#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২৪)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৬১)
কিছুসময় পূর্বে সন্ধ্যাকে ক্লিনিকে এনে ভর্তি করানো হয়েছে। অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে থাকা চেয়ারগুলোতে চিন্তিত, বিষন্ন মুখশ্রী নিয়ে বসে আছেন সাগরিকা চৌধুরী সহ চৌধুরী পরিবারের মধ্যবয়সের সকল সদস্যরা। কুশল চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে পায়চারী করছে। তরুনিমা ওদের থেকে কিছুটা দূরে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙুলের নখ কা*ট*ছে আর ভাবছে….
—“এই ক্লিনিকেই তো উনি নিলাদ্র ভাইয়াকে ভর্তি করিয়েছিলেন। তাহলে এই ক্লিনিকেই সন্ধ্যাকে কেনো ভর্তি করালেন? যদি সেই অজানা শ*ত্রু কোনো ভাবে জানতে পারেন যে নিলাদ্র ভাইয়া বেঁচে আছেন তখন কি হবে! এই বিষয় নিয়ে আমার ওনার সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কথা কি করে বলবো!”
কিছুসময় চিন্তা করার পর তরুনিমা স্থান ত্যগ করে। তরুনিমা চলে যেতেই কুশলের ফোন বেজে উঠে। কুশল ওর পকেট থেকে ফোন বের করতেই ফোন স্ক্রিণে তরুর হাস্স্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ভাসতে দেখে সামনের দিকে তাকাতেই দেখে তরু আশেপাশে নেই। কুশল কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তরুর কন্ঠস্বর ভেসে আসে…..
—“কোনো প্রশ্ন না করে দ্রুত বাহিরে আসুন।”
এই বলেই তরুনিমা কল কেটে দেয়। কুশল ফোন পকেটের ভিতর রেখে বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। কামিনী বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে ভ্রু কুঁচকে কুশলের যাওয়ার পানে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কুশল ক্লিনিকের বাহিরে এসে তরুকে খুঁজতে শুরু করে। ক্লিনিকের পিছন পার্শে আসতেই একটা হাত কুশলের হাত ধরে টান দিতেই কুশল অন্যহাত দিয়ে তাকে মা*র*তে উদ্যত হলে তরু দ্রুত কন্ঠে বললো…..
—“আরে আমি আমি..তরুনিমা!”
কুশল তরুর এমন কাজে কিছুটা অবাক হয়। পরক্ষণেই তরুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে প্রশ্ন করলো…..
—“কি হয়েছে? হঠাৎ এখানে নিয়ে আসলে কেনো?”
—“সবাই তো আপনাকে খুব বুদ্ধিমান ছেলে বলে মনে করে। কিন্তু আমি তো আপনার মাঝে বুদ্ধির কোনো ছিটেফোঁটাও দেখতে পারছি না।”
—“আমি যতোই ভালো কাজ করি না কেনো তোমার চোখে কখনও আমার ভালো দিক গুলো পড়বে না আমি জানি।”
—“পড়বে কি করে! তাড়াহুড়োর বসে আপনি কতো বড় একটা ভুল কাজ করে বসেছেন তা কি জানেন!”
—“কি করেছি আমি?”
—“এই একই ক্লিনিকে আপনি গতকাল রাতে নিলাদ্র ভাইয়াকেও ভর্তি করিয়েছিলেন তা হয়তো আপনার খেয়াল ই নেই। এখন যদি সেই অজানা শ*ত্রু নিলাদ্র ভাইয়ার বেঁচে থাকার খবর জেনে যায় তখন কি হবে! না পারবেন নিলাদ্র ভাইয়াকে বাঁ…..!”
