#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৭)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৩১)
মফিজুরের রুমে বিছানার উপর কুশল আর তরু বসে আছে। ঝর্ণা তরুর পাশে বসে আছে। সেইসময় ওদের পাশের রুম থেকে কারোর কাশির শব্দ ভেসে আসলে তরু শান্ত স্বরে ঝর্ণাকে প্রশ্ন করলো….
—“ঐ রুমেই কি তোমার দাদু আছেন ঝর্ণা?”
ঝর্ণা উপর নিচ মাথা নেড়ে হ্যা সূচক জবাব দেয়। তরু আবারও বললো….
—“তোমার ভাইয়াকে ডেকে আনো তো একটু, বলবে আমি ডাকছি।”
—“আচ্ছা সুন্দর চাচ্চী।”
এই বলে ঝর্ণা এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিয়ে বাহিরে চলে যায়। কুশল বললো….
—“হঠাৎ রাসেলকে ডাকতে বললে যে!”
—“আমাদের ওদের দাদুর সাথে কথা বলা উচিত। ঐ স্কুলের পাশে থাকা বট গাছটির রহস্য এখনও আমাদের সামনে খো*লা*শা হয় নি। ঐ রহস্য জানার জন্য আমার মন ভিষণ খ*চ*খ*চ করছে কুশল। তাই এই মূহূর্তে ওদের দাদুর সাথে কথা বলা যাবে কিনা তা জানতেই রাসলকে ডাকতে বললাম৷”
তরুর মুখে এরূপ কথা শুনে কুশল একবার শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেললো। পরক্ষণেই রাসেল আর ঝর্ণা একসাথে রুমের ভিতর প্রবেশ করার পরপরই তরু ওদের দাদু মুজাহিদ সাহেবের সাথে কথা বলার বিষয়টা রাসেলকে বললে রাসেল বললো….
—“আমি ছোট থেকেই দেখে আসছি আমরা ঘরের এই হাতাগোণা ৪জন মানুষ ব্যতিত দাদু বাহিরের কারোর সাথে কথা বলতে চানই না। যদি বাহিরের কেও তার সাথে কথা বলতে বা দেখা করতে আসতেন তাহলে তাদের সাথে অকারণেই উগ্র আচারণ করতেন। তবুও আপনারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আপনাদের সাথে বলতেও পারেন।”
রাসেলের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে তরু কুশলের দিকে একপলক তাকিয়ে বললো….
—“চলুন একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।”
—“হুম চলো।”
তরু আর কুশল দু’জনেই বিছানা থেকে নেমে একসাথে ঝর্ণার দাদু মুজাহিদ সাহেবের রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
(১৩২)
হসপিটালের মূল দরজার পাশে নিজ গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে তাহির। তাহিরের পাশেই জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে হুমায়রা। তাহির নিজের সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বললো….
—“ঐদিকে ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস? ডাক্তার. নিলয়কে এখানে রেখে আমার সাথে চলে যাওয়ার জন্য মন মানছে না তাই তো!”
তাহিরের এমন বাঁকা ভাষায় বলা কথাগুলো শুনে হুমায়রা তাহিরের দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রাখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য পরক্ষণেই কোনো প্রতিত্তুর না করে সোজা হয়ে বসে দু’চোখ বন্ধ করে নেয় সে। তাহির ও আর কিছু না বলে গাড়ি স্টাট করে। গাড়ি চলে থাকে তার গতিতে তালুকদার ভিলার উদ্দেশ্যে। বেশ লম্বা সময় ধরে গাড়ি চলছে। গাড়ির ভিতর পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। তাহির ঘাড় বাঁকিয়ে হুমায়রার দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে সে ঘুমিয়ে গিয়েছে। জানালা খোলা থাকায় শীতল হাওয়া এসে হুমায়রার আলসে ছোট চুলগুলো ওর চোখ, নাক এর উপর ফেলে রেখেছে। তাহির ওর বামহাত এগিয়ে দিয়ে হুমায়রার চোখ ও নাকের উপর এসে পড়ে থাকা চুলগুলো খুব যত্নসহকারে সরিয়ে ওর কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে জানালা বন্ধ করে দেয়। এরপর হালকা পাওয়ারে এ.সি অন করে দেয়। তাহির গাড়ি চালাতে চালাতে বললো….
