এলোকেশী_সে পর্বঃ২ #মাহমুদা_লিজা

0
341

#এলোকেশী_সে

পর্বঃ২

#মাহমুদা_লিজা

গোধূলীর সূর্যটা তেজ কমিয়ে যখন অম্বরে রক্তিম আভা ছড়িয়ে দেয় সেই সময়টা নিজের পোষা অবলা প্রাণীগুলো নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকে তোড়া। বিষণ্ন মনটাকে শীতল করার জন্য এই ছোট তুলতুলে খরগোশের ছানাগুলোকেই নিজের মুগ্ধ শ্রোতা বানিয়ে নিয়েছে। তারা শুনেই যায়, পাল্টা শান্তনা বাক্যের বুলি আওড়ায় না। এলোকেশী আনমনা তনয়ার অশান্ত মনের এলোমেলো ভাবনাগুলো শোনার জন্য তুলতুলে ছানাগুলোর কি দারুণ অপেক্ষা! অন্ধকার নামার আগেই তাদের খাঁচায় রেখে পাখিদের খাবার দিয়ে সন্ধ্যার নামাজটা আদায় করে মেয়েটা। আজও ছোট্ট ছানাটাকে বুকের মাঝের ওমে রেখে বাকিদের পিছনে ছুটে খাঁচায় রেখে দোর আঁটকে দিল। নরম কোমল ঘাসগুলোতে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে সে। বুকের ভেতর চুপটি করে বসে থাকা খরগোশ ছানাটার গায়ে নিজের হাতখানা আলতো করে ছুঁইয়ে দিতে দিতে বলল কতশত কথা। নীরব শ্রোতা শুনে গেল সব।
গোধূলির রক্তিম আকাশের সাথে মিলিয়ে তোড়াও যেন লাল নীল মিশেলের জামাটা পরেছে। এতক্ষণ খরগোশের পিছু ছোটাছুটির দরুন আলগোছে করা খোঁপাটা খুলে দীঘল কালো কেশরাশি কোমর পেরিয়ে ঝুলে পড়েছে। নাকের ডগায় চিকচিক করছে মুক্তোর মত বিন্দু বিন্দু ঘাম। মৃদু সমীরণে এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশ ছেড়ে শুন্যে ভাসছে। আলগোছে কানের পিছনে চুলগুলো গুজে তোড়া যেই সামনে এগোবে তখনি কানে এলো অহনের স্বর – খরগোশটার কানগুলো তোকে কত পরিমাণে গালাগাল দিচ্ছে তুই যদি শুনতি তাহলে ওর কান ছেড়ে নিজের কান টানতি।
কথাগুলো শুনেই পেছনে ঘুরল তোড়া। ধূসর রঙা আইরিশের মেয়েটা দু’বার চোখের পাতা ঝাপটে অধরের কোণে মৃদু হাসিটা টেনে কিন্নরী স্বরে বলল – ভাইয়া! আমি ওর কান আস্তে টানি, আদর করে।
অহন হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে লম্বা ঢোক গিলে ভাইয়া ডাকটা হজম করে বলল – এত জোরে বলার মত ইম্পর্ট্যান্ট কথা তো বলিস নি, চেঁচানোর কি আছে?
তোড়া কপালে ভাঁজ ফেলে খরগোশ ছানাটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল – চেঁচালাম কই?
