#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৪)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১০৯)
নিজের ঘরে চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে পায়চারী করছে আর একের পর এক কুশলকে কল করছে সন্ধ্যা। কিন্তু প্রতিবারই কল বেজে উঠে আপনা-আপনি কেটে যাচ্ছে দেখে সন্ধ্যা বিরবিরিয়ে বললো…..
—“মেজো ভাইয়া ফোন তুলছে না কেনো! এখন আমি কি করবো!”
পরমূহূর্তে আরো বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পরেও কুশলের কোনো রেসপন্স না পেয়ে সন্ধ্যা হতাশ হয়ে ফোনটা বিছানার উপর ছুঁ*ড়ে মে*রে বিছানার পাশে গিয়ে বসে দাঁত দিয়ে আলতো ভাবে নিচের ঠোঁট কা*ম*ড়ে ধরে কান্না নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বললো…..
—“নিলাদ্র…..কোথায় আপনি! কি অবস্থায় আছেন আপনি! আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন। প্লিজ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমার কাছে চলে আসুন। প্লিজ…!”
(১১০)
আইসিইউ এর বেডে ঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছে তাহির। আইসিইউ এর দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে তাহিরের উপর শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে হুমায়রা। সেইসময় হুমায়রার ফোন বেজে উঠলে ওর ধ্যন ভা*ঙে। হাতে থাকা ফোনটি সামনে আনতেই ফোন স্ক্রিনে তাহিরের মা রেবেকা তালুকদারের নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখতে পেয়ে হুমায়রা কলটি রিসিভ করে আবারও তাহিরের দিকে তাকিয়ে রয়। রেবেকা কিছু উত্তেজনার স্বরে বললেন….
—“হিমু….মা….কোথায় আছো তোমরা? এখনও বাসায় ফিরছো না যে! অনেক সময় ধরে আমি আর তোমার খালু জান তাহিরের ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু প্রতিবারই ওর ফোন বেজে বেজে আপনা-আপনি কে*টে যাচ্ছে। তোমরা ঠিক আছো তো? কোনো বি*প*দ হয় নি তো মা?”
হুমায়রা চোখ দিয়ে নিরবে কয়েক ফোঁটা অশ্রুপাত করে বললো….
—“খালা আমি আর তাহির দু’জনেই সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। আমি অনেক বছর পর বাংলাদেশে আসলাম তাই তাহিরের কাছে বায়না করেছিলাম আমাকে যেনো সে শহর থেকে দূরে দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। আশেপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘোরা শেষ করে বাসায় ফিরতে আরো ২-৩দিন সময় লাগবে। আমরা তো পূর্ব থেকে পরিকল্পনা করে বাসা থেকে বের হই নি তাই আমার আর তাহিরের দুজনের ফোনেই চার্জ স্বল্প পরিমাণে বেঁচে আছে। যখন তখন ফোন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আপনারা আমাদের জন্য চিন্তা করবেন না।”
—“আচ্ছা ঠিক আছে মা…সাবধানে ঘোরা-ফেরা করো তোমরা। তুমি তাহিরের সাথে আছো জন্যই আমি আর তোমার খালু কিছুটা চিন্তা মুক্ত আছি। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসো দু’জনেই কেমন!”
—“জ্বি….আচ্ছা।”
এই বলে হুমায়রা কল কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে থাকা চেয়ারের কাছে গিয়ে বসে পরে বললো….
—“আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন খালা…খালু..! আপনাদের থেকে এতো বড় একটা সত্য লুকিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ভিষণ দুঃখিত। কিন্তু নিরুপায় হয়ে আমাকে আপনাদের সাথে মি*থ্যে কথা বলতে হলো।”
(১১১)
পরেরদিন সকালে……..
হাসপাতালে তাহিরের চিকিৎসার জন্য খরচ হওয়া যাবতীয় বিল পরিশোধ করার সময় কুশল ওর পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখে সন্ধ্যার নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসডকল উঠে আছে। তাহির মুখ দিয়ে ‘চ’ এর মতো শব্দ উচ্চারণ করে বিল পরিশোধ করে দেয়। পরক্ষণেই কুশল সন্ধ্যার নাম্বারে কল দিতেই কিছুসময় রিং হওয়ার পরপরই কল রিসিভ হয়। ফোনের ওপাশ থেকে সন্ধ্যা অস্থির কন্ঠে বললো…..
—“মেজো ভাইয়া…কোথায় আছো তুমি! গতকাল রাত থেকে কতোবার কল করেছি তোমায় কিন্তু একবারও তুমি কল রিসিভ করলে না। সবকিছু ঠিক আছে তো!”
