#ওগো_মনোহারিণী ( #রৌদ্র_মেঘের_আলাপন ) [৫]
লেখনিতে #তাসলিমা_নাসরিন
বাসর ঘরে বিধ্বস্ত অবস্থায় নতুন বউয়ের সাজে বসে আছি আর নিরবে অশ্রু বিসর্জন করছি । নিজের ভাগ্যের উপর বড্ড আফসোস হচ্ছে । কেনো এইরকম নিয়তি দিলে আমায় আল্লাহ ? আমাকেই কেনো সব সাফার করতে হয় ? প্রথমেই তো জন্মধাত্রী মায়ের কাছে বড় হলাম না আর না তাদের ভালোবাসা পেয়েছি। তবে যেটুকু পেয়েছি এই তো অনেক। কোনো জন্মদাত্রী মা যে নিজ সন্তানকে অস্বীকার করে সেটা আমি আমার জীবনে না ঘটলে কখনোই জানতাম না।
আমার বিয়ে হলো ৫ ঘন্টা। আর এর মাঝেই আমার জীবন টা তছনছ করে দিয়েছে ধূসর চৌধুরী। এই মানুষটার জন্য আজ ভালোবাসা নেই , শুধু ঘৃণা কাজ করছে।
অতীত—-🍁
সেদিন একটি অজ্ঞাত ফোনকল পেয়ে বাবা বাহির থেকে কথা বলে এসে হাসিমুখে মাকে বলেন কাল-ই নাকি আমার বিয়ে। যিনি একটু আগে এসেছিলেন তিনি আমার শ্বশুর ছিলেন। তার একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে যেমন মেয়ে চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটাই নাকি আমি।
বাবাকে প্রথমে পথিকের পরিচয় দিয়ে আমাদের বাসায় আসে এবং ক্ষুধার্ত বলে রাতের খাবার খায়। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল আমার চালচলন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। অবশেষে বাসায় যাওয়ার আগেই তার পুত্র কে খুশির সংবাদ দেয় যে তার মেয়ে পছন্দ হয়েছে।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে ছেলের মা’কে নিয়ে। কোনো এক অজানা কারনে ছেলের মা আমার কথা জেনে বিয়েতে নাকোচ করে দেয়। কিন্তু যেখানে দু’জন রাজি সেখানে একজনের অমতে আমার বিয়েটা আটকানো সম্ভব হয়নি। অবশেষে বিয়েটাও সম্পন্ন হলো।
তারা হুট করি বিকালে এসে বলে আমাকে দ্রুত রেডি করে দিতে। রাতের বিয়েটা নাকি এখন-ই হবে। বাবা মা সকলের চিন্তায় পড়ে যায়। এত কম সময়ের প্রয়োজন কিভাবে তিনি করবেন? আর তখন অর্ধেক আয়োজন হয়েছে। তখন আমার শশুড় বলেছেন যে তিনি সব ব্যবস্থা করেই এসেছেন।
তারপর বাবা কে আড়ালে নিয়ে কিছু কথা বললেন আমার শশুড়। এতে আমার বাবা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু চিন্তার সূক্ষ ভাঁজ পড়েছিলো আমার মায়ের মুখে। এমনি একমাত্র মেয়ের দিয়ে দিচ্ছেন তাড়াহুড়ায় এখন যদি আবার দ্রত হতে বলে তাহলে তো চিন্তা হবেই তার।
এদিকে তার স্বামীও তাকে কিচ্ছুটি বলছেন না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো কোনো বিস্ময়ের কিছুই হয়নি। মা কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলে মাকে পাঠিয়ে দে আমার রুমে। মায়ের শতো অনিচ্ছার পরেও তাদের ট্রলি থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে আমাকে পরিয়ে দিলেন।
মাকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও কিছু বলতে পারলাম না। কারন যেখানে আমার ইচ্ছের মূল্য নেই সেখানে আমার প্রশ্ন করাটা অযৌক্তিক। তাই মোমের পুতুলের মতো বসে রইলাম।
শুনেছি বিয়ের পরে নাকি মেয়েদের স্বামীর বাড়িই সব। মা-বাবাও নাকি পর হয়ে যায়। তবে কি আমার ক্ষেত্রেও সেরকম টা হবে ? এই চিরচেনা বাড়ি, আমার রুমের প্রত্যেক টা জিনিস কি আমাকে মিস করবে না ? রুমটায় কেউ না থাকলে কি ওরা বলবে না যে আমারা সিয়ু কে চাই ?