—“জানি না আমি বুঝতে পারছি না আমার হয়েছে টা কি! তোর পুরো অধিকার আছে তুই যেকোনো ছেলের সাথেই মিশতে পারিস কথা বলতে পারিস যা খুশি করতে পারিস। কিন্তু তুই যখন ঐ ডাক্তার নিলয়ের বাহুডোরে আবব্ধ ছিলি! ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলি তখন আমার বুকের ভিতরটা যেনো হিংসার আগুনে জ্ব*লে পু*ড়ে খাঁ*ক হয়ে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে করছিলো ঐ ডাক্তারকে ওখানেই মাটির নিচে পুঁ*তে ফেলি। তোর উপর ও ভিষণ ভিষণ রাগ লাগছিলো। তাই তোর সাথেও যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছি। উল্টো-পাল্টা কথা শুনিয়ে ফেলেছি। আর এসব আমি কেনো করছি! তার কারণ কি! তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। তোর এই ঘুমন্ত মায়া মাখানো মুখশ্রী আমাকে কেও তোর দিকে এতো টানে! এতো এতো প্রশ্নের উত্তর আসলে কি আমি জানি না। আমাকে ক্ষমা করে দিস হিমু।”
(১৩৩)
কুশল আর তরু মুজাহিদ সাহেবের রুমের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখে মেঝের উপর একটা চাটাই বিছানো তার উপর পাতলা একটা তোশক রাখা। সেই তোশকের উপর কম্বল মুড়ি দিয়ে ৬০+ বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তি মুজাহিদ সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। একটু পর পরই খুক খুক খুক খুক করে কাঁশি দিচ্ছেন। ঝর্ণা ওর দাদুর মাথার কাছে গিয়ে বসে ওর দাদুর কপালের উপর হাত রাখতেই তিনি চোখ মেলে হাসি মুখে ঝর্ণার দিকে তাকালেন। ঝর্ণা বললো….
—“দাদু..দাদু..তোমার সাথে ঐ যে দাড়ানো সুন্দর চাচ্চু আর সুন্দর চাচ্চী স্কুলের পাশে থাকা বটগাছের গোড়ায় প্রতিদিন পানি দেওয়ার বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য এসেছেন দেখো…!”
ঝর্ণার মুখে এরূপ কথা শোনা মাত্র মুজাহিদ সাহেব থ*ম*কা*নো দৃষ্টি নিয়ে কুশল আর তরুর দিকে তাকায়। তার মুখশ্রী জুড়ে চি*ন্তা আর ভ*য়ে*র ছাপ স্পষ্ট হয়। পরক্ষণেই তরু কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই মুজাহিদ সাহেব উচ্চস্বরে রাগ নিয়ে বললেন….
—“চলে যান…এইমূহূর্তে এখান থেকে চলে যান আপনারা…আমি আপনাদের সাথে কোনো বিষয় নিয়েই কথা বলতে চাহ না। বেড়িয়ে যান আমার ঘর থেকে। দ্রুত…!”
ওনাকে এতো বেশি উত্তেজিত হতে দেখে কুশল, তরু সহ ঝর্ণা-রাসেল ও অনেক অবাক হয়। মুজাহিদ সাহেব তরু বা কুশলকে কোনো কথা বলার সুযোগ ই দিচ্ছেন না।অনরগল ভাবে একটা কথাই বলে যাচ্ছেন যে তিনি ওদের সাথে কোনো বিষয় নিয়েই কথা বলতে চান না। কুশল আর তরু যেনো এখান থেকে চলে যায়। কুশল শান্ত স্বরে তরুকে বললো….
—“আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত তরুনিমা। যেহেতু উনি আমাদের সাথে কোনো রূপ কথা বলতে চান না তাই ওনার শারিরীক অবস্থার কথা চিন্তা করে কথা বলার জন্য কোনোরূপ জোর না করাই সঠিক হবে।”
তরু মুখ মলিন করে বললো….