তরুনিমা পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই কুশল তরুর ঠোঁটের উপর নিজের ডান হাতের শাহাদত আঙুল ঠেকিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে নিজের মুখ তরুর কানের কাছে নিয়ে ধীর স্বরে বললো…
—“তোমার স্বামী এতো বোকা না যে তাড়াহুড়োর বসে এমন কোনো ভু*ল কাজ করে বসবে যার ফলে নিজের প্রিয় মানুষদের জীবন ঝুঁ*কি*র মধ্যে পড়বে। তাই অত্যাধিক চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করো না বউ। আর এভাবে নির্জনে ডেকে এনো না আমাকে বারবার কে জানে কখন আবার আমার প্রেমে যাও তুমি।”
কথাটুকু বলেই কুশল তরুর কাছে থেকে সরে এসে পেন্টের পকেটে দু’হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কুশলকে নিজের এতো কাছাকাছি আসতে দেখে তরু যেনো ফ্রীজড হয়ে গিয়েছে। পরক্ষণেই কুশল তরুর চোখের সামনে তুঁড়ি বাজাতেই ওর ধ্যন ভে*ঙে যায়। তরু কুশলের দিকে একপলক তাকিয়ে সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে এক ছুটে ক্লিনিকের ভিতরে চলে যায়। কুশল তরুর যাওয়ার পানে কিছুসময় তাকিয়ে থাকে অতঃপর নিজেও ক্লিনিকের ভিতরে প্রবেশ করে।
(৬২)
ঘন্টাখানেক পূর্বে সন্ধ্যাকে কেবিনে সিফট করা হয়েছে।
সন্ধ্যার সেন্স ফিরলে চৌধুরী পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা ওর সাথে সাক্ষাৎ পর্ব শেষ করে বাড়িতে চলে গিয়েছেন। ক্লিনিকে এখন শুধু কুশল আর তরুনিমা রয়ে গিয়েছে সন্ধ্যার প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখার জন্য। সন্ধ্যার কেবিনের বাহিরে রাখা চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছে কুশল-তরুনিমা। তরু শান্ত স্বরে কুশলকে বললো….
—“নিলাদ্র ভাইয়ার সত্যটা সন্ধ্যাকে জানিয়ে দিন। আজ একবার নিজের ক্ষতি করেছে কাল যে আবার এমন কাজ করবে না তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে বলুন! আর তাছাড়া সন্ধ্যা তো নিলাদ্র ভাইয়াকে ভালোবাসে তাই ওকে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কে বুঝিয়ে বললে ও এমন কোনো কাজ করবে না যার ফলে নিলাদ্র ভাইয়ার জীবন আবারও ঝুঁ*কির সম্মুখীন হবে।”
কুশল তরুনিমার দিকে কিছুসময় শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রাখে। পরক্ষণেই কোনো প্রতিত্তুর না করে বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে। তরুনিমা চেয়ারের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কপালের উপর ডান ভাজ করে দু’চোখ বুঁজে ফেলে।
কুশল সন্ধ্যার কেবিনের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখে সন্ধ্যা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কুশল ধীর পায়ে এগিয়ে সন্ধ্যার মাথার ডান পাশে চেয়ার টেনে বসে। সন্ধ্যা চোখ মেলে কুশলের দিকে তাকায়। কুশল সন্ধ্যার উপর নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত কন্ঠে বললো…..
—“তুই আমাদের পরিবারের সবথেকে ছোট সদস্য। আদরে, শাসণে, ভালোবাসায় কখনও কোনো ত্রুটি রাখি নি। তোর সকল আবদার হাসিমুখে পূরণ করার চেষ্টা করেছি সবসময়। সেই তুই নিজের শরীরে আ*ঘা*ত করার আগে একটাবার আমাদের কথা চিন্তা করলি না বোন!”
কুশলের কথায় সন্ধ্যার চোখ ছলছল করে উঠে। কিছুসময় পর কুশল আবারও বললো….
—“আজ যদি তোর কিছু হয়ে যেতো তাহলে কাল আমি নিলাদ্রকে কিভাবে মুখ দেখাতাম!”
