#এলোকেশী_সে
পর্বঃ৩
#মাহমুদা_লিজা
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত প্রায় এগারটা বাজতে চলল। রাতের খাবারটা শেষ করেই বসার ঘরের বিশাল পরিসরটায় সবাই একসাথ হয়েছে। কারণ দুটো রয়েছে অবশ্য।
প্রথম কারণ হলো নিজাম সবাইকে ডেকেছেন আর দ্বিতীয় কারণ হলো অয়ন কিছু জানাতে চায় তার মেজ কাকাকে।
হাতে থাকা মুঠোফোন নামক ডিভাইসটা পাশে সরিয়ে গলা ঝেড়ে অয়ন বলল – আমার কয়েকটা কথা ছিল কাকা। বলতে পারেন নালিশ।
নিজাম সাহেব অয়নের দিকে তাকিয়ে তার গাম্ভীর্যের গভীরতা অনুভব করতে চাইলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন বারবার। অয়নের আদলটা একদম শান্ত এবং স্বাভাবিক ছিল। কাঠিন্যের ছিটেফোঁটাও ছিলো না ঐ আদলে। তিনি ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাননি অয়ন কি বলতে চায়। মৃদু হাসির ছলে বললেন – বলো।
গভীর শ্বাসটা ছেড়ে গম্ভীর কন্ঠে সে শুধালো – তোড়া কি সত্যি আপনার সন্তান? আমি বলতে চাচ্ছিলাম আপনিই ওর বাবা?
ছেলের কথা শুনে নাঈম মজুমদার কেশে উঠলেন। এ ধরনের আঁতে ঘা লাগা প্রশ্ন তার দুই ছেলের দ্বারাই সম্ভব। কিভাবে, কখন তাদের মাথায় এসব আসে তিনি ভেবে পান না। সিনিয়র, জুনিয়র সবার সামনেই লাগাম ছাড়া কথা বলে বসে। মাঝে মাঝে তিনি চিন্তায় পড়ে যান এই ছেলে দু’টো জন্মের সময় এত এত মধু খাওয়ানোর পরও এসব তেতো কথা কিভাবে বলে। তিনি কিছুটা স্ত্রীর দিকে সরে এসে বললেন – এই, তুমি সত্যি ওদের জন্মের সময় মুখে মধু দিয়েছিলে? ভালো করে মনে করোতো, নাকি করলার রস দিয়েছিলে?
স্বামীর কথা শুনে অনিমা ভ্রু কুঁচকে নাকের ডগার এনে বলল – “তুমি ছিলে তখন, দেখোনি!”
নাঈম সাহেব দমে গিয়ে বুকের ভেতরে থাকা চাপা শ্বাসটা ছেড়ে বললেন – “কার মত হয়েছে কে জানে!”
অনিমা স্বামীর অসহায় আদলের পানে চেয়ে ফিক করে হেসে দিলেন। সিরিয়াস মুহূর্তেও তাঁর হাসি কেন আসবে! নিজেকে মনে মনে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে তবেই থামলেন তিনি।
ভাইপোর কথা শুনে কিঞ্চিৎ বিরক্তির আভা বদনে টেনে নিজাম মজুমদার পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লেন – “কি ধরনের অসভ্যতা এটা?”
