#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৮)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৩৪)
স্কুলের পাশে থাকা সেই বটগাছের গোড়ায় মাটির উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কুশল। কুশলের পাশেই নিরব হয়ে বসে ওর উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে তরুনিমা। কিছুসময় পর কুশল শোয়াবস্থায় থাকাকালীনই গাছের চারপাশের মাটি ও ঘাসগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে আর ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“জানো তরুনিমা আমার মনে হচ্ছে আমি এই মাটির উপর শুয়ে নেই, আমি যেনো আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। এই ঘাস আর ভেজা মাটি থেকে যে গন্ধ আমার নিঃশ্বাসের মাধ্যমে আমার শরীরের ভিতর পর্যন্ত যাচ্ছে! আমার মনে হচ্ছে আমি মা মা গন্ধ অনুভব করছি। মায়ের শরীরের গন্ধ বুঝি এমন মিষ্টি হয়! আমার মা তো এই এই মাটির নিচেই ঘুমিয়ে আছেন তাহলে এই মাটির সাথে তো আমার মায়ের শরীরের গন্ধও মিশে আছে বলো!”
তরুনিমা এইমূহূর্তে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তরুনিমা হয়তো মনে মনে চিন্তা করছে….
—“যে মায়ের অস্তিত্ব তার স্মৃতি থেকে চিরতরের জন্য মুছে গিয়েছে সেই মায়ের জন্যই কতো টান, কতো মায়া, কতো কষ্ট অনুভব করছেন কুশল। সত্যিই নাড়ির টান কেও কখনও ছি*ন্ন করতে পারে না।”
(১৩৫)
হাসপাতালের বেডের উপর পা ঝুলিয়ে বসে মুখশ্রী জুড়ে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট রেখে মেঝের উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে সন্ধ্যা। নিলাদ্র সন্ধ্যার সামনেই চেয়ারে বসে লম্বা সময় ধরে ওকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সেইসময় একজন নার্স ট্রে তে করে খাবার নিয়ে ওদের কেবিনে প্রবেশ করে। নিলাদ্রকে ওভাবে চেয়ারে বসে থাকতে আর সন্ধ্যাকে বেডের উপর বসে থাকতে দেখে নার্স কিছুটা কনফিউজড হয়ে গিয়েছেন হয়তো। নিলাদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে নার্সের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার হাত থেকে খাবারের ট্রে টা নিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“আপনার কি কিছু বলার আছে!”
নার্স নিলাদ্রের প্রশ্নে কি প্রতিত্তুর করবেন তা বুঝে উঠতে না পেরে তোতলানো স্বরে বললেন…
—“আ-আব-আ জ্বি না।”
—“কিন্তু আমার বলার আছে।”
—“জ্বি বলুন, স্যার।”
—“আমরা তো দু’জন মানুষ আছি এখানে তাই এই এক বাটি স্যুপ দিয়ে আমাদের হবে না। আপনি কাইন্ডলি আরেক বাটি স্যুপ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন।”
সেইসময় সন্ধ্যা শান্ত স্বরে বললো….
—“যে এক বাটি স্যুপ এনেছেন উনি তা আপনি খেয়ে নিন। আমি খাবো না কিছু।”
নিলাদ্র নার্সকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“আপনাকে যেটা বললাম আপনি সেটা করুন।”
সন্ধ্যা আবারও কিছুটা তেজী স্বরে বললো….
—“বললাম তে আমি খাবো না। তাই আর আনার কোনো প্রয়োজন নেই।”
—“আপনাকে তো আনতে যেতে বললাম আমি।”
নার্সটি দ্বিধায় পড়ে বললো…
—“কিন্তু স্যার..ম্যম তো বলছেন উনি খাবেন না।”
নিলাদ্র চোখ রাঙিয়ে নার্সের দিকে তাকাতেই নার্স বললো….
