#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪০)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৯৯)
বেশ লম্বা সময় ধরে জার্নি করার পর তাহির চৌধুরী মেনশনের মূল গেইটের পাশে এসে গাড়ি দাড় করিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে হুমায়রা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে গিয়েছে। অতঃপর তাহির আর হুমায়রাকে জাগানোর চেষ্টা না করে গাড়ি থেকে নেমে চৌধুরী মেনশনের মূল গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই নিজের চারপাশের পরিবেশটা রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারে আজ কোনো কারণে চৌধুরী মেনশনে আনন্দের মেলা জমেছে।
তাহির তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ধীরপায়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। একদিকে ভালোবাসার মানুষটিকে হারানোর বেদনায় এক প্রেমিক পুরুষের কলিজা পু*ড়ে ছা*ড়*খা*ড় হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে সেই মানুষটি বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা ছাড়াই শত শত মানুষের মাঝে আনন্দ মেলায় মেতে আছে। আহা প্রকৃতি কতোই না নিপুনতার সাথে নিজ কাজ সম্পন্ন করে যাচ্ছে। লোকজনের টুকটাক আওয়াজ কানে পড়তেই তাহির সেদিকে যেতে শুরু করে। পরক্ষণেই চৌধুরী মেনশনের পিছন সাইডে এসে দাঁড়াতেই শতশত মানুষের উপস্থিতিতে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ দেখতে পায় সে।
এই শতশত মানুষের ভিড়ে তাহিরের দু’চোখ শুধু একজনের মায়া মাখানো মুখশ্রী দেখার জন্য ছটফট করছে। তাহির যেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তার পাশেই ছোট্ট একটা স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র রাখা আছে। সেই স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে একজন মধ্যবয়সের পুরুষ লোক কারোর সাথে কলে কথা বলছে…..
—“আপনি এসব কি বলছেন মি.সায়মন হাসান! এই শেষ মুহূর্তে এসে আমি আরেকজন গায়কের ব্যবস্থা করবো কি করে? চৌধুরীদের থেকে ইতিমধ্যে আমি অর্ধেকের বেশি টাকা নিয়ে নিয়েছি। এখন এই অনুষ্ঠান পর্বে আপনার অনুপস্থিতির জন্য পুরো এরেঞ্জমেন্টই ন*ষ্ট হয়ে যাবে এটা আপনি বুঝতে পারছেন না কেনো?”
ফোনের ওপাশ থেকে সায়মন হাসান বললেন….
—“আই এম সরি মি.ইকবাল আকন্দ। পারসোনাল কিছু সমস্যার কারণে আমাকে শেষ মূহুর্তে এসে এই প্রোগ্রামটা কে*ন্সে*ল করতে হলো। আপনি যেকোনো ভাবে অন্য আরেকজন গায়কের ব্যবস্থা করে নিন। আমি এখন রাখছি।”
এই বলে সায়মন হাসান কল রেখে দেন। ইকবাল আকন্দের কপালে চিন্তার ভাঁ*জ স্পষ্ট হয়। কি করবে ভেবে না পেয়ে স্টেজের পাশে তাহিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে ইকবালের। ইকবাল মনে মনে ভাবলেন…..
—“এই ছেলেটাকে কোথায় যেনো দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছে আমার। কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে না কেনো?”
পরক্ষণেই ইকবাল ওর ফোনটা দিয়ে লুকিয়ে তাহিরের একটা ছবি তুলে গুগোলে প্রবেশ করে সার্চ অপশনে ছবিটি আপলোড করতেই কয়েক সেকেন্ডের ভিতর তাহিরের শত শত ছবি বেড়িয়ে আসে। তাহিরের ছবিগুলো দেখামাত্র ইকবাল চোখ বড়বড় করে তাহিরের দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললেন…..
—“২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরষ্কার লাভকৃত তওকির তালুকদার তাহির স্বয়ং চৌধুরী পরিবারের অনুষ্ঠান পর্বে উপস্থিত হয়েছেন! এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি লাভ হওয়ার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। এখন যেভাবেই হোক উনাকে আজকের অনুষ্ঠান পর্বে গান গাওয়ার জন্য রাজি করাতেই হবে আমায়। নয়তো চৌধুরীদের হাত থেকে নিজের প্রাণ বাঁচানোর আর কোনো রাস্তা আমার জন্য খোলা থাকবে না।”
এই বলে ইকবাল আকন্দ তাহিরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“এক্সকিউজ মি স্যার!”
তাহির ইকবালের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললো…
—“জ্বি..আমাকে বলছেন?”
—“জ্বি স্যার।”
—“হুম…বলুন!”