এতক্ষণে তোড়া আর রুবাবা বসার ঘরে এলো। গুমট পরিস্থিতি আঁচ করে রুবাবা মেয়েকে শাসালেন যাতে সে কোন কথা না বলে।
নিজাম মজুমদারের প্রশ্নবিদ্ধ উক্তিটা অয়নকে আরো গম্ভীর করে তুলল। সে নিজের স্বর স্বভাব সুলভ রাশভারি করে বলল -” এটা ঠিক সেই ধরনের অসভ্যতা যেই অসভ্যতা আপনার স্ত্রী প্রতিনিয়ত তোড়ার সাথে করে আসছে। ওনাকে জিজ্ঞেস করুন, উনি আজও তোড়ার গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হয়েছে। উনি ঠিক কতটুকু অধিকার রাখে তোড়ার গায়ে হাত তোলার, সীমাটুকু বুঝিয়ে দিবেন।”
নিজাম সাহেব কিছু বলার আগেই কানন আগ বাড়িয়ে বলল – “ও তো আমার স্বামীর সন্তান, ওর ভালোমন্দ বাছ বিচার করার বা শাসন করার অধিকার আমার আছে।”
এটুকু আলাপচারিতা বসার ঘরে বোমা ফাটালো যেন। অয়ন কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই তোড়া ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল – “ভালো মন্দ বাছ বিচার করার সেই বোধটুকুই তো নেই আপনার। আপনি কারো দ্বিতীয় স্ত্রী মানে এই নয় যে তার প্রথম স্ত্রীর সন্তানকে আপনি নোংরা শাসন করবেন তাও তার মায়ের বর্তমানে। আমার মা বেঁচে আছে, আমার অন্য কারো শাসনের প্রয়োজন নেই। আপনার শাসনের প্রয়োজন আছে। আপনার স্বামীকে বলে দিবেন আপনার শাসনের কঠিন প্রয়োজন। আপনি অযথা আমাদের মা-মেয়ের মধ্যে চলে আসেন বারবার, সেটা তাকে জানিয়ে দিবেন।”
নিজাম সাহেব এতক্ষণে মেয়ের দিকে শীতল দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন। কোমল স্বরে সন্তানকে জানালেন – “বড়দের সাথে তামিজের সাথে কথা বলতে হয়, মা।”
কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে কলি হন্তদন্ত পায়ে দরজা খুলতে গেল। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে অহন আসার সময় হয়েছে। নাঈম সাহেব ঘড়ির দিকে দৃষ্টি রেখে স্ত্রীকে ফিসফিসিয়ে বললেন -” ঐযে আরেক গভর্নর আসছেন, ঘটনার পোস্টমর্টেম হবে এবার।”
অনিমা ফিক করে হেসেই দিল এবার। ছেলে দুটোর সোজা-সাপটা কথা বলার ধরন যে তাঁদের অপ্রস্তুত করে দেয় তা ভাবলেও হাসি পায়।
দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই সবার থমথমে আদল দৃষ্টিগোচর হতেই অহন ভ্রু নাচিয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করল -“সন্ধ্যের আগেই বের হলাম, এরমধ্যে আবার কি হয়ে গেল? সবার মুখে অমন অমাবশ্যা নাচে কেন?”
নাঈম সাহেব বা’হাতে কপাল চাপড়ালেন। ছেলেগুলো এত সরাসরি কথা বলা বন্ধ না করলে একজনেরও বউ টিকবে না।
নিজাম সাহেব এবার মুখ খুললেন -“আচ্ছা মূল কথায় আসি।”
মেহেরজান এতক্ষণে কথা বললেন -“বইলা ফালা কি কইবি।”
একনজর তোড়ার দিকে তাকিয়ে তাকে নিজের পাশে এসে বসতে বললেন মেহেরজান। ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে প্রস্তাব নাকচ করল মেয়েটা।
কতক্ষণ উশখুশ করে নিজাম সাহেব বললেন -“তোড়ার তো বিয়ের বয়স হয়েছে, ওর জন্য পাত্র দেখেছি। ছেলে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের বসের ছেলে। খুবই ভদ্র এবং অমায়িক।”
রুবাবা মেয়েকে দেখলেন একবার। মেয়ের নির্লিপ্ততা তাকে ভেঙে দিচ্ছে যেন। নেহাৎ মানুষটার সাথে কথা বলেন না, নইলে এখনই ঘর ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতেন, “হবেনা এই সম্বন্ধ দেখাদেখির তামাশা।”
বাকিরা গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেও কানন লেফাফাদুরস্ত দিয়ে বলল, “খুউব ভালো ছেলে, মাস শেষে বেতনও ভালো পায়। আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে।”
অহন এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। তোড়ার নীরবতা তার হৃদয়টাকে ভস্ম করে দিচ্ছে যেন। বাবা মা, দাদীর দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল যাতে একটা বাঁধা দেয় কেউ। কিন্তু সবার মৌনতা তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ছেলের প্রোফাইল শুনে কেউ অমত করবে না। কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের পিঠ দিয়ে মুছে শার্টের টপ বাটনটা খুলতে খুলতে বলল, “মেঝ কাকা, তোড়ার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে এসব চিন্তা না করলেই নয়?”
