#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৫)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১১২)
হুমায়রাকে রাগী মুখশ্রী নিয়ে তাহিরের কেবিন থেকে বের হতে দেখে তরুনিমা হুমায়রার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুটা অবাক ভাব নিয়ে বললো….
—“এই তো কিছুসময় আগেই চেহারায় হাসি হাসি ভাব স্পষ্ট রেখে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করলে তুমি। এইটুকু সময়ের ভিতর তোমার আর তাহিরের মাঝে কি এমন কথপোকথন হলো যার দরুণ তুমি এতোটা রাগান্বিত ভাব নিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসলে জানতে পারি কি!”
হুমায়রা রাগে ফোঁ*স ফোঁ*স করতে করতে চেয়ারে বসে বললো…
—“নতুন করে কি আর হবে! সবই আমার পো*ড়া কপালের দো*ষ। ভিতরে যে গু*নো*ধ*র*টা শুয়ে আছে ওকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবাসাটাই আমার সবথেকে বড় ভু*ল হয়েছে। অপাত্রে সুজিনিস ঢালা তো ভু*ল ই। ঐ গু*নো*ধ*র*টার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজেকে কতোটা স*স্তা বানিয়ে ফেলেছি তবুও কু*ত্তা আমাকে বলে কি না ওকে বড় ভাইয়ের নজরে দেখতে! বলে এসেছি, আর একবার যদি আমার সামনে নিজেকে আমার বড় ভাই বলে সম্বোধন করে তাহলে ওকে নিজ হাতে খু*ন করবো আমি।”
কথাগুলো বলেই হুমায়রা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। হুমায়রার রাগী স্বরে বলা তাহিরকে নিয়ে ওর মনের কথা গুলো শোনার পর পুরো বিষয়টা ভালোভাবে বুঝে উঠতে তরুর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। পরমুহূর্তেই অজানা কারণে তরুর ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠে। তরু হুমায়রার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াতেই কুশলকে তাহিরের কেবিন থেকে বের হতে দেখতে পায়। তরু কুশলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“আমি কি তাহিরের সাথে এই মুহূর্তে একান্তে কিছু কথা বলতে ওর কেবিনের ভিতরে যেতে পারি!”
তরুর মুখে এমন অনুমতি মূলক প্রশ্ন শুনে কুশল শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে রয় কিছুসময়। পরক্ষণেই চোখ দিয়া ইশারা করে তরুকে তাহিরের কেবিনের ভিতর প্রবেশ করতে বলে কুশল। তরু ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসির রেখা স্পষ্ট রেখে তাহিরের কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে। তাহির চোখ তুলে সামনের দিকে লক্ষ্য করতেই তরুনিমাকে নিজের সামনে আবিষ্কার করে। তরুনিমা প্রতিটি কদম ফেলে তাহিরের দিকে যতোই অগ্রসর হচ্ছে তাহিরের হৃদপিণ্ডের গতি স্বাভাবিক এর তুলনায় ধীরে ধীরে ততোই বাড়তে শুরু করেছে। তরুনিমা তাহিরের হাতের বাম পার্শে বেডের মাঝবরাবর এসে দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির রেখে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“এখন কেমন লাগছে আপনার! বুকের ভিতর খুব বেশি ব্য*থা করছে নাকি?”
তাহির একবার ঢোক গিলে নিয়ে ধীর স্বরে বললো….
—“শরীরের এই ক্ষ*তে*র ব্য*থা মনের গহীনে হওয়া ক্ষ*তে*র ব্য*থা*র কাছে ভিষণ তু*চ্ছ। মনের গহীনের সেই ক্ষ*তে*র ব্য*থা সহ্য করে নেওয়ার মতো পদক্ষেপ যখন গ্রহন করতে পেরেছি তখন শরীরের এই ক্ষ*তে*র ব্য*থা গ্রহন করে নেওয়া আমার কাছে খুবই ছোট বিষয়।”
—“আপনার কাছে আমি ২দিক থেকে ঋণী হয়ে রইলাম। আজ আপনি আমার প্রাণ বাঁচানোর পাশাপাশি নিজের জীবনের পরোয়া না করে আমার স্বামীর প্রাণ ও বাঁচিয়েছেন।”
—“তুমি মানো বা না মানো তোমার প্রতি সৃষ্টি হওয়া আমার ভালোবাসা নামক অনূভুতি গুলো মি*থ্যে নয়। হয়তো তুমি আজ অন্য কারোর হয়ে গিয়েছো কিন্তু এই কারণে তো আমি তোমাকে ঘৃ*ণা করতে পারি না। আর যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনও ঘৃ*ণা করা যায় না। ভালোবাসা যেমন আপন করে নিজের কাছে আগলে রাখতে শেখায় তেমনি ভালোবাসার মানুষটির সুখের জন্য ত্য*গ স্বীকার করতেও শিখাও। আমি তো তোমাকে ভালোবেসে নিজের করে নিতে পারি নি। তোমাকে যে নিজের করে পেয়েছে সে যেনো সারাজীবন ধরে তোমাকে ভালোবেসে নিজের কাছে আগলে রাখতে পারে তাই তার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে আমি আরো হাজার বার নিজের প্রাণকে নিয়ে ঝুঁ*কি*র সম্মুখীন হতে পারি।”
—“একবার এমন কাজ করে আমাকে ঋনী করে দিয়েছেন কিন্তু আর কখনও এমন কাজ করার কথা চিন্তাও করবেন না। আপনার কাছে আপনার জীবনের কোনো মূল্য নাই থাকতে পারে কিন্তু আরো এমন অনেক মানুষ আছে যাদের কাছে তাদের জীবনের চেয়ে আপনার জীবনের মূল্য শত গুণে বেশি।”
—“কাদের কথা বলছো তুমি!”
