পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ তেতাল্লিশ

0
200

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ তেতাল্লিশ

রাতের নিস্তব্ধ রাস্তাকে পিছে ফেলে বিরতিহীন ভাবে ধূসর রঙের গাড়িটা ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যে। গাড়ির ভিতরে অবস্থানরত মানুষ দু’জনই নিশ্চুপ। একজন বিষাদে নিশ্চুপ আরেকজন অপ্রাসঙ্গিক হিংসায়। হুট করেই চলন্ত গাড়িটা সাবধানে ব্রেক কষলো মৃত্যুঞ্জয়। বাহিরের দিকে আচ্ছন্ন থাকা দর্শিনীর দৃষ্টি মৃত্যুঞ্জয়ে আবদ্ধ হলো। ক্ষানিক অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“গাড়ি থামালেন যে!”

মৃত্যুঞ্জয় সিট বেল্ট খুলতে খুলতে রুক্ষ স্বরে জবাব দিলো,
“গন্তব্য বহুদূর তাই বিরতি প্রয়োজন। আপনি বসুন, আমি আসছি।”

দর্শিনী হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় সে সুযোগ টুকু না দিয়েই বড় বড় পা ফেলে রাস্তার বিপরীত পাশে চলে গেলো। বিরাট রাস্তায় খালি গাড়িটাতে দর্শিনী একা বসে রইলো। মিনিট দশ গড়াতেই মৃত্যুঞ্জয় চলে এলো হাতে তার বিশাল প্যাকেট। দর্শিনী প্যাকেট টা দেখে ভ্রু কুঁচকালো, প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কিসের প্যাকেট এটা?”

“খুলেই দেখুন।”

দর্শিনী আর কথা বাড়ালো না, প্যাকেট টা ধীর গতিতে খোলা শুরু করলো। মৃত্যুঞ্জয়ও ততক্ষণে এসে গাড়িতে বসে পড়েছে। প্যাকেট টা খুলতেই হেল্থ ড্রিংকস্, কিছু ফল, বাটার বন, জলের বোতল, লাড্ডুর বাক্স চোখে পড়লো দর্শিনীর। মৃত্যুঞ্জয় সবে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে, তন্মধ্যেই দর্শিনীর বিষ্মিত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এত গুলো খাবার!”

“হ্যাঁ, সারারাত না খেয়ে থাকলে বাবুর যে শরীর খারাপ করবে জানেন না? শোকে তো ডুবে আছেন, বাবুটার চিন্তা করার কী আর প্রয়োজন আছে!”

দর্শিনী সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো তার পাশে বসা সুপুরুষটার দিকে। কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে বসে প্রথমেই হাত দিলো লাড্ডুর বক্সটাতে। সাথে সাথেই পুরুষালী, গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“খালি পেটে প্রথমেই মিষ্টি খেলে গা গুলিয়ে আসবে। প্রথমে বাটার বন খান তারপর জল। এরপর একটু ফল খেয়ে যা ইচ্ছে খাবেন। এত বড় হলেন অথচ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন না।”

মৃত্যুঞ্জয় আজ বেশ গম্ভীর হয়ে কথা বলছে। দর্শিনীর বিরক্ত লাগলো, কিঞ্চিৎ বিরক্ত প্রকাশ করেই বললো,
“এভাবে আমার সাথে কথা বলবেন না তো। যেন মাস্টারমশাই আসছে।”

দর্শিনীর উপর কিছুটা অভিমান থাকলেও দর্শিনীর বাচ্চামি মাখানো কথায় হেসে ফেলে মৃত্যুঞ্জয়। কেউ বলবে এই মেয়েটাই সবসময় এত গম্ভীর হয়ে থাকে।

মৃত্যুঞ্জয়কে হাসতে দেখে আরেকদফা বিরক্ত হলো সে। বাটার বন বের করে একটা মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে এগিয়ে দিলো। মৃত্যুঞ্জয় গাড়ি চালাতে চালাতে একবার খাবারের দিকে তাকিয়ে আবার গাড়ি চালানো তে মনোনিবেশ করলো।

দর্শিনী এবার বিরক্তির চরম মাত্রায় পৌঁছে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কী সমস্যা? এমন করছেন কেন!”

