ওগো_মনোহারিণী ( #রৌদ্র_মেঘের_আলাপন ) [১৬] লেখনিতে : তাসলিমা নাসরিন

0
585

#ওগো_মনোহারিণী ( #রৌদ্র_মেঘের_আলাপন ) [১৬]
লেখনিতে : তাসলিমা নাসরিন

— এ.সি আর এস.সি দু’জন একই ! ”

সিয়ার মুখে এইরুপ কথা শুনে ছোটোখাটো এক বিস্ফোরণ হলো যেনো সবার মনে। সবাই উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে সিয়ার পানে। তারা সহ এমনকি পুলিশ প্রশাসনে এই এ.সি র ভয়ে অনেকেই নিজেদের বাজে ধান্দা বন্ধ করে সঠিক পথে এসেছে। এ.সি আর এস.সি দু’জনেই বেশ নামকরা। কিন্তু তারা দু’জন কীভাবে এক হতে পারে ? একজন তো পুলিশ প্রশাসন মেইন্টেইন করে আরেকজন মেডিকেল + সিক্রেট গোয়েন্দা।

সবার মনে যে হাজার প্রশ্ন তা তাদের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই বোঝা যাবে। আর তা সিয়া বলে উঠে-

— আরে রিলাক্স। কুল ! কুল ! ”

— দিদিভাই কি বলছো তুমি ? ”

— হ্যাঁ দাদু ভাই। ”

সিয়া ইশারায় দু’টো গার্ডকে বলে রেহানা আর আরাভ চৌধুরী কে আরো দু’টি চেয়ারে বেঁধে দেয়। এদিকে আরাভ চৌধুরী অবাকের চরম পর্যায়ে। তারই গার্ড অন্য একজনের আদেশে তাকেই বাঁধছে। অপমানে তার গা রি রি করছে। তখন উঠে এসে কিছু বলতে যাবে তখনি সিয়া বলে উঠে-

— আরে নেওয়াজ শেখ উপস ওরফে আরাভ চৌধুরী আই মিন আমার সম্মানিত বাবা। চিন্তা করে করে বিপি লো করলে চলবে না কতো কাহিনী আপনাকে জানানোর আছে । স্বীকার করার আছে আমার পরিবারের কাছে। ”

সেটা শুনে আরাভ চৌধুরী খানিক টা দমে গেলেন। তখন বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে রাগ নিয়ে বলে-

— আমার গার্ডেরা তোমার কথা কেনো শুনছে ? ”

— ওরা আমার গার্ড ডিয়ার আংকেল ! ”

এই কথা শুনে সিয়ার দাদুভাই বলে উঠে-

— দিদিভাই কি একবার বাবা আরেকবার আংকেল আরেকবার নেওয়াজ শেখ। বুঝিয়ে বলবে প্লিজ ? ”

— হ্যাঁ হ্যাঁ দাদুভাই কেনো নয় ? তবে আরেকটু ওয়েট করো আরোহী, আবির, আমার শশুড় শাশুড়ী, স্বামী , কাকিমনি,কাকামনি আর পৃথা আপু আসুক। সবারই জানার অধিকার আছে। ”

এ কথা শুনে আরাভ চৌধুরী চমকে গেলেন আর শুকনো গলায় ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন-

— কি,কিসের সত্যি হ্যাঁ ? একরত্তি মেয়ে বাবাকে সম্মান করতে জানো না আর এখন বড় বড় কথা বলছো ? লজ্জা করেনা ? ”

— আপনি বাবা ? তাও আমার ! ওয়াও , এই সবাই হাততালি দাও। অনেক ভালো জোক্স বলেছে আংকেল। ”

এই বলে সিয়া একটা চেয়ার টেনে বসে। পড়নে তার জিন্স,স্পোর্টস শু, হুডি। পকেট থেকে একটা কিছু হাতরিয়ে সেটা খেতে লাগলো ! সেটা আর কিচ্ছু না। কিটকাট। ওর খাওয়ার মাঝেই কেউ একজন বলে উঠে-

