হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৫) #Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

0
855

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৫)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১২৯)
কুশলের হাতে পরপর ৪ বার থা*প্প*ড় ও একবার ঘুঁ*ষি খেয়ে মফিজুরের নাক ও ঠোঁটের কোনা দিয়া র*ক্ত ঝরছে। নিজের এমন বেহাল দশা দেখেও মফিজুর ক্ষি*প্ত কু*কু*রের মতো বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কুশলের দিকে অগ্রসর হতে নিলে কুশল ওর প্য*ন্টে*র ডান পকেট থেকে ছোট রি*ভ*ল*বারটা বের করে মুফিজুরের দিকে তাঁক করে। গা*ন পয়েন্টে নিজেকে দেখামাত্র মফিজুর থ*ম*কে যায়। কিছুটা ভ*য়ে শুকনো ঢোকও গি*লে নেয় সে। কুশল ওর হাতে থাকা রি*ভ*ল*বারটা দিয়ে মফিজুরকে ইশারা করে বললো….

—“বোস….মাটিতে হাঁটু গেড়ে বোস।”

কুশলের কথা যেনো এই মূহূর্তে মফিজুরের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো না। কুশল উচ্চস্বরে ধ*ম*ক দিয়ে আবারও বললো….

—“বোসসস বলছিইইই।”

কুশলের ধ*ম*কে*র স্বরে বলা কথাটি শোনামাত্র মফিজুরের সর্বশরীর ভ*য়ে কা*টা দিয়ে উঠে। তৎক্ষনাৎ সে কুশলের সামনে হাঁটু গে*ড়ে মাঠির উপর বসে পরে। কুশল মফিজুরের কপালের মাঝ বরাবর রি*ভ*ল*বারটা ঠেকিয়ে রাগী স্বরে বললো…

—“তুই কি ভেবেছিলি আমি এই ফাঁকা মাঠে তোকে ফাঁকা আওয়াজ শুনিয়েছিলাম! তোর থেকে বহুত গুণে খা*রা*প অ*মানুষদের আমি উচিত শিক্ষা দিয়ে সঠিক ঘাট দেখিয়ে দিয়েছি। সেখানে তুই তো আমার কাছে সামান্য মশার থেকেও তু*চ্ছ। তোকে নিজের পায়ের নিচে ফেলে পি*ষে ছি*ন্ন-বি*ন্ন করে দিতে আমার ২মিনিট ও সময় লাগবে না।”

মফিজুরের নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় অনুনয়ের স্বরে কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“দ-দয়া করে আমাকে প্রাণে মা-মার-বেন না সাহেব, দ-দয়া করুন আমার উপর। আমার প্রাণ ভি-ক্ষা দিন সাহেব।”

সেইসময় তরুর পিছন থেকে ঝর্ণা ঘাড় বাঁ*কি*য়ে ওদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা জোর গলায় বললো….

—“বাবাকে ছে*ড়ে দাও গো সুন্দর চাচ্চু। বাবাকে আর মে*রো না। মা*র*লে যে অনেক ব্য*থা লাগে। খুব য*ন্ত্র*ণা করে। বাবাকে আর য*ন্ত্র*ণা দিও না গো সুন্দর চাচ্চু। ও সুন্দর চাচ্চী তোমার এই মানুষটাকে বলো না বাবাকে যেনো আর না মা*রে।”

রাসেল ও ওর বোনের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললো…
—“মে*রো না গো বাবাকে। উনি আমাদের জন্ম দিয়েছেন। ভালো হোক কিংবা খা*রা*প বাবা হিসেবে তো ওনাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ওনার আদর-স্নেহ পাওয়ার মতো এতো ভালো ভাগ্য নিয়ে আমরা দু’জনের কেউই এই পৃথিবীতে আসতে পারি নি। তাই নিজেদের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি আমরা। এখন বাবা আমাদের যতোই আ*ঘা*ত করুক না কেনো আমাদের আর ততোটা ক*ষ্ট হয় না।”

ছোট্ট মেয়ে ঝর্ণা আর ছেলে রাসেলের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে কুশল ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দু’জনকেই একপলক দেখে নেয়। মফিজুরও অবাক নয়নে নিজের মেয়ে ও ছেলের দিকে তাকায়। মফিজুর মনে মনে হয়তো ভাবছে….