—“আমি আপনার গানের অনেক বড় ভক্ত স্যার। আগে আপনার গান অনেকবার শুনেছি আমি। কিন্তু গত ৫ বছর যাবৎ কোনো অনুষ্ঠান পর্বে আপনাকে গান গাইতে দেখি নি। এমনকি আপনার প্রোফেশনাল গানের পেইজেও কোনো নতুন গান রিলিজ হয় নি। তার কারণ আমি জানতে চাইছি না। কিন্তু আমি এই মুহূর্তে খুব বড় একটা সমস্যার মধ্যে ফেঁ*সে গিয়েছি স্যার। এই সমস্যা থেকে আমাকে একমাত্র আপনিই উদ্ধার করতে পারবেন স্যার।”
ইকবালের এরূপ কথা শুনে তাহির কিছুটা অবাক হয়ে বললো….
—“আমি কিভাবে আপনাকে সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে পারবো?”
—“আমি বড় বড় গায়কদের তাদের বাজেট অনুযায়ী টাকা দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ভাড়া করে নিয়ে আসি। সেখান থেকে যে স্বল্প পরিমাণ আয় হয় তা দিয়েই আমার সংসারের খরচ চালাতে হয়। আজ চৌধুরী পরিবারের বড় ছেলের স্ত্রী প্রেগন্যান্ট হওয়ায় এই আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন চৌধুরীরা। তাই সকালে আমাকে কল করে একজন ভালো গায়ককে আজকের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ইনভাইট করে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। আমি তাদের কথানুযায়ী বিশিষ্ট গায়ক মি. সায়মন হাসানকে ইনভাইট করেছিলাম। কিছুসময় পূর্বে সায়মন হাসান আমাকে কল করে বললেন উনি আজকের এই প্রোগ্রামে গান গাইতে আসতে পারবেন না। এদিকে আমি চৌধুরীদের থেকে অর্ধেকের বেশি টাকা নিয়ে আমার মেয়ের বিয়ের গহনা বানাতে স্বর্ণকারের কাছে জমা করে এসেছি। তাই এই শেষ মূহূর্তে এসে দাঁড়িয়ে এতোগুলো টাকা চৌধুরীদের ফিরিয়ে দিয়ে প্রোগ্রাম কেন্সেল করার কথা বলার সাহস ও আমি করে উঠতে পারছি না। তাই আপনি যদি দয়াকরে আজকের এই অনুষ্ঠান পর্বে মাত্র একটা গান গেয়ে দিতেন তাহলে চৌধুরীদের সামনে আমার সম্মানটা রক্ষা হতো স্যার। সারাজীবন আপনার এই ঋণ আমি মনে রাখতাম।”
দীর্ঘ ৫বছর পর আবারও কারোর আকুল কন্ঠে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে শুনে তাহির কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়। একদিকে তাহিরের মন-মানসিকতার অবস্থা ভালো না অন্যদিকে এতো বছর ধরে গান না গাওয়ায় ওর গানের কন্ঠ, সুর ও তাল ধরার ক্ষমতা যে ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে গিয়েছে এমনটাই তাহির ধারণা করতে পারছে। বেশ কিছুসময় পেরিয়ে গেলেও তাহিরের কোনোরূপ রেসপন্স না পেয়ে ইকবাল আবারও বললেন…..
—“স্যার….আপনি তো হ্যা বা না কিছুই বলছেন না। তাহলে আমি আপনার নিরাবতাকেই সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নিলাম!”
এই বলে ইকবাল তাহিরকে আর কোনোরূপ কথা বলার সুযোগ না দিয়েই স্টেইজ পাশে থাকা ছোট টেবিলের উপর থেকে মাউথ স্পিকারটা হাতে নিয়ে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন……
—“হ্যালো….হ্যালো….হ্যালো….লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যানস! চৌধুরী পরিবারে নতুন সদস্য আসার খুশিতে আজকের আয়োজিত এই পার্টিতে আপনাদের সকলের উপস্থিতি খুশির মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। তাই এই আনন্দময় পরিবেশের মাঝে খুশির মাত্রা আরো বাড়িয়ে তুলতে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী মি. তওকির তালুকদার তাহির। ওনার সুমধুর কন্ঠে একটি সুন্দর গান শোনার জন্য আপনারা প্রস্তুত তো!”
ইকবালের বলা কথা শুনে উপস্থিত সকলের মাঝে তাহিরের কন্ঠে গান শোনার জন্য উৎফুল্লতার মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এই পরিস্থিতি থেকে গান না গেয়ে বের হয়ে আসা তাহিরের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অগত্যা আর কোনো উপায় না পেয়ে তাহির একপ্রকার বাধ্য হয়েই স্টেজে উঠে মাইকের সামনে বসে পাশে থাকা স্ট্যন্ডের উপর থেকে গিটারটা হাতে তুলে নিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে গিটারের দিকে তাকিয়ে রয় কিছুসময়। অতঃপর তাহির গিটারে সুর তুলে গাইতে শুরু করে……..
