#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৩)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১২৫)
অনেক সময় ধরে সন্ধ্যার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিলাদ্র নিজের বুকের উপর লক্ষ্য করেই দেখে সন্ধ্যা ঘুমিয়ে পড়েছে। কান্না করতে করতে মেয়েটার সম্পূর্ণ মুখশ্রী হালকা লাল বর্ণ ধারণ করেছে, বন্ধ চোখজোড়ার নিচের অংশ অনেকটা ফুলো ফুলো দেখাচ্ছে। নিলাদ্র আলতো ভাবে সন্ধ্যাকে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে বেড থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ওর উপর দৃষ্টি স্থির করে। সন্ধ্যার দুই চোখের কোটরে জমে থাকা নোনা জলের কণা টুকু নিলাদ্র আলতো হাতে মুছে দিতেই সন্ধ্যা হালকা নড়ে উঠে। অতঃপর নিলাদ্র একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যার পাশ থেকে সরে কুশল আর তরুর দিকে তাকাতেই দেখে কুশল তরুর কোলের উপর মাথা রেখে সোফায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। নিলাদ্র তরুকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে নিবে সেইমূহূর্তে তরু নিজের ঠোঁটের উপর এক আঙুল ঠেকিয়ে ইশারায় নিলাদ্রকে চুপ করতে বললো। নিলাদ্রও থেমে যায়। পরক্ষণেই তরু নিজের পিঠের পিছন থেকে সোফার বালিশটা হাতে নিয়ে সাবধানে বসাবস্থা থেকে উঠে কুশলের মাথা সেই বালিশের উপর রাখে। অতঃপর নিলাদ্রকে ইশারা করে কেবিন থেকে বাহিরে বের হওয়ার জন্য। তরুর ইশারা বুঝতে পেরে নিলাদ্র তরুর পিছন পিছন কেবিন থেকে বের হয়ে কেবিনের দরজার পাশে রাখা চেয়ারগুলোতে বসে। তরুনিমা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো…..
—“অ*মানুষ গুলো এতোটা নি* কৃ* ষ্ট কি করে হতে পারে ভাই! বড় মায়ের মতো নিষ্পাপ মানুষটাকে কতোটা ক*রু*ণ য*ন্ত্র*ণা দিয়ে মে*রে ফেলেছে ওরা সেসব কথা ভাবতেই আমার সর্বশরীর শিউরে উঠছে। বড় বাবাকে দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ হাসপাতালের বেডে জীবিত লা*শে*র মতো সয্যাশায়িত করে রেখেছিলো ওরা। নিজেদের মুখোশ যেনো সকলের সামনে উন্মোচিত না হয় তাই বড় বাবাকে ২য় বারও মে*রে ফেলার চেষ্টা করেছিলো এরা। যতোক্ষণ না পর্যন্ত ঐ নি* কৃ* ষ্ট অ*মানুষ গুলোকে নিজের চোখের সামনে নি*র্ম*ম ও জ*ঘ*ন্য ভাবে মৃ*ত্যু য*ন্ত্র*ণা*য় ছ*ট-ফ*ট করতে দেখবো, অত্যাধিক অসহনীয় য*ন্ত্র*ণার পরও যখন মৃ*ত্যু তাদের গ্রহন করবে না! এরজন্য আ*ত্ম*হ*ত্যা করতে চাইবে কিন্তু সেই চেষ্টা করার শক্তিটুকু পর্যন্ত নিজেদের মাঝে জুগিয়ে উঠতে পারবে না, ওদের সমস্ত অ*হং*কা*র মাটির সাথে মিশে যেতে না দেখবো ততোক্ষণ পর্যন্ত আমার মনে শান্তি কাজ করবে না ভাই।”
নিলাদ্র কিছু বলতে নিবে সেইসময় কেবিনের দরজা খুলে কুশলকে বের হতে দেখে নিলাদ্র দাঁড়িয়ে যায়। তরুনিমাও ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে লক্ষ্য করতেই দেখে কুশল ওর চেহারায় শান্ত ভাব স্পষ্ট রেখে দাঁড়িয়ে আছে। পরক্ষণেই কুশল তরুর বাম হাত ধরে ওকে বসাবস্থা থেকে দাঁড় করিয়ে নিলাদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো…..
—“সন্ধ্যার খেয়াল রাখিস।”
প্রতিত্তুরে নিলাদ্র কিছু বলতে নিলে তরু ইশারায় ওকে থামিয়ে দেয়। অতঃপর কুশল তরুকে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। নিলাদ্র ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। কিছুসময় পর ওরা চোখের আড়াল হতেই নিলাদ্র একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে।
(১২৬)
কেবিনের ভিতর বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে তাহির। হুমায়রা ওয়াশরুম থেকে বের হতেই তাহির শান্ত স্বরে হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“আমার যাবতীয় জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে নে। ক্লিনিক থেকে রিলিজ নিয়ে নিয়েছি। বাসায় ফিরতে হবে একটু পরই।”
তাহিরের এমন কথায় হুমায়রা কিছুটা অবাক হয়। তাহির হুমায়রাকে অবাক ভাব নিয়ে ঠায় ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা রাগ নিয়েই বললো….
