এলোকেশী_সে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ২৫

0
365

#এলোকেশী_সে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ২৫

ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সময়টা মধ্য রাত। বসার ঘরে আলো জ্বলতে দেখে নেমে এলো অহন। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। সোফার দিকে নজর ঘুরতেই অহন থমকে দাঁড়াল। বিমর্ষ নিজাম মজুমদারের চোখে মুখে অস্হিরতা। তাঁর এতদিনের সম্মানে আঘাত হেনেছে নৃশংস প্রতিশোধ নেশা। সন্তানদের সামনে তিনি লজ্জায় মাথা উঁচু করার সাহস পাচ্ছেন না। আশেপাশের সবাই কেমন হেয় দৃষ্টিতে দেখছে। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করছেন এমন কাজ তোড়ার দ্বারা মোটেও সম্ভব নয়। সব দোষ বর্তেছে অহনের উপর। ক্রুদ্ধ নিজাম মজুমদারের ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে এনে সমস্ত শক্তি দিয়ে পেটাতে। অমন বখাটেপনা ঐ ছেলেটা ছাড়া তাঁর ভদ্র মেয়ের দ্বারা মোটেও সম্ভবপর হতো না। তাঁর রাগে ঘি ঢালার কাজটা করলো অহনের স্বর -“মেজ কাকা, আপনি এখনো ঘুমান নি?”

কথাটা কর্ণকুহরে শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করতেই ঘুরে তাকালেন নিজাম মজুমদার। চোখ ঠিকরে যেন আগুন বের হবে। অহন চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইল ফিরতি জবাবের আশায়। ফিরতি জবাব ঠিকই এলো। তবে সাধারণ ভাবে নয়, অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাষায় -“তা তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে নাকি? অসভ্য, অভদ্র ছেলে কোথাকার। আমার মেয়েকে ব্যবহার করে আমার ধ্বংস টানছো। কি ভেবেছিলে? আমার মেয়েকে ব্যবহার করে আমার সর্বনাশ করতে পারলে আমার ভাগের সম্পত্তি তোমার হবে? লোভী, স্বার্থপর ছেলে।”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো অহনের। ইচ্ছে করছে কিছু একটা করে বসার কিন্তু সম্পর্কের জালে বন্দী সে। হাত মুঠ করে ছেড়ে দিল। ভেতরের ফুঁসে ওঠা ক্রোধটা নিয়ন্ত্রণ করে রসিকতার ছলে বলল -“ইয়ে মানে শ্বশুর মশাই, আপনাদের বাবা-মেয়ের ইয়েতে মানে যুদ্ধে আমাকে টানছেন কেন? আপনি তার সাথে অন্যায় করেছেন আর সে প্রতিবাদ করেছে। ব্যস এটুকুই। আপনি ঘটনাটাকে এত মেকওভার করছেন যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে আপনি মিত্র পক্ষ আমি শত্রু পক্ষ।”
নিজাম মজুমদার দাঁত কিড়মিড় করে বললেন -“একদম আমার সাথে ফাজলামো করতে আসবে না। ওসব ন্যাকামি তোমার বাবার সাথে দেখাবে আর আমার মেয়েকে কুবুদ্ধি দেয়া থেকে দূরে থাকবে। নয়ত সম্পর্কের কথা ভুলে অঘটন ঘটিয়ে দেব।”