“কেমন করছি?”

“এই যে বাচ্চাদের মতন গাল ফুলিয়ে আছেন।”

“কারণ আছে, তাই।”

দর্শিনী এবার বাটার বনটা প্যাকেটে রাখলো। খুব মনযোগী শ্রোতার ন্যায় বসে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কারণটাই তো জানতে চাচ্ছি, কী হয়েছে?”

মৃত্যুঞ্জয় গাড়ি থামালো রাস্তার এক পাশে। নিরিবিলি রাস্তা। যতটুকু মনে হয় শহর ছেড়ে বড় রাস্তায় গাড়ি প্রবেশ করেছে। আশেপাশে কোনো জনমানসের চিহ্ন নেই। একদম নির্জন রাস্তা। এই নির্জন রাস্তাটাই কত নির্দ্বিধায় একজন পর পুরুষের সাথে বসে আছে দর্শিনী, অথচ তার হৃদয়ে কোনো ভয় নেই। পৃথিবীতে সকল পুরুষই খারাপ না। বছরের পর বছর এই পুরুষদের ছায়াতলেই নারীরা থাকে, সব পুরুষ খারাপ হলে এটা আদৌও সম্ভব হতো!

ভাবনার মাঝেই মৃত্যুঞ্জয়ের রাশভারি কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনি আজও আপনার প্রাক্তনকে ভালোবাসেন, তাই না?”

হঠাৎ এই প্রসঙ্গ উঠায় নড়েচড়ে বসলো দর্শিনী। ক্ষানিক অস্বস্তিতেও পড়লো। আজকাল ভালোবাসা শব্দটাতেই তার অস্বস্তি। কারণ একটাই, ভালোবাসার মানুষটাই যে আস্ত এক বিব্রতকর মানুষ!

দর্শিনীর উত্তর না পেয়ে অধৈর্য হলো মৃত্যুঞ্জয়। অধৈর্য কণ্ঠেই বললো,
“বিপ্রতীপ এতকিছুর পরও কী অবলীলায় আপনার ভালোবাসা হয়ে রইলো! কতটা সৌভাগ্যবান সে!”

“বিপ্রতীপ আমার ভালোবাসা হয়ে রয়েছে সেটা আপনার ভুল ধারণা। হ্যাঁ, আমার জীবনে যখন ভালোবাসা নামক অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তখন বিপ্রতীপ নামের মানুষটাই আমার সারা অনুভূতি জুড়ে বিরাজ মান ছিলো। বছর বছর যাবত যে ভালোবাসা তৈরী হয়েছে তা তো আর এক নিমিষে তুরুপের তাসের মতন ভেঙে যাবে না তাই না? তবে হ্যাঁ, আমি ভালোবাসাকে আজও ভালোবাসি কিন্তু বিপ্রতীপকে না।”

“তাহলে কী জীবনে মুভ অন করবেন না আর? একটা মানুষের জন্য আটকে রাখবেন নিজের জীবনটা?”

মৃত্যুঞ্জয়ের প্রশ্নে ক্ষানিক হাসলো দর্শিনী। হাসি মুখেই বিনীত স্বরে বললো,
“আপনাদের কাছে মুভ অন মানে কী? একজনকে ভুলে আরেকজনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া? এত সহজে ভুলা যায় আদৌও! আমার কাছে মুভ অন মানে এটা না। জীবনে এগিয়ে যাওয়াটাই হলো মুভ অন। স্বামী মানে কেবল আমার একা গন্তব্যে হাঁটার জন্য আরেকজন সঙ্গী এ ছাড়া আর কিছুই না। সঙ্গী ছাড়াও পথ হাঁটা যায়। একবার তো সঙ্গীর সাথে হাঁটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছি, এবার নাহয় একা হাঁটলাম।”