—“জ-জ্বি-জ্বি স্যার…আমি এক্ষুণি আরেক বাটি স্যুপ নিয়ে আসছি।”
এই বলে নার্সটি কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। নিলাদ্র খাবারের ট্রে টা বিছানার এক পার্শে রাখে। সন্ধ্যা নিলাদ্রের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললো…
—“বললাম না আমি খাবো না…একটা কথা একবার বললে আপনি বুঝ…!”
সন্ধ্যা পুরো কথা শেষ করার আগেই নিলাদ্র সন্ধ্যার দুই ঠোঁটের মাঝ বরাবর নিজের ডান হাতের শাহাদাত আঙুল ঠেকিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“খাওয়া নিয়ে মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ যদি বের করেছিস তাহলে এইযে বেডের পার্শে রাখা ট্রে টার উপর বাঁ*কা সুই আর সুতো রাখা দেখছিস! এগুলো দিয়ে তোর মুখ সারাজীবনের জন্য সেলাই করে দিবো।”
নিলাদ্রের শীতল কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে সন্ধ্যা শুকনো ঢো*ক গিলে নেয়।
(১৩৬)
তালুকদার ভিলার মূল গেইট দিয়ে গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে তাহির। পার্কিং সাইডে এসে গাড়ি ব্রেক কষতেই হুমায়রার ঘুম ভেঙে যায়। হুমায়রা একপলক তাহিরকে দেখে আবার গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরটা দেখে বুঝতে পারে যে ওরা বাড়িতে এসে পড়েছে। হুমায়রা মুখে কিছু না বলে সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। তাহির ও নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নামে। লম্বা সময় ধরে বসে থেকে ড্রাইভিং করায় তাহিরের বুকের বাম পার্শে গু*লি লাগা ক্ষ*ত স্থানটিতে চি*ন-চি*নে ব্যথা করতে শুরু হওয়ায় সে নিজের ক্ষ*ত স্থানের পাশে আলতো করে হাত রেখে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। হুমায়রা বিষয়টা লক্ষ্য করতেই তাহিরের কাছে এসে বললো….
—“এই জন্যই বলেছিলাম আর কয়েকটা দিন হাসপাতালে থাকতে। ক্ষ*ত স্থানটা একটু শুকিয়ে যেতো তারপর চলে আসলে কি যে মহাভারত অ*শুদ্ধ হয়ে যেতো ওনার! সবসময় নিজে যা বুঝবে সেটাই সঠিক বাকিরা সেই বিষয়ে হাজার কথা বলতে বলতে শ*হী*দ হয়ে গেলেও তার কিছু যায় আসবে না। তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে আর সরানো যাবে না। বাড়িতে ফিরবে বলছে মানে ফিরতেই হলো। এখন যে য*ন্ত্র*ণা করছে! ক*ষ্ট টা কার হচ্ছে শুনি! নিজের ভালো একটা পা*গ*ল ও খুব ভালো ভাবে বুঝে কিন্তু এই মহাশয় তা বুঝে না।”
তাহির বললো….
—“এবার একটু নিঃশ্বাস নে তুই..এতো কথা এক সাথে একজন মানুষ বলতে পারে কি করে! বা*চা*ল কোথাকার।”
হুমায়রা তাহিরের দিকে তাকিয়ে রাগে দাঁত কি*ড়*মি*ড় করছে। তাহির আবারও বললো…
—“এখন কি এখানেই দাঁড়িয়ে আমাকে চি*বি*য়ে চি*বি*য়ে খাওয়ার পরিকল্পনা করছিস নাকি আমাকে ভিতরে যেতে একটু সাহায্যও করবি!”
তাহিরের মুখে এরূপ কথা শুনে হুমায়রার যেনো মনে হচ্ছে রা*গে দুঃ*খে এখানেই হাত-পা ছড়িয়ে বসে কান্না করতে। হুমায়রা নিজের রা*গ*কে নিজের মাঝেই দ*মিয়ে রেখে তাহিরকে ধরে বাড়ির ভিতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
(১৩৭)
চৌধুরী মেনশনে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছেন সায়মন, সাবরিনা, কামিনী আর রিজভী। সেইসময় কামিনী বললেন…
—“মেজো ভাইয়া..মেজো ভাবী..! তোমরা কি কুশল আর সন্ধ্যাকে সারাজীবন ধরে নিজেদের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছো! যদি তেমনটাই ঠিক করে থাকো তাহলে সে কথা আমাদের সরাসরি বলে দাও। তারপর আমাদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা আমাদেরই চিন্তা করতে হবে!”
