#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬০)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৪১)
গভীররাত……
তরু আর কুশল দু’জনেই নিজরুমে একই বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। সেইসময় কুশলের পানি পিপাসা পাওয়ায় ওর ঘুম ভেঙে যায়। কুশল শোয়াবস্থা থেকে উঠে বসে বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা পানির জগ থেকে গ্লাসে ডেলে নিয়ে পানি পান করে। পানি পান করা শেষ করে কুশল গ্লাসটি আগের স্থানে রেখে তরুর দিকে তাকাতেই দেখে তরু চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই কেমন অদ্ভুত মুখ ও অঙ্গভঙ্গীমা করছে। মানুষ ঘুমিয়ে থাকাকালীন কোনো স্বপ্ন দেখলে যেমন করে ঠিক তেমন। কুশল লক্ষ্য করে তরুর সম্পূর্ণ মুখশ্রী জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে। আশ্চার্য বিষয় রুমে এ.সি চলা সত্ত্বেও সে ঘেমে গিয়েছে।কুশল তরুর গালে আলতো করে চা*প*ড় দিয়ে ওর নাম ধরে সম্বোধন করে ওকে জাগানোর চেষ্টা করে। কিছুসময় ধরে ডাকাডাকির পর তরুর ঘুম ভে*ঙে যায়। তরু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। পরক্ষণেই নিজের পাশে কুশলকে বসে থাকতে দেখে তরু আর কিছু না ভেবেই শোয়াবস্থা থেকে উঠে কুশলের কোলের উপর বসে শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ তরুর এমন কাজে কুশল কিছুটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে সে তরুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এভাবে পেরিয়ে যায় বেশকিছুসময়। কুশল অনুভব করে ওর বুকের বামপার্শে টি-শার্টের অংশ ভিজে ভিজে লাগছে। কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“শান্ত হও তরুনিমা। তুমি হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছো! ভ*য় পেও না আমি আছি তোমার কাছে।”
কুশলের এরূপ কথা শুনে তরু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। শব্দ করে কেঁদে উঠে সে। কুশল তরুকে শান্ত করার চেষ্টা নিয়ে বললো….
—“কান্না করো না৷ কি হয়েছে বলো আমায়! কি স্বপ্ন দেখেছো তুমি! বলো..।”
তরু কুশলের বুকের বাম অংশের টি-শার্টে নাক ঘষতে ঘষতে বললো….
—“আমি আজ স্বপ্নে বড়পুকে দেখেছি। আমি দেখেছি বড়পু আর আমি একটা খুনসুটি করতে করতে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেনো যাচ্ছি। সেইসময় কোথায় থেকে যেনো একজন মুখোশ পড়া লোক এসে বড়পুর হাত ধরে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে জোরপূর্বক। আমি বড়পুর অন্য হাত ধরে তাকে আটকানোর চেষ্টা করি কিন্তু আমি সেই লোকটির শক্তির সাথে পেরে উঠি না। বড়পুকে আমার থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে ঐ লোকটি আমার সামনেই বড়পুর পেটে আর বুকে ধা*রা*লো ছু*রি দিয়ে আ*ঘা*ত করে পরপর বেশ কয়েকবার। এমনটা দেখে আমি বড়পুকে ঐ লোকটির হাত থেকে বাঁচাতে ওদের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে আমার জায়গা থেকে একচুল পরিমাণ নড়তে দেয় নি। ঐ মুখোশধারী লোকটি সেখান থেকে চলে যায়। বড়পু আমার চোখের সামনে য*ন্ত্র*ণা*য় ছ*ট-ফ*ট করতে থাকে, আমার দিকে সাহায্য চেয়ে নিজের র*ক্ত মাখা হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টা করেও বড়পুর কাছে যেতে পারি নি। আমি পারি নি। আমার চোখের সামনে বড়পু ক*রু*ণ য*ন্ত্র*ণা*য় ছ*ট-ফ*ট করতে করতে নি*স্ত*ব্ধ হয়ে গেলেন। আমার কলিজা ফে*টে যাচ্ছিলো বড়পুকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু আমি পারি নি।”
তরুনিমা কান্না করতে করতে নিজের স্বপ্নে দেখা সম্পূর্ণ ঘটনা কুশলকে বলে। কান্না করতে করতে ইতিমধ্যে তরুর হিঁ*চ*কি উঠে গিয়েছে। কুশল তরুর মনের বর্তমান অবস্থা বুঝতে পারছে। কুশল তবুও তরুকে শান্ত করার যথাযথ চেষ্টা করছে। বেশ কিছু সময় পর তরু কিছুটা শান্ত হলে কুশল বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বললো…..
