#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২৭)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৭১)
সকালবেলা….
সন্ধ্যা নিজের কেবিনে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে আর বারবার দরজার দিকে লক্ষ্য করছে। তরুনিমা সন্ধ্যার জন্য আনা টুকটাক জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। সেইসময় কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে কুশল। কুশলকে দেখামাত্র সন্ধ্যার মুখে হাসি ফুটে উঠে। পরক্ষণেই কুশলকে একা ভিতরে আসতে দেখে সন্ধ্যার হাসিমুখ মলিন বর্ণ ধারণ করে। কুশল শান্ত স্বরে তরুনিমাকে প্রশ্ন করলো….
—“সব গোছানো শেষ হয়েছে তোমার?”
তরুনিমা সোফার উপর রাখা লাগেজটার চেইন লাগিয়ে কুশলের সামনে রেখে বললো…
—“হুম শেষ। রিসিপশনে সন্ধ্যার রিলিজের জন্য ফর্ম পূরণ করার কাজ শেষ হয়েছে কি আপনার?”
—“হুম শেষ করেই আসলাম। এখন তাহলে যাওয়া যাক!”
—“হুম আপনি লাগেজটা নিয়ে এগোন আমি সন্ধ্যাকে নিয়ে আসছি।”
—“আচ্ছা।”
কুশল লাগেজটা নিয়ে কেবিন থেকে বেড়োতে নিলে সন্ধ্যা কুশলকে ডাক দেয়….
—“মেজো ভাইয়া…!”
কুশল সেখানেই থেমে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। তরুনিমা সন্ধ্যার কাছে এসে বললো….
—“তোমার হাতে কি কোনো স*ম*স্যা হচ্ছে সন্ধ্যা?”
—“না, ভাবী।”
কুশল লাগেজটা সেখানে রেখেই সন্ধ্যার হাতের বাম এসে দাঁড়াতেই সন্ধ্যা বললো…
—“ওনার সাথে দেখা করাবে বলেছিলে।”
—“এখন সম্ভব না। নিলাদ্রের সাথে দেখা করার জন্য তোকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। সঠিক সময় হলে আমি নিজেই তোকে নিলাদ্রের কাছে নিয়ে যাবো।”
সন্ধ্যা কিছুটা জেদী স্বরে বললো…
—“আমি ওনার সাথে আজ এক্ষুণি দেখা করতে চাই। নয়তো আমি এখান থেকে এক চুল পরিমাণ জায়গাও সরবো না।”
কুশল সন্ধ্যার দিকে রাগী দৃষ্টি স্থির করে কঠিন কন্ঠে বললো….
—“এটা কোনো ছেলেমানুষি করার সময় নয় সন্ধ্যা। এটা একটা মানুষের জীবন-মৃ*ত্যু*র বিষয়। আমাদের চারপাশে মু*খো*শ*ধা*রী অগুনিত শ*ত্রু*রা ঘোরাঘুরি করছে। আমি চাই না আমাদের করা একটা ভু*লে*র মা*শু*ল বা*জে ভাবে নিলাদ্রকে ওর জীবন দিয়ে পো*হা*তে হোক। নিজের জেদ ও ইচ্ছের উপর কন্ট্রোল রাখার চেষ্টা কর। তরুনিমা আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি ওকে নিয়ে দ্রুত এসো।”
এই বলে কুশল লাগেজটি নিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। কুশলের এমন কথায় সন্ধ্যার চোখ দিয়ে অশ্রুপাত হতে শুরু করে। তরুনিমা যন্তের সহিত সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো….
—“সন্ধ্যা…আমার জান…এভাবে কান্না করতে হয় না। তোমার ভাইয়া তো তোমার বা নিলাদ্র ভাইয়ার খারাপ হোক এমনটা চায় না বলো! এখন পরিস্থিতি ভালো না তাই উনি তোমার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারলেন না। কিছুদিন অপেক্ষা করো পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হোক তারপর নিশ্চয়ই তুমি নিলাদ্র ভাইয়ার সাথে দেখা করতে পারবে। এখন কান্না থামাও। কাঁদলে কিন্তু তোমাকে পুরো বটগাছের শা*ক*চু*ন্নিদের মতো লাগবে। তখন নিলাদ্র ভাইয়া তোমাকে দেখে ভ*য় পাবে।”
তরুনিমার এমন কথায় সন্ধ্যা অশ্রুসিক্ত নয়নে হেসে দিয়ে কান্না থামায়। অতঃপর তরুনিমা সন্ধ্যাকে নিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে ক্লিনিকের বাহিরে দাঁড় করানো গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। কুশল ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। তরুনিমা পিছনের দরজা খুলে সন্ধ্যাকে নিয়ে সেখানেই বসে। তরুর এমন কাজে কুশল অবাক হয়। পরক্ষণেই কুশল গাড়ির ভিতরে থাকা গ্লাসটি দিয়ে তরুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো…..