চোয়াল শক্ত করে অহন হাত বাড়িয়ে তোড়ার হাত থেকে ছানাটা টেনে নিল। আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল – মেজ কাকা তোর জন্য বিয়ে ঠিক করছে, তোড়া। যেই মানুষটা জন্ম দেয়া ব্যতীত তোর জীবনে কোনো ভূমিকা রাখেনি, সে নিশ্চয়ই তোর জীবনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখেনা।
মেয়েটার শান্ত, স্হির, টলমলে নয়নজোড়ার দিকে তাকিয়ে ফটাফট কথাগুলো বলে গেল অহন। এই মেয়েটার বিয়ের কথা উঠলেই তার বুকে তোলপাড় তুলে দেয় দুশ্চিন্তা নামক অথৈ ঢেউ। এই ধূসর রঙের আইরিশ আর কৃষ্ণ পিউপিলের মেয়েটাকে তার জীবনেই চাই। আয়তলোচনা এই রমণী যে তার কত রাতের ঘুম কেড়েছে তা যদি মেয়েটা জানত তাহলে সেই ঘায়েল করা দৃষ্টি নিয়ে কখনোই তাকাতো না।
নীরবতা কাটিয়ে তোড়া ভেতরের দীর্ঘশ্বাসটাকে বাহিরে এনে বলল – আমার জন্মটাই আমার ব্যর্থতা ভাইয়া। মায়ের দুর্দশার কারণ। জীবনটাকে আরেকবার ব্যর্থ করতে চাইনা ঐ লোকটার জন্য। বড় ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের জন্মের অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলতে আমার বেশ বাঁধছে কিন্তু ঐ মানুষটাকে আমার জীবন এলোমেলো করার কোন অধিকার দিতে আমি সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক।
কথাগুলো বলতে বলতে অবাধ্য চুলগুলো হাত খোঁপা করার জন্য যেই পেঁচিয়েছে অমনি অহন গলা উঁচিয়ে বলল – বুড়া মহিলাদের মত চুলে খোঁপাটা যদি বেঁধেছিস, এখনই একদম চুলের অপারেশন করে দিব বললাম।
তোড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অহনের দিকে তাকিয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিল। কপালের ওপর এদিক সেদিক ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো তর্জনী দিয়ে সরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই মায়ের মুখ ঝামটা শুনতে হবে। রাজকন্যার গমনপথে কোন এক রাজপুত্রের অপলক চাহনির হদিস যদি ভুল করেও রাজকন্যার অবগত হত, তবে সেই কন্যার হৃদয় হরণ করতে রাজপুত্রের সময় বিশেষ লাগবেই না। দীর্ঘশ্বাসটা বুকের গহীনেই চাপা পড়ল অহনের। আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তাকে!

বাড়ির দরজায় পা রাখতেই মায়ের আদলে সূক্ষ্ম ভ্রূ কুঞ্চন পরিলক্ষিত হলো। বিরস কন্ঠে মায়ের অভিযোগ – কয়বার ডেকেছি? চুল এখনো খোলা কেন? কোথায় গিয়েছিলে?
প্রতিটি দিন সন্ধ্যার আগে এই প্রশ্ন মায়ের কাছ থেকে শুনতে হয় তোড়াকে। প্রতিদিন একই প্রশ্ন, একই উত্তর, তবুও কেউই ক্লান্ত হয়না যেন। মায়ের প্রশ্নের গতানুগতিক জবাব দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই তোড়াকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে ফের প্রশ্ন ছুড়লো রুবাবা – তুই আবারও অন্যের ড্রেস সেলাইয়ের কাজ করছিস?
ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই চোখজোড়া দেখে পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে ধাতস্থ করল তোড়া। ঘুরে দাঁড়াল মায়ের দিকে। শারীরিক ভঙ্গিমায় এবং স্পষ্ট জবাবে জানাল – ফর্ম ফিলাপের টাকাটা দিয়েছিলাম ঐ টাকাগুলো থেকে।
মেয়ের অমন রসকসহীন কাঠখোট্টা জবাবে রুবাবার কপালের পাশের শিরাগুলো দগদগ করে উঠলো। গলার স্বর দ্বিগুণ শৃঙ্গে চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন – আম্মা যে টাকাগুলো দিয়েছে ওগুলো কোথায়? কয়টাকা কম পড়ছিল যে তোকে অন্যের জামা সেলাই করে নিজের পড়ার খরচ দিতে হবে?
