#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৬)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১১৪)
সন্ধ্যা মাথা নিচু রেখে চেহারায় মলিনতার ছাপ ফুটিয়ে তরুর পাশে বসে আছে। সন্ধ্যার সামনা-সামনি সোফায় বসে আছেন ছেলে সাইফুদ্দিন ইসলাম ও ছেলের বাবা শরীফ ইসলাম এবং মা জয়নাব ইসলাম। জয়নাব ইসলামের পাশেই একটা ঢাকনা ওয়ালা কাঁসার বাটি নিয়ে দাড়িয়ে আছেন তার নিজস্ব কাজের মেয়ে বিউটি। জয়নাব ইসলাম পান চিবুতে চিবুতে কাজের মেয়ে বিউটির দিকে মুখ ঘুরাতেই বিউটি ওর হাতে থাকা বাটির উপর থেকে ঢাকনাটি সরায়। অতঃপর জয়নাব বাটির ভিতর নিজের মুখ থেকে পানের পিক ফেলেন। জয়নাবের এমন কাজে তরুনিমার যেনো শরীর গু*লি*য়ে আসার উপক্রম হয়। তরু সঙ্গে সঙ্গে জয়নাবের উপর থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। জয়নাব সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বললেন……
—“মিসেস.চৌধুরী আপনার নাতনী তো দেখছি অনেক লাজুক স্বভাবের। এসে বসেছে পর সেই যে মাথা নুইয়েছে আর উঠানোর নাম গন্ধই নিচ্ছে না। নাতনীকে বলুন মাথাটা এমন নামিয়ে না রেখে একটু উপরে উঠায় যেনো, নয়তো তার চাঁদপানা মুখ দেখে আমাদের পরাণ জুরাবে কি করে!”
জয়নাবের কথাগুলো সন্ধ্যার কান পর্যন্ত পৌছালেও ওকে আগের ন্যয় মাথা নিচু রেখেই বসে থাকতে দেখে সন্ধ্যার হাতের ডানপার্শে বসারত সাগরিকা চৌধুরী শান্ত স্বরে বললেন….
—“মুখ তুলো দিদিভাই।”
তরুনিমা সন্ধ্যার হাতের বাম পার্শে বসে ছিলো। তরু ধীর স্বরে বললো…
—“মুখ তুলো সন্ধ্যা।”
সন্ধ্যা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ উঠায়। জয়নাব সন্ধ্যার মুখশ্রী দেখে হাসি দিয়ে বললেন….
—“মেয়ের শরীরের রং স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বেশিই ফর্সা লাগছে। মেয়ের ভিতরে কোনো চাপা অসুখ নেই তো মিসেস. চৌধুরী!”
জয়নাবের এরূপ কথা শুনে পাশ থেকে শরীফ বললেন…
—“আহহহ…সাইফের মা! উল্টো পাল্টা না বলে খেয়াল রেখে কথা বলো। ক্ষমা করবেন আপনারা আমার স্ত্রীর কথায় কিছু মনে করবেন না।”
—“এখানে মনে করার মতো কিছুই হয় নি। মানছি ওনারা সম্ভ্রান্ত পরিবার, সমাজে উনাদের ক্ষমতা ও সম্মানের তুলনা অন্যকারোর সাথে করার সাধ্য আমাদের নেই। কিন্তু ওনাদের পরিবারের মেয়ের মাঝে কোনো শারিরীক স*ম*স্যা থাকলে তা আমাদের থেকে লুকিয়ে আমার সুস্থ-স্বাভাবিক ছেলের ঘাড়ে চেপে দিতে পারেন না। ভবিষ্যতে যদি আমাদের বংশধরও তার মায়ের মতো চাপা রো*গ নিজের শরীরে নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখে তখন কি হবে! আমি আমাদের ভালোর কথা চিন্তা করেই এই কথা বলেছি মাত্র।”
কুশল নিরব থেকে চোখ বন্ধ করে সোফার হাতলের সাথে নিজের ডান হাত ভাজ করে কপালের ডানপার্শে এক আঙুল দ্বারা আলতো ভাবে ঘষা দিচ্ছে। সন্ধ্যা কিছুটা অ*প*মা*নি*ত বোধ করে নিজের ওড়নার নিচের অংশ শক্ত ভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো। তরুনিমা মনে মনে বললো….
—“ছি্-হ: কি নি*চ চিন্তাভাবনা।”
সাবরিনা চৌধুরী হাসিমুখে বললেন….