যে বাবাকে ছাড়া মুখে দু’কণা ভাত গলায় তুলতে পারি না তারা কীভাবে আমাকে রেখে রোজ খাবে ? তারা কি একা হয়ে যাবেনা ? শত হোক তারাই আমার সব।আমার কথায় ঘোর কাটিয়ে আয়নায় তাকালাম ।
— বাহ ! পুরোপুরি বউয়ের মতো । আরে বউয়ের মতো কি ? আমিই তো নতুন বউ ! সত্যিই আজ আমাকে ধূস,,,”
— নিচে ডাকছে আন্টি আংকেল। যাবেন না ?
আমার কথা অসম্পূর্ণ থেকে গেলো অরণ্য আর অর্পিতার কথায়। আর নিজের ভাবনা কেই ধিক্কার জানালাম। কাকে নিয়ে ভাবছি এই শুভ দিনে ? যে কিনা আমার’ই না। কিছু মূহুর্তের মধ্যেই আমি অন্য কারোর নামে আটকে যাবো, জুঁড়ে যাবে তার নাম। তবে এতো ব্যস্ততার মাঝে হবু বরকেই দেখা হয়নি আমার। অথচ বিয়ের পিড়িতে বসে গেলাম। আর একটু পর তার জন্য আমি হালাল হয়ে যাবো।
এইসব ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। তা দেখে মা আমাকে কিছু বলবে তখনই বাবা এসে মা’কে এক সাইডে নিয়ে কানে কানে কিছু বোঝালো। আর মা-ও তাতে হ্যাঁ হ্যাঁ করলো। আমি শুধু নিরব দর্শক হয়ে আয়নায় তাদের দেখছি । অরণ্য আর অর্পিতা আমার মন ভালো করতে ব্যর্থ এক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, আমি শুধু তাদের দিকে চেয়ে আছি।
কি যেনো কি হলো আজ আমার ? এতো পাথরের ন্যায় কেনো আজ আমি ? কথায় আছে না ? অতি শোকে পাথর। সেটা আজ স্বচক্ষে দেখলাম। বুকটা কেমন মৃদু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। বলার মতো কিছু নেই যে আমার।
এই ভাবতে ভাবতে ড্রেসিং টেবিলের উপর দুই হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে কাঁদতে লাগলাম। তা দেখে অরণ্য আর অর্পিতা চুপে গেলো, কারন টা তারা জানে তাই আর আমাকে বিরক্ত করলো না। তারাও হেরে যাওয়া অপমানিত হওয়া এক মেয়ের ভালোবাসা দেখে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। তারা জানে যে আমার সামনে তারা ক্রন্দনরত চেহারা আমাকে আরো ভেঙে ফেলবে তাই তারা এতক্ষণ শান্ত থাকার ভাব করছিল , কিন্তু তার পারলো না।
মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন ।
— সিয়ু মা ! এতক্ষণ আমি চিন্তায় থাকলেও এখন আমি সম্পূর্ণ চিন্তা মুক্ত। কারণটা এখন তোকে বলতে পারব না রে মা। সবকিছুর একটা সঠিক সময় থাকে,সময় হলে তোকে সবটা জানাবো কিংবা তুই নিজেই জেনে যাবি। আর তখন আর এই অভাগা বাপ মার উপর রাগ করে থাকতে পারবি না। ”
মায়ের এমন কথায় মাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। যেনো এতক্ষণে ধরে রাখা চাপা কান্না এক নিঃশ্বাসে বের করলাম , শব্দ করে খেতে পারলাম। এতে বাবা এসে আমার দিকে অসহায় জানি নিক্ষেপ করে বলেছিলো –