মায়ের যুক্তি শুনে তাচ্ছিল্যের হাসিটা ঠোঁটের কোণে চলেই এসেছে। এমন কথাই আশা করেছিল তোড়া। তাইতো উত্তর আগেই সাজিয়ে রেখেছে – তুমি তো জানোই আমি পড়ালেখা কিংবা আমার হাতখরচের টাকাটা এই পরিবারের কারো কাছ থেকে নেইনা। তুমি তো জানোই মা, আমি অন্যের টাকায় যে খাবারটা খাচ্ছি সেটা কাঁটার মত গলায় বিঁধে থাকে, বাধ্য হয়ে একান্ত বাধ্য হয়ে এখানে খাচ্ছি, থাকছি। শুধু তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবো না বলে। নইলে এখান থেকে বেরিয়ে নিজে উপার্জন করে সবাইকে দেখিয়ে দিতাম তোড়া আর যাই হোক দূর্বল নয়।
কথাগুলো শেষ করতে না করতেই মায়ের থাবার মত হাতের জোড়ালো চড়টা এসে পড়ল মেয়েটার বাম গালে।
পরিণাম জানাই ছিল, তাইতো তার প্রতিবাদ নেই। বা’হাতে গালটা ধরে মায়ের দিকে আর তাকালো না তোড়া। ভূমিতে দৃষ্টি রেখেই অপেক্ষা করছে পরবর্তী সুনামির। সাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করতে করতে রুবাবা বললেন – সবকিছুই বেশি বুঝতে হবে তোকে? কেন, দুনিয়ায় আর কারো বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেনি?
মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই তোড়া মা’কে থামিয়ে বলল – অনেক পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করে মা, তারা দুই বউকেই প্রাধান্য দিতে জানে। তারা নিশ্চয়ই প্রথম বউকে ঘরের কোণে ঠেলে দিয়ে অন্য বউ নিয়ে মেতে থাকেনা! ওসব বাদ দাও। ঐ মানুষটা কখনো আমার জন্য দায়িত্ব পালন করেছে? স্কুলের প্যারেন্টস মিটিংয়ে কেন তুমি নয়ত বড় জ্যেঠুকে যেতে হয়েছে? তিনি তো দিব্যি দ্বিতীয় বউয়ের সন্তানদের নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করেন। শুধু টাকা দিলেই দায়িত্ব পালন হয়ে যায় না, অধিকার জন্মে যায় না, কর্মও করা লাগে। তোমাকে বলে কি হবে! তুমি তো কবেই মেরুদণ্ড ভেঙে বসে আছো।
মেয়ের অমন বেফাঁস কথাবার্তা আর সহ্য হলো না। হাতে থাকা খুন্তিটা দিয়েই একচোট বসিয়ে দিলেন মেয়ের বাহুতে। নিজের হৃদয় গহীনের রক্ত ক্ষরণটা যদি মেয়ে দেখতো তাহলে এত বড় অভিযোগ আনত না। সে ও তো চায় এমন জীবন থেকে মুক্তি পেতে কিন্তু মেয়ের অধিকারের বেলায় ঐ মানুষটাকে নাকানি চুবানি খাওয়াতে চান তিনি, ঐ লোকটার পরিণতি নিজ চোখে দেখতে চান। সবাই যাকে দুর্বল ভাবছে, সেই মানুষটার প্রতিশোধ স্পৃহার প্রবলতর আক্রোশ কেউ কল্পনাও করছে না।
কয়েক চোট মার খেয়ে স্হির দাঁড়িয়ে তোড়া। পাথুরে মূর্তির মত শক্ত হয়ে আছে সে। এমন জীবনের চেয়ে মৃত্যু ঢের। চোখের অবাধ অশ্রুকণা গাল গড়িয়ে চিবুক বেয়ে পড়ছে। দুধে আলতা ফর্সা গালটায় লাল হয়ে বসে আছে মায়ের আঙ্গুলগুলোর দাগ। লম্বা স্লিভে ঢাকা বাহুগুলোর না জানি কি অবস্থা!
রুবাবার চিৎকার শুনে কলি,অনিমা,মেহেরজান আর কানন বেরিয়ে এলো। অনিমা দৌড়ে এসে রুবাবাকে থামালো, কলি এসে তোড়াকে সরিয়ে নিল, আলতো করে চোখের জল মুছিয়ে বলল – দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছিস, একবার ডাকবি না?