—“প্রথমত আপনার জন্মদাত্রী মা ও বাবা। দ্বিতীয়ত আপনার কেবিনের বাহিরে বসারত মেয়েটি।”
—“হিমুর কথা বলছো তুমি….! ওর কথা বাদ দাও। অল্প বয়সেই অত্যাধিক পেঁকে গিয়েছে সে। একটু আগেই আমাকে ভালোবাসার কথা বললো! বাচ্চা মেয়ে…ভালোবাসার বুঝে টা কি! আবেগের বশীভূত হয়ে এমন মনগড়া কথা অনেক বলা যায়। আরেকটু বড় হলে, নিজের ভিতর ম্যচিউরিটি চলে আসলে এসব আবেগ চিরকালের জন্য ঘাড় থেকে নেমে যাবে।”
—“হিমু আবেগের বশীভূত হয়ে আপনার কাছে নিজের মনের অনুভূতি গুলোর বহিঃপ্রকাশ করে নি। আমি ওর চোখে আপনার জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি। আপনার গু*লি লাগার সময় থেকে সেন্স ফেরার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ওর চোখ জোড়া থেকে পড়া প্রতিটি অশ্রুকণা যেনো চিৎকার করে বলছিলো সে আপনাকে কতো বেশি ভালোবাসে। যখন ডাক্তার বলেছিলো যে আগামী ৪৮ঘন্টার ভিতর আপনার সেন্স না ফিরলে আপনাকে হয়তো আর বাঁচানো সম্ভব হয়ে উঠবে না তখন ওর চোখে আপনার ভালোবাসা পাওয়ার আগেই আপনাকে হারিয়ে ফেলার এক অতৃপ্ত য*ন্ত্র*ণা*র ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম আমি। একটাবার কিছু সময়ের জন্য ওর চোখের দিকে নিজের চোখ দু’টো স্থির করে রাখিয়েন। আপনিও ওর চোখের মনির মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি ও নিজের প্রতি ওর সীমাহীন ভালোবাসা গুলোও দেখতে পারবেন। দয়াকরে আবেগ বলে এই সত্যিকারের ভালোবাসাটিকে নিজের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে দিবেন না।”
কথাগুলো বলে তরুনিমা একবারের দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরপায়ে তাহিরের কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। তরুর বলা প্রতিটি শব্দ এখনও যেনো তাহিরের কানে বাজছে। তরুনিমাকে কেবিন থেকে বের হতে দেখে কুশল শান্ত স্বরে বললো……
—“আমাদের এক্ষুণি বাসায় ফিরতে হবে তরুনিমা। বিকালে সন্ধ্যাকে দেখার জন্য ছেলেপক্ষ আসবে।”
কুশলের মুখে এরূপ কথা শুনে তরুনিমা অত্যন্ত অবাক হয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে বললো…
—“কিন্তু নিল….!”
তরু পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই কুশল তরুর ঠোঁট জোড়ার উপর নিজের শাহাদত আঙুল ঠেকিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো….
—“দেওয়ালের ও কান আছে তরুনিমা।”
তরুনিমা কুশলের কথার ভাঁজ বুঝতে পেরে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুমায়রার কাছে গিয়ে বসে বললো….
—“নিজের খেয়াল রেখো। তুমি সুস্থ না থাকলে তোমার তাহিরের খেয়াল এমূহূর্তে আর কে রাখবে বলো! নিজের রাগকে কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করো সবসময়। ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যেই যু*দ্ধ করতে হয় তাতে জয় লাভ করা এতো সহজ বিষয় না হিমু৷ আমরা আসছি এখন।”
হুমায়রা শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তরু আর কুশলের দিকে তাকায়। অতঃপর তরুনিনা আর কুশল হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যায়।
(১১৩)
কুশল আর তরুনিমা চৌধুরী মেনশনের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই ড্রয়িং রুমে পরিবারের সবার সাথে বাহিরের আরো কয়েকজন কম ও মধ্য বয়সের পুরুষ-মহিলাকে বসে থাকতে দেখতে পেয়ে দু’জনেই বুঝতে সক্ষম হয় এরাই আজ সন্ধ্যাকে দেখার জন্য এখানে এসেছে। কুশল ও তরুনিমা ধীরপায়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াতেই সাগরিকা চৌধুরী হাসিমুখে বললেন….
