এক_সমুদ্র_প্রেম! লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (০৫)

0
204

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৫)

সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ বাড়ি। অথচ বসার ঘর ভর্তি মানুষে। সামান্যতম জায়গা হয়ত ফাঁকা! রাত প্রায় দশটা বাজে। এক ঘর মানুষের মধ্যে গম্ভীর চোখমুখ নিয়ে বসে আছেন সিকদার বাড়ির তিন কর্তা। তাদের ঠোঁটে বিন্দুমাত্র হাসির দেখা নেই। আফতাব সিকদারের ভাবভঙ্গি হ*তাশ,বি*ধ্বস্ত। মানুষ হিসেবে আমজাদ ঠিক যতটা গর*ম, ধূসরের বাবা ঠিক ততটাই নরম আর শান্ত গোছের। ছেলের একেকটি কাজে তার আক্ষেপ নিরন্তর। উনিই সবচেয়ে বেশি ভ*য়ে থাকেন,পূত্র নিয়ে ভাইয়েদের ক*টু কথা শোনার।

কাঠগড়ায় ধূসর ভাই। অহেতুক আর অযৌক্তিক বিচারকার্য চলছে তার ঘটানো অনাকাঙ্ক্ষিত কাজটি নিয়ে। ধূসরের প্রিয় ডার্ক মেরুন রঙের গাড়িটি বিক্রিতেই ,আহা*জারি সবার। এমনকি পিউয়েরও সমান মন খারাপ । কেন ধূসর গাড়িটা বেঁচে দিলো সে নিজেও বুঝতে পারছেনা। তার প্রিয় রং মেরুন, সাথে তার ধূসর ভাইয়ের গাড়িও মেরুন। অতীব পছন্দের এই গাড়িটি ধূসর ভাই এইভাবে বেঁচে দেবেন ব্যাপারটা মোটেই খুশি হওয়ার মত কিছু নয়।

বসার ঘরের এক কোনায় ঠোঁট উলটে দাঁড়িয়ে পিউ। ওড়নার কোনাটা আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে একবার তাকাল ধূসরের দিকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো,এই যে ও এমন একটা কান্ড ঘটাল, অথচ বিন্দুমাত্র হেলদোল দেখা যাচ্ছেনা। কী নিরুদ্বেগ, গা ঝাড়া ভাবভঙ্গি! পিউ মুখ ভেঙচায়। কী দরকার ছিল গাড়িটা বেচার? হুহ!

এতক্ষণের রাশ*ভারি পরিবেশটির রেশ কাটালেন আমজাদ। হাস্যহীন কন্ঠে বললেন,
” আমাকে একটা কথা পরিষ্কার করে বোঝাবে ধূসর?’

ধূসরের আঙুলের মাথায় বাইকের চাবি ছিল। এতক্ষন ধরে টুংটুং করছিল সেটা নিয়ে। তাকাল এইবার।
তিনি বললেন,
” গাড়ি বিক্রি কেন করলে?”
ধূসর ওপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চে*পে ধরল। অন্যদিক তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলে আবার ফিরল চাচার দিক। বিরক্তি চেপে ধীরস্থির জবাব দিল,

” বলেছিতো চাচ্চু,ভালো লাগছিল না গাড়ি।”
” তোমার জবাব আমার উপযুক্ত মনে হয়নি। ভালো লাগছিল না বলে কেউ গাড়ি বেচে দেয়? বাইকের দরকার,কিনতে ইচ্ছে করেছে বেশ,কিনেছো। ভালো কথা সেটা। তাই বলে গাড়ি কেন বেচবে।ওটাও থাকতো! ”

রুবায়দা পাশ থেকে উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
” আমারও তো একই কথা! এরকম করার কোনও মানে হয় বলুন তো ভাইজান । ঘরের জিনিসপত্র বেঁচাকেনা এসব কি ভালো না কী? আচ্ছা,তুমি কিছু বলছোনা কেন? কথা কি ফুরিয়ে গেছে?”

কথাটুকু স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি । আফতাব ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বড় দুঃ*খ নিয়ে বললেন,
” কী বলব? তোমার ছেলে কি আমার কথা শোনে?”

রুবায়দা তৎক্ষনাৎ জ্ব*লে উঠে বললেন,
” এখন আমার ছেলে বলছো কেন? যখন স্কুল/কলেজের রেজাল্ট কার্ড দেখতে,তখন তো সারাবাড়ি নাঁচতে নাঁচতে বলে বেড়াতে ‘ আমার ছেলে,’ ‘আমার ছেলে’ । ভালো কিছু করলে ছেলে তোমার, আর তোমার মনঃপুত কাজ নাহলেই ছেলে হয়ে যায় আমার,তাইনা?”

আফতাব মুখ দিয়ে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করলেন,
” এক কথার মধ্যে আরেক কথা ঢুকানোর স্বভাব কি কোনও দিন যাবেনা তোমার? আমি কী বলছি আর তুমি কী বলছো? কথা না বুঝে উত্তর দিচ্ছো কেন?”

” আমি যা বুঝেছি ঠিকই বুঝেছি। তুমি…”

সবাই গোল গোল চোখে ঝ*গড়া দেখছিল দুজনের। ধূসর কন্ঠ খানিক উঁচু করে বলল,
” চুপ করবে তোমরা? ”
কথাটুকুন সম্পূর্ণ করতে ব্যর্থ হলেন রুবায়দা। গিলে ফেলে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ওমন। ধূসর কপাল গুছিয়ে বলল,
” আমি বুঝলাম না,একটা সামান্য বিষয় নিয়ে তোমাদের এত স*মস্যা কেন হচ্ছে? আমার ইচ্ছে হয়েছিল গাড়ি কিনেছিলাম,ইচ্ছে করল বিক্রি করলাম,সিম্পল! ”
পিউ চোখমুখ কুঁচ*কে আরো একবার ভেঙচি কাটল। বিড়বিড় করল,
‘ ব্যাপারটা এতটাও সিম্পল না বুঝলেন! আপনি যে আস্ত একটা নি*র্বোধ, আবারও তার প্রমান দিলেন হুহ।’
আনিস মুখ খুললেন এবার। নম্র কণ্ঠে বললেন,
” হ্যাঁ, কিন্তু থাকলে কী হতো,দুটোই ব্যাবহার করতে….”