অহনের দমিয়ে রাখা রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ক্রমে। চোয়াল শক্ত করে সে সবে জবাব দিবে তার আগেই মেয়েলি কন্ঠটা বলল -“আপনার নিকট সম্পর্কের দাম কে আশা করে? আপনি কতটা অঘটন ঘটন পটিয়সী তা আমরা সবাই জানি। আম্মুর সাথে যা করেছেন তার দাম দিতে দিতে আপনার সময় কুলোবে না ওনার সাথে অন্যায় করে তার দাম দেওয়ার।”
নিজাম মজুমদার আঙ্গুল তুলে শাসানোর স্বরে বললেন -“আমার জীবনের কোন পাপের ফল ভোগ করছি তোমার মত সন্তান জন্ম দিয়ে। তোমার মায়ের প্রতি ভালবাসার ছিটেফোঁটা যা ছিল আজ তা ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। সেই মানুষটা না আমাকে বেঁচে থাকতে শান্তি দিয়েছে, আর না মরে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করছে! অবাঞ্ছিত হয়েও নির্লজ্জের মতো সংসারে পড়ে থেকে আমার জীবনটা ছারখার করে দিয়েছে। তোমার মত নির্লজ্জ সন্তান শত্রুরও না হোক।”
ফুটন্ত তরলের ন্যায় টগবগ করে উঠল তোড়া। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি অথচ শান্ত স্বর -“সহীহ বলেছেন। নির্লজ্জতা আমার ধমনীতে, শিরায় শিরায়।”
নিজাম মজুমদার ফের কিছু বলার আগেই প্রস্হান করল তোড়া। সে জানে এখানে থাকা মানে তর্ক সৃষ্টি করা। অহেতুক তর্ক তার অপ্রিয়। অহন একবার তাকালো নিজাম মজুমদারের পানে, কথা না বাড়িয়ে সে-ও উঠে এলো তোড়ার পিছু পিছু।
তোড়ার নির্লিপ্ততা ভাবাচ্ছে ভীষণ। নিজাম মজুমদারের ভাবনায় চলেই এলো, তার চারপাশের অক্সিজেন বিষাক্ত হয়ে গেছে।

*************

আড়ালে দাঁড়িয়ে ছেলে আর ভাইয়ের তর্কযুদ্ধ শুনলেন নাঈম মজুমদার। ছেলের বউয়ের নীরবতায় আঁচ করলেন মেয়েটা নতুন কোনো ফন্দি আঁটছে। কি অদ্ভুত মেয়েটার প্রতিবাদের ভাষা! স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ হলেন তিনি। তাঁর ছেলের জন্য এই মেয়েটা যে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। নীরবে ঘরে ফিরলেন তিনি।

ঘুমে চোখ আপনাআপনি লেগে আসছে অনুর। তবুও পরীক্ষার পড়াটুকু শেষ হয়নি এখনো। অল্প বিস্তর বাকি রয়ে গেছে। এদিকে বসার ঘর থেকে অহন আর নিজাম মজুমদারের তর্কাতর্কি শুনে মনোযোগ খানিক বিক্ষিপ্ত হয়েছিল তখন। অয়নকে অবশ্য বারবার তাগাদা দিয়েছিল নিচে নামার জন্য। অয়নেরও ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু নিজাম মজুমদার আর অহনের সম্পর্কটা এখন আর চাচা-ভাতিজায় সীমাবদ্ধ নয়, তারা শ্বশুর-জামাই নামক নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ। সেই দোহাইতে অয়ন চেয়েছিল তার ভাই সামলে নিক, বাড়াবাড়ি বেশি হলে না হয় তখন দেখা যেত।

চেয়ারে ঢুলে ঢুলে অনু পড়ছিল। অয়নও পাশের চেয়ারে বসে আছে। অনু অবশ্য বার কয়েক চেষ্টা করেছিল আড্ডা জমানোর, তবে অয়নের স্পষ্ট আদেশ -“আপাতত ভুলে যাও আমি তোমার বর। এখন আমিই তোমার অভিভাবক। আমার তরফ থেকে সোজা আদেশ হচ্ছে পড়া শেষ না করা অবধি ওঠা যাবেনা।”
অনু পড়ছিল বিধায় সে নিজেও ঘুমোয়নি, ঠায় বসে ছিল স্ত্রীর পাশে। একধ্যানে দেখছিল স্ত্রীকে। মেয়েটা পড়তে পড়তে ঢুলে টেবিলে পড়ে যায় ঘুমে, তখন আবার তাকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে ফের পড়ার তাগাদা দেয় অয়ন।