মেয়ের ফুলে ওঠা চোখের দিকে দৃষ্টি দিতেই মায়ের কোমল মনটা কেঁপে উঠল। তিনি জানেন অন্যের রাগ মেয়ের উপর মিটিয়েছেন, তিনিই তো চান মেয়েটা প্রতিবাদী আর আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠুক। জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে হাতের খুন্তিটা ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। মেহেরজান এতক্ষণে মুখ খুললেন – দিন দিন পাষাণ হইয়া যাইতাছো রুবা। আমার নাতনীর চাঁদ মুখখানা দেইখাও তার গায়ে হাত উঠানোর মত শক্তি যহন তোমার শইরলে আইছে তাইলে বুঝা যাইতাছে তুমি নিষ্ঠুর হইয়া গেছো।
রুবাবা কিছু বলার আগেই কানন মুখ খুলল – ওনার জায়গায় আমি হলেও এই কাজই করতাম, বরং বেশি মারতাম আরো। মেয়েদের মুখে এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা মানা যায় নাকি?
কথাটা শোনা মাত্রই পরিবেশ আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠল। রুবাবা নীরবে হাসলেন কথাটা শুনে। তিনি জানেন প্রতিবাদ মানেই কথার পিঠে কথা নয়। প্রতিবাদের ভাষা মানেই কি ফিরতি জবাব?
সবসময় গর্জে উঠে তর্জনী তুলে প্রতিবাদ না করেও কিন্তু অপরপাশের মানুষটাকে কঠিন জবাব দেয়া যায়। ঐ যে নিজেকে বদলাতে হয় একটু, এই আর কি! প্রতিবাদের ধ্বনিতে থাকে হুংকার আর পরিবর্তনের ভাষায় থাকে ডোন্ট কেয়ার। অন্যকে বদলানোর ক্ষমতা তো আমাদের নেই, তাই নিজেকে বদলে রক্তচক্ষু না দেখিয়ে শীতল, শোণিত দৃষ্টি নিয়েও জবাব দেয়া যায়। অনিমা, কলি আর মেহের জান ক্রুদ্ধ নয়নে চাইলেন কাননের দিকে। এই মহিলাটাই যত নষ্টের মূলে। কিন্তু তোড়া থেমে থাকলো না। গলার স্বরে সর্বোচ্চ আওয়াজ এনে বলল – গরুর দুধে গরুর মূত্র যেমন অবাঞ্ছিত, ঠিক আপনার মত মহিলাও আমাদের মা-মেয়ের মাঝে অবাঞ্ছিত। নিজের বিশ্রী বা’হাতটা আমাদের মাঝে না ঢুকিয়ে নিজের এখতিয়ারে থাকুন।
তোড়ার ঝাঁঝালো কথাগুলো শুনে কানন তেড়ে এসে বলল – অসভ্য মেয়ে, থাপড়ে সোজা করে দিব।
তখনই কানে এলো অনিমার ছোট ছেলে অয়নের গম্ভীর স্বর – নিজের সীমায় ফুলস্টপ টানুন, আমাদের বাড়ির মেয়ের গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করবেন না।
অয়নকে দেখে ঘড়ির দিকে তাকালেন সবাই। সময়টা সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে নামল সেই খেয়াল নেই কারো। এবার যে একে একে ঘরের পুরুষেরা আসা শুরু করবেন, তার আগেই পরিস্থিতি সামাল দিতে রুবাবা মেয়েকে ঘরে যেতে বলে নিজেও চলে গেল। তোড়া একবার অয়নের দিকে তাকালো, আরেকবার কাননের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলল – ভাইয়া, আপনার মেজ কাকার দ্বিতীয় স্ত্রীর এই ঔদ্ধত্যের খবরটা তার স্বামীকে জানিয়ে দিবেন। দেখি ঐ পুরুষ মানুষটা নিজের দ্বিতীয় স্ত্রীকে কি শাসন করে।
কথাটা বলেই স্হান ত্যাগ করল তোড়া। কানন মুখটাকে বাঁকিয়ে মনে মনে কথা সাজাচ্ছেন কিভাবে স্বামীর কানে মেয়ের নামে কথা ঢালা যায়! অয়ন এগিয়ে এসে হাতের ব্যাগটা সেন্টার টেবিলে রাখতে রাখতে বলল – এক কাপ চা দিও আম্মু, আর মেজ কাকা আসলে আমি কথা বলব, ওনাকে জানিয়ে দিও।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here