—“জন্মের পর থেকে যাদের আমি একটাবারের জন্য নিজের কোলে বসিয়ে আদর করি নি৷ উঠতে-বসতে, কোনো কারণ ছাড়াই যাদের শরীরে আ*ঘা*তের পর আ*ঘা*ত দিয়েছি। পঁ*চা-বা*সি খাবার ছাড়া একবেলা টাটকা ভালো খাবার খেতে দেই নি আজ সেই ছেলে-মেয়েরাই আমাকে মা*র খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে অনুরোধ করছে! আমার য*ন্ত্র*ণা ওরা সহ্য করতে পারছে না! আমার প্রতি ওদের ঘৃ*ণা, রা*গ হওয়ার জায়গায় স্নেহ মায়া কাজ করছে! ওদের ছোট্ট মনটাকে আমি আ*ঘা*ত করতে করতে বিঁ-ষি*য়ে দিতে পারি নি!”

কুশলের কথায় মফিজুরের ভাবনায় ছে*দ ঘটে। কুশল বললো….
—“থু*তু ফেল এখন নিজের উপর। তোর মতো কা*পুরুষের ঘরে জান্নাতের দু’টো নূর জন্ম নিয়েছে দেখে ভিষণ আ*ফ*সো*স হচ্ছে আমার। তুই তো ওদের বাবা হওয়ার কোনো যোগ্যতাই রাখিস না। থু*তু দে নিজের উপর, থু*তু।”

কুশলের বলা কথাগুলো শুনে মফিজুর লজ্জায় মাথানত করে ফেলে। অনুশোচনার আ*গু*নে দ*গ্ধ হয়ে যাচ্ছে এখন সে। নিজের অজান্তেই মফিজুরের চোখযুগল থেকে নোনাজল পড়তে শুরু করে। কুশল ওর রি*ভ*ল*বারটা পুনরায় পকেটে ভরে নেয়। বেশকিছুসময় ধরে ওদের চারপাশ জুড়ে ঝিঁঝি পো*কা*র ও পেঁ*চা*র ডাক ছাড়া কোনো মানবের শব্দ শোনা যায় না। সেইসময় রাসেল নিজের বুকের ভিতর সাহস সন্ঞ্চয় করে ওর বাবা মফিজুরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো…

—“বা-বাবা, বাড়িতে ফিরবে না! মেলা রাইত হইয়া গেলো যে। এখনও না ফিরলে মায় আবার তোমাকে ঝা*র*বো। আমাদের জন্য তুমি মায়ের ঝা*রি খাইবা তা তো হয় না কও!”

রাসেলের মুখে এরূপ কথাগুলো শোনামাত্র মফিজুর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ছোট্ট শিশু রাসেলকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে দেয়। এই ১ম নিজেকে নিজের বাবার বুকের সাথে আ*ষ্টে*পৃ*ষ্টে জড়িয়ে থাকতে দেখে রাসেল খুশি হবে নাকি নিজের বাবাকে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে দেখে তাকে শান্তনা দিবে তা বুঝে উঠতে পারছে না রাসেল। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে ঝর্ণার ভ*য় ও কে*টে যায়। সে তরুর পিছন থেকে সরে সামনে এসে দাড়িয়ে ওদের বাবা-ছেলের উপর দৃষ্টি স্থির করে। সেইসময় মফিজুর নিজের আরেকহাত মেলে ধরে ইশারায় ঝর্ণাকে নিজের বুকে আসতে বলে। ঝর্ণা একপলক তরু আর কুশলের মুখের দিকে তাকায় ওরা দু’জন ও ঝর্ণাকে ওর বাবার কাছে যেতে বললে ঝর্ণা এক ছুটে ওর বাবার বুকের উপর হা*ম*লে পড়ে। মফিজুর দু’হাতে নিজের দুই ছেলে-মেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখা অবস্থাতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন….