— খুব সুখী হবে মা তুই, দেখে নিস। আর আমি জানি আমার সিয়ু বড্ড বুদ্ধিমতী। সে বিবেচনা না করে কোন কাজ করবে না। আচ্ছা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। আমি জানিনা এরপর কি হবে সবটাই আল্লাহ ভরসা। আর বিয়েটা ওই পাত্র তোমার ভাগ্যে ছিল তাই আজ বিয়েটা হবে। আর আমি এমন কিছু সত্য জানি যার কারণে চুপ থাকতে হচ্ছে আমাকে। আর হ্যাঁ তুই সেখানে থেকেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবি। এতে তাদের কোন দ্বিমত নেই। ”
এই বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। তখনই আমার শশুর আমার ঘরে এসে বলল-
— আমি আমার মেয়েকে আমার ঘরে তুলছি কোন দাসীকে না, তাই ভাই আপনি চিন্তা মুক্ত থাকতে পারেন। আর আপনি অবশ্য আমার ব্যাপারে জানতে পেরেছেন কিছু যে আমি মানুষ টা কেমন। তাই দুশ্চিন্তা না করাই শ্রেয়। ”
— চলো মা ! ” ( আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন আমার শশুড় )
অতঃপর গুটি গুটি পায়ে আগন্তুকের সাথে বসানো হলো। বুঝতে পারলাম আমি তার অর্ধাঙ্গিনী। যার নামে একটু পর নিজের নাম টাও যোগ করবো। নিয়মাবলী পালন করে অবশেষে কবুল বলে তার হয়ে গেল।
সাথে ছিলো আমার মা-বাবা , আমার মামাতো বোন তিন্নি,মামি,অরণ্য, অর্পিতা, হবু স্বামী আর শশুড়। (আমার বাবার কোনো বোন বা ভাই নেই আর মায়ের একটাই বোন! তারই মেয়ে তিন্নি। বয়স তার ১২।)
কাবিননামা যখন আমার সামনে পড়ছিলো তখন শুনতে পেয়েছিলাম একটি নাম “অভ্রনীল আহমেদ ” যার মানে তিনিই আমার স্বামী। আর আজ থেমে আমি তার ব্যক্তিগত সম্পদ হয়ে গেলাম।
বেশ খানিকক্ষণ পর সময় হলে বিদায়ের। এতক্ষণ চুপ থাকলেও বিদায়ের সময় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। হু হু করে কেঁদে ফেললাম। সাথে গেলো আমার মামাতো বোন তিন্নি। গাড়িতে জানালার পাশে বসলাম আর আমার পাশে আমার স্বামী , জানতে পারলাম আমার শশুড়বাড়ি যেতে ঘন্টা তি’নেক সময় লাগবে।
হাইএসে অন্যদের মতো বমি করার রোগ আমার নেই, তাই নিশ্চিন্ত হয়ে বসলাম , সেইসাথে এই গরমে এসি তো আছেই। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে আমার পাশে বসে থাকা লোকটির ব্যবহৃত পারফিউম চেনা চেনা মনে হচ্ছে আমার কাছে।
কিন্তু গাড়িতে মানুষ তিনজন। আমি,তিন্নি, আমার স্বামী আর ড্রাইভার। তিন্নি বড় হলেও তো পারফিউম এর “প” টাও বোঝে না। বাকি রইলো আমার স্বামী আর ড্রাইভার।
নিজের চিন্তাকে এক সাইডে রেখে পেছন দিকে গা এলিয়ে দিলাম। কাঁদতে কাদতে বড্ড ক্লান্ত আমি আজ। পরক্ষণে ভাবলাম পাররফিউম তো অনেকেরই হতে পারে। তাই আর চিন্তা না বাড়িয়ে চোখ বুজঁলাম! চোখ গুলো যে বড্ড ক্লান্ত, সেইসাথে মনটা-ও ।
(চলবে)
রিচেইক করিনি। বানানে ভুল হতে পারে। গঠনমূলক মন্তব্য করবেন, কেমন হয়েছে জানাবেন। ধন্যবাদ। 🍁