❝বড় ইচ্ছে করছে ডাকতে ,
তার গন্ধে মেখে থাকতে ,
কেনো সন্ধ্যে সন্ধ্যে নামলে সে পালায়?
তাকে আটকে রাখার চেষ্টা ,
আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তেষ্টা ,
আমি দাঁড়িয়ে দেখছি শেষটা জানলায়।
বোঝেনা সে বোঝেনা (৪বার)
বোঝেনা (৬বার)❞
(১০০)
গানের স্টেইজ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকজন কম বয়সী মেয়ের সাথে গল্প করছিলো তরুনিমা। সেইসময় বেশ পুরোনো পরিচিত কারোর কন্ঠে গাওয়া গানের আওয়াজ ভেসে আসায় তরু গানের স্টেইজের দিকে তাকায়। স্টেইজের সামনে অনেক মানুষের ভীর হওয়ায় তরু তাহিরের চেহারা দেখতে পারছে না। ভীর ঠেলে ধীরপায়ে একটু একটু করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তরুনিমা। তরুর হৃৎস্পন্দনের গতি অজানা কারণে স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বেড়ে গিয়েছে, যার কারণ এই মুহূর্তে জানা নেই তরুর।
❝পায়ে স্বপ্ন স্বপ্ন লগ্নে ,
তার অন্য অন্য ডাকনাম ,
তাকে নিত্য নতুন যত্নে কে সাজায়?
সব স্বপ্ন সত্যি হয় কার!
তবু দেখতে দেখতে কাটছি ,
আর হাঁটছি যেদিক আমার দু’চোখ যায়।
বোঝেনা সে বোঝেনা (৪বার)
বোঝেনা (৬বার)❞
(১০১)
হুমায়রার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে চোখ মেলে সামনে তাকাতেই দেখে ওদের গাড়িটা কোথাও থামানো অবস্থায় আছে। গাড়ির ভিতরে তাহির নেই। হুমায়রা আন্দাজ করে তাহির হয়তো তরুনিমার সাথে দেখা করার জন্য চৌধুরী মেনশনে এসেছে। হুমায়রা তড়িৎগতিতে গাড়ি থেকে নেমে সামনে লক্ষ্য করতেই মূল গেইটের পাশে বড় বড় অক্ষরে ‘চৌধুরী মেনশন’ লেখা দেখতে পায়। ওর আন্দাজই সঠিক হয়। হুমায়রা নিজের মধ্যে কাজ করা সব সংকোচ বোধকে দূরে সরিয়ে চৌধুরী মেনশনের মূল গেইট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সেইসময় চৌধুরী মেনশনের পিছন সাইড থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসে। তাহিরের কন্ঠ চিনতে হুমায়রার ভুল হয় না। হুমায়রা একমুহূর্তের জন্য না দাঁড়িয়ে ছুট লাগায় সেদিকে।
.
.
.
তরুনিমা একেবারে স্টেইজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাহিরের দিকে তাকিয়ে পুরোপুরি ভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়। এতোবছর পর নিজের শ্বশুড় বাড়িতে তাহিরের উপস্থিতি দেখে তরুনিমা অবাক না হয়ে পারে না। তরুনিমার থেকে কয়েকহাত দূরে হুমায়রাও অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহির ওর দু’চোখ বন্ধ রেখে গান করছে…..
❝এটা গল্প হলেও পারতো ,
পাতা একটা-আধটা পড়তাম ,
খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখতাম তাকে।
জানি আবার আসবে কালকে!
নিয়ে পালকি পালকি ভাবনা ,
ফের চলে যাবে করে একলা আমা…….!❞
.
.
.
তাহিরের গান গাওয়া শেষ হওয়ার পূর্বেই তরুনিমা উচ্চস্বরে বলে উঠলো….
—“বন্ধ করুন এই গান গাওয়া।”
উপস্থিত সকলেই তরুর দিকে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাহির চোখ মেলে তাকাতেই নিজের সামনে বহুবছর পর নিজের না হওয়া প্রিয় মানুষটিকে রুক্ষমূর্তি রূপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় না। তরুনিমা তো এখনও আসল সত্যটা জানে না যে তাহির ওর বড় বোন অরুনিমাকে খু*ন করে নি। তাই এখন তাহিরকে নিজের চোখের সামনে দেখে তরুনিমার রেগে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ……….