কথাটা বলে তোড়ার দিকে তাকাল অহন। বারবার চাইছে মেয়েটা স্পষ্ট স্বরে কিছু বলুক। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তোড়া বলল,”দাদীজান, চলো তোমার পান সাজিয়ে দেই। মা এসো।”
নিজাম সাহেব স্পষ্ট বুঝতে পারলেন মেয়েটা তাঁকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করল। তবুও তিনি মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমার মতামত বললে না, মা।”
তোড়া ঘুরে দাঁড়াল বাবার মুখোমুখি। মেকি হাসলেও চোখে তার টলমলে জলের ধারা। সবে মুখ খুলবে কিছু বলার জন্য, তার আগেই কানন বলে বসল,”ওর বিয়ে ও কি বলবে, ছোট মানুষ। ছেলে ভালো হলে বিয়ে দিয়ে দেবে, ব্যস। ও সুখে থাকলেই হলো।”
মেহেরজান এবার আর নিজের ভেতরের সুপ্ত ক্রোধ সংবরণ করতে পারলেন না। চোখজোড়ায় মনে হয় আগুনের লেলিহান শিখা দাউদাউ করছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ছেলে সঙের মত তাকিয়ে আছে বউয়ের দিকে। হয়ত কিছু বলতও না। পূর্বের জায়গায় বসে পড়লেন এবার তিনি। গলার ক্ষীণ স্বরটাকে যথাসম্ভব জোরালো করে বললেন, “আমার পোলায় কি তোমার মতামত জানতে চাইছে নি? এইখানে তো আমার আরো বউ আছে, কেউ তো জবাব দিলো না, আমার নাতনীর মা পর্যন্ত কথা কইল না, তোমার এত ফটরফটর করা লাগব কিসে?”
শাশুড়ির কথার পিঠে কথা বলার জন্য কথা সাজাচ্ছিল কানন কিন্তু নাঈম সাহেব স্পষ্ট বাক্যে আদেশ করলেন, “তোড়া ছাড়া এখন আর কেউ কথা বলবে না।”
অহন দু’হাত কচলে ইতোমধ্যে লাল করে ফেলেছে। কপাল, চিবুক, পুরো গাল ঘেমে নেয়ে উঠেছে। বুকের ভেতর দুরুদুরু
কাঁপুনিটা এবার হাত আর পায়েও নেমে এসেছে। চোখজোড়া তোড়ার পানে চেয়ে, কানজোড়া অপেক্ষা করছে তার কাঙ্খিত উত্তরটা শুনতে। অয়ন বার দুয়েক বড় ভাইয়ের দিকে তাকাল। মুখ মোছার ছলে হাসিটা লুকালো হাতের আড়ালে। গলা খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এমন ছটফট করছিস কেন?”