— বনু ! এক ফালি চকলেটের ভাগ দে আংকেল কে ! অনেক সুন্দর জোক্স। আমরাও শুনেছি। ”

— হ্যাঁ তা তো অবশ্যই। কিইইই !! না না আমার চকলেটের ভাগ কাউকে দেবো না। কিন্তু ,,,! দাদা ভাইইইইইই ! ”

“দাদাভাই” বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে। পুরো চকলেট মুখে দিয়ে দৌড়ে গেলো একটি ছেলের নিকট। তাকে জড়িয়ে ধরেই আভিমানির সুরে বলতে লাগলো –

— এতোক্ষন লাগে দাদাভাই ? সেই কখন থেকে এদের মাঝে বসে বসে বোরিং হচ্ছিলাম। পেটের কথাগুলো গুতুগুতি করছিলো যে। ”

— হ্যাঁ এখন চলে এসেছি। আস্তে আস্তে বের কর। ”

ভাইয়ের কথা শুনে আশপাশ তাকিয়ে দেখে পুরো পরিবার এসেছে । পুরো পরিবার বলতে সিয়ার মতে অনুপস্থিত ছিলো যারা কিংবা যাদের আসার কথা ছিলো। তবে সিয়ার বাদে সকলের অচেনা দু’টি মুখ এসেছে সাথে। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে সবার বসার ব্যবস্থা করা হলো। পরিবারের লোকেরা সবটাই জানে যে বসে থাকা লোকজন কারা। তবে পুরোটা সবাই জানতে চায় সিয়ার থেকে , কারন সিয়া মেয়েটা বড্ড লড়াই করেছে। আরাভ আর রেহানার মুখ বেধেঁ দিয়ে সিয়া-ও বসলো বলতে –

— সবাই আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবে । ”

সিয়ার কথা শুনে সকলেই সিরিয়াসলি হয়। শুধু রেহানা এবং আরাভ চৌধুরী বাদে। সিয়া সেসব তোয়াক্কা না করে বলতে শুরু করে-

— আমার আরোহী চৌধুরী। আরাভ চৌধুরী’র বড় মেয়ে। আমিই এ.সি কিংবা এস.সি। এ.সি পূর্ণরূপ হচ্ছে আরোহী চৌধুরী। আর এস.সি হলো সিয়া চৌধুরী। আমার মা অয়না চৌধুরী যিনি এই মুহূর্তে আমার সামনেই আছেন কিন্তু আমার বাবা নেই। আমি পেশায় একজন সফল নিউরোলজিস্ট ডক্টর , সিক্রেট সিআইডি অফিসার , নরমাল সিআইডি অফিসার।

এখানে অনেকেরই প্রশ্ন থাকবে যে আমি এতোগুলো জব আমি কি করে করি ! তাহলে শোনাই আমার লড়াইয়ের গল্প। আমার বয়স যখন ১০ তখন আমি জানতে পারি যে আমি যাদের কাছে থাকি তারা আমার আসল মা-বাবা নন। মায়ের সাথে তাদের নাকি গভীর সম্পর্ক।

তাদের সন্তান না থাকায় আমাকে অস্বীকার করার ব্যাপারটা তারা জেনে যায় আর আমাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসে। আর তবে থেকেই ছোট্ট মনে প্রতিবাদ আর প্রতিশোধ নিতে চাইতাম। কিন্তু আমার স্কুলে মাস্টারমশাই একদিন বলেছিলেন যে –

“ প্রতিষ্ঠিত হও আগে , তারপর সব কাজের প্রতিশোধ সবাই নিতে পারে। তবে হ্যাঁ প্রতিশোধ শুধু খারাপ নয় ভালো দিক-ও আছে। ”