—“আমাকে ক্ষমা করে দিবেন কুশল। আপনার মায়ের কবর খুঁজে পাওয়ার শেষ আশার আলো আমি আপনার মনে জাগিয়ে দিয়ে তা কাজে লাগাতে না পেরে আপনার ক*ষ্টে*র পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিলাম।”
কুশল তরুর কথা শুনে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো…
—“চলো..যাওয়া যাক।”
এই বলে কুশল আর তরু মুজাহিদ সাহেবের রুম থেকে বের হতেই ভিতর থেকে ঝর্ণার ‘দাদুউউউ’ বলে চি*ৎ*কার করার আওয়াজ ভেসে আসে। কুশল আর তরু আবারও তড়িৎগতিতে রুমের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখেন মুজাহিদ সাহেব কেমন যেনো নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন। কুশল দ্রুত তার কাছে গিয়ে ঝর্ণাকে তরুর কাছে দেয়। অতঃপর মুজাহিদ সাহেবের বাম হাতের কবজি ধরে পালসের গতি চেক করে বললো….
—“পালস খুব ধীর গতিতে চলছে। রাসেল দ্রুত একটা ছোট ধা*রা*লো ছু*ড়ি এনে দাও আমায়।”
কুশলের কথা শোনামাত্র রাসেল দৌড়ে ওর দাদুর রুম থেকে বের হয়। কুশল মুজাহিদ সাহেবের বুকের উপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে ওনার ফতুয়ার বোতাম গুলো খুলে ফেলে। এরপর নিজের দু-হাত একত্র করে বিসমিল্লাহ বলে ওনার বুকের উপর হালকা ও জোড়ে দুই ভাবেই চা*প দিতে শুরু করেন। পরপরই রাসেল একটা ছোটো ছু*রি এনে কুশলকে দিলে কুশল ছু*রি*টা নিয়ে মুজাহিদ সাহেবের বুকের বামপাশে ছোট্ট করে একটা ছিদ্র করে দিয়ে আবারও তার বুকের উপর হাত দিয়ে চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে। পরক্ষণেই মুজাহিদ সাহেব খুব জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে কাশতে শুরু করেন। কুশল এবার ওনার পালস চেক করে দেখে এখন স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। তরু অবাক ও মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে আছে। কুশল ওর পাশে থাকা ছোট কাঠের জলচৌকির উপর রাখা মাটির কলসী থেকে অল্পপরিমাণে পানি গ্লাসে নিয়ে মুজাহিদ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো…
—“পানিটুকু খেয়ে নিন ভালো লাগবে।”
তিনিও বিনাবাক্যে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে খেতে শুরু করলেন। কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে বললো…
—“আমি গাড়ি থেকে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে আসছি। ওনার কা*টা স্থানে ঔষধ লাগিয়ে দিতে হবে।”
এই বলে কুশল রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ঝর্ণা তরুর কাছ থেকে সরে ওর দাদুর পাশে গিয়ে বসে বললো….
—“জানো দাদু…সুন্দর চাচ্চু জাদু করে তোমাকে সুস্থ করে দিয়েছেন। সুন্দর চাচ্চু আর সুন্দর চাচ্চী দু’জনেই খুব ভালো গো। ওনারা আমাদের বাবা-মাকে পুরোপুরি ভাবে বদলে দিয়েছেন। জানো দাদু…আজ প্রথম বাবা-মা দু’জনেই আমাকে আর ভাইয়াকে বুকে জড়িয়ো নিয়ে আদর করেছিলেন। তুমি ওনাদের সাথে খা*রা*প ব্যবহার করো না গো। তাহলে আমি আর ভাইয়া দু’জনেই তোমার উপর ভিষণ মন খারাপ করবো।”
ছোট্ট ঝর্ণার মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে মুজাহিদ সাহেব অনুতপ্ততা ও অনুশোচনার দৃষ্টি নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে বললেন….
—“আমাকে ক্ষেমা কইরা দে মা.. না জাইনা, না বুইঝা তগো লগে খুব খা*রা*প ব্যবহার কইরা ফেলছি৷”
তরু বললো….
