#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বঃ২৩
মৃতদেহ হস্তান্তরের মুহূর্তে রামীম অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ল। হাসপাতালের বিল মিটিয়ে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে স্হান লপেল রুবাবার নিথর দেহ। নাঈম মজুমদার বারবার চেয়েছেন রুবাবার শেষ খরচটা দেয়ার। রামীমের জেদের কাছে হার মানলেন তিনি। কাটকাট ভঙ্গিতে তরুণ ছেলেটা বলেছিল -“আমার বোনকে সমাহিত করার আগে আপনার ভাইকে জেলে ঢুকাব ভাইয়া। আনার বোনকে নিয়ে আপনাদের বাড়ি যাব। ওখান থেকে আমার বোনের মৃতদেহ আর আপনার ভাইয়ের জীবিত দেহ একসাথে বেরোবে। আমার বোন বের হবে দাফনের জন্য, আর আপনার ভাই বের হবে জেলে ঢোকার জন্য। আজ কারো বাঁধা আমি শুনব না।”
রামীমের কড়া হুশিয়ারিতে অয়ন সমর্থন জানিয়ে জানাল -“আমি যাব আপনার সাথে, মামা। আমি সাক্ষ্য দেব। আমার ছোট মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের হেস্তনেস্ত না করে আমি ক্ষান্তি দিবো না।”
নাঈম মজুমদার রামীমের কাঁধে হাত রেখে চোখজোড়ার ইশারায় নিজের আকুন্ঠা সমর্থন জানালেন। বিষণ্ণ, বিবশ মেয়েটাকে নিজের সাথে আগলে রেখে অহন বলল -“যেতে হবে মামা, চলুন।”
দূর থেকে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। লাঠিতে ভর করে কাঁপা দেহটা টেনে এনে বাড়ির মূল ফটকে দাঁড়ালেন মেহের জান। একদিন এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে স্বাগতম জানিয়েছিলেন রুবাবাকে, সেদিন লাল বেনারসী পরিহিতা রমণীকে দু’হাত বাড়িয়ে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। জায়গাটা একই, মানুষটাও একই, শুধু কাপড়ের রং বদলেছে। মিরান আর অয়ন ঢুকেছে বাইক নিয়ে। অহনের বাইকটা মিরান এনেছে। পরপরই গেটের সামনে থামল বাড়ির কালো রঙা গাড়িটা আর লাল-সাদা মিশেলের বিশেষ গাড়িটা। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স লেখা গাড়ি থেকে রামীম নেমে এলো। অহন নামল পরপর। এক হাতে টেনে নামাতে চাইল তোড়াকে। মায়ের হাত আঁকড়ে ধরে রাখা মেয়েটা কোনমতেই মা’কে ছেড়ে আসবে না। অহন আবারও অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে গেল। পরম মমতায় জড়িয়ে ধরল স্ত্রীকে। মাথায় নিজের ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে বলল -“এসো, ছোট মা’কে নামিয়ে আনি।”
কায়দা করে স্ত্রীকে নামিয়ে আনল অহন। অ্যাম্বুলেন্স থেকে পা নামিয়েই গগন বিদারী আর্তনাদে মুষড়ে পড়ল তোড়া। ধূলোর লুটিয়ে বসল। ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে স্ট্রেচারে করে নামিয়ে আনা হলো রুবাবার নিথর দেহ। তোড়া দৌড়ে এসে মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুক ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল সবাই।
অহনের স্মৃতিতে হানা দিল পুরোনো সেই দিনগুলো। যখন হোমওয়ার্ক করার জন্য মায়ের হাতে কান মলা খেত, তখন এই মানুষটা এসে সরিয়ে নিতো নিজের জিম্মায়। নিজ হাতে কত হোমওয়ার্ক করে দিত। আর দু’ভাই মিলে দুষ্টুমিতে মেতে উঠত। দৌড়ে এসে এটা সেটা খাওয়ার বায়না করত, তখন এই মানুষটা সুপারিশ করত অনিমার কাছে। মায়ের আদরে আগলে রাখত।