অহন চমকে গেল, কপালের ঘামগুলো হাতের পিঠ দিয়ে মুছে বলল, “পানি আনতো।”
অয়ন উঠে গেল।
তোড়া শীতল স্বরে বেশ সময় নিয়ে বলল, “আমি রাজি।”
রুবাবা চকিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। তাঁর সব আশা আকাঙ্ক্ষায় জল ঢেলে দিল যেন কেউ। মনের গহীনে উথাল-পাতাল ঢেউয়ের তোড়ে জলে ডুবে নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো। চোখ উপচে জল গড়িয়ে এলো গালে।
কানন খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল, “এই তো লক্ষ্মী মেয়ে, আমি জানি এমন সম্বন্ধ সব মেয়ের স্বপ্ন।”
বাকিদের মুখেও যেন স্বস্তির হাসি ফুটল। অবশেষে মেয়েটা দূর্দশার জীবন ছেড়ে নিজের জীবন সাজাতে পারবে। অনিমা, কলি এসে রুবাবার পাশে দাঁড়িয়ে তার চোখজোড়া মুছে বলল, “মেয়েটা অন্তত এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবে। কাঁদছিস কেন? ও সুখে থাকলেই তোর কষ্ট স্বার্থক।”
অহন হাতে থাকা পানির গ্লাসটা নামিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখল। অবিশ্বাসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে চড়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোল্ড করা শার্টের কাফড ছেড়ে কব্জি পর্যন্ত টানল। ঠোঁট গোল করে দ্বিতীয় শ্বাসটা ছেড়ে ভূমিতে দৃষ্টি রাখতেই শুনল তোড়ার কোমল স্বরটা, “আমি রাজি, তবে একটাই শর্ত আছে।”
নিজাম সাহেব আহ্লাদে আটখানা হয়ে মেয়েকে দোয়া করলেন। হাসিমুখে জানতে চাইলেন মেয়ের শর্ত।
তোড়া সহাস্যে জবাব দিল, “তার আগে আপনি আমাকে বলবেন, কেন আমার মা বর্তমান থাকা সত্ত্বেও আপনি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেছেন? কেন আপনার বাকি দুই সন্তানের জন্য আপনি এত সিরিয়াস অথচ আমার ব্যাপারে আপনি কেয়ারলেস? আমি এর উত্তর পেলে হাসিমুখে আপনার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করব।”
চোখের সামনে নিজের করা ঘৃণ্য অপরাধটা ভেসে উঠতেই নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারলেন না নিজাম মজুমদার। অতীত মনে করিয়ে দিয়ে তোড়া যেন তাকে পুনরায় সবার সামনে নিকৃষ্টতর বানিয়ে দিল। দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন তিনি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের শত চেষ্টা করেও যখন পারলেন না তখনই মেয়ের গালে নিজের শক্তপোক্ত হাত দিয়ে কঠিন চড় বসালেন। চড়ের তোড়ে মেয়েটা গিয়ে আচড়ে পড়ল সেন্টার টেবিলের কোণে। মেহেরজান আঁতকে উঠলেন। রুবাবা অপ্রকৃতস্থের মত চেয়ে রইলেন তার জীবনে দেখা নিষ্ঠুরতম পুরুষের দিকে। মেয়েকে ধরলেন না তিনি। উঠাতেও গেলেন না। কলি আর অনিমা দৌড়ে আসতেই হাত উচিয়ে তাদের থামতে বলল তোড়া। অয়ন গম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও অহন দৌড়ে এসে তোড়াকে ধরার আগেই সে উঠে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি হেসে সাফ বলল, “কখনো আদর করেননি কিন্তু গায়ে হাত ঠিকই তুলেছেন। কোন দায়িত্ব পালন না করেও অধিকার ফলাতে এসেছেন। আপনার শাসন কিংবা অধিকার কোনোটাই আমার জন্য নয়, আপনার দুই সন্তানের জন্য তুলে রাখুন।”
নাঈম সাহেব চোয়াল কটমট করে বললেন, “অমানুষ কোনোদিন মানুষ হয় নাকি?”
তোড়া মায়ের দিকে এগিয়ে এলো, মায়ের বুকে মাথা রাখার আগেই তিনি সপাটে চড় বসালেন মেয়ের গালে। চিৎকার করে বললেন, “অন্যের হাতে মার না খেয়ে আমার হাতে মার খেয়ে মরে যা। আমিও শান্তিতে মরতে পারব, কোনো পিছুটান থাকবে না।”
অহন এবার চেচিয়ে উঠল। সিংহের মত গর্জন তুলে বলল, “কি শুরু করেছো তোমরা? ঘরটা সার্কাসের মাঠ বানিয়ে নিয়েছো। ”
একটানে সরিয়ে নিল তোড়াকে। মায়ের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে বলল – সার্কাস না দেখে ওকে একটু ধরলে কি হতো মা?