ঘড়ির কাঁটায় দু’টো বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। অনুর পড়া মোটামুটি আয়ত্ত্বে এসেছে। তখনই অয়নের গম্ভীর স্বর -“পাশ আসবে? নাকি ট্যাগ পাবেন ফেল্টুসের?”
অনু ভ্রু কুঁচকে বলল -“ভালোমতো পড়েছি।”
অয়ন সটান দাঁড়িয়ে গেল চেয়ার ছেড়ে। বিছানার দিকে এগোতে এগোতে বলল -“শাড়ি চেঞ্জ করে থ্রিপিস পরে এসো, রাত বিরাতে মাথা নষ্ট করার দরকার নেই তো।”
অনু মুচকি হাসল স্বামীর কথা শুনে। তারও বেশ লাগে অয়নকে জ্বালাতে। তাইতো হাই তুলতে তুলতে ঘুম ঘুম ভাব করে জবাব দিল -“মাথা নষ্ট হলে ডাক্তার দেখান পদার্থবিদ। আমাকে দোষারোপ করবেন না।”

বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়েছিল অয়ন। অনুর কথা শুনে অপলক চেয়ে রইল তার পানে। সবুজ রঙা শাড়িতে কি ভয়ংকর রকমের সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।
অনু ঘাড় সমান চুলগুলো সামনে এনে অয়নের ঘোর ভাঙানোর জন্য বলল -“আমার ঘোড়ার লেজের মত চুলগুলো বড় হবে কবে? বাচ্চা মেয়েদের চুলও আমার চুলের চাইতে বড় হয়।”
অয়নের দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত হলো না। মুগ্ধ নয়নে আগের মতই তাকিয়ে থাকল। অনুর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো। ধুপধাপ পা ফেলে লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল। পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা টেনে শরীর ঢেকে শুয়ে পড়ল উল্টোপাশে ঘুরে। ওভাবে শুয়েই বলল -“শুভ রাত্রি।”
অয়নের ঠোঁটজোড়া ঈষৎ প্রশস্ত হলো। অনুর গায়ে জড়ানো কাঁথাটা টেনে সরিয়ে নিল। ভ্রু নাচিয়ে বলল -“আলো বন্ধ করবে কে? বিছানায় যে পরে আসবে আলো তাকে বন্ধ করতে হবে। হয়ত আলো বন্ধ করে এসো, নয়ত ঘুমোতে দেব না।”
অনুর হেলদোল হলোনা মোটেও। চুপটি করে শুয়ে রইল। অয়ন শীতল কন্ঠে বলল -“তুমি কি উঠবে? পোশাক বদলে আসবে। দু’মিনিট সময় দিলাম নয়ত ওয়াশরুমে আঁটকে রাখব নিয়ে।”
পাশ ফিরল অনু। মিনমিন করে জবাব দিল -“মাথা ধরেছে। একদম উঠতে ইচ্ছে করছে না।”
কথা বাড়ালো না অয়ন। নিজেও শুয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে অনুকে টেনে নিজের বুকের উষ্ণতায় জড়িয়ে বলল -“ঘুমাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

****************

বইপত্র গুছিয়ে টেবিলে রাখল তোড়া। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা অহনের পাশে এসে বসল। এক হাত তার পিঠে ছোঁয়াতেই উঠে বসল। মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল -“কিছু বলবে?”
তোড়া উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বলল -“কষ্ট পেয়েছেন?”
অহন হাসল নিঃশব্দে। তোড়ার বা’হাতটা টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল -“এসব ছোটখাটো কথায় আমার কিছু হয়না।”
ওষ্ঠযুগল প্রশস্ত হলো তোড়ার। ডান হাতটা দিয়ে অহনের গোছানো চুলগুলো এলোমেলো করে বলল -“শুয়ে পড়ুন, আমি আলো নিভিয়ে আসছি।”