” আমি তো অনেকবার বললাম ছোট চাচ্চু,গাড়ি ভালো লাগছিল না। আর যে জিনিস আমার পছন্দ নয় সেটা আমি আমার কাছে রাখিনা। আমার মনে হয়, এ নিয়ে অহেতুক মাতামাতি করছো তোমরা। ”

” এসব তোমার অহেতুক মনে হচ্ছে?”

আমজাদের কথায় ধূসর মুখের ওপর বলল,
” হ্যাঁ, হচ্ছে। আমার ব্যাপারটা আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক?”

চেহারা থমথমে হয়ে এলো ভদ্রলোকের । ধূসর আবার বলল,
” গাড়ি আমি আমার স্কলারশিপের টাকায় কিনেছিলাম। কারোর টাকা ন*ষ্ট করিনি। তাই তোমাদের এসব বাড়াবাড়ি যুক্তিহীন! ”

সোজাসাপটা জবাবটায় ভাষাহীন সকলে। বিরাট দানবীয় একখানা তালা যেন ঝুলে পড়ে ঠোঁটে। কেউই আর উপযুক্ত উত্তর খুঁজে পেলো না। ধূসর মিনার দিকে চেয়ে বলল,
” তুমি টেবিলে খাবার দাও বড় মা,আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

এক মুহুর্ত আর দাঁড়ায়না সে। শব্দযুক্ত কদমে ঘরের দিক রওনা করল। তার যাওয়ার দিক চেয়ে দীর্ঘ*শ্বাস ফেলল পিউ। ধূসর গাড়ি কিনেছে এ অবধি দুটো। প্রথমে দেশে ফিরেই কিনেছিল একটা ধবধবে সাদা গাড়ি। এর মাস খানেক পরে সেটা ছোট চাচ্চুকে দিয়ে দিল। তারপর হুট করে কিনে আনল মেরুন রঙের এই চকচকে গাড়িটা। যেটা চলছিল প্রায় বছর তিনেক। সবার উদ্দেশ্যে ঘোষণাও করেছিল গাড়িটা ওর ভীষণ শখের! আর তাই পরিবারের কেউ সে গাড়িতে উঠতে পারেনি। তার শখের গাড়ি মানে সে একাই ব্যবহার করবে। এমনকি রুবা-আফতাবও যেখানে ঠাঁই পেলেন না, সেটাই আজ বিক্রি করল ছেলেটা। ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে না!

পিউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল এসব। ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক ব্যস্ত হিসেব মেলাতে। পরপর কী ভেবে হঠাৎই সচকিত হয় ও। বড় চোখদুটো, কোটর ছড়িয়ে আসে অন্যরকম চিন্তায়।
‘ এক সেকেন্ড! সেদিন আমি সাদিফ ভাইকে বলেছিলাম আমার গাড়ির থেকে বাইক ভালো লাগে! ধূসর ভাই কী এনি হাউ সেটা শুনতে পেয়েই এই কান্ড ঘটালেন? আমার জন্যেই কী এসব?’

পিউ নড়েচড়ে দাঁড়াল। সতর্ক ভঙিতে,বিদ্যুৎ বেগে ধূসরের রুমের দিকে ফিরল। ধূসর ভাই কি আমাকে খুশি করতেই এরকম করলেন? এর মানে ওনার অনুভূতি আছে আমার প্রতি?
পিউয়ের স্বপ্ন পূরনের উদ্ভট এই ভাবনা লতাপাতার মতন বেঁয়ে চলল নিমিষে। তৎক্ষনাৎ পা বাড়াল ওর কামড়ায়। এই রহস্যের সত্যতা যতক্ষণ না জানবে,ঘুম তো দূর, শান্তিতে বসতে অবধি পারবে না। আনচান আনচান মন নিয়ে ছুট লাগাতে গেল পিউ। হুট করে পেছন থেকে হাত টেনে ধরল সাদিফ। ও কপাল কুঁচ*কে ফিরলে,ফিসফিস করে শুধাল,
” কোথায় যাচ্ছিস?”
মহাবিরক্ত হলো পিউ। এই লোক আসলেই একটা ডিস্টার্ব। ও যাচ্ছে জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আর মূল্যবান একটা কাজে, অথচ ব্যাটা ঠিক বাগড়াটা দিয়ে দিল? পিউ বিদ্বিষ্টটুকুন ঢেকে রাখে। ওপর ওপর ভীষণ সভ্য মেয়ে সে। ভদ্রভাবে বলল,
” আসছি একটু। ”

ওপাশ থেকে উত্তরের আশায় রইল না। নিজেই সাদিফের হাতখানা ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে উঠে গেল সিড়িতে।

ঝড়ের বেগে ধূসরের ঘরের সামনে হাজির হলো পিউ। দরজা চাপানো। ও আস্তে করে মাথা নামিয়ে উঁকি দেয়। ভেতরটা দেখে আবহাওয়া বোঝার চেষ্টা চালায়।
‘ কী করছেন উনি? ঢুকব এখন? যা কান্ড ঘটল নিচে রে*গে টেগে নেইতো? ‘
পিউয়ের বিভ্রান্তির মধ্যেই ভেতর থেকে ছুটে এলো একটি হিম-হিম আওয়াজ,
” অভদ্রের মতো উঁকি না মেরে ভেতরে ঢোক।”

পিউ চমকে ওঠে। গোল চোখে চায়। পরপর বুকে হাত দিয়ে জোরে নিঃশ্বাস টানল দুবার। নিজেকে তৈরী করল প্রিয় ধূসর ভাইয়ের মুখোমুখি হতে। ছাদের দিক চেয়ে বিড়বিড় করল,
” হে আল্লাহ! দেখো,ওনাকে যেন ঠিক ঠিক প্রশ্ন করতে পারি।”

তারপর গুটিগুটি পায়ে ঢুকল ভেতরে। ধূসর ফ্রেশ হয়েছে। পড়নের শার্ট পালটে টি-শার্ট পরেছে এখন। পিঠ ফেরানো এদিকেই । পিউ ঘন-কালো পল্লব ঝাপটাল।
‘উনি অন্যদিকে ফিরে আমাকে কী করে দেখলেন?’