—“গতকাল সন্ধ্যার পার্টিতে আমাকে বাঁচাতে গিয়ে যে গু*লি বি*দ্ধ হয়েছিলো ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। এসব নিয়েই একটু ব্যস্ত ছিলাম। আর ফোনও সাইলেন্ট ছিলো তাই এতোবার কল দিয়েছিস তবুও বুঝতে পারি নি। এদিকে সবকিছুই ঠিক আছে। তোর কি হয়েছে! এতোবার কল দিয়েছিস যে? বাসায় সবাই সুস্থ আছেন তো?”
—“মেজো ভাইয়া….নিলাদ্রের এখন কি অবস্থা! আমায় ওনার কাছে কবে নিয়ে যাবে তুমি! এদিকে বাসায় মা, চাচী, দাদীমা সবাই আমার বিয়ের জন্য ছেলে পছন্দ করেছেন। আজ বিকালে ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতেও আসবেন। মেজো ভাইয়া…. তুমি তো জানো আমি আর নিলাদ্র একে-অপরকে কতোটা ভালোবাসি! মেজো ভাইয়া…. কিছু একটা করো তুমি। বাসার সবার এই সিদ্ধান্ত থেকে মন উঠিয়ে নেওয়ার কাজ তুমি ব্যতিত আর কারোর পক্ষে করা সম্ভব না। নিলাদ্রকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না মেজো ভাইয়া…! কিছু একটা করো। এই সমস্যার একটা সঠিক সমাধান বের করো তুমি প্লিজ।”
সন্ধ্যার সম্পূর্ণ কথা শুনে কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“এতো বেশি উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছুই হয় নি সন্ধ্যা। মাথা ঠান্ডা রাখ…দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় না। আমি দেখছি কি করা যায়।”
—“ঠিক আছে।”
এই বলে সন্ধ্যা কল কেটে দেয়। সেইসময় তরুনিমা দ্রুত পায়ে হেঁটে কুশলের সামনে এসে কমোরে একহাত ও বুকের মাঝবরাবর আরেক হাত রেখে দাঁড়িয়ে হাঁ*পা*তে শুরু করে। কুশল ওর ফোনটা পকেটে রেখে ভ্রু কুঁচকে তরুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো…..
—“কি হয়েছে তোমার! এভাবে হাঁ*পা*চ্ছো কেনো? ”
তরুনিমা জোড়ে জোরে বারকয়েক নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো……
—“তাহির…তাহিরের জ্ঞান ফিরেছে কুশল। ও এখন পুরোপুরি ভাবে বি*প*দ মুক্ত রয়েছে। একটু পর তাহিরকে আইসিইউ থেকে আলাদা কেবিনে সিফট করার ব্যবস্থা করবেন বলেছেন ডাক্তার সাহেব। কেবিনে সিফট করা পর্যন্ত আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।”
তরুর এরূপ কথা শুনে কুশল একবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো…..
—“শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। ইয়া আল্লাহ… আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। চলো এখন তাহিরের সাথে দেখা করে আসি।”
অতঃপর কুশল আর তরুনিমা আইসিইউ এর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
.
.
.
কুশল আর তরুনিমা আইসিইউ এর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হুমায়রা বসাবস্থা থেকে উঠে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো….
—“আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা। তাহিরের সমীচীন অবস্থা দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলো না। রাগের বশে তোমাদের অনেক ছোট-বড় কথা শুনিয়ে ফেলেছিলাম। আমি আমার ব্যবহারের জন্য ভিষণ ভাবে দুঃখিত।”
তরুনিমা স্মিত হাসি দিয়ে বললো….
