এলোকেশী_সে #মাহমুদা_লিজা পর্বসংখ্যাঃ ১৩(বর্ধিতাংশ-২)

0
222

#এলোকেশী_সে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বসংখ্যাঃ ১৩(বর্ধিতাংশ-২)

সদর দরজার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে দিলো অহন। কোনমতেই সে হাসি দমিয়ে রাখতে পারছে না। বাবা আর মায়ের দিকে তাকিয়ে তাদের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করল। নাঈম মজুমদারের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে, অনিমা ততক্ষণে ধুপ করে বসে পড়ল সোফায়। বিলাপের মত আর্তনাদ করে বসল মানুষটা। স্ত্রীর আচমকা কান ফাঁটা শব্দের কান্নাটা নাঈম মজুমদারকে আরো চটিয়ে দিল। খ্যাক করে উঠে বললেন -“থামো, যখন তখন মরা কান্না জুড়াবে না তো। এখনও মরিনি তো, কিন্তু তোমার ছেলে মারার প্ল্যান করছে।”
কথাটা শুনেই অয়ন অস্পষ্ট স্বরে বলল -“বাবা!”
ব্যস ষোলকলা পূর্ণ হলো যেন। অয়নের মুখে বাবা ডাকটুকু শুনেই চিৎকার দিয়ে বললেন -“কে তোর বাবা? আমি তোর বাবা নই। এখানে এসেছিস কেন, বেরিয়ে যা। কত বড় লায়েক হয়েছিস? বাবা মাকে না জানিয়ে বড় ভাইয়ের আগে অন্যের মেয়েকে ভাগিয়ে বিয়ে করেছিস।”
অয়নের পান্ডুর মুখটা এবার ভীষণ অসহায় লাগছে। কতটা নিরুপায় হয়ে সে কাজটা করেছে তা বোঝার চেষ্টা করছে না কেউ। অনু মাথা নুইয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে লজ্জা আর ভয়ে। সবুজ রঙা থ্রিপিসের বড় ওড়নাটা দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। বা’হাতটা ধরে রেখেছে অয়ন।
ছোট ভাইয়ের উস্কেখুস্ক চুল আর শুকনো মুখটা দেখে এবার বেশ মায়া হলো অহনের। এগিয়ে এসে বাবাকে বলল -“আগে ওদের ঘরে আসতে দাও বাবা, সম্পূর্ণ ঘটনাটা শুনে না হয় সিদ্ধান্ত নিও।”
অহনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফুঁসে উঠল অনিমা। গর্জে উঠে বলল -“একদম উমেদারি করবি না ওর হয়ে, ও কি চোর নাকি? চুরি করে বিয়ে করল কেন?”
অহন মায়ের কথায় খানিক বিরক্তবোধ করল, তবুও নিজপর স্বরটাকে সংযত রেখে বলল -“চুরি করে বিয়ে করলে তো পালিয়েই যেত আম্মা, দরজার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াত না।”
তোড়া রুবাবার ডান বাহুটা আঁকড়ে ধরে দেখছে তামাশা। বড়দের মাঝে কথা বলাটা বারণ, নয়ত এতক্ষণে দৌড়ে গিয়ে অনুকে জড়িয়ে ধরত।
ছেলের কথা শুনে নাঈম মজুমদার অনুকে উদ্দেশ্য করে বললেন -“এই মেয়ে! তুমি ঘরে এসো আর ওকে বাহিরে থাকতে বলো। তোমার মুখ থেকে শুনব আগে সব।”
নিজের বা’হাতটা আগলে রাখা অয়নের হাতটাকে খামচে ধরল অনু। এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠল মেয়েটা। সবাই তব্দা খেয়ে গেল যেন ঐ কান্নার শব্দে। অয়নের বুকটায় ধ্বক করে উঠল যেন। বাবার দিকে করুণ দৃষ্টি নিয়ে বলল -“ওর দোষ নেই বাবা, ওকে ধমকিয়ো না।”
কথাটা শোনা মাত্রই নাঈম মজুমদারের মেজাজ শৃঙ্গে চড়ল। প্রায় ছুটে গিয়ে ছেলের গালে চড় বসানোর আগেই ছুটল তোড়া কিন্তু তার আগেই বাবা আর ভাইয়ের মাঝে এসে দাঁড়াল অহন। তোড়া জ্যেঠার পাশে এসে থমকে দাঁড়াল। মিহি স্বরে বলল -“বড় বাবা শান্ত হোন, আপনার বিপি বেড়ে যাবে।”
অহন শীতল চাহনিতে তোড়াকে একপলক দেখে বাবার উদ্দেশ্যে বলল – “কেন এমন করছো বাবা? বিয়ে করাটা কি অন্যায়? আমি মানছি আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছে ও। আচ্ছা বাবা, অয়ন যেভাবে কথা বলে, কাজ করে তোমার কি মনে হয় ও এভাবে বিয়ে করবে! বাবা কোন সমস্যা না হলে ও নিশ্চয়ই এমনটা করত না। ফাঁসির আসামীকেও তো নিজের পক্ষে যুক্তি রাখার সুযোগ দেয়া হয় কিন্তু তুমি ওকে সেই সুযোগটাও দিচ্ছো না।”