—“ছি:ছি: চাচা..আপনি এসব কি বলছেন! আপনার আমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি আমাদের থেকে বয়সে যথেষ্ট বড়। তাই এভাবে ক্ষমা চেয়ে আমাদের ল*জ্জি*ত করবেন না।”
তরুর কথা শেষ হতে না হতেই কুশল ফাস্ট এইড বক্স হাতে নিয়ে রুমের ভিতর প্রবেশ করে মুজাহিদ সাহেবের পাশে এসে বসে ওনার বুকের বাম পার্শে ছু*রি দ্বারা ছি*দ্র করা স্থানে ঔষধ লাগিয়ে দেয়। মুজাহিদ সাহেব বললেন…
—“এই শেষ বয়সে আইসা আমার প্রাণ বাচাইয়া তোমাগো কাছে ঋণী কইরা দিলা বা’জান! এই ঋণ আমি কেমনে শো*ধ করতাম।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“একজন মানুষ হিসেবে নিজের সাধ্যের ভিতরে যতোটুকু করা সম্ভব হয়েছে আমি ততোটুকুই করেছি চাচা। প্রাণ দেওয়ার ও নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা৷ আমরা তো শুধু উছিলা।”
তরু বললো….
—“চাচা..যদি কিছু মনে না করেণ তাহলে আমাদের ঐ বিশাল বটগাছের গোড়ায় প্রতিদিন পানি দেওয়ার পিছনের আসল কারণ টা বলবেন!”
তরুর মুখে এরূপ কথা শুনে মুজাহিদ সাহেব একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন….
—“ঐ বটগাছের গোড়ায় প্রতিদিন পানি দেওয়ার পিছনে একটাই কারণ আছে তা হলো আমার করা মহা পা*পে*র বোঝা কিছুটা হলেও হালকা করা।”
তরু অবাক স্বরে বললো….
—“মহা পা*প..! মানে টা ঠিক বুঝলাম না চাচা।”
—“এখন যেই জমির উপর স্কুল আছে ঐ জমির মালিক যিনি ছিলেন তার হয়ে ঐ জমিতে আমি চাষাবাদ করতাম।”
আজ থেকে ২০ বছর আগে বিকেলের সময়ে……..
জমিতে হাল বয়ার জন্য মুজাহিদ লাঙল নিয়ে যাচ্ছেন। কিছুসময় পর কাঙ্ক্ষিত স্থান থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়িয়ে পরেন তিনি। মুজাহিদ সামনে লক্ষ্য করতেই দেখলেন ওনার জমির মালিক তৎকালীন সময়ের পাহাড়তলী গ্রামের মেম্বার জব্বার সাহেব একজন পুরুষ ও একজন মহিলার সাথে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। ওনাদের পাশেই মাটির উপর কাওকে শুইয়ে রাখা অবস্থায় দেখতে পেলেন মুজাহিদ। পরক্ষণেই লাঙল টা সেখানেই ফে*লে রেখে ওনাদের কাছে যেতেই দেখলেন যাকে মাটির উপর শুইয়া রাখা হয়েছে তিনি একজন মহিলা। যার সর্বশরীর র*ক্তে ভিজে একাকার অবস্থা হয়ে আছে। মুজাহিদকে দেখা মাত্র ঐ পুরুষ ও মহিলাটি ভরকে উঠলেন। জব্বার সাহেব মুজাহিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“মুজাহিদ…তুই যখন এখানে এসেই পড়েছিস তবে একটা কাজের কাজ করে দে।”
মুজাহিদ অবাক ও ভী*ত গ্রস্থ হয়ে বললেন….
—“মালিকা এনারা কেডা? আর এই মহিলাই বা কেডা? এনার এমন বা*জে অবস্থা হইলো কি করে? আপনেরা এইনে কি করতে আইছেন!”
মুজাহিদকে এতো প্রশ্ন করতে দেখলে অন্য পুরুষটি জব্বার সাহেবের হাত ধরে তাকে একটু সাইডে এনে বললেন….
—“দেখ জব্বার এটা অনেক সেন্সিটিভ বিষয়। আমি চাই না আমরা আর তুই ব্যতিত এই বিষয়ের কোনো চাক্ষুষ সাক্ষী থাকুক। তাই এই ব্যডাকেও মে*রে এখানেই পুঁ*তে ফেলাটাই উত্তম হবে।”
জব্বার সাহেব বললেন….
