হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৩) #Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

0
864

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৩)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১০৬)
ডাক্তার আকরামের কল পেয়ে কুশল দ্রুত নিজের আস্তানা থেকে বেড়িয়ে সৌহার্দ্যকে (নিলাদ্রের নতুন নাম সৌহার্দ্য ইশরাক) যেই ক্লিনিকে ভর্তি ছিলো সেই ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। বেশকিছুসময় ড্রাইভ করার পর সঠিক গন্তব্যস্থলে এসে পার্কিং সাইডে গাড়ি রেখে কুশল ক্লিনিকের ভিতরে প্রবেশ করে সরাসরি ডাক্তার আকরামের পারসোনাল কক্ষে চলে যায়। কুশল আকরাম সাহেবের কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি শান্ত স্বরে বললেন….

—“বসুন মি.কুশল চৌধুরী।”

কুশল শান্ত মুখশ্রী নিয়ে চেয়ারে বসে পরে। আকরাম সাহেব বললেন…..
—“আপনার ভর্তিকৃত পেশেন্ট মি.সৌহার্দ্য ইশরাকের কিছুসময় পূর্বেই জ্ঞান ফিরেছে। আপাতত কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ ইনজেক্ট করে ওনাকে ঘুমিয়ে রাখা হয়েছে। আর চিন্তার কোনো কারণ নেই। ওনার যে ক্রি*টি*ক্য*ল অবস্থা ছিলো তাতে এতো তাড়াতাড়ি ওনার সেন্স ফেরার আশা আমরা করি নি। সম্পূর্ণই আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমত বলতে পারেন। যেহেতু ওনার সেন্স ফিরে এসেছে তাই আগামী পরশু সকালেই ওনার মুখে থাকা ব্য*ন্ডে*জটি আমরা খুলে ফেলতে পারবো। ওনার প্লা*স্টি*ক সা*র্জা*রি করা হয়েছে তাই নতুন চেহেরা দেখার পর উনি হয়তো কিছুটা অস্বাভাবিক আচারণও করতে পারেন। তাই পরশু সকালে ওনার শুভাকাঙ্ক্ষী আরো যদি কেও থাকেন তাহলে তাকে নিয়ে আপনাকে এখানে উপস্থিত থাকতে হবে।”

কুশল কিছুটা চিন্তিত ভাব নিয়ে বললো….
—“সৌহার্দ্যের স্মৃতিশক্তি লো*প পাওয়া নিয়ে কোনো রি*স্ক আছে কি ডাক্তার সাহেব!”

—“যেহেতু ভিষণ বা*জে ভাবে ওনার এ*ক্সি*ডে*ন্টটি হয়েছিলো তাই ওনার স্মৃতিশক্তি লো*প না পাওয়ার বিষয় নিয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিয়তা দিতে পারছি না আপনাকে। তবে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ভালোকিছুরই আশা রাখুন।”

—“জ্বি, আমি তাহলে এখন উঠছি।”

—“ঠিক আছে।”

অতঃপর কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে আকরাম সাহেব এর কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যায়।

(১০৭)
তমালিকা সিকদার এর মুখে তাহিরের বলা সব কথা শোনার পর তরুনিমার মনেও তাহিরকে নিয়ে ভালো খারাপ দুইরকম চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে। তরুনিমা মনে মনে ভাবে…….

—“তাহিরের জন্যই আজ কুশল সুস্থাবস্থায় চলাফেরা করছে এটা তো মিথ্যে নয়। যদি তাহির মনে মনে খারাপ বা অসৎ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আজ চৌধুরী মেনশনে আসতো তাহলে প্রথমত বি*ষা*ক্ত ঔষধী সেবন করার হাত থেকে আমাকে আর দ্বিতীয়ত নিজের প্রাণকে ঝুঁ*কি*র সামনে ফেলে কুশলকে বাঁচাতো না। পাঁচ বছর আগে বড়পুর মৃ*ত্যু*র দিন শুধুমাত্র তাহিরের হাতে র*ক্ত মাখা ছু*ড়ি*টি দেখেই আমরা সবাই ওকেই বড়পুর খু*নি বানিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। একটা বার পুরো বিষয়টা যাচাই করে দেখারও প্রয়োজন মনে করি নি। তবে কি তাহিরকে আমি বা আমরা যে ঘৃ*ণ্য নজরে দেখি তা শুধুমাত্রই ভু*ল বোঝাবোঝির থেকে সৃষ্টি হয়েছে! উফহহহ আমার মাথা কাজ করছে না। কোনটা ঠিক আর কোনটা যে ভু*ল তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। এখন এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে তাহিরের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই মনে হয় সঠিক হবে।”