—“তরুনিমা এই পানি টুকু খেয়ে নাও।”
তরুনিমা কুশলের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে কুশলের হাত থেকে সামান্য পরিমাণ পানি পান করে। তরু এখনও শক্ত হাত কুশলকে জড়িয়ে ধরে আছে। কুশল বুঝতে পারে তরু যথেষ্ট ভ*য় পেয়েছে। তাই কুশল তরুকে নিজের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করে না। অতঃপর কুশল তরুকে নিজের বুকের উপর রেখেই শুয়ে পরে তরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিছুসময় পর কুশল লক্ষ্য করে তরু ঘুমিয়ে গিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে তরুর ফর্সা মুখশ্রী হালকা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ এর নিচের অংশ আর গাল দু’টো স্বাভাবিক এর তুলনায় হালকা ফুলে উঠেছে। কুশল তরুর মুখশ্রীর উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। তরুকে দেখতে দেখতেই কুশলও ঘুমিয়ে যায়।
সকালবেলা….
তরুর ঘুম ভে*ঙে যায়। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে কুশলের বুকে আ*ষ্ঠে-পৃ*ষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে তরু। কুশল শক্ত ভাবে তরুকে জড়িয়ে ধরে থাকায় তরু একটুও নড়চড় করতে পারছে না বিধায় সে কুশলের বুকের উপর থুতনি রেখে ওর মুখশ্রীর উপর দৃষ্টি স্থির করতেই দেখে ওর সামনের দিকের কিছু চুল একটু লম্বা হওয়ায় তা কপাল পেরিয়ে চোখের উপর এসে পড়েছে। তরু কিছুসময় ওভাবে কুশলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর হালকা ভাবে ফুঁ দিয়ে ওর চোখের উপর এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তরুর এমন কাজে কুশলের ঘুম ভে*ঙে যায়। কুশলকে নড়তে দেখে তরু আবারও ওর বুকের উপর মাথা নুইয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভা*ন ধরে। কুশল চোখ মেলে তাকাতেই দেখে সে তরুকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। তরু ঘুমিয়ে আছে ভেবে কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“বুকের ভিতরটা ভিষণ অ*শান্ত হয়েছিলো। এই অ*শান্ত বুকে তুমি মাথা রাখায় ভিষণ শান্তি অনুভব হচ্ছে আমার তরুনিমা। ধীরে ধীরে তোমার প্রতি অনেক দূর্বল হয়ে পড়ছি আমি। এখন ভ*য় হয় যদি শ*ত্রু*রা তোমার কোনো ক্ষ*তি করে দেয় তখন আমার কি হবে! এই পৃথিবীতে তুমি ব্যতিত আর কেও নেই যে আমাকে আমার সবরকম পরিস্থিতিতে শান্তি দিতে পারে। তোমার প্রতি সৃষ্টি হওয়া এই অনুভূতিগুলোর নাম যদি ভালোবাসা হয় তবে হ্যা আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি তরুনিমা। অনেক অনেক বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাকে আমি কখোনই হারাতে চাই না। সারাজীবন এভাবেই আমার বুকের মাঝে আগলে রাখবো তোমায়।”
কুশলের মুখে এই প্রথম ভালোবাসার কথা শুনে তরুর হৃৎস্পন্দনের গতি স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বে*ড়ে গিয়েছে। পাশাপাশি তরু কুশলের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে থাকার কারণে কুশলের হৃৎস্পন্দনের উঠানামার ফলে হওয়া ধুক-পুক শব্দও সে শুনতে পারছে। অজান্তেই তরুর ঠোঁটে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠে।
(১৪২)
গোসল শেষ করে তোয়ালে দিয়ে ভে*জা চুলগুলো মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই নিজের বিছানার উপর রাজবীরকে আধশোয়া হয়ে বসে থাকতে দেখে সন্ধ্যা কিছুটা ভ*র*কে যায়। হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে জামার উপরে নিজের শরীরের উপরের অংশ ঢেকে নিয়ে বললো….
—“ছোটো ভাইয়া…এতো সকাল সকাল তুমি আমার রুমে কি করছো!”