—“পিছনের সিটে বসে কি আমাকে আপনাদের ড্রাইভার বানিয়ে দিলেন নাকি!”
তরু পায়ের উপর পা তুলে আয়েসি ভঙ্গিতে বসে বললো…
—“চালকের সিটে বসে যে গাড়ি চালায় তাকে তো ড্রাইভার ই বলা হয়। আপনি তো গাড়ি চালাবেন জন্য স্বইচ্ছায় চালকের সিটে বসেছেন তাহলে আপনাকে নতুন করে ড্রাইভার বানানোর আমাদের দরকার কি?”
তরুর এমন প্রতিত্তুর শুনে সন্ধ্যা ওর ডান হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে হাসি নিয়ন্ত্রণ করার বৃ*থা চেষ্টা করছে। তরু ওর মুখের সামনে নিজের ডান হাতের আঙুল গুলো এনে হালকা ফুউউউ দিতে শুরু করে। কুশল রাগে ফোঁ*স ফোঁ*স করতে করতে গাড়ি স্টার্ট করে।
(৭২)
রূপগঞ্জ গ্রামে মহসিন মেম্বার এর স্ত্রী আমেনা বেগম নিজ বাড়ির বারান্দায় রাখা চৌকিতে বসে ছেলে মুরাদকে নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন। সেইসময় মহসিন মেম্বার ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রাগী স্বরে বললেন….
—“খাওয়াও..খাওয়াও..তোমার আদরের দুলালরে নিজ হাতে ইচ্ছে মতো খাবার খাওয়াও। কাল তো বিচার বৈঠকখানায় ব*লি*র পা/ঠা*র মতো ব/লি হবে তোমার আদরের দুলাল। তাই ব*লি হওয়ার আগে গান্ডে পান্ডে খাওয়াইয়া তরতাজা করো ওরে।”
আমেনা বেগম কিছুটা রাগ নিয়ে বললেন….
—“আহহহ..ম’র*ণ! সকাল সকাল তোমার মুখ থেকে এমন অ*লু*ক্ষু*ণে কথা গুলো বের না করলেই কি হচ্ছে না নাকি গো? কতোদিন পর পোলাটা আমার হাসপাতাল থেকে বাড়িত ফিরলো, একটু শান্তিতে খাবার খাইবো তোমার তি*ক্ত কথার জন্য তো দেখছি তারও জোঁ নেই।”
—“তি*ক্ত কথা কি সাধে আমার মুখ থেকে বের হইতাছে নাকি মুরাদের মা! তোমার আদরের দুলাল যে কামটা করছে তার জন্য কাল আমাকে পুরো গ্রামবাসীর সামনে কতোখানি ছোট হওন লাগবো সেই চিন্তা কি করছিলা একটাবার! তোমার পোলার কু*কর্মের জন্য আমাকে মেম্বার এর পদ থেকেও ইস্তফা নেওয়া লাগবো। তখন এই সাধের খাওন আর জুটবো না এটাও মনে রাইখো।”
—“আমার পোলায় অ*ন্যা*য় করছে আমি মানতাছি। আর তার জন্য সেদিন রাতে শহরের বাবুটা আমার পোলাটারে তো কম মা*ই*র মা*রে নি! মা*র*তে মা*র*তে আমার পোলাটার কি দূ*রাবস্থাই না করছিলো। ৫দিন ধইরা হাসপাতালে থাকার পর বাড়িত আসতে পারছে। এতেও কি তার শা*স্তি*র দেওনের দৌড় ফুরায় নাই!”
—“যদি ফুরাইতোই তাহলে তো আর আগামীকাল বিচার বৈঠকখানা বসানোর কথা কইয়া যাইতেন না উনি। তবে একটা শেষ কথা কইতাছি শুইনা রাখো তোমরা মা-পোলায় ভালো কইরা। কালকে যদি আমারে তোমার পোলার কু*কর্মের জন্য মেম্বার এর পদ থাইকা ইস্তফা দেওন লাগে তাহলে আমিও তোমার পোলারে তেয্য-পুত্র কইরা এই বাড়িত থেকে আজীবনের জন্য বাহির কইরা দিমু।”
নিজের বাবার মুখে এমন কথা শুনে মুরাদ আর চুপ থাকতে পারে না। মুরাদ রাগ নিয়ে উচ্চস্বরে বললো…
—“শা*স্তি যদি পাইতেই হয় তবে আমি একলা পামু কেন বাবা?”