অহনের কথা শুনে ফের চেচিয়ে উঠল অনিমা -“এজন্য বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করে আসবে, তাইতো!”
অহন এবার নিজেকে দমাতে পারল না। সে-ও খানিক ক্রুদ্ধ হয়ে বলল -“নিয়ম যদি হয় বড় ভাই আগে বিয়ে করার তাহলে আমি যদি জীবনেও বিয়ে না করি তবে কি ওকেও ঘরে পুষে রেখে দেবে নাকি?”
বাবা মায়ের মৌনতাকে সম্মতি মেনে অয়ন আর অনুকে ঘরে আসতে বলে অহন। অহনের আদেশ শুনে কলি এগিয়ে গেল তাদের ঘরে আনতে, রুবাবার ইচ্ছে থাকলেও সে গেলো না। তার মনে পড়ে গেল এই বেশেই সেই জায়গায়টায় এসে দাঁড়িয়েছিল কানন আর নিজাম মজুমদার। দগদগে অতীতটা তাজা হয়ে উঠেছে যেন। চোখজোড়া বন্ধ করে আবার খুললেন তিনি। মনে করতে চান না সেই নিষ্ঠুর স্মৃতি।

তোড়াও জ্যেঠার পাশ থেকে সরে অনুর হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসল। ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়াল অয়ন। অনুকে সোফায় বসিয়ে তোড়া আবার জ্যেঠার পাশে এসে দাঁড়াল। অনুর কান্নারত আদলটা খানিক শীতল করে দিয়েছে নাঈম সাহেবের রাগকে। পিতৃস্নেহকে উপেক্ষা করতে পারলেন না তিনি। রাগটা দমন করে তিনি এবার খানিক তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন -“মেয়েদের দোষ কি জানো? তারা ভালো ছেলেদের দিকে না তাকিয়ে অপদার্থ, উজবুকের পাল্লায় বেশি পড়ে। তা আম্মাজান আপনিও সেই ভুল কেন করেছেন? এই বানরের গলায় মুক্তোর মালাটা কেন জড়িয়েছেন? নিজের জীবনখানা নিয়ে কোন স্বপ্ন নেই নাকি!”

এত এত কথার পরও অয়নের নীরবতা মানতে পারছে না অনিমা। তার ছেলেতো এতটা শান্ত নয়! অহনও আঁড়চোখে ভাইয়ের মৌনতা দেখছে। অল্পতে কাবু হওয়ার ছেলেতো অয়ন নয়। ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখতেই ছিটকে দূরে সরে গেল অহন। জ্বরের তোপটা আজ অনেকটাই বেশি। অহনের মনে হলো অয়নের শরীরটা কাঁপছে। বাবার দিকে তাকিয়ে সে বেশ ঝাঁঝাল স্বরে বলল -“তোমার জেরা থামাবে বাবা! তোমায় ব্যবসায়ী হিসেবে জানতাম, উকিলবনে গিয়েছ কবে? অয়নের অবস্থা দেখেছো একবার?”
মাতৃস্নেহের কাছে হার মানল সকল অপরাধ। দৌড়ে এসে ছেলের পাশে দাঁড়াল অনিমা। তার গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন তিনিও। কন্ঠে রাগ ছিল নাকি অভিমান ছিল বোঝা গেলো না। খানিক নিভু নিভু কন্ঠে তীর্যক চাহনি নিয়ে বললেন -“এত জ্বর নিয়েও বিয়ে করতে চলে গেলি। বিয়ের আনন্দে জ্বর পালানোর কথা তো।”