সাবরিনা বললেন….
—“হঠাৎ নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এতো উতালা হয়ে উঠছিস কেনো তুই ছোট!”
—“দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তোমাদের এই ভালো মানুষি রূপ দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পরেছি। বুদ্ধি খাটিয়ে তো কুশলকে নিজেদের ছোট ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দিলে। সেই হিসাব অনুসারে সিংহভাগ সম্পত্তির মালিকানাও কনকের মাধ্যমে তোমরা পেয়ে গেলে। এরপর কুশলের ভাগও তোমরাই নিয়ে নিবে। বাকি অবশিষ্ট টুকু রেখেছো আমার ছেলে রাজবীরের জন্য! যদি এই সামান্য অংশই আমাদের পেতে হয় তাহলে ২০ বছর আগে তোমাদের সাথে হাত মিলিয়ে ওতো বড় একটা কাজ কেনো করেছিলাম আমরা!”
—“ছোট…কি বলতে চাইছিস তুই তা সরাসরি বল। এভাবে ঘুরিয়ে পেঁ*চি*য়ে কথা বলার তো কোনো মানে দেখছি না।”
—“এভাবে কথাগুলো না বললে তো আবার তোমাদের মনে করিয়ে দিতে পারতাম না যে ২০ বছর আগে এই স্থানেই ঠিক কি কি ঘটেছিলো।”
সায়মন কিছুটা রাগ নিয়ে রিজভীকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“রিজভী…তোর বউ কি একটু বেশিই বলে ফেলছে বলে তোর মনে হচ্ছে না!”
রিজভী বললেন…
—“আমার কাছে তো বেশি বলছে বলে মনে হচ্ছে না মেজো ভাই, বরং এটা মনে হচ্ছে যে কামিনী আজ উচিত কথা গুলোই বলছে।”
সায়মন কিছু বলতে নিলে সাবরিনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন….
—“আহা..সায়মন! মাথা ঠান্ডা করো তুমি। এখানে আমরা নিজেদের লোকজনই আছি৷ নিজেদের মাঝে এইসব সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা করার বিষয় নিয়ে কথা কা*টা-কা*টি করলে কি চলে বলো! ছোট কি বলতে চায় ওকে বলতে দাও। ছোট… বল তুই কি বলবি।”
কামিনী বললেন…
—“যা বলার সহজ ভাষায় সরাসরিই বলছি আমি।”
—“হুম বল।”
—“যেহেতু সম্পত্তির ভাগ সঠিক ভাবে পাওয়ার জন্যই ২০ বছর আগে আমরা এই জায়গায় র*ক্তে*র খেলা খেলেছিলাম তাই এখন আমরা চাই চৌধুরী পরিবারের সম্পূর্ণ সম্পত্তিকে সমান ভাবে ২ ভাগ করতে। এক ভাগ কনক পাবে আরেকভাগ আমার ছেলে রাজবীর পাবে। এর জন্য তোমাদের কি উচিত তা নিশ্চয়ই ভে*ঙে বলতে হবে না!”
—“তারমানে তুই বলতে চাচ্ছিস কুশলকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের পথ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে তাই তো!”
কামিনী ওর বিনুনী নাড়াতে নাড়াতে বললো….
—“হুম পথের কা*টা*কে যতো তাড়াতাড়ি উ*ফ*রে ফেলা যাবে ততো তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছেতে পারবো।”
কামিনীর কথা শেষ হতেই পিছন থেকে একটি পুরুষালী কন্ঠে ‘মামনি’ ডাক ভেসে আসে। ওরা সবাই মূল দরজার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…….