অহনের হাতটা ছাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল তোড়া। দু’গালে বাবা আর মায়ের হাতের দাগ স্পষ্ট। ফর্সা গালটা জ্বলে যাচ্ছে যেন।
রুবাবা দৌড়ে শাশুড়ির ঘরে গিয়ে পাগলের মত হাত কচলাতে শুরু করলেন। কেন অন্যের রাগ মেয়ের উপর মিটান সে কষ্টটা পুড়িয়ে দিচ্ছে ভেতরটাকে। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে যেন। দগদগে অতীতটা নতুনরূপে আবার হানা দিল মানসপটে।
মেহেরজান লাঠিতে খুটখুট শব্দ তুলে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। রুবাবা বারবার চলে যেতে চেয়েছে, তিনি আঁটকে রেখেছিলেন মায়ার দোহাই দিয়ে। আজ নিজেকে ভুল মনে হচ্ছে।
নিজাম মজুমদার ত্রস্ত পায়ে হেঁটে মেয়ের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। সাহস করলেন না ভেতরে যাওয়ার। অনিমাকে পাঠালেন মেয়ের কাছে। অনিমার পিছু পিছু অহন আর অয়নও এসেছে।
খাটের পাশে পিঠ ঠেকিয়ে শুন্য দৃষ্টি নিয়ে নির্লিপ্ত চাহনি তোড়ার। এরমধ্যে কলিও এসেছে। পরম স্নেহের ছোঁয়ায় অনিমা আর কলি গালে হাত বুলিয়ে দিল। চোখের অবাধ অশ্রুকণা কিছুতেই শান্ত হওয়ার নাম নিচ্ছে না। পরম আবেশে তোড়াকে বুকের মাঝে টেনে নিল অনিমা, রুবাবার হয়ে এটা সেটা বোঝাচ্ছে।
অহন এগিয়ে এসে তোড়ার মুখোমুখি বসল। এলোমেলো চুলে অগোছালো চাহনি বুকের ভেতরটা ফালাফালা করে দিচ্ছে। ছোট্ট করে শুধোলো, “কি দরকার ছিল অমন কথা বলার? বিয়ে করবিনা বললেই তো হতো।”
অয়ন নিভৃতে বড় ভাইয়ের অস্হিরতা দেখে যাচ্ছে। সময় বিশেষ লাগলো না ভাইয়ের মন পড়তে। মুচকি হেসে নিজের মুঠোফোনটা বের করে দু’হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ফটাফট টাইপ করল কিছু। ভাইয়ের নামটা তুলে সেন্ড অপশনে ক্লিক করে দিল। ডানহাত দিয়ে নিজের সিল্কি চুলগুলো কপাল থেকে সরাতে সরাতে বলল, “ভাইয়া, তোর ফোনে টেক্সট এসেছে কারো।”
অহন হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলেও খেয়াল ছিল তার সামনে বসে থাকা এলোকেশীর দিকে। কোনোরকমে শার্টের স্লিভ ফোল্ড করে নিজের এলোমেলো চুল সেট করে কাঠকাঠ স্বরে বলল, “মার খেয়েছিস, খেয়েছিস। এত আফসোস করার কিছু নেই। মার খাওয়ার বয়স নেই। ধর আমার কপালেও আজ দু একটা মার জুটতে পারে। উঠে পড়, শুয়ে ঘুমা। গাল বেশি জ্বললে বরফ ঘষে নে। বেকুবের মত বসে না থেকে গিয়ে ঘুমা, কাজে দিবে।”
ছেলের কথা শুনেই অনিমা তার পিঠে ধুম করে এক কিল বসিয়ে দিল। কড়া চাহনিতে ইশারা করল বের হতে। অহন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল, “দেখছিস, মার খাওয়ার বয়স নাই। আমি তোর বড় হয়েও কিল খেতে পারলে তুই চড়টা অনায়াসেই হজম করতে পারিস।”
সবাই ফিক করে হেসে দিলেও তোড়া স্বাভাবিক স্বরে বলল, “বড়মা আমি একটু ঘুমোবো। তোমরা যাও।”