এবার আর চুপ থাকতে পারল না অয়ন। ভারী গলায় বলেই বসল -“বউয়ের যদি দুইটা গুন্ডা ভাই আর অসুরের মত বাবা থাকে তখন বিয়ের আনন্দের বদলে পেটে মোচড় মারে। বুকের ভেতরও জ্বলে, অ্যাসিডিটি বলে জ্বালাপোড়া চালিয়ে নেই।”

ছোট ছেলের দিকে এক পলক তাকিয়ে নাঈম সাহেব ফের বোমা ফাটালেন -“আমি কিন্তু বিয়েটা মানিনি অয়ন।”
বাবার কথায় অয়ন চুপ থাকলেও মুখ খুললো অহন। থমথমে মুখটাকে এবার হাস্যোজ্বল করে বলল -“বাবা, তুমিই চ্যালেঞ্জ করেছিলে কেউ ওর বউ হবেনা। এখন বাজিতে হেরে কি ট্রিট দিবে সেই বাজেট রেডি করো।”
তোড়া হাসতে চেয়েও হাসলো না। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে অহন গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াল মাকে শান্ত করার জন্য। তার কানে এলো তার মা আর ছোট চাচীর নিষ্ঠুর কথোপকথন -“এখন কি হবে বড় ভাবী? দেখছো অয়নও আমাদের মত তোড়ার কথা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছে। নয়ত মুখ গোমড়া করে রাখত নাকি! তোড়ারও নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে অয়নের বিয়েটা ও কিভাবে মানবে? কত সুন্দর মিলমিশ ছিল দুজনের! না জানি মেয়েটার মনের কি অবস্থা! ওর বান্ধবীই তো ওর জন্য কাল হলো।”

কান দিয়ে যেন উষ্ণ বাষ্প আসা যাওয়া করছে, নিঃশ্বাস যেন আঁটকে গেছে গলায় এসে। নিজেকে আর প্রবোধ দিতে পারল না। কর্কশ স্বরটাকে সর্বোচ্চ আওয়াজে নিয়ে বলল -“অদ্ভুত তোমাদের মন মানসিকতা। কারো সাথে কেউ একটু হেসে কথা বললেই তোমরা ভাবো প্রেম জমে গেছে। অয়ন অনুকে ভালবাসে বিধায় এতটা রিস্ক নিয়ে ওকে বিয়ে করেছে। সেখানে অন্য কারো কথা আসছে কেন? এখন দেখছি কারো সাথে কথাও বলা যাবে না।”

আচমকা অহনের চিৎকারে পিলে চমকে গেল সবার। অনিমা আর কলিতো ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেছে। ছেলের লালায়িত আদলখানা দেখে নাঈম সাহেব কড়া স্বরে শুধালেন -“ষাঁড়ের মত মায়ের উপর চেঁচাচ্ছো কেন? বেশি বড় হয়ে গেছো?”

চোখের কোণে জল জমা হয়েছে অহনের। বাবার কথা শুনে মুখ ফসকে কিছু বলেই ফেলছিল প্রায়। সম্বিত ফিরতে নিজেকে সংযত করে সে জবাব দিল -“ওনাদের কথাটা শুনলে অয়ন কষ্ট পেত। উদ্ভট চিন্তা ভাবনা ওনাদের।”
সবাই কয়েদখানায় বন্দী আসামিদের মত অনিমা আর কলিকে দেখছে। কলি মিনমিন করে রুবাবাকে বলল -“এভাবে দেখবেন না ছোট ভাবী, আমার শরম করে।”
কলির হেয়ালী কথায় ফিক করে হেসে দিল রুবাবা। সজোরে চিমটি কাটল তার গায়ে। ফিসফিস করে বলল -“মার খাবি বললাম।”
তিন জা’য়ের মিটমিটিয়ে হাসি দেখে তেতে উঠল কানন। মুখ ঝামটা মেরে বলল -“ঘরে সার্কাস চলে।”
কথাটা সবাই নীরবে হজম করলেও অয়ন ধুম করে বলে বসল -“ঘরে সার্কাস চলে বিধায় ফ্রি-তে দেখতে পাচ্ছেন, নয়ত কাগজ গুনতে হতো।”
ছেলে দুটোর জন্য নিজের রাগটাও মিটাতে পারে না কানন, তাইতো ক্ষণে ক্ষণে অভিশাপ দেয় তাদের।

ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সময় গড়িয়েছে অনেক। কাজও পড়ে আছে ওদিকে। যেভাবেই হোক ঘরে বউ এসেছে, তাকে তো আর এতক্ষণ খালি মুখে বসিয়ে রাখা যায় না। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ছেলে মেয়ে দুটোই না খেয়ে আছে। নাঈম সাহেব স্ত্রীকে জানালেন রাতের রান্না করতে হবে না। তিনি খাবার আনানোর ব্যবস্হা করছেন। সেই ফাঁকে ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে নেয়ার আদেশ করে নিজের ঘরে চলে গেলেন তিনি। সবসময় বন্ধুর মত মেশা বাবা নামক মানুষটাকে আজ বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছে অয়নের।

অনিমা অনুর সামনে বসতেই শুকনো ঢোক গিলল মেয়েটা। ভয়ে ঝরঝর করে জল নামতে শুরু করল চোখের কোল বেয়ে। অনিমা তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় এনে নরম স্বরে বলল -“কেন এমন করলে? বাবা-মায়ের মুখটা মনে পড়ে না? আচ্ছা বাবার কথা বাদ দাও, মায়ের অসহায় মুখটা মনে পড়েনি? তোমার এই কাজে সবচেয়ে বেশি কষ্ট তোমার মা পাবে, কারণ সবাই তার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে সে মেয়েকে মানুষ করতে পারেনি।”
শাশুড়ির নরম স্বর অথচ কথাগুলোর ভার নিতে পারছে না অনু। হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে, কাঁপা কাঁপা স্বরে জানাল -“আমার মা নেই আন্টি, আমার জ্ঞান হওয়ার আগেই মারা গেছেন।”
অনেক কথা বলার ছিল অনিমার কিন্তু অনুর এই এক কথায় নির্বাক হয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে বললেন -“তোমার এই কাজের জন্য আমার ছেলের কোন ক্ষতি হবে?”
অনুর জবাবের অপেক্ষা না করে অহন জবাব দিল -“আমি আছি আম্মা। আমার ভাইতো আর একা বিয়ে করেনি। আসুক কেউ ঝামেলা করতে। থ্রি সিক্সটি ডিগ্রীর হট ওয়াটার ফর্মূলা এপ্লাই করব।”
এবার আর হাসি আটকে রাখতে পারল না কেউ। ঠোঁটের উপর হাতের তালুটা চাপা দিয়ে তোড়া ডানে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
ভাইয়ের কথায় আরেকটু জোড়া দিল অয়ন -“শালার ভাই সম্বন্ধী আসুক একবার, দেখিয়ে দেব সে যদি শের হয় আমি তাহলে বাঘা শের।”

থমথমে পরিবেশটা একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে যেন। সবার অজ্ঞাতে দু’জোড়া দৃষ্টি মিলেছিল ক্ষণিকের জন্য। সবার অলক্ষ্যে আড়াল হলো তোড়া। হাতের কাজগুলো সময়ের মধ্যে শেষ করতে না পারলে স্বপ্ন ভেঙে যাবে। অনু আশেপাশে তাকে খুঁজলেও তোড়া জানে আজ অনুর হয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। মা আর জ্যেঠী মিলে ঠিক আগলে নিবে তাকে। তাদের সান্নিধ্যে তাকে ছেড়ে তাইতো নিজের কাজে ফিরল। স্বপ্ন পূরণ তাকে করতেই হবে। একটু একটু করে এগিয়ে যাবে। অল্পকেই একদিন গল্প বানাবে, সফলতার গল্প।

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here