ধূসর ঘুরে চাইল। ছোট করে শুধাল,
” কিছু বলবি?”
তার ব্যস্ত প্রশ্ন,সাথে গায়ের পেস্ট রঙের টিশার্টে, শক্তপোক্ত, দারুণ চেহারাখানা মাথা গুলিয়ে দিলো পিউয়ের। এক লহমায় ভুলে বসল সব। মাথা নাড়ল দুদিকে। পরক্ষনে সজাগ হয়ে দাঁড়াল। মনে পড়ল, না সেতো বলতেই এসছে। রা করার আগেই ধূসর বলল,
” তাহলে কী আমার চেহারা দেখতে এসেছিস?”

পিউ হা করতে গিয়েও,তত্র মুখটা বন্ধ করে ফেলল। ভাবল,
‘কথাটা যে একেবারে ভু*ল, তা কিন্তু নয়। আপনার চেহারা দেখার শর্তে যদি সারাদিন ভাত না খেতে দেয়,আমি তাতেও রাজি। আপনার এই রুপের আ*গুনে কবেইত ঝ*লসে গেছি ধূসর ভাই!
তার ভেতরের মুগ্ধতা ভেসে উঠল ঠোঁটে। ধূসর চোখ ছোট করে বলল,
” বোঁকার মত হাসছিস কেন?”

পিউয়ের সদ্য ফোটা রঙীন হাসি,এন্টেনার ন্যায় ঝিরঝির হয়ে এলো সহসা। ঘনঘন মাথা নাড়ল ফের। অ*ধৈর্য ধূসর, চ*টে গেল এতে। ক*টম*ট করে বলল,
” তোর মুখ নেই? কথা বলতে পারছিস না?”

তার নিরেট চোয়াল দেখেই পিউ তটস্থ হয়ে দাঁড়ায়। মিনমিন করে
ব্যস্তভাবে বলল,
” কিছু না,কিছুনা।”

” কিছু না হলে যা এখন। তোকে না বলেছিলাম,আমার রুমের ধারেকাছে না আসতে? খুব অবাধ্য হচ্ছিস পিউ। কী ভাবছিস? চাচ্চু ফিরেছেন বলে কিছু বলব না? ভ*য় পাই ওনাকে? ”

ধূসরের আকষ্মিক এই ক্ষ্যা*পাটে রুপটায় পিউয়ের আদলে আমাবস্যা নামে। আস্তে করে বলল,
” কখন বলেছি এ কথা?”

ধূসর চোখ পাঁ*কাল, ” তুই বের হবি?”

পিউয়ের নড়বড়ে সম্মানে আঘাত হানল এইবার। এরপরে আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয়না এখানে। সে কী অত ক্যা*বলা,মানসন্মান হীন না কী? এমন ভাব করছে যেন রুম নয়,রাজার সভা। সে অদৃশ্য চো*টপাট দেখিয়ে সত্যি সত্যিই ঘুরে হাঁটা ধরল। ভাবখানা এমন, যে ওনার ছায়াও মারাব না আর। অথচ দরজা অবধি গিয়েই পা জোড়া থ*মকে গেল কেমন! পুরনো অনুভূতি গর্যে উঠল সজোরে। জো*রদার দাবী জানাল, “একবার জিজ্ঞেস কর পিউ, একবার জেনেই নে না,তোর ধারনা ঠিক কীনা!”

সেই ক্ষনে ঘুরে তাকায় সে। সেকেন্ডে ধূসর মুখ ঘোরাল আরেকদিক। পিউ ধৈর্য হীন কন্ঠে শুধাল,
” আপনি কি গাড়িটা আমার জন্যে বেঁচেছেন ধূসর ভাই? ”

ও তাকাল। খুব অবাক হয়ে বলল,
” তোর জন্যে বলতে…!”

পিউ জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। মনের প্রশ্নটা সাজিয়ে-গুছিয়ে মুখ ফুঁটে করতে পারলে হয়! আমতা-আমতা করে বলল,
” না মানে… সাদিফ ভাইয়ের বাইকে ওইদিন___”

” তুই আজ কলেজ যাসনি শুনলাম।”
তার প্রশ্নটুকুন পূর্নতা পেলনা। পালটা প্রশ্ন ছু*ড়ে আট*কে দিলো ধূসর। পিউ তার ক্ষুদ্রাকার চোখের দিক সরু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
” কার কাছে শুনেছেন?”

ধূসর গুঁটিয়ে রাখা ডান ভ্রুঁটা নাঁচিয়ে বলল,
” জবাব দিহিও চাইছিস আজকাল? ইম্প্রেসিভ!”

পিউ উদ্বেগ নিয়ে বলল,
” না না তা বলিনি। আমি আসলে জানতে এসেছিলাম যে…..”