—“আপনার কথায় আমরা কেউ কিছুই মনে করি নি মিসেস. ইসলাম। আর আপনার মাঝে এরূপ স*ন্দে*হ বা ভ*য় থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়৷ এক বংশের সাথে অন্য বংশের সম্পর্ক জোড়ার পূর্বে খুঁটিয়ে খাঁটিয়ে দেখা ও জেনে নেওয়াটাও আবশ্যক।”
কামিনী বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললেন….
—“মেজো ভাবী একদম ঠিক কথা বলেছেন। তাই আপনারা চাইলে সন্ধ্যার মেডিকেল টেস্টও করে নিতে পারেন।”
কামিনীর এরূপ কথা শুনে সন্ধ্যা দাঁত দিয়ে আলতো ভাবে নিচের ঠোঁট কাঁ*ম*ড়ে ধরে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। জয়নাব হাসি দিয়ে বললেন….
—“তা তো অবশ্যই করতে হবে।”
জয়নাবের কথার পিঠে সাইফুদ্দিন বলে উঠলো….
—“মাম্মি….আমাকেও কি মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে!”
জয়নাব সাইফুদ্দিনের দিকে একনজর তাকিয়ে বললেন…
—“না আমার সোনা বাবা, তোমাকে কোনো প্রকার টেস্ট করাতে হবে না। বিয়ের জন্য নিখুঁত ভাবে পরীক্ষা মেয়েদেরই করা হয়, ছেলেদের নয়।”
জয়নাবের এমন কথায় রাগে তরুনিমার শরীর যেনো রিরি করে উঠছে। শুধুমাত্র পরিবারের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে সে চুপচাপ সব সহ্য করে নিচ্ছে। সাইফুদ্দিন সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো…..
—“তুমি কি সবসময় গাইয়াদের মতো সালোয়ার-কামিজ পড়েই চলাচল করো নাকি! বিয়ের পর কিন্তু এসব গাঁইয়া চালচলন রাখা যাবে না। কারণ বিয়ের পর তোমাকে আমার সাথে আমেরিকাতে থাকতে হবে। সেখানে বসবাসরত সকলেই যেহেতু ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়েই চলাচল করে তাই তোমারও ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়তে হবে। আর তোমার নাম কি যেনো বললো! সন্ধ্যা রাইট? এই নামটাও শুনতে অনেক বোরিং লাগছে। বিয়ের পর তোমার নামটাও পরিবর্তন করে একটা স্মার্ট নাম রাখতে হবে। এখন একটা কাজ করো রুমে গিয়ে এই সালোয়ার-কামিজ পরিবর্তন করে একটা ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়ে এসো। দেখি ওয়েস্টার্ন পোশাকে তোমায় কেমন দেখায়।”
সাইফুদ্দিন এর কথা শেষ হওয়া মাত্র কুশল নিরবতার দেওয়াল ভেঙে বলে উঠলো….
—“প্রতিটা স্বামীর উচিত নিজের স্ত্রীকে পর্দা করার জন্য বাধ্য করা। পরপুরুষের সামনে নিজের স্ত্রীর শরীরের অর্ধাংশ বের করে রেখে তাদের আকর্ষিত করে যেই স্ট্যটাসের মান রক্ষা করতে হয় সেই স্ট্যটাসের ধারের কাছে আমরা ঘেঁ*ষি না। আমাদের বংশের মেয়েরা সকলেই ঘরে-বাহিরে শালীন পোশাক পড়েই চলাচল করেন সবসময়। আর সারাজীবন এভাবেই চলাচলন করবেন।”
—“বিয়ের পর সন্ধ্যার উপর আমার অধিকার সবথেকে বেশি থাকবে। আমার পছন্দনুযায়ী চলাচল করতে সে বাধ্য থাকবে।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…..
—“যেখানে বিয়েটাই হবে না সেখানে বিয়ের পরের বাধ্যবাধকতার কথা উঠানোরও প্রশ্ন আসছে না।”
কুশলের এরূপ কথায় সকলেই বেশ অবাক হয়ে যায়। জয়নাব বললেন….
—“বিয়ে হবে না মানে!”
—“আপনার ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে হবে না। এই সম্বন্ধ এখানেই ভেঙে দিচ্ছি আমি।”
সাবরিনা বললেন…
—“কিন্তু কু..!”
সাবরিনা পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই কুশল হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। জয়নাব সাগরিকা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললেন….