সন্ধ্যা অবাক স্বরে কুশলকে বললো…
—“ওনাকে কিভাবে মুখ দেখাবে মানে! উনি তো…উনি….!”
সেইসময় তরুনিমা কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে সন্ধ্যার দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো….
—“নিলাদ্র ভাইয়া বেঁচে আছে সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা অবাক দৃষ্টি নিয়ে একবার কুশলকে দেখছে তো আরেকবার তরুনিমাকে। নিজের কানকে যেনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না। কুশল সন্ধ্যার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো….
—“হুম নিলাদ্র বেঁচে আছে, সন্ধ্যা।”
সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো….
—“তাহলে আজ সকালে বাসায় যার লা*শ এনেছিলে সে কে ছিলো?”
—“নিলাদ্রকে বাহিরের সকলের সাথে মৃ*ত প্রমাণ করতে অন্যরকম লা*শ এনে মি*থ্যে নাটক করিয়েছিলাম আমি।”
—“কিন্তু কেনো? এমন করার কারণ কি মেজো ভাইয়া?”
অতঃপর কুশল সন্ধ্যাকে সম্পূর্ণ পরিস্থিতির কথা জানিয়ে দেয়। কুশলের মুখে সম্পূর্ণ বিষয়টা শুনে সন্ধ্যা স্তব্ধ কন্ঠে বললো….
—“কাকে সন্দেহ করছো তুমি মেজো ভাইয়া?”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“এটা অনুমান করে বের করার মতো বিষয় না সন্ধ্যা। তবে খুব তাড়াতাড়ি প্রমাণ সরূপ আমি আসল কা*ল*প্রি*ট*কে খুঁজে বের করবো। ততোদিন পর্যন্ত এই সত্যটা তুই আমি আর তরুনিমা ব্যতিত ৪র্থ কোনো ব্যক্তি যেনো না জানে সেই বিষয়ে সতর্ক থাকবি।”
—“তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মেজো ভাইয়া। আমি কাওকে জানতে দিবো না ওনার বেঁচে থাকার সত্যটা। শুধু শেষ একটা অনুরোধ করবো রাখবে তুমি?”
—“বল।”
—“আমি ওনাকে একবার দেখতে চাই মেজো ভাইয়া।”
—“ঠিক আছে, তুই আগে সুস্থ হয়ে ওঠ। তারপর আমি তোকে নিয়ে যাবো নিলাদ্রের কাছে।”
কুশলের কথায় সন্ধ্যার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠে। কুশল সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বসাবস্থা থেকে উঠে দাড়িয়ে বললো…..
—“তুই এখন রেস্ট কর। আমরা আবার পরে আসবো।”
সন্ধ্যাও হাসিমুখে চোখ বুঁজে নেয়। অতঃপর কুশল আর তরুনিমা কেবিন থেকে বেড়িয়ে দরজার পাশে রাখা চেয়ার গুলোতে পাশাপাশি বসে। তরুনিমা শান্ত স্বরে বললো….
—“নিলাদ্র ভাইয়ার বিষয়ে ডাক্তার আকরাম কি আপনাকে আর কিছু জানিয়েছেন?”
—“হুম।”
—“কি জানালেন?”
—“আজ নিলাদ্রের আরেকটা অপারেশন হবে। তারপর নিলাদ্র আর নিলাদ্র থাকবে না। ওর চেহারা, পরিচয় সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে।”
—“প্লাস্টিক সা*র্জা*রি করাতে হবে?”
—“হুম।”
—“অপারেশন সাকসেসফুল হয়ে গেলে নিলাদ্র ভাইয়ার জীবন নিয়ে আর কোনো প্রকার ঝুঁ*কি থাকবে না। একবার নতুন চেহারা আর নতুন পরিচয় তৈরি হলে কোনো শ*ত্রু*র তাঁকে চেনার সাধ্য হবে না।”
চলবে ইনশাআল্লাহ……….