ধূসর এবারেও থামিয়ে দিল। পথিমধ্যেই বলল,
” বাড়িতে বলব,ইদানীং কান ধরে কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকছিস? ”

শীতল হুমকিতে ভ্রু কপালে তুলল পিউ। এই কথা পরিবারের কেউ জানলে স*র্বনা*শ। ঘটনা একদিনের, অথচ ওকে ক্ষে*পিয়ে মারবে সারাটাজীবন। আর বাবা? উনি জানলে সঙ্গে সঙ্গে কলেজে যাবেন,খোঁজ নেবেন। কেন ওনার মেয়ে কান ধরল তার তদন্ত করবেন! তারপর কোনও ভাবে ম্যাম যদি বলে দেয় খাতা ভরে ধূসর ভাইয়ের নাম লিখে ধ*রা খেয়েছিল বলে? ইয়া মা’বূদ! সে থাকলেও তার মাথাটা থাকবেনা। পিউ বি*মুর্ত লোঁচনে চেয়ে রইল ধূসরের দিক। কী সাংঘা*তিক লোক! কী ধু*রন্ধর!
ধূসর ফের ভ্রুঁ উঁচায়,
” বলব?”

পিউ শুকনো ঢোক গিলে দুদিকে মাথা নাড়ল। কাচু*মাচু চেহারায় অনুরোধ জানাল,
” না। প্লিজ!

ধূসর বুকের সঙ্গে হাত বেঁধে দাঁড়াল। বলল,
” বেশ! তাহলে ঠিক পাঁচ গোনার মধ্যে রুম ছাড়বি। আর এই গাড়ি বেঁচা-কেনার ব্যাপার নিয়ে ভবিষ্যতে কোনও দিন তোকে যেন মাথা ঘামাতে না দেখি। মনে থাকবে?”

পিউয়ের বিগত কয়েক মিনিটের স্ফুর্ত মনটা ঝুপ করে খা*রাপ হলো এবার। আহত হয়ে ভাবল,
‘ আপনি মানুষটা এমন অনুভূতিহী*ন,উদাসীন কেন ধূসর ভাই? আমি যে কী বলে, কী বোঝাতে চেয়েছি,চেয়ে এসেছি,তা কী কোনও দিন বুঝবেন না? নাকী বুঝেও ভাণ করেন না বোঝার!’

তার চিন্তাভাবনার মধ্যেই ধূসর গুনে উঠল,
” এক, দুই….
পিউ ভেতর ভেতর ক্ষিপ্ত হয়। ধূসরের পাতলা ওষ্ঠে একটা স্কচটেপ পেঁচিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু ফেলে আসা তর্জণ ভেবেই তার পাঁচ গোনার পূর্বেই ভীষণ জো*রে দৌড়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

সচেতন দুরুত্বে এসে দেয়াল ধরে দাঁড়াল পিউ। ধূসরের প্রতি রা*গে টগ*বগ করছে শরীর। এত্ত ভাব কীসের? ভালোবাসে বলে মাথা কিনে নিয়েছে না কি? মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে ধূসরের চৌদ্দ গোষ্ঠীকে গা*লি দিয়ে উড়িয়ে দিতে। শুধু সেটা নিজেরও গোষ্ঠি বলেই ,পারেনা,ব্যর্থ হয়।

________

সেই রাত কাটল। ধূসরের গাড়ির ব্যাপারটা ধামাচা*পা পরল তার ঠান্ডা আচরনের তলায়। কিন্তু পিউয়ের মন খা*রাপ গেল না। মাঝে-মধ্যে মনে হয় সে হয়ত একটু বেশিই ছ্যাচ*ড়ামো করে ফেলছে। একটা ছেলের প্রেমে এত পা*গল হওয়ার কিছু নেই। তারপর সুদৃ*ঢ় মনে প্রতিজ্ঞা করল,
” কাল থেকে আর ধূসর ভাইয়ের জন্যে এমন করবনা। ওনাকে দেখলেও ফিরে তাকাব না।”

আফ*সোস! সে কাল আর ওর আসেনা। মেয়েটা আজেতে ডুবেছে। আর সেই আজকের পুরোটা ঘিরে ধূসর ভাই। তার আদ্যপ্রান্ত জুড়ে ধূসর ভাই। কিশোরি মনের, বিরাট তটিণী-র কানায় কানায় স্রোত আসে ধূসর ভাইয়ের নামে। এক মুঠো রঙিন পৃথিবীর সবটাই যে ধূসরময়!
আচ্ছা, সে কী সময় কা*টানোর জন্যে প্রেমে পড়েছে? না, একদমই নয়। পড়েছে অনুভূতির কবলে পরে। তাহলে সেই প্রেমে পাগলামো থাকবে না,তো কী থাকবে?
এই একটা চিন্তাই পিউয়ের সকল দৃঢ় শপথের দেয়াল খানখান করে ভে*ঙে দেয় প্রতিবার। পারেনা,কোনও ক্রমেই পারেনা নিজেকে সামলাতে। এই দোষ কী ওর? না,এই অপরাধ সম্পূর্ন সেই মানুষটার, যে এত বি*শ্রী ভাবে ওকে আসক্ত করেছে তার প্রতি।

পিউ ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। শীতের সময় হলেও দুপুর বেলা বেশ কড়া রোদ। তারপর কলেজের ইউনিফর্মেই গর*ম লাগতে যথেষ্ট। ছুটির প্রায় আধঘন্টা, কিন্তু এখনও বাড়িতে পৌঁছায়নি। গাড়ির তেল শেষ। ড্রাইভার গিয়েছেন তেল ভরতে। সে অ*ধৈর্য মানুষটা কীভাবে এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবে? গাড়ি এলে এই রাস্তা দিয়েই আসবে। পিউয়ের মন-মস্তিষ্ক হাঁটতে হাঁটতেও যখন ধূসরকে নিয়ে ব্যস্ত,পিছু হতে কেউ ডাক ছুড়ল,

“এই যে, মিস পিউপিউ! ”
চেনা পুরুষালি স্বরে পিউ ঝটপট ঘুরে চাইল। গাড়ির জানলা থেকে মাথা বের করল আগন্তুক। পরিচিত,সুতনু চেহারাটা দেখেই ঠোঁটে হাসি ফুটল ওর। ওপাশের মানুষটা হৈহৈ গলায় বলল,
” কী খবর আপনার? একা একা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন কই? সঙ্গী দরকার?”