মৃত্যুঞ্জয় আর কোনো কথা বললো না। অনেকে তো সঙ্গী ছাড়া হাঁটতে চায় ই, তবুও তো পথে দেখা হয় কত পথচারীর সাথে। সে নাহয় পথচারী হয়ে রবে।

দর্শিনীও নিজের মতন করে খেতে শুরু করলো। মৃত্যুঞ্জয়ের কথার ইঙ্গিত বুঝবে না অত ছোটও সে না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবুঝ থাকাটাই শ্রেয়।

মৃত্যুঞ্জয় গাড়ির বর্তমান গুমোট পরিস্থিতি কাটানোর জন্য হঠাৎ ই বলে উঠলো,
“আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, বিহঙ্গিনী আর মৈত্র দাদাকে মায়া দেখে রাখবে?”

দর্শিনী খাবার চিবুতে চিবুতে উত্তর দিলো,
“মায়ার নিজেরই তো ঠিক নেই, ও আবার আরেক জনকে কী দেখবে!”

মৃত্যুঞ্জয় অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“নিজের ঠিক নেই মানে?”

“মায়ার দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। কয়েকদিনের মাঝে ডোনার না পেলে মেয়েটা আর বাঁচবে না।”

মৃত্যুঞ্জয়ের হঠাৎ করেই খারাপ লাগা শুরু করলো। মায়া এমন একটা মেয়ে যাকে দেখলে একবার অন্তত কারো না কারো মায়া জন্মাবেই। আর মেয়েটার বয়সও তো খুব কম, এতটুকু বয়সে এমন রোগ!

দর্শিনী আকষ্মিক খাবার রেখেই বলে উঠলো,
“আপনার কী মনে হয়, শাশুড়ি মায়ের পালানোর এই কাজটা কী একার পক্ষে সম্ভব!”

দর্শিনীর প্রশ্ন যুক্তিযুক্ত দেখে মৃত্যুঞ্জয় খানিক ভাবতে বাধ্য হলো৷ সত্যিই তো, মোহনার পক্ষে তো এটা একা করা সম্ভব না।

মৃত্যুঞ্জয় সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার কী কাউকে সন্দেহ হয়! কে মোহনাকে সাহায্য করেছে! আসলেই তো ঐ মহিলার পক্ষে একা পালানো সম্ভব না কারণ উনি যখন পালিয়েছে তখন পুরো এলাকার বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিলো, তার মানে কেউ তাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু কে সে!”

দর্শিনী খাবারের লাস্ট অংশ টুকু মুখে তুলে নিয়ে কুটিল হেসে বললো,
“জানেন তো পৃথিবীর সকল হিসেব ভালোবাসার কাছে এসে গড়মিল হয়ে যায়। যে একবার সত্যিকার অর্থে ভালোবেসে ফেলে সে যেকোনো মূল্যে ভালোবেসে যেতে চায়। শাশুড়ি মায়ের সাহায্য করার ক্ষেত্রেও হয়তো এটা হয়েছে।”

মৃত্যুঞ্জয় আর প্রশ্ন করলো না কারণ সে জানে দর্শিনী এটার উত্তর দিবে না। দেওয়ার হলে প্রথমেই দিতো। আবারও সব নিশ্চুপ। আজকাল নিস্তব্ধতার মাঝেই চির সুখ।

_

বাড়িতে পৌঁছাতেই যে এত বড় চমক দর্শিনীর জন্য অপেক্ষায় থাকবে, সে ঘূনাক্ষরেও টের পায় নি। গ্রাম জুড়ে প্রিয় মানুষটার নামে ছিঃ ছিঃ আর নানান কটু কথায় সে বাকরুদ্ধ। অবশেষে তাকে ছোট বৌদি সবটা খুলে বললো। দর্শিনীর বাড়ির লোক অবশ্য জানে দর্শিনী একটা ক্যাম্পিং এ গিয়েছিলো, তাই তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিলো না তাকে নিয়ে।

একফোঁটা বিশ্রাম না করেও দর্শিনী ছুট লাগালো হিমাদ্রি’দার বাড়ি। আট মাসের ভারী পেট নিয়ে এত ছুটোছুটি তার দেহ নিতে পারছে না তবুও সে ছুট লাগায়। এই ছোট কাকীই একটা সময় তার আদর্শ ছিলো, আজও আছে, এ মানুষটাকে নিয়ে নোংরামো সত্যিই মানা যায়!