—“কি রে কথা কি কানে যায় নি তোর!”
তাহিরের রাগী স্বরে বলা কথাটুকু শুনতেই হুমায়রার ধ্যন ভা*ঙে। পরক্ষণেই তাহিরের দিকে ধীর পায়ে অগ্রসর হতে হতে হুমায়রা বললো…
—“আজই বাসায় ফেরাটা কি খুব জরুরী ছিলো! আর কয়েকটা দিন এখানে থাকলেই হতো। তোমার ক্ষ*ত স্থানটিও শুকিয়ে…..!”
হুমায়রাকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই তাহির হুমায়রার দিকে রাগী দৃষ্টি স্থির করে দাঁ*ত কি*ড়*মি*ড়ি*য়ে বললো….
—“আমার ক্ষ*ত শুকানো না শুকানো নিয়েও ভাবার সময় আছে নাকি তোর! এসেছিস তো যুবক ডাক্তারদের সাথে রঙ্গলীলা করতে। তাদের স্পর্শ পেতে তো অনেক ভালো লাগে। আবার নতুন কোনো ডাক্তারের সঙ্গে লীলাখেলা খেলতে পারিস যেনো তাই আমার ক্ষ*তে*র দোহাই দিয়ে এখানে থাকতে চাইছিস! আমি বুঝি না ভেবেছিস? আমাদের বংশের যথেষ্ট সম্মান আছে। আমাদের বংশের মেয়েরা এভাবে যেখানে সেখানে পরপুরুষদের সঙ্গে ঢলাঢলি করে না৷”
তাহিরের মুখে নিজের সম্পর্কে এরূপ তি*ক্ত কথাগুলো শুনে হুমায়রার সর্বশরীর রি রি করে উঠে। মলিনতার কালো মেঘের ছাপ হুমায়রার সম্পূর্ণ মুখশ্রী জুড়ে বিরাজমান হয়। চোখজোড়া নোনা জলে টইটম্বুর হয়ে উঠে। হুমায়রা কোনোরূপ টু শব্দ না করে মাথা নতবস্থায় রেখে কেবিনে রাখা তাহিরের প্রয়োজনীয় সব ঔষধ, প্রেসক্রিশন, রিপোর্ট, কাপড় গুলো গুছিয়ে নিতে শুরু করে। তাহির নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
(১২৭)
কুশল ড্রাইভিং সিটে বসে তার আপন গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। কুশলের পাশেই নিরব হয়ে বসে আছে তরুনিমা। তরু একটু পর পর কুশলের দিকে তাকাচ্ছে আবার দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। তরুর এই দৃষ্টিভঙ্গী জুড়ে ঘুরছে সহস্র প্রশ্নমালা কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দ ও সে বের করতে পারছে না। বেশ লম্বা সময়ের জার্নির পর একটা ফাঁকা মাঠের সামনে এসে গাড়ি থামায় কুশল। অতঃপর কুশল নিজের সিটবেল্ট খুলতে খুলতে শান্ত স্বরে বললো….
—“গাড়ি থেকে নামে তরুনিমা।”
তরুনিমা বিনাবাক্যে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। কুশলও গাড়ি থেকে নেমে তরুর পাশে এসে দাঁড়ায়। থালার মতো আকাশ জুড়ে ছোট্ট একটা চাঁদের টুকরো যার চারপাশে ছড়িয়ে আছে কোটি কোটি তারারা। সেই এক টুকরো চাঁদের আলোয় পুরো পরিবেশ আলোকিত হয়ে আছে। তরু নিজের চারপাশটা ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই দেখে ওদের থেকে ২০-৩০ হাত দূরে একটা সরকারী প্রাইমারী স্কুল এর একতলা বিল্ডিং আছে। মাঠের দুইধার দিয়ে বিশাল বিশাল আম, বট, জাম ও কাঁঠালের গাছ লাগানো আছে। তরু ঘাড় ঘুরিয়ে কুশলের দিকে তাকাতেই কুশল হাঁটু গেড়ে মাঠের উপর ধপ করে বসে পরে। তরুও সঙ্গে সঙ্গে ‘কুশল’ বলে ওর পাশে বসে পরে। কুশল দু’হাতে নিজের চারপাশের মাটি ও মাটির উপর থাকা ঘাসগুলো ছুঁয়ে দেখতে দেখতে বললো…..