পিউ হৃষ্ট চিত্তে শুধাল,
” কেমন আছেন ভাইয়া?”
ইকবাল মাথা দোলাল,
” মা*রাত্মক ভালো আছি। তোমার কী খবর? ”

” এইতো আলহামদুলিল্লাহ! আজকাল বাসায় কেন যাচ্ছেন না? ”
” সে বলছি, তার আগে বলো তুমি হাঁটছো কেন? গাড়ি কই?”

পিউ কাঁধ উঁচু করে জানাল,
” তেল শেষ। ”
ইকবাল বলল,
” ও, তাহলে আর হেঁটে লাভ নেই। এসো, আমি পৌঁছে দিচ্ছি। ”
সঙ্গে গাড়ির দরজাও খুলে দিল সে। পিউ বিনাদ্বি*ধায় উঠে বসল সেখানে। ইকবাল, তার ধূসর ভাইয়ের ছোট্ট বেলার বন্ধু। একেবারে গলায় গলায় দোস্তি। সেই নার্সারি থেকে একসঙ্গে পড়াশুনা করেছে দুজন। মাঝে মাঝে তো এই ইকবালটাকেও হিং*সে হয় পিউয়ের। ধূসরের কলিজার টুক*রো হচ্ছেন ভদ্রলোক। এত মাখোমাখো প্রেম এদের! এর এক ফোঁটা যদি ওর প্রতি থাকত। যা করবে, একসাথে। ঈদে পাঞ্জাবিও কিনবে একইরকম।

সে অনেক আগের কথা,একবার মিছিলে গিয়েছিল দুজন। তাও স্কুল জীবনে প্রথম বার। আর সেই খবর পৌঁছে গেল সিকদার বাড়িতে। তারপর ধূসরকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিয়েছিলেন আমজাদ। বন্ধুকে ওইভাবে মার খেতে দেখে কেঁ*দেকে*টে বুক ভাসিয়েছিল ইকবাল। আমজাদের পা অবধি ধরেছিল প্রহার ঠেকাতে।
ওসব এখন অতীত! এখন সেই আমজাদকেই ধূসর পা*ত্তা দিচ্ছেনা। তার একটা কথাও কানে তোলেনা। পিউ মনে মনে ভাবল,
‘আচ্ছা, বিদেশ থেকে ফিরলে মানুষ বুঝি ভ*য়ড*র ও ফেলে আসে? তাহলে আমারও কি একবার বিদেশ যাওয়া উচিত? আমিও না হয় সব আ*তঙ্ক রেখে এসে একদম, ধূসর ভাইয়ের চোখের দিক চেয়ে বলে দেব ” আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

” কী ভাবছো? এই পিউপিউ!’

পিউ নড়ে উঠল। গহীন ধ্যান ছুটে গেল ইকবালের ডাকে । অপ্রস্তুত হয়ে চাইল ওর দিক। গাড়ির ভেতরে এসির ঠান্ডা বাতাস বইছে। ইকবাল ভ্রুঁ গুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ এত কী নিয়ে চিন্তা করছিলে শুনি?”

” না, তেমন কিছুনা।
আচ্ছা, আপনি বাড়ি আসেন না কেন, বললেন না তো!”

সে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
” দুটো কারণে যাইনা।
এক, সামনে মেয়র নির্বাচন, অনেক ঝা*মেলা। আর দুই,তোমার বাবা।”
পিউ চোখ সরু করতেই বলল,
” সে তো রাজনীতির নাম শুনলেও চেঁ*তে যায়৷ আমাকে দেখলে বিরাট কপাল চলে আসে একজায়গায়। তাই ভাবি ওনাকে একটু শান্তি দেই। আপাতত চোখের সামনে না যাই। আমি ভাই এখন মনে প্রানে একজন রাজনৈতিক নেতা। একটা গোটা জেলার সভাপতি হয়েছি যেখানে,সেখানে ভাবতে পারছো আঙ্কেলের মুখের অবস্থা কী হবে আমায় দেখলে? চেয়ার টেয়ার ছু*ড়ে না মা*রলে হয়!

পিউ হেসে ফেলল।
” এটা কিন্তু অজুহাত হয়ে গেল ভাইয়া। বাবা মোটেই এরকম নন। উনি তো ধূসর ভাইকেও দেখতে পারেন না। দিন রাত ওনার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেন রাজনীতি ছাড়ো,ব্যবসায় আসো। কই উনি তো এক কান দিয়ে ঢুকাচ্ছেন অন্য কান দিয়ে বের করছেন। তাহলে? ”

ইকবাল চক্ষু কপালে তুলে বলল,
” কে ধূসর? ওতো ওর নামের মতোই। ওর খা*রাপ লাগা, ভালো লাগা কিচ্ছু বোঝা যায়না। মাঝেমাঝে আমিই দ্বিধায় ভুগি ও রাগ করে না কি খুশি হয়! মানুষ এতটা নিরুদ্বেগ কী করে হয়? আমি ওর মতো নই বাবা! যে দেখেও না দেখার ভাণ করব,আবার কিছু জিনিস বুঝেও না বোঝার নাটক করব।”

পিউ আগামাথা বুঝল না। তার জিজ্ঞাসু চেহারা দেখে ইকবাল হাসল। বিজ্ঞের মত মাথা দুলিয়ে বলল,
” বড় হও পিউ,সব বুঝবে।’

পিউয়ের মেজাজ সাং*ঘাতিক বিগড়াল এবার। সবাই কেন কানের কাছে এই একটা কথা বলছে?সে কি ছোট? ফিডার তো খায়না। ভালোবাসার মতন কঠিন বিষয়বস্তু বোঝে, তাহলে?