মাস্টার মশাইয়ের কথাটা মাথায় গেঁথে বড় হতে লাগলাম। পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলাম বেশ। আর আমার পালিত মা-বাবাদের ও বুঝতে দেইনি যে আমি সত্যিটা জেনেছি একটু। এভাবেই মেডিকেল শেষ করলাম।আর তারপরেই দাদুভাই আমাকে একটা বুদ্ধি দেয়। তিনি নিজেও সিআইডি থাকায় আমাকে উপযুক্ত করে তার রেফারেন্সে-ই আমি দু’টো পদে ঢুকতে পেরেছি। এতে অবশ্য আমার যোগ্যতা টাও ছিলো অনেক।

আর হ্যাঁ ! আমার ব্যাপারে দাদুভাই ই আমার পালিত বাবা-মাকে দেয়। যেনো আমি সুরক্ষায় থাকতে পারি। কারন আমার বাবা আরাভ চৌধুরী আমার নামে জন্মের আগে থেকেই উইল করেছিলেন। যেখানে এইরকম টা লেখাছিলো যে আমার ২৫ বছর হলে আমার বাবার পুরো সম্পত্তি আমি নিজের হাতে পাবো। আর বাবার সম্পত্তি সম্পর্কে সবারই ধারনা ছিলো। বাবা বরাবরই চেয়েছিলেন একটা সন্তান নিতে। কিন্তু আমরা হয়েছিলাম টুইন। মা জানার আগেই এক বাচ্চাকে সরিয়ে নিয়েছিলেন দাদুভাই। তাকে বোর্ডিং এ রেখেই মানুষ করা হয়। আর মা তখনি জানে যে আরাভ চৌধুরী তার গর্ভধারণের ৮ মাসের মাথায় মারা যান। কিন্তু যিনি আরাভ চৌধুরী আছেন তিনি বাবার বেস্টফ্রেন্ড নেওয়াজ শেখ। বাবার মুখের মতো সার্জারি করিয়েছেন। আর এক্সিডেন্টের বাহানায় বললেন যে তার কন্ঠ বদলে গিয়েছে। মা সন্দেহ করলে তাকে ইঞ্জেকশন পুশ করে পাগল বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায় নেওয়াজ শেখ। তাই দাদুভাই কে দিয়ে বুদ্ধি করে অন্য এক ওষুধ ওই বোতলে ঢুকিয়ে দিই কিন্তু নাম একি থাকে। তারপর মাকে জানানো হলে মা ও পাগলামো করার ভান ধরে। তারপরেই আনা হয় দাদুভাইদের নিকট।

আর এই ভয়ংকর সত্য টা জানায় আমার দাদুভাই। তিনি সিআইডি হওয়াতে তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি কাউকে। তারই সহয়তায় তারই প্লেনে আমি আজ এখানে। তিনিই আমাকে সব ব্যবস্থা করে দেন। আর নিজেও না জানার ভান করেন। নয়তো কবেই মেরে ফেলতো এই নেওয়াজ শেখ। ”

এইটুকু বলেই থেমে গেলো সিয়া। সকলের চোখেই পানি। সিয়া পাশে থাকা বোতল থেকে কয়েক বোতল পানি ঢকঢক করে গিলে ফেললো। তার গলা শুকিয়ে এসেছে যে। আর নিজেরই কাহিনী শুনে খানিকটা অবাক হয় তিনি। এরা তো তার থেকেও বড় প্লেয়ার।

এবার অন্য একজন বলতে শুরু করে –

— আমি আহিয়ান চৌধুরী। আরাভ চৌধুরী’র বড় ছেলে। আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে সেই বোর্ডিং এ বড় হতে হয়েছে। সেটা করেছে দাদাভাই-ই। আর আমিই সিয়ার জমজ ভাই। আমি সিয়ার থেকে ১৫ মিনিটের বড়। মূলত আমাকে আকঁড়ে-ই ও এতোদিন টিকে ছিলো। ”

আহিয়ানের কথা শুনে সকলে একপ্রকার চমকিত হলো। কারন এই ব্যাপারটা কেউ জানতোনা। তবে কিছু মানুষের মুখে তৃপ্তির হাঁসি।

—চলবে 🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here