—“একে মা*র*তে হবে না স্যার। এ আমার অনেক পুরোনো আর বিশ্বস্ত একজন কাজের লোক। বহু বছর ধরে আমার জমিতে কামলা খে*টে নিজের রুজিরোজগার করছে। এর মুখ কিভাবে সারাজীবনের মতো বন্ধ করতে হয় তা আমার খুব ভালো ভাবেই জানা আছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আর দেখুন আমি কি করি।”
—“যদি কোনো সমস্যা হয়েছে তবে এর ফল কিন্তু তোর জন্য হবে না সেটা ভালো ভাবে নিজের মাথার ভিতর ঢুকিয়ে নিয়ে যা করার কর।”
এই বলে পুরুষ লোকটি মহিলাটির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে মুজাহিদের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই জব্বার সাহেব মুজাহিদের কাছে এসে ওর হাত ধরে টেনে অন্যপাশে এনে দাঁড় করিয়ে বললেন…..
—“নিজের বউ-বাচ্চা, বাবা-মায়ের জীবন তোর কাছে কতোটা মূল্যবানরে মুজাহিদ!”
জব্বার সাহেবের মুখে এরূপ প্রশ্ন শুনে মুজাহিদ অবাক স্বরে বললো…
—“এ আপনি কেমন প্রশ্ন জিগাইতাছেন মালিক! আমাট বউ-বাচ্চা, বাবা-মায়ের পরাণের মূল্য আমার কাছে আমার পরাণের থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান।”
—“তাহলে এখন একটা কথা নিজের মাথার ভিতর খুব ভালো ভাবে ঢুকিয়ে নে।”
—“কোন কথা মালিক!”
—“আজ এই মূহূর্তে দাড়িয়ে তুই এখানে যা যা দেখতাছিস তা ভুইলা যাবি। এখানে কি করা হইতাছে তা তুই ভুইলা যাবি। কারা উপস্থিত ছিলো এখানে তাদের তুই জীবনে কখোনই দেখিস নি এটা ভেবেই মুখে কু*লো মে*রে থাকবি আজীবন। যদি কখনও কারোর সামনে আজকের এই ঘটনার সামান্য তম কথাও মুখ ফ*স*কে বের করেছিস তাহলে তোর পুরো গুষ্টিকে আমি এই পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিমু বইলা দিলাম।”
জব্বার সাহেবের শেষ কথা টুকু শোনামাত্র মুজাহিদ ভী*ত গ্রস্থ হয়ে দু’কদম পিছনের দিকে পিছিয়ে যান। মুজাদিহ ইতিমধ্যে এতোটুকু খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে যে আজ এখানে এনারা নিজেদের করা বড় পা*প ঢাকার পরিকল্পনা করছেন। মুজাহিদকে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জব্বার সাহেব আবারও বললেন….
—“এখন সং*য়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ঐ জায়গায় কবর খুঁ*ড়ে দে। এই লা*শটাকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দা*ফ*ন করে ফেলতে হবে।”
জব্বারের এরূপ কথা শুনে মুজাহিদ মহিলাটির লা*শে*র উপর দৃষ্টি স্থির করে মনে মনে বললো….
—“আজ কতো বড় পা*প এর বোঝার ভাগিদার আমাকে হতে হচ্ছে আমি জানি না। মালিকের কথা না মানলে যদি সত্যিই উনি আমার পরিবারের মানুষদের মে*রে ফেলেন তখন কি হবে!”
এসব নানান চিন্তাভাবনা করতে করতেই একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুজাহিদ ঐ পুরুষ ও মহিলাটির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে কো*দা*ল হাতে নিয়ে খু*ড়*তে শুরু করে। কিছুসময়ের মধ্যেই কবর খোঁ*ড়া*র কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর উনি ক*ব*রের ভিতর থেকে উঠে দাঁড়াতেই পুরুষ লোকটি মুজাহিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন…
—“লা*শ*টিকে উঠিয়ে দ্রুত দা*ফ*ন করে দে।”
মুজাহিদ পুরুষ মানুষটির দিকে একপলক দেখে জব্বারের দিকে একপলক দেখে। পরক্ষণেই মহিলাটির লা*শে*র পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তার দিকে দৃষ্টি স্থির করে মনে মনে বললো….