অপেক্ষা না করেই তোড়া বিছানায় শুয়ে পড়ল। সবার দিকে পিঠ দিয়ে উল্টো পাশ ফিরে রইল। তার অশ্রুজলের সাক্ষী কাউকে রাখতে চায়না সে। মায়ের প্রতি অভিমানটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। স্বর্ণলতার মত পরগাছা হয়ে না থাকলে আজকের দিনটা আসত না হয়ত। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠা অহনের মায়াবী আদলটা ভুলতে চায় সে। অহনের মনটা পড়ার মত বয়স তার হয়েছে। কিন্তু বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হলে জীবনটা যদি মায়ের মত হয়? অহনের চোখভরা আকুতি, হৃদয় নিংড়ানো আহ্বান সুকৌশলে উপেক্ষা করে আসছে এক বছর যাবত। বুঝেও ন্যাকা সেজে থাকতে হচ্ছে। পুরুষ সংসর্গই তার জন্য ভীষণ রকম ভয়ের। অনুভূতি যে তার হৃদয়ে জন্মায়নি ঠিক তা নয়। অমন মায়াবী সুপুরুষের জন্য অনুভূতি না জন্মালেই হয়ত অনিয়ম হত। পুরুষদের মায়াবী হতে হয়, ফর্সা নয়। তার প্রতিটি কথায় নেচে ওঠা ভ্রু, তর্জনী ঘুরিয়ে কথা বলা, কথার ফাঁকে চুলের স্তরে স্তরে আঙ্গুল চালানো, নির্দ্বিধায় সরাসরি বলতে পারা ছোট্ট মেয়ের মনে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছে। কিন্তু ভয়টা পুরুষের জন্য, সব পুরুষই এক মনে হয় তার। মায়ের সাথে ঘটা অন্যায়ের কারণ না জেনে কোন পুরুষের সাথেই জীবনটাকে জড়াবেনা সে। অথচ সে জানেও না মায়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অনিয়মের কারণ জানলে পুরুষদের প্রতি তার ঘৃণাই থাকবে, কোন অনুভূতি থাকবে না।
—————————
অনিমার পথ আগলে দাঁড়ালো কলি। অনুরোধ করল বড় জা’কে। খুব করে অনুরোধ করে জিজ্ঞেস করল রুবাবা থাকা সত্ত্বেও কেন নিজাম সাহেব দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। টেনে নিজের জন্য বরাদ্দ করা ঘরটায় নিয়ে এল বড়’জাকে। স্বামী বিদেশ থাকায় নিশ্চিন্তে আড্ডা বসে তার ঘরটায়। আজও বড় জা’য়ের বলা সকল কথা শুনতে চায়, জানতে চায় মেজ জা’য়ের জীবনের ব্যর্থতা কোথায় ছিল।
অনিমা শুরুতে গড়িমসি করলেও ধীরে ধীরে বলতে থাকে শ্বাসরুদ্ধকর সেই নির্মম ঘটনা। তারা দু’জন ব্যতীত দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ একজন। কলির অনুরোধ আর অনিমার স্বীকারোক্তি দুই-ই আড়াল থেকে শুনে ঘটনা শোনার আগ্রহটা আর দমাতে পারলো না। পা টিপে টিপে দরজার বাহিরে সতর্ক হয়ে দাঁড়াল মানুষটা। পূর্ণ মনোযোগ বন্ধ দরজার ওপারে।
রয়েসয়ে অনিমা বলতে শুরু করল, “রুবার যখন বিয়ে হয় তখন ওর বয়স আঠারোর মত হবে। মা ওকে যেদিন দেখতে যায় সেদিনই কাবিন করে রেখে আসে। কিন্তু মেজ ভাইয়ের পাগলামিতে পরেরদিন কয়েকজন মানুষ নিয়ে ছোট করে অনুষ্ঠান করে এ বাড়িতে আনা হয় রুবাকে। ওর এইচএসসি পরীক্ষাটা আর দেয়া হয়নি কারণ বিয়ের পর ওকে আর পড়ার সুযোগ দেয়া হয়নি।”