ইকবালের ফোন বাজল তখন। কথা বলায় ব্যস্ত হলো সে। পিউ রাস্তার দিক ফিরল। ইকবালকে ওদের পরিবারের সবাই চেনে। ওকেও আদর করে ভীষণ। ইকবালের সাথে যতটা জড়োতাহীন সে মিশতে পারে,এমন নিজের ভাই ছাড়া হয়না। ইকবাল লাইন কাটল কথা শেষে।
জিজ্ঞেস করল,
‘ ধূসর কি বেরিয়েছি বাড়ি থেকে? জানো?”
পিউ ক্ষনশ্বর ভেবে বলল,
” আমি তো দেখিনি আজ। হতে পারে!”

ইকবাল মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বলল,
” বড় ঝা*মেলায় আছি বুঝলে! রাজনৈতিক ঝ*ঞ্জাট এমন আগাছার মতন,ছড়িয়ে পরলে ছা*টাই করতে জান বেরিয়ে যায়। ধূসরটা সাথে আছে বলে একটু ভরসা পাচ্ছি,নাহলে কীভাবে যে ম্যানেজ দিতাম গড নোস! ”

” কী ঝামে*লা ভাইয়া? ”

” বলে শেষ করা যাবেনা রে পিউপিউ! সামনে মেয়র নির্বাচন না? বিপক্ষ দলের সাথে বড়সড় ঠান্ডা যু*দ্ধ চলছে। যে কোনও সময় ভ*য়াবহ রুপ না নিলে হয়!”

” এত ঝুঁ*কির কাজ কেন করেন আপনারা? ছেড়ে দিলেই তো হয়!”

ইকবাল হাসল,যেন মজার কিছু শুনেছে। বলল,
” বোঁকা মেয়ে! বি*পদ তো সব জায়গায় থাকে,তাই বলে নিজেদের প্যাশন ছেড়ে দেব? শোনো,রাজনীতি হচ্ছে আমার আর তোমার ধূসর ভাইয়ের প্যাশন। আমার তো মনে হয় রাজনীতি আমাদের র*ক্তে মিশে। আমি আর ধূসর বরাবর অন্য কারো ঔ*দ্ধ্যত স*হ্য করতে পারিনা। না পারি অনুপযুক্ত,অযোগ্য লোকের নেতৃত্ব মেনে নিতে। তোর মনে আছে কী না জানিনা,কারন তুমি তখন ছোট খুব, সেই ক্লাশ টেন থেকে আমরা নেমেছিলাম এই পথে। তারপর প্রথম যখন মিছিলে নেমে ধূসর ধরা পরল বাড়িতে? সেবারই তো তোমার বাপ মশাই বেধ*রম মে*রেছিলেন ওকে। তারপরেও যখন ফিরল না ধূসর,বিদেশ পাঠাল ওকে। কিন্তু কী হলো? রাজনীতি কী পারল ছাড়াতে? হা হা হা!

ইকবাল সশ্বব্দে হাসল। ঠাম দেহ হেলেদুলে ওঠে। কিন্তু পিউয়ের হাসি পেলনা। এটা কী হাসির ব্যাপার? মোটেইনা।

ইকবাল হেসে-টেসে চুপ করল। হঠাৎই প্রশ্ন ছুড়*ল,
” তুমি ধূসর কে পছন্দ করো পিউ?”

পিউ আশ্চর্য বনে চাইল। বৃহৎ চোখ বিস্ময়ে নি*ক্ষেপ হলো ওর পানে। ইকবাল মিটিমিটি হেসে ভ্রুঁ নাঁচায়,
” কী? করো? ভালো-টালো বাসো?”

পিউ হা টুকু বুজে নেয়। ধাতস্থ হয়ে, দুপাশে মাথা নেড়ে বোঝায়,” না”।
হাস্যরসিক ইকবাল এতেও হাসল। শব্দ পেলেও না চেয়ে শক্ত হয়ে বসে রইল পিউ।

” মিথ্যে বলো না মেয়ে! তোমার চোখ দেখলে বোঝা যায়,তুমি ধূসর কে ভালোবাসো।”

পিউ দ্বিতীয় দফায় অবাক হয়। ইকবালের দৃঢ়তা দেখে খুব আগ্রহ নিয়ে শুধায়,
” আসলেই তাই?”
” অবশ্যই! ”

পিউ চিন্তায় পড়ে গেল। সত্যিই কী হয় এরকম? তার চোখ দেখে বোঝা যায় সে ধূসর ভাইকে ভালোবাসে? তাহলে উনি কেন এতদিনেও বুঝলেন না?

পিউয়ের চোখমুখ দেখে মজা পেলো ইকবাল। হুহা করে হেসে উঠল সহসা। নীরব গাড়িটায় হাসিটা এদিক সেদিক ছুটে বেড়াল। পিউ লজ্জ্বা পায়। নিম্নাষ্ঠ চেপে মিহি স্বরে শুধায়,
” তবে উনি কেন বুঝতে পারেন না ভাইয়া?”
ইকবালের হাসিটা চলে গেল হঠাৎ। গুরু*ভার কণ্ঠে জবাব দিল,
” কী জানি! সেতো ধূসরই জানবে,ওর মনে কী আছে,বা কে আছে!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিউ। ধূসর ভাইয়ের মনটা যদি একটু চি*ড়ে দেখা যেত,এতটা বিভ্রান্তিতে তার দিন-দুনিয়া খোয়াতো না।

গাড়ি এসে থামল সিকদার বাড়ির সামনে। ইকবাল বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিলে, আপ্লুত হাসল পিউ। কত বড় মাপের মানুষটাও কতটা গুরুত্ব দিল ওকে! সাথে আফসোস হলো খুব, ইকবাল কেন ওর নিজের ভাই হলোনা!
বড় বলতে আছে একমাত্র সাদিফ৷ সে লোক এমন যত্ন তো দূর, তাকে নিয়ে ভাবে কী না সন্দেহ! মাথায় ঘুরপাক খায় ওকে খাটি*য়ে মা*রার কথা। পিউ পানি দে,পিউ তোয়ালে এনে দে,চা নিয়ে আয়,শার্ট ধুতে দিয়ে আয়, উফ!