—“আমারে মাফ কইরা দিয়েন আপামনি।”
এই বলে মুজাহিদ একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহিলাটিকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে কবর খোঁ*ড়া জায়গাটিতে শুইয়ে দিয়ে তার দাফনকার্য সম্পন্ন করে। মুজাহিদ মহিলাটির কবরের পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। সেইসময় পুরুষ লোকটি মুজাহিদের পিছনের দাঁড়িয়ে ওর মাথার সামনের অংশের চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে ওর গলায় ধা*রা*লো একটা ছু*রি ঠেকিয়ে বললো….
—“নিজের ও নিজের পরিবারের সবার জীবন বাঁচানোর হলে নিজের মুখ আজীবনের জন্য ব*ন্ধ করে রাখিস। যদি ভুলেও কখনও আজকের এই বিষয় সম্পর্কে ৫ম কোনো ব্যক্তির কাছে তুই মুখ খুলিস তাহলে তোর আর তোর পরিবারের সবার পরিণতি ঠিক কতোটা ভ*য়া*ব*হ হবে তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না।”
এই বলে লোকটি মুজাহিদের গলা থেকে ছু*রি*টি সরিয়ে ওকে ধা*ক্কা প্রয়োগ করে। মুজাহিদ মাটির উপর লু*টি*য়ে পরে। লোকটি জব্বারকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“আজ থেকে এই জমিতে কোনো প্রকার চাষাবাদ হবে না। এই চা*ষা*কে চাষ করার জন্য অন্য কোনো জমি দিয়ে দিস জব্বার।”
এই বলে পুরুষ লোকটি উপস্থিত ঐ মহিলাকে নিয়ে স্থান ত্যগ করেন। জব্বার মুজাহিদকে একপলক দেখে সেও স্থান ত্যগ করে। মুজাহিদ মাটিতে পরে থাকা অবস্থাতেই নিরবে চোখের পানি ফেলতে শুরু করেছে৷
…..………………………….বর্তমান…………………………….
মুজাহিদ সাহেব তার অতীতের কথাগুলো বলতে বলতে চোখ থেকে নোনা জল ফেলছে। কিছুসময় নিরব থাকে পুরো পরিবেশ। মুজাহিদ সাহেব আবারও বললেন….
—“ওনাকে দা*ফ*ন দেওয়ার ১০ দিনের মাথায় গ্রামে ম*হা*মা*রী শুরু হয়ে গিয়েছিলো। ছোঁ*য়া*চে রোগ কলেরা পাহাড়তলী গ্রামের এমন কোনো ঘর বাকি ছিলো না যে সে ঘরে প্রবেশ করে নি। চারদিকে একের পর এক মানুষের মৃ*ত্যু দেখা আর স্বজনদের আহাজারি শুনতে শুনতে সকাল থেকে রাত আর রাত থেকে সকাল হতে শুরু করলো। তখন পাহাড়তলী গ্রামে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিলো না, আর না ছিলো কোনো ভালো ডাক্তার বা চিকিৎসালয়। একমাসের মাথায় আমার স্ত্রী, আমার ২ছেলে, ১মেয়ে ও আমার বাবা-মা কলেরায় আ*ক্রা*ন্ত হয়ে মৃ*ত্যু বরন করেছিলেন। একে একে নিজের প্রিয় মানুষগুলোকে মৃ*ত্যু*র কোলে ঢ*লে পড়তে দেখে কি যে কঠিণ য*ন্ত্র*ণা হয়েছিলো বুকের ভিতর সেসব মনে পড়লে আজও আমার বুকটা হাহাকার করে উঠে। পাহাড়তলী গ্রাম এর অর্ধেকের বেশি মানুষ সেবার মা*রা গিয়েছিলো। আমার পরিবার বলতে কেও ছিলো না এই পৃথিবী জুড়ে। যখন সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে পরেছিলাম তখন আমার মনে অনুশোচনার আ*গু*ন দা*উ*দা*উ করে জ্ব*ল*ছিলো। ১মাস আগে আমি নিজের পরিবারের প্রা*ণ বাঁ*চা*নোর কথা চিন্তা করে অন্যদের করা পা*প*কে ঢাকার কাজে সহযোগিতা করেছিলাম আর সেই পা*পে*র ভাগিদার হওয়ার ফল হিসেবে আল্লাহ আমার থেকে আমার পুরো পরিবারকে একমুহূর্তের মধ্যেই