এই বলে তরুনিমা ঘাড় ঘুরিয়ে ও.টির সামনে রাখা চেয়ারে বসারত হুমায়রার দিকে তাকায়। হুমায়রাকে এখনও কান্না করতে দেখে তরুর মাঝে বেশ খারাপ লাগা কাজ করছে। পরক্ষণেই তরুনিমা একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হুমায়রার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তমালিকা ও তারেক সিকদার সেখানেই রাখা চেয়ারে পাশাপাশি বসে পরে। তরুনিমা হুমায়রার পাশে গিয়ে বসে শান্ত স্বরে হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“তুমি তাহিরের কে হও!”

হুমায়রা অশ্রুসিক্ত নয়নে তরুর দিকে একপলক তাকিয়ে পরপরই দৃষ্টি সরিয়ে মেঝের উপর স্থির করে বললো….

—“কাজিন।”

—“ওহহ।”

—“তুমিই সেই না, যাকে শেষ বারের মতো একপলক দেখার জন্য তাহির ওনার কাছে নত হয়ে বাচ্চাদের মতো কান্না করে অনুরোধ করেছিলো!”

হুমায়রার এমন কথায় তরু কিছুটা অবাক হয়। হুমায়রা একহাতে নিজের দু’চোখের পানি মুছে নিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো…..

—“আজ অনুষ্ঠান পর্বে পরপর ২বার যাচ্ছে তাই বলে তুমি যাকে অ*প*দ*স্থ করলে সেই মানুষটার কারণেই তোমার সোহাগের মানুষটা সুস্থাবস্থায় চলাফেরা করতে পারছে স্বস্তির সাথে প্রতিটি নিঃশ্বাস ফেলছে। তোমার সোহাগের মানুষটাকে বাঁচাতে গিয়ে আজ সেই ঘৃ*ণ্য মানসিকতার মানুষটা নিজের জীবন-মৃ*ত্যু*র সাথে ল*ড়া*ই করছে। এমন পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়ে কি তোমার মধ্যে অনুশোচনা বোধ কাজ করছে! আজ ঐ মানুষটাকে এতোটা অ*প*মা*ন মূলক কথা না শুনালেও হয়তো চলতো এমন চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে তোমার মাঝে! নাকি এমনটা ভাবছো আজ যদি ঐ মানুষটা আর জীবিত অবস্থায় অপারেশন থিয়েটার থেকে বের ই না হতে পারে তবে তার কাছে আর ক্ষমা চাওয়া হবে না তোমার। নিজের মনের উপর থাকা পাহাড় সমতুল্য বোঝাটা কখনই আর নামাতে পারবে না। সারাজীবন এই বোঝাটাকেই বয়ে বেড়াতে হবে তোমায়।”

হুমায়রার এরূপ কথাগুলো শুনে তরু যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রতিত্তোরে ওরও যে কিছু বলা উচিত তা বোঝার ক্ষমতাটুকুও যেনো তরুর ভিতর থেকে লোপ পেয়ে গিয়েছে। হুমায়রা চোখ তুলে সামনের দিকে লক্ষ্য করতেই কুশলকে হেঁটে হেঁটে ও.টির দিকে অগ্রসর হতে দেখে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যত্র দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।

কুশল এসে ও.টির সামনে দাঁড়ানোর কিছুসময় পর পরই ও.টির দরজার উপর জ্বলতে থাকা লাল বাতিটি নিভে যায়। পরক্ষণেই ও.টির ভিতর থেকে একজন পুরুষ ডাক্তারকে বেড়িয়ে আসতে দেখে হুমায়রা বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তমালিকা আর তারেকও ওদের কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ান। কুশল শান্ত স্বরে বললো…

—“ডাক্তার…তাহিরের অবস্থা এখন কেমন!”