ইকবাল মিষ্টি হেসে বলল,
” যাও। পড়াশুনা ভালো করে করবে। সামনে পরীক্ষা না? এ প্লাস চাই কিন্তু!

” সে ঠিক আছে,কিন্তু আপনি কী আজও বাড়িতে ঢুকবেন না ভাইয়া? এভাবে দরজায় এসে ফিরে যাবেন? ”

ইকবাল হাতঘড়ি দেখে বলল,
” আজ যাব না, অন্য সময়। আমি আসি এখন…”
পিউ তীব্র আপ*ত্তি জানিয়ে বলল,
” মোটেইনা। চলুন…”

ইকবাল মাথা নাড়ল। ভেতরে এখন যাবে না। পিউ ততটাই জো*র করছে। তার বাবা এখন বাড়িতে নেই। তাহলে অসুবিধে কোথায়? ওদের বাকবিতন্ডার মধ্যেই ধূসর বেরিয়ে এলো। শোনা গেল তার নিরেট স্বর,
” কী ব্যাপার? তুই?
এক যোগে তাকাল ওরা। তাকে দেখেই ফটাফট ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়াল পিউ। উবে গেল সব চনমনে ভাব। ইকবাল এতেও ঠোঁট চে*পে হাসে। জবাব দেয়,
” এইতো এলাম। তোর ফুলটুসি বোনটা রাস্তায় হাঁটছিল,মায়া হলো দেখে তাই গাড়ির তেল পু*ড়িয়ে পৌঁছে দিলাম বাড়িতে। তোর বোনের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে না বল!”

পিউ উৎসুক হয়ে চাইল ধূসরের দিক। বুঝতে চাইল ওর অভিব্যক্তি। এই যে ইকবাল ভাই বারবার বোন বোন বলছে ওনার কি খা*রাপ লাগছেনা? তারতো লাগছে। কিন্তু না, এবারেও এক মুঠো হতাশা ছুঁয়ে দিল ওকে। ধূসর চট করে ওর দিক তাকায়, পরপর ফট করে ধমকে বলে
” হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে যা।”

পিউয়ের সরু নাক ফেঁপে ওঠে। এই শুরু হলো! দেখলেই হয়েছে ওকে। এই লোক মনে হয় ধম*কা ধম*কি সবসময় পকেটে নিয়ে ঘোরে। সে এলেই বের করে ছুড়ে মারবে বলে। পিউ মুখ কালো করতেই ইকবাল মায়া করে বলল,
” আহা ব*কছিস কেন? বাচ্চা মেয়ে! থাক পিউপিউ,তুমি মন খা*রাপ করো না।”

এই সান্ত্বনায় তার মন খা*রাপ লাঘব হলোনা। ছোট করে বলল,
” আসি ভাইয়া। ”

তারপর পা বাড়াল বাড়ির ভেতর। পেছন থেকে হঠাৎই ধূসরের একটা কথায় লম্বা কদম স্থিত হলো। সে বলতে যায়
” তোকে না বলেছি,পিউকে আমার বো___
কী সম*স্যা তোর? যেতে বললাম না ?”

পিউয়ের বুক ছ্যাত করে কাঁপে! এইরে,ব্যাটা ঠিক লক্ষ্য করেছে সে কান পেতে ছিল? ফের একটা রামধ*মক খেয়ে আর দাঁড়ানোর সা*হসে কূলোলানো ওর। এক ছুটে ঢুকে গেল বাড়িতে।

সিড়ি অবধি এসেই পিউয়ের পা জোড়া থেমে গেল হঠাৎ। কিছু একটা খেয়াল করে ঘাড় কাঁত করে ফিরে চাইল। পরের দৃশ্যে কপালে ভাঁজ পরে। পুষ্প বসার ঘরের জানলা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। পর্দা আগলে উঁকি দিচ্ছে। কী দেখছে এভাবে? পিউ আগ্রহভরে আস্তে আস্তে এসে পেছনে দাঁড়াল। ওর চোখ,ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে দেখল। সেখানে ইকবাল আর ধূসরকে ব্যাতীত বিশেষ কিছু খুঁজে পেলো না। দুজন দাঁড়িয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। তাহলে এইভাবে মেয়েটা দেখছে কী? পিউ কৌতূহল মেটাতে জিজ্ঞেস করল,
” কী দেখছিস?”
ভূত দেখার মতন চমকে চাইল পুষ্প। পিউকে দেখতেই চোর ধ*রা পরার ন্যায় চেহারা হয়। ঢোক গিলল সবেগে । হাসার চেষ্টা করে বলল,
” কিছু না। কিছুনা। ”
” তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ”
পুষ্প চোরা চোখে একবার ধূসরদের ওদিকটায় দেখল। পরপর তড়িঘড়ি কদমে চলে গেল ঘরে। পেছনে রেখে গেল, ব্যক্কল হয়ে চেয়ে থাকা পিউকে।

______

সেদিন সন্ধ্যায় একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। প্রতিদিনকার মত বিকেলে পিউয়ের টিউটর এলেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র সে। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠা থেকে পড়াচ্ছ ওকে। মিনা নীচ থেকেই হাঁক ছাড়লেন,
” পিউ! তোর স্যার এসছেন। ”
মেয়েটা ঝিমুচ্ছিল ঘুমাবো বলে। মায়ের ডাকে তটস্থ হয়ে বইখাতা গুছিয়ে বসল। ছেলেটার নাম ফয়সাল। বয়সে সাদিফের ছোট হবে। কক্ষে ঢুকলে, দাঁড়িয়ে সালাম দিলো পিউ। সে শুভ্র হেসে বলল,
” বসো।’
নিজেও পাশের কেদারায় বসতে বসতে বলল,
” কেমন আছো?”

