে তো কখনও দেখি নাই। পোশাক-আশাক দেইখা তো শহরের ম্যম-বাবুগো মতোন লাগতাছে। ইস্কুলের বাইরে দেখলাম বিশাল একখান চার চাকার গাড়িও দাঁড় করানো। ঐ গাড়িখানা কি আপনাগো?”

তরু বললো….
—“আমরা শহর থেকে এসেছি। আর ঐ গাড়িটা আমাদেরই।”

—“এইহানে এতো রাইতে কি মনে কইরা আইছেন আপনেরা?”

তরু বললো….
—“কেনো এসেছি সেসব তো পরেও জানতে পারবেন। কিন্তু এখন একটা কথা বলুন তো। ঝর্ণা আর রাসেলের মতো ওমন ফুটফুটে মিষ্টি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জনকে আপনি মা*র*তে চাইছিলেন কেনো? কি দো*ষ করেছে ওরা!”

তরুর এমন প্রশ্নে মফিজুর ওর কন্ঠে পুরুষালী একটা বিশেষ ভাব এনে বললো….

—“হেইয়ার কইফিয়াত আমি আপনেরে দিতাম কিল্লাই? আমার পোলা-মাইয়া আমি হেগোরে জন্ম দিয়া এই দুনিয়াত আনছি, তিন বেলা খাওয়াইতাছি, পড়াইতাছি হেগোরে আমি মা*র*মু নাকি কা*ই*টা ফা*লা ফা*লা করমু সম্পূর্ণ আমার ব্যপার।”

মফিজুরের এমন কথা শুনে কুশল নিরব থেকে ওর দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। সেইসময় মফিজুরের পাশ থেকে ছেলেটি বলে উঠলো…

—“বাবা আপনে তো ভু*ল বললেন! আপনে তো আমাদের তিনবেলা খাইতে দেন না। সকালে দু’জনকে দুইখান বাসি রুটি থাকলে তা দেন আর রাইতে আপনার আর মায়ের সারাদিনের খাওনের পর বাইছা যাওয়া সাদা ভাত যাতে মা পানি ঢাইলা দিয়া রাখে ঐ ভাতগুলো খাইতে দেন। আমরা তো ওমন খাবার ঠিকভাবে খাইতেও….!”

ছেলেটি ওর পুরো কথা শেষ করার আগেই মফিজুর ওর গালে একটা থা*প্প*ড় দিয়ে বসলেন। থা*প্প*ড়ের বে*গ এতোটাই বেশি ছিলো যে ছেলেটি ছি*ট*কে ওদের থেকে কিছুটা দূরে মাঠের উপর গিয়ে পরে। মফিজুরের এমন কাজে কুশলের রাগে যেনো সর্বশরীর জ্ব*লে উঠে। সে আর নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কুশল মফিজুরের কাছে এসে দাড়িয়ে ওর শার্টের কলার্ট ধরে স্বজোরে ওর বাম গালে পরপর ৪বার থা*প্প*ড় দেয়। আকস্মিক কুশলের এমন কাজে তরুর পিছনের দাঁড়িয়ে থাকা ঝর্ণা ও মাঠে পরে থাকা রাসেল অনেক অবাক হয়ে যায়। তরুর ঠোঁটে কোনে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠে। কুশল মুফিজুরের কলার্ট ছেড়ে দিয়ে ওর নাক বরাবর একটা ঘু*ষি প্রয়োগ করে। সঙ্গে সঙ্গে মফিজুর মাঠের উপর লুটিয়ে পরে। কুশল রাগ নিয়ে উচ্চস্বরে বললো…

—“জন্ম দিয়েছিস মানে এই নয় এই নিষ্পাপ শিশুগুলোর শরীরে আ*ঘা*ত করার অধিকার তোর আছে। আর একবার যদি তোর ঐ হাত এই নিষ্পাপ শিশুদের উপর উঠিয়েছিস তৎক্ষণাৎ তোর হাতজোড়া কে*টে তোকে এই মাঠের ১০০ ফিট নিচে পুঁ*তে ফেলবো আমি।”

এই বলে কুশল রাসেলের কাছে গিয়ে ওকে ধরে উঠায়। মফিজুর দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে নিজের নাকের নিচে হাত রাখতেই দেখে নাক ফে*টে র*ক্ত বের হচ্ছে। ঠোঁটের কোণা কে*টে ও র*ক্ত ঝড়ছে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here