সন্ধ্যার কন্ঠস্বর শুনতেই রাজবীর ঘাড় ঘুরিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সন্ধ্যার ভেজা চুলগুলো দিয়ে টপটপ করে পানি মেঝেতে পড়ছে। ঘাসের উপর পরা শিশির বিন্দুর মতো ওর মুখে ও গলায় বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। জানালা দিয়ে আসা সকালে মিষ্টি রোদ সন্ধ্যার মুখশ্রীর উপর পড়ায় জমে থাকা সেই বিন্দু বিন্দু পানিগুলো জ্বল জ্বল করছে। রাজবীর একদৃষ্টিতে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছে। রাজবীরকে এভাবে নিজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সন্ধ্যা ভিষণ ইতস্তত বোধ করে। পরক্ষণেই সন্ধ্যা বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রাজবীরের পায়ের কাছে রাখা নিজের ওড়নাটা নিতে ধরলে রাজবীর ওর কাজে বি*ঘ্ন ঘটিয়ে নিজে ওড়নাটা নিয়ে নেয়। সন্ধ্যার এবার ইতস্ততার মাত্রার পেরিয়ে রাগ লেগে যায়। তবুও সন্ধ্যা নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে বললো….
—“ছোটো ভাইয়া..ওড়নাটা দাও আমায়। এসব বিষয়ে মজা করা আমার একদমই পছন্দ না।”
রাজবীর সন্ধ্যার ওড়নাটা নিজের হাতে পেঁ*চা*তে পেঁ*চা*তে বাঁকা হেসে বললো…..
—“ছোট বেলায় তো আমার সামনে দিব্যি ওড়না ছাড়াই ঘুরে বেড়াতি তাহলে এখন কি সমস্যা!”
সন্ধ্যা দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো….
—“আমি এখন আর ছোট নেই। ভালোয় ভালোয় বলছি ওড়নাটা দাও।”
—“তুই চাইলে এখনও থাকতে পারিস আমার কোনো সমস্যা নেই।”
রাজবীর এর এমন নোং*ড়া মানসিকতার রূপ দেখে সন্ধ্যার রাগে ঘৃণায় সর্বশরীর তির তির করে কাঁপতে শুরু করে। অতঃপর সন্ধ্যা রাজবীরের থেকে ওড়না নেওয়ার আর কোনোরূপ চেষ্টা না করে ওয়ারড্রবের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ড্রয়ার খুলে অন্য আরেকটি ওড়না বের করে নিজের শরীরকে ভালোভাবে ঢেকে নিয়ে রাজবীরের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো….
—“আমরা মেয়েদের বড় হওয়ার পরও যখন ওড়না ছাড়া ঘুরলে তোমাদের মতো ছেলেদের কোনোরূপ স*ম*স্যা হবে না তখন নিজের হাতে থাকা ঐ ওড়নাটা এবার নিজের শরীরেই ভালোভাবে জড়িয়ে রাখো। এতে যদি সামান্য পরিমাণ লজ্জা-ভ্রম তোমাদের মতো মানসিকতার ছেলেদের ভিতর জন্মায় তাহলে ওড়নাটি নিজেকে ধন্য মনে করবে।”
এই বলে সন্ধ্যা দ্রুত কদমে ওর রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। সন্ধ্যার বলা এরূপ কথাগুলোর মানে বুঝতে রাজবীরের কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে যায়। মানে বুঝে উঠা মাত্র রাজবীর রাগে উচ্চস্বরে ‘আআআআহহহহহ’ বলে নিজের হাতে থাকা ওড়নাটা মেঝের উপর ছুঁ*ড়ে ফেলে দিয়ে বললো….
—“সেদিনের পুঁ*চ*কে মেয়ে আমাকে এতোবড় অ*প*মা*ন মূলক কথা শুনিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো! এই রাজবীর চৌধুরীকে অ*প*মা*ন করার ফল কতোটা খা*রা*প হতে পারে সে সম্পর্কে তো তোর কোনো ধারণাই নেই রে সন্ধ্যা। যেই শরীরকে ঢাকার জন্য তোর এতো চেষ্টা সেই শরীরের অবস্থা আমি…..!”
এতোটুকু বলেই রাজবীর স্বশব্দে হেসে উঠে।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
(থ্রিলার কাহিনী লেখা কতো সহজ🫤। আর এতোটুকু হালকা রোমান্টিক অংশ লিখতে গিয়েই আমাকে কতো চিন্তা করতে হলো কিভাবে সাজাবো না সাজাবো🎃 কপাল রেএএ😬)