নাক টেনে চোখের জল আড়াল করে অহন বলল -“ছোট মা’কে নিয়ে যাওয়া হবে আবার। কে কে যাবে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে যাও।”
পুলিশের গাড়ির হুইসেল ছুটে আসছে মজুমদার বাড়ির পানে। মিনিট দুয়েক বাদে উর্দি পরিহিত চারজন পুলিশ এলো ভেতরে। দুপুরের পরই থানায় গিয়েছিল রামীম। বোনের সাথে শেষবারের মত কথা বলার সময়ের কনভারসেশনটা রেকর্ড করেছিল মুঠোফোনে। সেই কনভারসেশনের উপর ভিত্তি করে নিজাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে এসেছিল।
বাড়িতে শোকের মাতম চলছে, তার উপর পুলিশ দেখে থমকালো সকলে। গমগমে আওয়াজে একজন পুলিশ বলল -“নিজাম মজুমদার কে? তাকে হাজির করুন।”
সঙ্গে সঙ্গে মেহেরজান জবাব দিলেন -“আমার মেজ পোলা। ঘরে আছে, টাইনা নিয়া আসেন।”
মেহেরজানের অনুমতি পেতেই দু’জন পুলিশ বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। খানিক বাদে নিজাম মজুমদারকে নিয়ে বাহিরে আসতেই অয়ন বলল -“ওনার করা মানসিক অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে আমার ছোট মা আজ শেষ হয়ে গেছে। নিয়ে যান টানতে টানতে।”
কানন এক প্রকার উড়ে এসে বলল -“সব মিথ্যা কথা।”
এক প্রকার হৈ – হল্লা শুরু হলো বাড়ির সামনে। নিজাম মজুমদারের অবনত মস্তক। তুষার, তন্ময় দু’ভাই ভীত নয়নে চেয়ে রইল। তোড়া চোখ মুছে মায়ের বুকের উপর থেকে মাথা তুলে বসল। ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে বলল -“এই লোকটা আমার আম্মুকে উস্কেছে বারবার। আমার আম্মুকে প্রতিদিন কথার যাঁতাকলে পিষে মারত। সেই অপমান, অপবাদ সহ্য করতে না পেরে আমার আম্মুর মানসিক চাপ সীমা ছাড়িয়েছে, মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছে। আমার বা আমার মায়ের প্রতি কোনো রকম দায়িত্ব পালন না করে উনি ওনার দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে বেশ উড়েছেন। আমাদের মা-মেয়ের প্রতি অবহেলা এবং ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ জানাচ্ছি ইন্সপেক্টর। আমি এর কঠিন থেকে কঠিনতর দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই। এই মুহূর্তে যদি আমাকে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে হয়, আমি তাই জানাব। তবুও আমার মায়ের লাশ বেরোনোর আগে ওনাকে জেলে দেখতে চাই।”
অপ্রত্যাশিত ঘটনায় নিজাম মজুমদারের চক্ষু চড়কগাছ। এইদিকে তোড়ার মৌখিক বয়ান লিপিবদ্ধ করে ওসি বললেন -“আমরা অভিযোগ গ্রহণ করেছি। মিস্টার নিজাম, আপনি চলুন আমাদের সাথে।”
মেহেরজানও অভিযোগ করলেন ছেলের বিরুদ্ধে। কানন দৌড়ে এসে থামানোর চেষ্টা করল পুলিশকে। বুক ফাটা আর্তনাদে মাথা চাপড়াতে লাগল। তুষার আর তন্ময় এগিয়ে এসে অহনের পাশে দাঁড়াল। মিনমিন করে বলল -“বাবাকে সত্যি নিয়ে যাবে?”
অহন পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো -“অনিয়ম হচ্ছে নাকি?”