ডাক্তার নিজের চেহারার উপর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট রেখে বললেন….
—“ওনার বুকের বাম পার্শে বি*দ্ধ হওয়া গু*লি*টি আমরা বের করেছি। কিন্তু ওনার অবস্থা ভিষণ সমীচীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুসময় পর ওনাকে আই.সি.ইউ তে সিফট করা হবে। আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবো ওনাকে বি*প*দ*সীমা থেকে বের করে আনার। কিন্তু আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে যদি ওনার সেন্স না ফেরে তাহলে আমাদের আর করার কিছুই থাকবে না। আল্লাহর কাছে ওনার সুস্থতা কামনা করুন। এখন উনিই একমাত্র ভরসা।”

এই বলে ডাক্তার চলে যান। হুমায়রা ধপ করে চেয়ারের উপর বসে পরে আবারও কান্না করতে করতে বললো…..

—“সব শেষ হয়ে গেলো, সব….সবটা শেষ হয়ে গেলো। আমার তাহিরকে আজ ঐখানে আসতে দেওয়াই উচিত হয় নি।”

হুমায়রার এমন কথা শুনে কুশল কিছুটা অ*প*রা*ধী দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকায়। তরুনিমা নিজের মধ্যে থাকা সকল সং*কো*চ বোধকে দ*মি*য়ে রেখে আবারও হুমায়রার পাশে বসে। হুমায়রা কিছুটা রাগ নিয়ে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে তরুকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“চলে যাও তুমি আমার সামনে থেকে। তোমাকে আমার একটুও স*হ্য হচ্ছে না। তোমাকে দেখলেই আমার চোখের সামনে তাহিরের য*ন্ত্র*ণা দায়ক মুখশ্রী ভেসে উঠছে।”

তরুনিমা মুখে কিছু না বলে হুমায়রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। হুমায়রা প্রথমত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও পরপরই হাল ছেড়ে দিয়ে হু হু করে কান্না করতে থাকতে। অজানা কারণে তরুর দু’চোখ ও নোনাজলে ভরে উঠে।

(১০৮)
নিজের ঘরে মুখশ্রী জুড়ে বি*ষ*ন্ন*তা ছাপ ফুটিয়ে রেখে ফ্রেমে বাঁধা নিলাদ্রের একটা ছবি হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা ছবির উপর হাত বোলাতে বোলাতে অভিমানের স্বরে বললো….

—“আজ কতোদিন হলো আপনাকে একপলক দেখার জন্য আমার দু’চোখ ও মন যে কতোটা ছটফট করছে আপনি তে সেই খবর রাখেন নি আর না রাখার প্রয়োজন মনে করেছেন। যেদিন মেজো ভাইয়া আমাকে আপনার কাছে নিয়ে যাবে সেদিন আপনার সব কর্মের হিসাব সু*দে-আসল উশুল যদি না করেছি তবে আমার নামও সন্ধ্যা চৌধুরী নয়। আমাকে এতোটা য*ন্ত্র*ণা দেওয়ার অধিকার আমি আপনাকেও দেই নি। আপনি আপনার সীমা ল*ঙ্ঘ*ণ করেছেন। তাই যথাযথ শা*স্তিও আপনাকে পেতে হবে। সেই শা*স্তি আমি নিজ হাতে দিবো।”

—“কাকে শা*স্তি দেওয়ার কথা বলছিস তুই দিদিভাই?”

আকস্মিক নিজের পিছন থেকে সাগরিকা চৌধুরীর কন্ঠস্বর শোনামাত্র সন্ধ্যা কিছুটা ভরকে গিয়ে ওরণার নিচে নিলাদ্রের ছবিটা আড়াল করে দাদীমার দিকে ঘুরে বসে হাসিমুখে বললো….