—“মিসেস.চৌধুরী…! আপনি চুপ করে আছেন কেনো? এই পরিবারের সবথেকে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য আপনি। আপনি এখানে উপস্থিত থাকাকালীন এই ছেলে সম্বন্ধ ভে*ঙে দেওয়ার মতো এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস পায় কোথায়!”
সাগরিকা চৌধুরী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন….—“দাদুভাই যখন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে তখন আমি আর দ্বিমত পেষ করবো না এই সিদ্ধান্তের উপর। এই সম্বন্ধের ইতি এখানে টানা হচ্ছে মিসেস.ইসলাম। আপনারা এখন আসতে পারেন।”
সাগরিকা চৌধুরীর এরূপ কথায় জয়নাব রাগে রি রি করতে করতে বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন….
—“এতো বড় অ*প*মান! আমার ছেলের মতো এতো ভালো ছেলে সারা পৃথিবী খুঁজেও আর দু’টো পাবেন না আপনি মিসেস.চৌধুরী কথাটা মনে রাখবেন। এই সম্বন্ধের ইতি টেনে ভালো করলেন না। আজ এই মুহূর্ত থেকে আপনাদের সাথে পারিবারিক ও ব্যবসায়িক বন্ধুত্বের সম্পর্কের ইতি আমি টেনে দিলাম।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“দরজাটা ঐদিকে।”
কুশলের এরূপ কথা শুনে শরীফ ও সাইফুদ্দিন বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর ওরা দ্রুত পায়ে চৌধুরী মেনশন থেকে বেড়িয়ে যায়। ওরা চলে যেতেই কামিনী বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললেন….
—“এতো ভালো সম্বন্ধটা এভাবে হাতছাড়া না করলেও চলতো।”
কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো….
—“যেখানে আমার বোন নিজের জন্মগত নাম নিয়ে বাঁচতে পারবে না। নিজের পছন্দনুযায়ী শালীন পোশাক পড়তে পারবে না। সেখানে তো দু’দিন নিজের ইচ্ছে মতো নিঃশ্বাস ও ফেলতে পারতো না সে। নিঃশ্বাস ফেলতেও ওর স্বামীর অনুমতি নিতে হতো। এমন সম্বন্ধকে ভালো বলো কি করে তুমি চাচী!”
কুশলের এরূপ কথা শুনে কামিনী আর কোনো প্রতিত্তুর করার ভাষা খুঁজে পায় না। কুশল আবারও বললো….
—“যেই পরিবারে আমার বোন সম্মানের সাথে বাস করতে পারবে সেই পরিবারের ছেলের হাতেই আমি আমার বোনকে তুলে দিবো। আর এমন পরিবারের সন্ধান ও আমি নিজ দায়িত্বে করবো। তাই আমার বোনের বিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে আর কোনো সম্বন্ধ যেনো বাড়তি কেও না আনে। এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।”
এই বলে কুশল নিজ রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। সন্ধ্যা হাসিমাখা মুখশ্রী নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। কুশলের সিদ্ধান্তে বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন সাবরিনা চৌধুরী। তিনি নিজের চেহারায় অসন্তুষ্ট ভাব স্পষ্ট রেখে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। কামিনীও সাবরিনার পিছন পিছন সেদিকেই ছুট লাগালেন। সাগরিকা চৌধুরী বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন….
—“দিদি ভাইয়েরা তোমরা নিজ নিজ রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো যাও।”
সাগরিকা চৌধুরী চলে যেতেই তরু ও সন্ধ্যাও স্থান ত্যগ করলো।
(১১৫)
কেবিনে নিজ বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে তাহির। বেডের পাশে থাকা চেয়ারে বসে হুমায়রা তাহিরের জন্য বানানো স্যুপটা ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করছে। সেইসময় তাহির হুমায়রাকে রাগাতে মজার স্বরে বললো….
—“রাগের ঠ্যলায় আবার ফুঁ দিয়ে স্যুপ ঠান্ডা করার জায়গায় থুতু দিচ্ছিস নাকি!”
তাহিরের এমন কথা শুনে হুমায়রা রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাহিরের দিকে তাকায়। তাহির সঙ্গে সঙ্গে নিজের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বললো…..
—“এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? চোখ দিয়েই আমাকে গি*লে খাওয়ার ধা*ন্দা করেছিস নাকি!”
হুমায়রা দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো…..
—“মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ বের করলে এই গরম স্যুপ তোমার শরীরের উপর ঢেলে দিবো ধলা ইঁ*দু*র।”
হুমায়রার মুখে নিজের এমন উ*দ্ভ*ট নাম শুনে তাহিরের মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ………….