—“একলা অ*কাম করছোস তো তোর শা*স্তি*র ভাগিদার অন্যকেও কেন হইতো যাইবো হ্যা?”
—“আমি একলা ঐ চাষীর মাইয়ারে ধ্ব*র্ষ*ণ করি নি। আমার লগে চেয়ারম্যান চাচার পোলা আরিফ ও ছিলো। যদি আমার কু*কর্মের জন্য তোমারে মেম্বার এর পদ থাইকা ইস্তফা দেওন লাগে তাহলে আমার সঙ্গ দেওয়ার জন্য আরিফের বাপরেও চেয়ারম্যানের পদ থাইকা ইস্তফা দেওন লাগবো।”
মুরাদের মুখে এমন কথা শুনে মহসিন মেম্বার ও আমেনা বেগম দু’জনেই অনেক অবাক হন। পরক্ষণেই মহসিন মেম্বার কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন….
—“চেয়ারম্যানের পোলা তোর লগে আছিলো এই কথাখান আমারে আগে কইতে কি তোর শরম করতাছিলো নাকি?”
মুরাদ কোনো প্রতিত্তুর করলো না। মহসিন মেম্বারও আর কিছু না বলে দ্রুত কদমে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আমেনা বেগম আর মুরাদ মহসিন মেম্বারের যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
(৭৩)
চৌধুরী মেনশনের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে কুশল, তরুনিমা ও সন্ধ্যা। পরক্ষণেই কুশল সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“তুই রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর। বিকালে আমাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে।”
সন্ধ্যা প্রশ্নসিক্ত নয়নে কুশলের দিকে তাকিয়ে বললো….
—“হঠাৎ আমাকেও কেনো গ্রামে যেতে হবে মেজো ভাইয়া? কোনো বিশেষ কাজ আছে কি সেখানে!”
কুশল ওর পেন্টের পকেটে দু’হাত রেখে বললো….
—“না, তোর কোনো কাজ নেই। আমার কিছু জরুরী কাজ আছে গ্রামে। শুরুতে আমি একাই গ্রামে যেতে চেয়েছিলাম। কাজ শেষ করতে গিয়ে কয়েকদিন লেগে যেতো গ্রাম থেকে ফিরতে। তোর ভাবী নাকি আমাকে ছাড়া একটা মূহূর্ত একলা কাটাতে পারবে না তাই নিজেও আমার সাথে গ্রামে যাওয়ার জন্য আর্জি জানিয়েছে। আর তোকেও আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। গ্রামের মনোমুগ্ধকর পরিবেশের মাঝে কয়েকটাদিন কাটালে তুইও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারবি এমনই তোর ভাবীর চিন্তা-ভাবনা।”
সন্ধ্যার সামনে কুশলের এমন কথা শুনে তরুনিমা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে।
সন্ধ্যা তরুর বিষয়টা বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে বললো….
—“আচ্ছা ঠিক আছে।”
এই বলে সন্ধ্যা নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে। সন্ধ্যা চলে যেতেই তরু কুশলের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো….
—“আপনাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত আমি একলা কাটাতে পারবো এই চরম মি*থ্যে কথাটা আপনাকে কে বলেছে শুনি!”
কুশল তরুর দিকে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে ধীরস্বরে বললো…
—“তাহলে আমার সাথে গ্রামে যাওয়ার একটা যুক্তিযুক্ত কারণ দেখাও।”
কুশলের এমন কথায় তরু কি কারণ বলবে তা ভেবে পায় না। কুশল তরুকে কিছু বলতে না দেখে বাঁকা হেসে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। তরু অবাকের পাশাপাশি ভাবুক চাহুনি নিয়ে কুশলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বললো….
—“এই লোকটা যখনি আমার কাছে কোনো বিষয় নিয়ে যুক্তিযুক্ত কারণ জানতে চায় তখন আমার বুদ্ধি গুলো এমন লো*প পেয়ে যায় কেনো? আমি তো কিছু না কিছু বলে ওনাকে ভু*ল প্রমাণিত করতেই পারতাম। কিন্তু বলতাম টা কি?”
চলবে ইনশাআল্লাহ……….