—“আমরা তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছি আপু। তাই তোমার ব্যবহারে আমরা খারাপ কিছু মনে করি নি। এসব নিয়ে মনের ভিতর কোনোরূপ অনুশোচনা রেখো না, ভুলে যাও এসব।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“তাহিরের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। ওর জন্য আমি আবারও মৃ*ত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি। আল্লাহ তায়ালা ওকে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ করে দিক এই দোয়াই করছি।”
কুশল আর তরুর কথাগুলো শুনে হুমায়রার মন অনেকটা হালকা হয়ে যায়। সেইসময় আইসিইউ এর দরজা খুলে যায়। ২জন নার্স তাহিরকে একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে আইসিইউ থেকে বাহিরে বের করে। তাহির চোখ মেলে ওদের তিনজনের দিকেই তাকায়। এখানে তরুনিমার উপস্থিতি তাহির আশা করে নি। তবুও তরুনিমাকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহিরের মনেও কিছুটা স্বস্তি কাজ করছে। নার্স দু’জন তাহিরকে কেবিনে রেখে আসার জন্য সেদিকে অগ্রসর হয়। কুশল তরুনিমা ও হুমায়রাও ওদের পিছন পিছন যেতে শুরু করে। কিছুসময় পর তাহিরের জন্য নির্ধারিত কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই একজন নার্স ওদের তিন জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। আমরা পেশেন্টকে ভিতরে ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে তার সাথে আপনাদের দেখা করার সুযোগ করে দিবো।”
নার্সের কথানুযায়ী ওরা তিনজন কেবিনের বাহিরেই দাঁড়িয়ে রয়। নার্স দু’জন তাহিরকে নিয়ে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করেন। বেশ কিছুসময় পর নার্স দু’জন কেবিন থেকে বের হয়ে ওদের তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“এবার আপনারা একজন একজন করে পেশেন্ট এর সাথে স্বল্প সময় হাতে নিয়ে সাক্ষাৎ করতে পারেন। তবে ওনার শরীরে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে এমন উত্তেজনা মূলক কথা ওনাকে বলবেন না।”
প্রথমত হুমায়রা তাহিরের সাথে দেখা করতে ওর কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে। হুমায়রা তাহিরের পাশে দাঁড়াতেই তাহির ভ্রু কুঁচকে হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বললো….
—“কি রে স্টু*পি*ডের মতো কাঁদতে কাঁদতে নিজের চেহারার এ কি হাল করেছিস তুই! কি ভেবেছিলি আমি মা*রা যা….!”
তাহিরকে পুরো কথা শেষ করতে নি দিয়ে হুমায়রা সঙ্গে সঙ্গে একহাত দিয়ে তাহিরের মুখ চেপে ধরে রাগী স্বরে বললো…
—“চুপ…একদম চুপ…! যতোসব আজে-বা*জে কথা বলা। মুখ দিয়ে আর একটা আজে-বা*জে শব্দ বের করলে বরাবরের মতো এই মুখ সুঁই-সুতো দিয়ে সেলাই করে দিবো বলে দিলাম।”
তাহির ওর মুখের উপর থেকে হুমায়রাকে নিজের হাত সরিয়ে নিতে চোখ দিয়ে ইশারা করে। হুমায়রা নিজের হাত সরিয়ে নিতেই তাহির বললো…..
—“বড় ভাই হই আমি তোর। আমার সাথে এতো কড়া ভাষায় কথা বলতে তোর বিবেকে বাঁধছে না!”
তাহিরের মুখে আবারও বড় ভাই সম্বোধন করে কথা বলতে শুনে তাহিরের হাতে খুব জোড়ে একটা চিমটি কেটে দেয়। তাহির ব্য*থা*য় মুখ দিয়ে ‘আহহহহ’ শব্দ উচ্চারণ করে বললো….
—“ডা*ক*নী রেএএএ….!”
হুমায়রা দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো….
—“পৃথিবীতে বসবাসরত সকল পুরুষকে আমি আমার বড়-ছোট ভাই, চাচা, মামা, খালু হিসেবে মেনে নিতে পারবো কিন্তু তোমাকে কখনও ভাই বলে মানতে পারবো না। কারণ তোমাকে আমি ভালোবাসি, তোমাকে আমি আমার জীবনসঙ্গী রূপে আপন করে নিতে চাই। তাই আর কখনও যদি আমার সামনে নিজেকে আমার বড় ভাই বলে সম্বোধন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করো তবে তোমাকে নিজ হাতে খু*ন করবো আমি বলে দিলাম।”
এই বলে হুমায়রা হনহনিয়ে তাহিরের কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। হুমায়রার এরূপ কথা শুনে তাহিরের মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়। তাহির অত্যন্ত অবাক দৃষ্টি নিয়ে হুমায়রার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ….
(বি-দ্রঃ গল্প লেইট দেওয়ার কারণ আমার মন মানসিকতা ঠিক নেই। গতকাল আম্মুর অপারেশন হইছে। তার শারীরিক অবস্থা ততোটা ভালো না। এখনও ক্লিনিকেই ভর্তি আছেন। কাঁ*টা-ছেঁ*ড়ার যে কি ব্য*থা তা অবশ ছেড়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারছেন। প্রচন্ড ব্য*থায় সারারাত ঘুমাতে পারেন নি। আপনারা আমার আম্মুর সুস্থতার জন্য দোয়া করবেন 🙂…..!)