মাথা নাড়িয়ে তুষার বলল -“জানি না।”
অয়ন মুখ ফিরিয়ে বলল -“এতদিন তোড়া পায়নি ছোট কাকার আদর। সেই কষ্টে ছোট মা গুমরে মরেছে। এবার তোরা বঞ্চিত হবি আদর থেকে। এই যাত্রায় তোরা, তোদের মা এবং তোদের বাবা গুমরে গুমরে মরবি। সেই ব্যবস্হার শেষ পাতায় লিখে দেব অসংজ্ঞায়িত।”
পুলিশের গাড়ি এবং অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন আলাদা করা যাচ্ছে না, দু’টোই ছুটে চলছে গন্তব্যে।
*******************
দেখতে দেখতে দু’টো দিন কেটে গেল। মজুমদার বাড়িতে ফিরে এলো সবাই। সব কেমন নেতিয়ে গেছে। কেমন রঙহীন লাগছে সবটা। উপর থেকে নিচে নামলো তোড়া। সোফায় বসে থাকা অনিমার গা ঘেঁষে বসল। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বলল -“জ্যেঠীমা, থানায় যাব। আমার অভিযোগ তুলে নিতে চাই। ওনার ছেলেরা আমার কাছে অনুনয় করছে। ওনার স্ত্রী আমার নিকট সাহায্য আবেদন করেছে। ওনার বিরুদ্ধে আমি অভিযোগ তুলে নিতে চাই। ওনাকে জানাতে চাই ওনার স্ত্রীর করা সাহায্যের আবেদন আমি মঞ্জুর করেছি।”
অয়ন মুখ তুলে তাকাল। কলি মিনমিন করে বলল -“অহনকে বলেছিস?”
উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে তোড়া বলল -“বলেছি।”
অনিমার বিচক্ষণ দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করলো মেয়েটাকে। এই সিদ্ধান্তের পেছনের হেতুটা জানার জন্য তিনি মরিয়া। সেই মেতাবেক জানতে চাইলেন -“হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের কারণ কি মা?”
তোড়ার ঠোঁটে মলিন হাসি। সদ্য মা হারানো মেয়েটার বুকে তখনো থরথরে কাঁপন। মাতৃবিয়োগের হাহাকারে খন্ড খন্ড তার হৃদয়। তবুও চোখ মুছে জবাব দিলো -“এই বাড়িতে ফিরে আসলে ওনার মনে হবে উনি জেলফেরত আসামী। পাড়ার লোকে বলবে উনি আমার মায়ের পরোক্ষ হত্যাকারী। ওনার স্ত্রী সন্তান জানবে উনি ফেরারি। ওনার কর্মস্হলের লোকজন জানবে উনার মুখোশের আড়ালের সত্যি রূপ। আর সবচেয়ে বড় কথা, উনি জানবে আমি ওনার মত মানুষরূপী অমানুষ নই। আমার জন্য উনি বাড়ি ফিরতে পারছেন। এরচেয়ে লজ্জাজনক, ন্যাক্কারজনক মানসিক যন্ত্রণা দ্বিতীয়টা কি হয়, জ্যেঠীমা!”
হাতের পিঠে চোখ মুছে তোড়া অপেক্ষা করতে লাগল অহনের জন্য। ঐ মানুষটা স্পষ্ট জানিয়েছে সে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। নয়ত একাই যেত তোড়া। বাবা নামক মানুষটাকে মানসিক যন্ত্রণা দেয়ার আয়োজন শুরু হয়েছে তার। এখন শুধু হিসাবটা বুঝিয়ে দেয়া বাকি। প্রতিটি ক্ষণ তার মায়ের জন্য যেরূপ বিষাদময় ছিল, ঐ মানুষটাকেও সেরূপ প্রতিটি ক্ষণ উপহার দিতে চায় সে। সবসময় ছাড় দিতে হয়না, কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া মানে অন্যায়। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে ন্যায়ের বিলুপ্তি ঘটবে যে।
চলবে……
(অসুস্থতা নিয়ে এটুকু টাইপ করতে পারলাম। খাপছাড়া লাগবে আজ, মানিয়ে নিবেন প্লিজ।)