—“আমার একজন বান্ধবী কল করেছিলো একটু আগে।
আজ সন্ধ্যাতেই ওর জন্মদিনের পার্টি ছিলো। কিন্তু আমি তো বড় ভাবীর জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানের কারণে সেখানে যেতে পারলাম। তাই আগামীকাল বিকালেই যদি আমাকে আলাদা ভাবে ট্রিট দেওয়ার ব্যবস্থা না করে তাহলে ওকে আমি কঠিন শা*স্তি দিবো।”

সেইসময় সাবরিনা ও কামিনী হাসিমুখে সন্ধ্যার রুমে প্রবেশ করে। সাবরিনা শান্ত স্বরে বললো….

—“আগামীকাল তোর বাসার বাহিরে যাওয়া বারণ সন্ধ্যা।”

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে সন্ধ্যা অবাক স্বরে বললো…
—“কেনো মা?”

কামিনী বিনুনী নাড়াতে নাড়াতে সন্ধ্যার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ওর দু’গাল টেনে দিয়ে নিজের বত্রিশপা*টি দাঁত বের করে বললো….

—“কারণ আগামীকাল তোমাকে দেখতে আসবে।”

সন্ধ্যা অত্যন্ত অবাক হয়ে বললো….
—“দেখতে আসবে মানে! কি বলছো কি তোমরা এসব?”

কামিনী সন্ধ্যার সামনে থেকে সরে দাঁড়াতেই সাবরিনা বললো….
—“এই সামান্য বিষয় নিয়ে এতোটা অবাক হওয়ার কি আছে সন্ধ্যা! বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স হয়ে গিয়েছে তোমার। ভালো বংশ, ভালো ছেলের সন্ধান যেহেতু পেয়েছি তাই তোমাকে বিয়ে দিতে তো আমাদের কারোরই কোনো দ্বিমত নেই।”

—“কিন্তু মা…!”

—“কোনো কিন্তু না সন্ধ্যা। আগামীকাল ছেলেপক্ষ তোমাকে দেখতে আসবে আর তুমি ভদ্র ভাবে তাদের সামনে যাবে এটাই আমার শেষ কথা।”

সন্ধ্যা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে সাগরিকা চৌধুরীর দিকে তাকায়। সাগরিকা চৌধুরী শান্ত স্বরে বললেন….

—“আহা আমার নাতীনটার উপর রাগ হইও না তো তুমি মেজো বউমা। আমি বুঝাইয়া কইতাছি ওরে। তোমরা যাও দেখি এখন এইখান থেকে।”

—“হুম…আপনার নাতনীকে সঠিক বুঝ দিন মা। ছোট চল এখন, অনেক কাজ পরে আছে।”

এই বলে সাবরিনা ও কামিনী দু’জনেই সন্ধ্যার রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। সাগরিকা চৌধুরী সন্ধ্যার পাশে বসতেই সন্ধ্যা সাগরিকা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। সাগরিকা চৌধুরী সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত স্বরে বললেন….

—“তুই কি কাওকে পছন্দ করিস দিদিভাই! যদি করে থাকিস তাহলে নির্দ্বিধায় আমাকে তার কথা জানাইয়া দে। কুশল দাদুভাইকে দিয়ে তার সকল খোঁজ-খবর নেওয়ার পর যদি বুঝি ছেলেটা ভালো তাহলে ঐ ছেলের সাথেই তোর বিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করমু।”

দাদীমার মুখে এমন কথা শুনে সন্ধ্যার বুক ভে*ঙে কান্না বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়। কিন্তু অনেক ক*ষ্টে সন্ধ্যা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ নিলাদ্র যে বেঁচে আছে এই কথা বাহিরের আর কোনো ব্যক্তির কাছে প্রকাশ না করা নিয়ে কুশল ও তরুর কড়া নি*ষে*ধা*জ্ঞা রয়েছে। তাই নিজের পছন্দের পুরুষ থাকা স্বত্বেও তাঁকে সবার সামনে আনা এইমূহূর্তে সন্ধ্যার পক্ষে অসম্ভব।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here