—“এই অ*ধ*ম বাপটাকে ক্ষমা কইরা দে তোরা। তগো আমি অনেক ক*ষ্ট দিছি। বা’জান, আম্মা’জান আমার কলিজা টুকরা তোদের মূল্য আমি এতো কাল বুঝি নাই।আমি আর কখনও তোদের শরীরে এক চুল পরিমাণও আ*ঘা*ত করবো না কথা দিলাম আজ থাইকা। সবসময় তগো যত্নে যত্নে রাখবো৷ তগো সৎ মায়ের বা*র*ন্ত স্বভাও ও আমি ছু*টা*ই*য়া দিমু। হেয়ের লাইগাই আমি তগো সাথে মেলা অ*ন্যা*য় কইরা ফেলছি। নিজের র*ক্ত*কে আ*ঘা*ত করে পরনারীর কথা মাইনা চলছি। আজ থাইকা আর এসব হইবো না। তগো তিনবেলাই ভালো খাবার খাইতে দিবো আমি। আমার চোখ খুলে দিয়েছিস তোরা।”

মফিজুরকে নিজের ভু*ল বুঝে নিজের ছেলে-মেয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের আপন করে নিতে দেখে তরু আর কুশলের মুখশ্রী জুড়ে তৃপ্তিদায়ক খুশির ছাপ ফুটে উঠে। পরমুহূর্তেই কুশল একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরস্বরে বললো….

—“জীবনের এই ২৮ বছর বয়সে এসে দাঁড়িয়ে কখনও নিজের বাবাকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে মন হালকা করতে পারলাম না। কো*মা*য় থাকার পূর্বের সময়ে কখনও বাবা আমাকে এভাবে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে আদর করেছিলেন কিনা, আমার জন্মদায়িনী অ*ভা*গি*নী মা আমাকে স্নেহ-মমতা দিয়েছিলেন কিনা সেসবের কিছুই মনে নেই। এতোটাই নি*র্ম*ম ভাগ্যের অধিকারী আমি যে নিজের জন্মদায়িনী মায়ের মুখশ্রী পর্যন্ত আমার স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছে! প্রকৃত ও মি*থ্যে সম্পর্কগুলোর মাঝের তফাৎগুলো আজ চোখের সামনে স্বচ্ছ পানির মতো ভাসছে। যারা আমার মায়ের খু*নি, যারা বাবার জীবন থেকে ২০ টা বছর যারা কে*ড়ে নিয়েছে, যারা আমার স্মৃতি থেকে আমার জন্মদায়িনী মায়ের মুখশ্রীটুকুও মুছে ফেলেছে তাদেরই কিনা গত ২০টা বছর ধরে নিজের মা-বাবা, চাচা-চাচী বলে সম্বোধন করে এসেছি! এসব ভেবেই ক*ষ্টে, ঘৃ*ণা*য় আমার সর্বশরীর রি রি করে উঠছে তরুনিমা।”

কুশলের কথাগুলো শুনে তরুনিমা কোনো প্রতিত্তুর করার ভাষা খুঁজে পায় না। কুশলের ডান হাত নিজের দু’হাত দ্বারা জড়িয়ে ওর কাধের উপর মাথা রাখে। বেশকিছুসময় পর ঝর্না আর রাসেল মফিজুরের বুক থেকে মাথা তুলে তার সামনে সোজা হয়ে দাড়ায়। অতঃপর ঝর্ণা ওর বাম হাত দিয়ে আর রাসেল ও ডান হাত দিয়ে মফিজুরের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া নোনাজলে ভিজে থাকা গালদ্বয় যত্নসহকারে মুছে দেয়। ওদের তিন জনের মুখশ্রী জুড়েই ফুটে আছে আনন্দের ছাপ। পরক্ষণেই ঝর্ণা তরুর সামনে আর রাসেল কুশলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে ওদের দিকে তাকায়। মফিজুর বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ঝর্ণা ওর মিষ্টি কন্ঠে বললো….

—“সুন্দর চাচ্চী… জানো! তুমি আর সুন্দর চাচ্চু দু’জনেই অনেক ভালো।”

এই বলে ঝর্ণা তরুর পেট জড়িয়ে ধরে তরু হাসি দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রাসেল বললো….

—“আপনাদের জন্য আজ আমরা আমাদের বাবাকে প্রকৃত বাবার রূপে ফিরে পেলাম। আপনাদের জন্য আমি আর আমার বোন বাবার আদর কতোটা মধুর হতে পারে তার স্বাদ অনুভব করতে পারলাম। বোন ঠিকই বলেছে আপনারা দু’জনের অনেক অনেক ভালো।”

এই বলে রাসেল ও কুশলের পেটের উপরের অংশ জড়িয়ে ধরে। মফিজুর বললো….