—“এই যে আমার মেজো নাতী কুশল চৌধুরী ও মেজো নাত বউ তরুনিমা চৌধুরী এসে গিয়েছে। দাদু ও দিদি ভাই ওনাদের সাথে পরিচিত হয়ে নাও। উনি হচ্ছেন শরীফ ইসলাম। তোমাদের দাদুভাই এহমেত চৌধুরীর খুব কাছের বন্ধু সালজুক ইসলামের একমাত্র ছেলে উনি। উনি হচ্ছে শরীফের স্ত্রী জয়নাব ইসলাম আর ও হচ্ছে ওদের একমাত্র ছেলে সাইফুদ্দিন ইসলাম।”
সাগরিকা চৌধুরীর মুখে নিজের নাম শুনে সাইফুদ্দিন ডান হাত দিয়ে নিজের চোখের উপর থেকে কালো সানগ্লাসটা খুলে ফেলে বললো….
—“ওহহহ…কাম অন গ্রাণ মা….আমাকে সাইফুদ্দিন নামে কল করো না। এই নেইম টা সো বোরিং। সো আমাকে সাইফ বলে কল করো… অনলি সাইফ।”
সাইফের মুখে এমন আধভা*ঙা ইংরেজি শুনে তরুনিমা মুখ কুঁচকে ফেলে। কুশল ওর চেহারায় শান্ত ভাব স্পষ্ট রেখে নিজের জন্য নির্ধারিত করা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে পড়ে। সাইফের কথার ধরণ এমন হওয়া নিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদের যে কোনোরূপ সমস্যা নেই তা তাদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছে তরুনিমা। সাবরিনা চৌধুরী হাসিমুখে তরুনিমাকে বললেন….
—“মেজো বউ মা….এবার সন্ধ্যাকে ওনাদের সামনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো।”
তরুনিমা জোরপূর্বক নিজের মুখে হাসি স্পষ্ট রেখে সন্ধ্যার রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিছুসময় পর সন্ধ্যার রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তরু দরজায় টোকা দিতে গিয়ে দেখে দরজা খোলা। তরু দরজা ঠেলে রুমের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখে সন্ধ্যা বিছানার উপর বসে হু হু করে কান্না করছে। তরু অস্থির হয়ে সন্ধ্যার কাছে গিয়ে বললো….
—“সন্ধ্যা….আমার জান….! কি হয়েছে তোমার এভাবে কান্না করছো কেনো তুমি!”
সন্ধ্যা তরুর দিকে ঘুরে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো….
—“মেজো ভাবী….সব শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার আর নিলাদ্রের এক হওয়ার জন্য আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। আমাকে তোমারা সেদিন কেনো মৃ*ত্যু*র হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে বলো তো! আমি মা*রা গেলেও শান্তি পাবো। তবুও বেঁচে থাকতে নিলাদ্র ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের সহধর্মিণী হিসেবে পরিচয় বহন করতে পারবো না।”
—“সন্ধ্যা মাথা ঠান্ডা করো। এখন এমন ছেলেমানুষী আচারণ করার জন্য কোনোরূপ সময় নেই। নিজের আবেগ, রাগকে কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করো। ওনারা শুধু তোমাকে দেখার জন্যই এসেছেন। বিয়ে হওয়ার জন্য অনেক টা পথ অতিক্রম করতে হবে। যেকোনো বিষয় নিয়ে তোমার মেজো ভাইয়ার উপর তো তুমি ভরসা করো তাই না!”
তরুর বুক থেকে মাথা তুলে বললো….
—“হুম।”
—“এই ভরসার বাঁধণটা ধরে রাখো। আর চিন্তা মুক্ত থাকো এটা ভেবে যে, নিলাদ্র ভাইয়া বেঁচে থাকাকালীন ২য় কোনো পুরুষের সাথে তোমার বিয়ে হতে দিবে না তোমার মেজো ভাইয়া। এখন পরিবারের সবার সম্মান রক্ষার খাতিরে ওনাদের সামনে যেতে হবে তোমায়।”
—“আচ্ছা।”
তরুনিমা সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিয়ে ওকে তৈরি করে ছেলে পক্ষের সামনে নিয়ে আসে। সন্ধ্যা মাথা নিচু রেখে বসে আছে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…..
(বি-দ্রঃ আমার আম্মুর অপারেশন হয়েছে ৬দিন হলো আপনারা অনেকেই সেই বিষয়ে অবগত নন। আম্মু এখনও বসতে পারেন না। সবসময় শুয়ে থাকেন। বাসার সব কাজ আমাকে একা হাতেই করতে হয়। সামনের মাসের ১৬ তারিখ থেকে আমার অনার্স ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। তাই সব কাজ শেষ করে ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনাও করতে হয়। ২-৩দিন সময় নিয়ে একটা পর্ব লেখা শেষ করি। শরীর, মন কুলিয়ে উঠতে পারছি না। আপনারা আমার প্রতি বি*র*ক্ত হলেও আমার করণীয় কিছুই নেই। আমি ক্ষমা প্রার্থী🙂)