—“মা…মা গোওওও….ও মা….কোথায় ঘুমিয়ে আছো তুমি! এই মাঠের কোন অংশে ঐ জা*লি*ম*রা তোমায় দা*ফ*ন করে দিয়েছিলো গো মা! জানো মা….আমার যে তোমার মায়া মাখানো মুখশ্রী টুকুও মনে নেই গো। মা গোওও তুমি তো আমায় অনেক আদর করেছিলে তাই না! স্নেহে ভরপুর তোমার হাত যুগল দিয়ে তো তুমি আমায় তিনবেলা খাইয়ে দিয়েছিলে বলো! তোমার কোলের উপর মাথা রেখে আমায় কবিতা শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলে তাই না! মা গো আমার যে এসবের কিছুই মনে নেই। ও মা তুমি আমাকে আর একটা বার তোমার কোলে মাথা রাখতে দাও না গো। কোথায় তোমার কবর গো মা! এতো বড় মাঠের কোন অংশে নিরব হয়ে শুয়ে আছো তুমি মা! তোমার ছেলের আকুল কন্ঠের এই ডাক কি তুমি শুনতে পারছো না মা! ও মা….সাড়া দাও না গো মা….আমার বুকের ভিতরটা যে য*ন্ত্র*ণা*য় শেষ হয়ে যাচ্ছে…মা…মাগোওওওওওও….
ও আল্লাহহহহহহহ…আল্লাহ গোওওওও…কোথায় আমার নিষ্পাপ মায়ের কবর…আমার মা কোথায় ঘুমিয়ে আছে আপনি বলে দিন….ইয়া মাবুদ…!”
এই বলে কুশল কাদতে কাদতে হাটু গাঁ*ড়া অবস্থাতেই যতোটা সম্ভব নিজের চারপাশের মাটি আর ঘাস গুলো ছুঁয়ে দেখতে শুরু করে। তরু কুশলকে এভাবে য*ন্ত্র*ণা পেয়ে কান্না করতে দেখে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। তরুরও যেনো বুক ভে*ঙে কান্না বেড়িয়ে আসতে শুরু হয়। ২০ বছর আগের দাফনকৃত কবরের চিহ্ন এখন খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব তরু তা বুঝতে পেরে কুশলের কাছে গিয়ে ওকে শান্ত করতে নিজের বুকের সাথে ওকে জড়িয়ে ধরে। কুশল হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে তরুর বুকের ভিতরেই নিজেকে পুরোপুরি ভাবে গুটিয়ে নিতে চায় যেনো। তরু কুশলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এভাবেই পেরিয়ে যায় আরো বেশকিছুসময়। হঠাৎ তরু ওর সামনের দিকে লক্ষ্য করে ওদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে ২জন ৮-১০ বছর বয়সী বাচ্চা ছেলে-মেয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাচ্চা ছেলেটির হাতে একটা হারিকেন আর বাচ্চা মেয়েটির কাঁখে একটা মাঝারি সাইজের সিসার কলসী নেওয়া যার উপর চাঁদের আলো পড়ায় চকচক করছে। তরু গভীর ভাবে ওদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দু’জন স্কুলের বিল্ডিং এর পাশেই থাকা বট গাছটির সামনে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর মেয়েটি নিজের কাঁখে থাকা কলসীর পানিগুলো বটগাছটির গোঁড়ায় ঢেলে দিতে শুরু করে। দেখতে দেখতে বাচ্চা মেয়েটি কলসীতে থাকা সবটুকু পানিই শুধু ঐ গাছের গোড়াতেই ঢেলে দেয়। এরপর ওরা আবারও ওদের পূর্বের রাস্তার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ওদের এমন কাজে তরু অনেক অবাক হয়। তরু মনে মনে চিন্তা করে…..
—“এই মাঠে এতোগুলো ফলের গাছ থাকতে ওরা শুধু ঐ বটগাছের গোড়াতেই সবটুকু পানি ঢেলে দিলো কেন?”
#চলবে ইনশাআল্লাহ………
(বি-দ্রঃ গত ৭দিন যাবৎ গল্প না দেওয়ার কারণ গত ১৬ তারিখ থেকে আমার অনার্স বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছিলো। ১ম পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই আমি হঠাৎ অ*সুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। যার দরুণ গত ১৯ তারিখে থাকা পরীক্ষাটিতেও আমি এটেন্ড করতে পারি নি 🙂। আল্লাহর রহমতে শরীর এখন অনেকটা ভালো হয়েছে। সুস্থ বোধ করছি জন্যই আজ গল্প দিতে পারলাম 😊। আমার অনিয়মিতের জন্য আমি ভিষণ ভাবে দুঃখিত।)