—“আপনেদের কারণে আমি আমার ভু*ল গুলো শুধরাইয়া নিতে পারছি। আপনেরা আমার পা*পে*র বোঝা কমাইয়া দিয়েছেন। তাই এই অ*ধ*ম গরীবের বাড়ির ভিটায় পা রেখে যদি আপনেরা দু’মুঠো খাবার খাইতেন তয় নিজেরে মেলা ধইন্ন মনে করতাম সাহেব।”

রাসেল আর ঝর্ণা তরু ও কুশলের পাশে দাড়িয়ে একস্বরে বললো….
—“হুম..হুম..চলো না গো আমাদের বাড়িতে তোমরা। তাহলে আমরা অনেক খুশি হবো।”

বাচ্চাদের এই আবদার ফেলার শক্তি কুশল বা তরু কেওই করে উঠতে পারলো না। ওরা দু’জন একে-অপরের দিকে একপলক দেখে বললো….

—“ঠিক আছে যাবো আমরা।”

ঝর্ণা বললো….
—“সুন্দর চাচ্চু..! তোমার কাছে একটা যন্ত্রটা আছে না? ঐ তো যেটা দিয়ে তুমি বাবা ভ*য় দেখালে! ওটা আমাকে দিয়ে যাবে!”

ছোট্ট ঝর্ণার মুখে এরূপ কথা শুনে ওরা ৪জন অনেক অবাক হয়। কুশল ঝর্ণার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো…
—“ঐ যন্ত্রটা দিয়ে তো খেলা করা যায় না মা। আমি তোমাকে ঐ যন্ত্রটা তো দিতে পারবো না কিন্তু ঐ যন্ত্রের মতো একটা খেলনা যন্ত্র দিতে পারবো। সেটা দিয়ে তুমি খেলো কেমন!”

ঝর্ণা বললো….
—“খেলার জন্য তো লাগবে না আমার।”

—“তাহলে কি জন্য চাইছো শুনি!”

ঝর্ণা একপলক ওর বাবা আর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবারও কুশলের উপর দৃষ্টি স্থির করে বললো….

—“আমাদের বাড়িতে একজন কু*চু*টে বুড়ি আছে। ঐ বুড়িটা আমার বাবাকে সবসময় ঝা*রি*র উপর রাখে জানো! আমাকে আর ভাইয়াকে দিয়ে সব ধরনের কাজ করিয়ে নেয়। একটু ভু*ল হলে বাবার কাছে উল্টোপাল্টা বলে আমাদের প্রতিদিন মা*র খাইয়ে নেয়। তোমার ঐ যন্ত্রটা দিয়ে তুমি যেমন বাবাকে ভ*য় দেখিয়ে ভালো বাবা বানিয়ে দিলে তেমনি আমিও ঐ যন্ত্রটা দিয়ে ঐ কু*চু*টে বুড়িকে ভ*য় দেখিয়ে ভালো মা বানিয়ে দিবো।”

ছোট্ট মেয়ে ঝর্ণার মুখে এতো গোছালো কথাগুলো শুনে কুশল আর তরু বেশ অবাক হয়। মফিজুর কিছুটা লজ্জা বোধ করে মাথা নিচু করে ফেলে। পরক্ষণেই কুশল শান্ত স্বরে বললো…

—“তোমাকে কিছুই করতে হবে না পাকনি বুড়ি। তুমি আর তোমার ভাইয়া যেনো এখন সনসময় ভালো থাকতে পারো তার সব ব্যবস্থা করে তবেই আমি আর তোমার ভালো চাচ্চী খা*ন্ত হবো।”

ঝর্ণা অনেক খুশি হয়ে কুশলের গালে একটা চুমু দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। কুশল হাসি দিয়ে ঝর্ণাকে নিজের কোলে রাখাবস্থাতেই উঠে দাড়ায়। তরু মফিজুরকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“চলুন তাহলে আপনাদের বাড়িতে যাওয়া যাক। রাসেল বাবা…আমার কাছে এসো আমার হাত ধরো।”

তরুর ডাক শোনামাত্র রাসেল খুশিমনে তরুর হাতের বামপার্শে এসে দাঁড়িয়ে ওর বাম হাত শক্ত করে ধরে। অতঃপর ওরা মফিজুরের সাথে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here