খানিক থেমে ঢোক গিললেন অনিমা। চোখের সামনে সেই স্মৃতি ভেসে আসছে একে একে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার শুরু করলেন, “বিয়ের পরপরই রুবা কনসিভ করে। আস্তে আস্তে তার শরীরটা খারাপ হতে থাকে। আজ জ্বর তো কাল সর্দি, দিনে দিনে ওর সমস্যা বাড়তেই থাকল। তবুও ও কেমন করে যেন ঘরের কাজও করত, সবার খেয়ালও রাখত। কিন্তু বাবার বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। দেখতে দেখতে তোড়া পৃথিবীতে এলো। তিন পুরুষের মধ্যে তোড়াই একমাত্র কন্যাসন্তান ছিল। খুশিতে বাবা পুরো এলাকায় মিষ্টি বিলিয়েছেন। সবাই খুশি হয়ে রুবাকে কত কত উপহার দিল। মেজ ভাই খুশিতে তো হার গড়িয়ে দিয়েছিলেন বউকে। তুই তো জানিস, আমরা সবাই জানি বাচ্চা জন্মের দেড় মাস পর্যন্ত নারীদের নেফাস চলে। কিন্তু মেজ ভাইয়ের সেটা সহ্য হলো না। তিনি রুবাকে আহ্বান করেছিলেন কিন্তু রুবা তাকে জানায় সে অপারগ। আরো কিছু দিন তার ছুটি প্রয়োজন। তখনই বাধে বিপত্তি। মেজ ভাই হম্বিতম্বি শুরু করে, এক পর্যায়ে বলেই বসে বউ পাশে থাকার পরও এতদিন অপেক্ষা করার চেয়ে আরেকটা বিয়ে করে নেয়াই ভালো। একটা মেয়ের জন্য এই লাইনটা কতটা বেদনার তা মেজ ভাই বুঝলো না। এই পঁয়তাল্লিশটা দিনই মেজ ভাইয়ের সহ্য হলো না, নাকি নিজের ইগো স্যাটিসফিকশন হলো না তা বুঝতে পারলাম না। তোড়ার বয়স দুইমাস হতে না হতেই মেজ ভাই সত্যি কাননকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। ওদের বিবাহবার্ষিকীর এক বছর পূর্ণ হতে না হতেই রুবা আজীবনের জন্য সংসার হারাল। পরে অহনের বাবা, আমাদের আর মায়ের জোর অনুরোধ অগ্রাহ্য করে রুবা যায়নি এ বাড়ি ছেড়ে। মেজ ভাই অনুতপ্ত কিনা জানিনা তবে মা বেশ লজ্জায় পড়ে গেছে এর পর থেকে।”
কলি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। বড় বোনের জা’কে বলল, “আমাকে চিমটি কেটে দেখুনতো, সব সত্যি শুনছি নাকি!”
অনিমা তাচ্ছিল্যের হাসিটা হেসে বলল, “সব সত্যি শুনেছিস।”
দরজার ওপারের মানুষটা দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল। একজন পুরুষ হয়েও আরেকজন পুরুষের প্রতি এতটা ঘৃণা এক মুহূর্তে আসতে পারে তা মোটেও জানা ছিলো না। নিজের চাহিদার জন্য অমন নাজুক পরিস্থিতিতে একটা মেয়েকে এতটা আঘাত দেয়া মানুষটা কি সত্যি মানুষ হয়? আয়নার সামনে নিজের অবয়ব দেখে অহন সজোর ঘুষি বসালো ঐ আয়নাতে। নিজের পৌরুষ অবয়ব দেখলেই তো মনে হবে এ বাড়িরই কোন একজন পুরুষ নেহাৎ যৌনতার দায় সারতে দুটো জীবন তছনছ করে দিয়েছে। সে কিভাবে এলোকেশীর সামনে দাঁড়াবে!
চলবে……
[নিজাম সাহেবের ঘটনাটুকু একজনের জীবন থেকে শুনে নেয়া আর বাকি অংশ কাল্পনিক]