” ভালো আছি স্যার। আপনি? ”
” তোমার চুলের এই অবস্থা কেন?”
পিউ কুণ্ঠায় মিইয়ে আসে। অগোছালো চুলে হাত বুলিয়ে মিনমিন করে জানায়,
” ঘুমিয়ে পরেছিলাম একটু।”

ফয়সাল মুচকি হাসল,
” তাও খারাপ লাগছেনা দেখতে। যাক গে,কী পড়বে আজ? কেমিস্ট্রি? ”
” আপনার যা ইচ্ছে।”
রসকষহীন রসায়ন বইটা স্যারের কাছে এগিয়ে দিল সে। ফয়সাল পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চাইল ওর দিক। বলল,

” তুমিতো কেমিস্ট্রিতে ভালো। রিয়্যেল লাইফেও ভালো না কী!”
পিউ বোঝেনি। প্রশ্ন করতে গেলে আচমকা চোখ পড়ল দোরে। ধূসর দাঁড়িয়ে। এদিকেই চেয়েছিল। পিউ তাকানো মাত্রই গটগটিয়ে রুমে ঢুকে গেল নিজের। এই সময় সে বাড়িতে থাকেনা,আজ দেখে খানিক অবাক হলো পিউ।

ফয়সাল তাগাদা দিলো পড়ায়। মনোনিবেশ না চাইতেও সেদিকে চলে গেল ওর।

***
বসার ঘরে তখন চায়ের আসর বসেছে সন্ধ্যের। আয়োজনে বাড়ির গৃহীনিরা। ফয়সাল চলে গিয়েছে পড়ানো শেষে। পিউ নীচে এসে পুষ্পর পাশে বসল।
না বলতেই, কাপ ভর্তি চা এগিয়ে দিল সে। সামনের সোফায় আম্মু,মেজো মা,ছোট মা, সেজো মা গল্প জুড়েছেন। সুমনা তার প্রিয় সিরিয়ালের খলনায়িকাকে বকাঝকা করছেন!
পাশে খেলছে রাদিফ আর রিক্ত। এর মধ্যে ধূসর নেমে আসে। ওকে দেখেই রুবায়দা বললেন,
” চা খাবি ধূসর?”
পিউ আড়চোখ তুলে চাইল। শ্যাম বর্ণ মুখে চাপদাড়িওয়ালা এই লোকটাকে দেখে হৃদপিণ্ড কেমন কেমন করে ওঠে তার।

” না।”
একটু চুপ থেকে সরাসরি মিনাকে শুধাল,
” পিউয়ের টিউটরের ফোন নম্বর আছেনা তোমার কাছে? ”
তিনি বললেন,
” হ্যাঁ আছে তো। কেন ? ”
ধূসর ফটাফট ঘোষণা দিল,
” ওকে ফোন করবে। বলে দেবে কাল থেকে যেন
আর পড়াতে না আসে।’
সদ্য চুমুক দেয়া গরম চা জ্বিভ পুড়ি*য়ে দিল পিউয়ের। ছোটখাটো ছ্যা*কা খেয়েও ভাবান্তর হলোনা তেমন। চোখ পিটপিট করল ধূসরের দিক চেয়ে। হঠাৎ স্যারকে মানা করবে কেন?

সুমনা বললেন,
” কেন রে? ছেলেটাতো ভালোই পড়ায়। এক ঘন্টার জায়গায় দেড় ঘন্টা পড়াচ্ছে। সামনে পিউয়ের পরীক্ষা, এই সময় কি ঠিক হবে?”

” এসব আমার মাথায় আছে ছোট মা। কারণ ছাড়া বলছি না নিশ্চয়ই? পিউয়ের পড়াশোনায় ক্ষতি হোক এমন কিছু আমি করব কী?”

” না তা বলিনি…”
জবা বেগম বললেন,
” কিন্তু ওকে পড়াবে কে? তুই? ”

বলার সময় ভদ্রমহিলার চোখ-মুখ ঝলকে উঠলেও মুখমণ্ডল শুকিয়ে গেল পিউয়ের। ভী*ত হল,আবার এই লোকের পড়ানোর কথা উঠছে কেন?
ধূসর বলল,
” না। তোমাদের এত চিন্তা করতে হবেনা। আমার এক বন্ধু আছে,ও এসে পড়িয়ে যাবে।”

বক্তব্য শেষ করে চলে গেল, যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই। প্রত্যেকে বিভ্রম নিয়ে চেয়ে রইল ওর গমনপথে। রুবা বললেন,
” কী যে হয় ছেলেটার!”

মিনা ততধিক নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বললেন,
” যা হবে ভালোই হবে৷ ধূসর যখন দায়িত্ব নিচ্ছে আমার আর চিন্তা নেই। যাই,ফয়সাল কে বারণ করে দেই।আর এ মাসের বেতনটাও নিয়ে যেতে বলি।”

বলতে বলতে তিনি রওনাও করলেন। পিউ আশ্চর্য না হয়ে পারছেনা। এত ভরসা নিজের পেটের ছেলেমেয়েকেও মানুষ করে কী না সন্দেহ। পরিবেশটা নিমিষে স্বাভাবিক হলেও অস্বাভাবিক বনে রইল সে। গভীর মনোযোগে ভাবল,
‘ধূসর ভাইয়ের মতিগতি সুবিধের নয়। আকষ্মিক আমার স্যারের পেছনে পরার কারণ তো একটা আছেই। ‘

চলবে,

গল্প দিতে দেরি করার জন্যে দুঃখিত! দুঃখিত আপনাদের অপেক্ষা করানোর জন্যে। ইচ্ছে করে করিনি,ব্যক্তিগত সমস্যার কবলে পরেই করে ফেললাম🙂
নিয়মিত হব ইনশাআল্লাহ। শুধু তিন/চারদিন সময় দিন আমায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here