সৌভাগ্যবশত হিমাদ্রীদের বাড়ি যাওয়ার পথেই হিমাদ্রীর সাথে দেখা হয়ে যায় তার। মাস্টার জেঠুদের বাগানের পাশের খালি জায়গাটাতেই হিমাদ্রী বসে আছে। দৃষ্টি তার উদাস।

দর্শিনী ধীর পায়ে হিমাদ্রীর পাশে দাঁড়ালো, শক্ত কণ্ঠে বললো,
“এমনটা কেনো করলেন হিমাদ্রী দা!”

হিমাদ্রীর ধ্যান ভাঙলো। চোখ গুলো তার কেমন টকটকে লাল! কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলো দর্শিনী তবে চেহারার কাঠিন্যতা কমলো না। রুক্ষ কণ্ঠে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কাকিমনিকে আমি প্রচুর বিশ্বাস করি তাই আমি জানি সে কোনো ভুল কাজ করবে না। কিন্তু আপনি, আপনাকেও তো অনেক বিশ্বাস করতাম , তাহলে এমন করলেন কেনো!”

হিমাদ্রী দর্শিনীর দু’হাত ধরে ফেললো আচমকা। লাল চোখ গুলো থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু কণা। আকুতি মাখা কণ্ঠে বললো,
“আমি জানিনা প্রিয়, কি থেকে কি হয়ে গেলো। আমি তো কাল অস্মি মানে তোমার কাকাতো বোনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বাচ্চাটাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি ওদের ঘরে যেতেই দেখি তোমার কাকী মানে কুহু কেবল স্নান করে বেরিয়েছে। এর মধ্যেই হৈচৈ পরে গেলো সে ঘর ঘিরে। সবাই ছড়িয়ে ফেললো বিশ্রী ঘটনা। অথচ সবটাই সাধারণ, স্বাভাবিক ছিলো।”

হিমদ্রীর কথার ধরণে দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কাকীর নাম ধরে ডাকছেন যে!”

“কারণ কুহুকে আমি ভালোবাসি। আমি জানি সে আমার চার বছরের বড়, কিন্তু কী করবো, ভালোবাসা কি বয়স মানে! কিন্তু কে জানতো আমার জন্যই সে মানুষটা কলঙ্কিত হবে। পাহাড়ের চূড়ার মতন উঁচু মাথা তার নিচু হবে। আমার ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে যে।”

দর্শিনী অনেকটাই অবাক হলো হিমাদ্রী দা এর কথায়। সাধাসিধে আটপৌরে মানুষটা কিনা একজন বিধবা, বয়সে বড় মেয়েকে ভালোবাসে!

হিমাদ্রীর অসহায় কান্নায় মায়া হলো দর্শিনীর। সে হিমাদ্রীর হাতটা মুঠ করে ধরলো। তন্মধ্যেই বাগান থেকে এক তাচ্ছিল্য মাখা কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ছিহ্, তোমাদের বাড়ির মেয়েদের সবারই কী চরিত্র খারাপ!”

#চলবে

[পর্ব ৪২ এর সেরা কমেন্ট কারীগণ
#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
শুভকামনা সবাইকে❤️

@ফাতেমা আক্তার বৃষ্টি
@Nasrin khan
@Nandini Saha
@tahmina Toha
Subarna Mostofa
@Sohely Islam
Shruti Mukherjee
Afrin Munshi
Janifer Gomez]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here