কে*ড়ে নিলেন। পরবর্তীতে আমি যখন ঐ মহিলার ক*ব*রের কাছে গিয়েছিলাম তখন তার ক*ব*রের পাশে ১৫ বছর বয়সী একজন ছেলেকে সাদা চাদরে মোড়ানো আরেকজন নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে দেখেছিলাম। বাচ্চাটির কান্নার আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসছিলো। ছেলেটি অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাটির কান্না থামাতে পারে নি। চারপাশে তাকিয়ে আর কোনো মানুষের চিহ্ন আমি খুজে পাই নি। পরমূহূর্তেই আমি ছেলেটির কাছে গিয়ে তার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলেছিলো, ‘তার নাম মফিজুর, কলেরায় তার বাবা-মা মা*রা যাওয়ায় তার চাচা-চাচী তাদের বাড়িভিটের সামান্য সম্পত্তিটুকু নিজেদের নামে লিখে নিয়ে তাদের বের করে দিয়েছে। অপরিচিত হওয়ায় গ্রামের কেওই তাদের আশ্রয় দেয় নি তাই ওরা এই মাঠে এসে বসেছে। ওদের এমন করুণ অবস্থা দেখে আমার ভিষণ মায়া কাজ করে। আমি বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিতেই সে কান্না থামিয়ে দিয়েছিলো। তখন আমি ভেবে নিয়েছিলাম আমার মতো নিঃস্ব ব্যক্তিকে হয়তো স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এই মাসুম শিশুটি ও তার ভাইকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব দিলেন। এরপর আমি মফিজুর আর সেই বাচ্চাটির ভরোণপোষণের দায়ভার নিজের উপর তুলে নেই । কিছুদিন পর আমি আবারও ওনার কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম। তখন দেখলাম ওনার কবরের উপর থেকে থেকে কচি বটগাছের একটা চাড়া বের হয়েছে। এরপর থেকে রোজ ঐ বটগাছের গোড়ায় পানি দিতে যেতাম আমি। প্রতিদিন ওনার কাছে ক্ষ*মা চাইতাম। আর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যতোদিন বেঁচে আছি ততোদিন এই গাছের গোড়া আমি শুকিয়ে যেতে দিবো না।”
মুজাহিদ সাহেবের মুখে সম্পূর্ণ ঘটনাগুলো শুনে কুশল স্তব্দ হয়ে বসে আছে। তরু ওর ফোন থেকে কামিনী আর রিজভীর ছবি বের করে মুজাহিদ সাহেবের সামনে ফোনটা ধরে শান্ত স্বরে বললো…
—“চাচা..দেখুন তো একবার ভালো করে.. ঐদিনের ঐ পুরুষ আর মহিলাটি এনারা দু’জন ই ছিলেন কিনা!”
তরুর কথানুযায়ী মুজাহিদ সাহেব চোখ ছোট ছোট করে ফোনস্ক্রিণের থাকা কামিনী আর রিজভীর ছবি দেখে। কিছুসময় পর বললেন….
—“হুম..হুম…এরাই..এরা দু’জনেই উপস্থিত ছিলো সেদিন।”
মুজাহিদের মুখে এরূপ কথা শোনামাত্র তরুর আর বুঝতে বাকি রইলো না ঐ বট গাছের নিচেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কুশলের মা। তরু ছলছল দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকায়। কুশল কিছু না বলে বসাবস্থা থেকে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। তরুও কুশলের পিছন পিছন চলে যায়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…………
(পুরো বিষয়টাকে তুলে ধরতে এই পর্ব ২৫০০+ শব্দের হয়ে গেলো। ভু*ল-ত্রু*টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আল্লাহ হাফেজ, আসসালামু আলাইকুম)