সুইচ টিপে আলো বন্ধ করে বিছানার নিকট আসতেই মুঠোফোনে ফ্ল্যাশ লাইট অন করল অহন। নির্বিঘ্নে বিছানায় উঠে বসল তোড়া। মলিন মুখটায় বিষণ্নতার ছাপ। বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। ছোট্ট করে ফের শুধাল -“ঘুমাবেন না?”
মূর্তির মতো বসে থাকা অহন বলল -“একটা জিনিস চাইব। ইচ্ছে হলে দেবে, না-হলে দেবে না। উত্তর জেনে ঘুমাবো।”
তোড়াও এবার উঠে বসল। দু’জনের দূরত্বটা কমিয়ে তোড়া আরেকটু ঘনিয়ে বসল। অল্প ভাষায় বলল -“বলুন।”
আলতো হাতে স্ত্রী গাল স্পর্শ করে শুধালো -“ভালোবাসি বলবে না!”
খানিকটা সময় নিয়ে কিছু ভাবল তোড়া। তারপর দু’জনের দূরত্ব আরো কমিয়ে বলল -“আপনার মন কি বলে? আমি আপনাকে ভালবাসি নাকি বাসিনা?”
অহনের নীরবতায় তোড়া ফের শুধাল -“আপনি বড্ড চুপচাপ থাকেন।”
মৌনতা ভেঙে জবাব এলো -“উত্তর পাইনি।”
তোড়ার ঝটপট উত্তর -“যদি বলি ভালবাসি!”
শীতল স্বরে ফিরতি জবাব -“তবে তুমি আমার।”
ফিসফিসিয়ে তোড়া শুধাল -“যদি ভালো না বাসি?”
সরল বাক্যে জবাব এলো -“তবুও তুমি আমার।”
অহনের হাতজোড়া টেনে নিল তোড়া। দু’হাত ছুঁয়ে নির্দ্বিধায় স্বীকার করল -“ভালবাসি মাস্টার মশাই। যতটা ভালোবাসলে আমার কঠিন খোলসটা আপনার একটুখানি সান্নিধ্যে চুরমার হয়ে যায়, ঠিক ততটা ভালবাসি। এবার পরিমাপ করার দায়িত্ব আপনার।”
কি অকপট স্বীকারোক্তি! অহন ফিসফিস করে বলল -“বুকের ভেতরটা অস্হির ছটফট করছে, হাত দিয়ে দেখো না, হার্টবিট মিস করছি যেন।”
নাক টেনে তোড়া বলল -“ওটা অ্যাসিডিটির জন্য হয়েছে। মেডিসিন নেয়া উচিত ছিল। আপনি বরং বেশি করে পানি খেয়ে আসুন।”
মুখে কথাটা বললেও নিজে ঠিকই এগিয়ে এসে মাথা রাখল অহনের উথাল-পাতাল বুকটায়। গভীর আবেশে জড়িয়ে ধরে বলল -“মাস্টার মশাই, মেয়েরা কি অভিশাপ?”
অহন স্ত্রীর মাথাটাকে নিজের বুক থেকে উঠিয়ে দু’হাতের তালুতে তার ছোট্ট মুখটা আবদ্ধ করে বলল -“উহু আশীর্বাদ।”
তোড়া মিষ্টি করে হেসে বলল -“সৃষ্টিকর্তার নিকট খুব করে চাইব, আমাদের প্রথম সন্তানটা যেন কন্যা নামক আশীর্বাদ হয়।”
তোড়ার এই রূপটায় রীতিমতো চমকাল অহন। সবার সামনে গম্ভীর মেয়েটা তার কাছে খোলা বইয়ের মত। নতুন করে চিনছে যেন। অহনের মৌনতায় ভ্রু কুঁচকে তোড়া শুধালো -” কিছু বলবেন না?”
সম্বিত ফিরল অহনের। মিষ্টি হেসে বলল -“সবার কাছে তোড়া ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট, তবে আমার তোড়া ভীষণ রকমের চঞ্চল মেয়ে। আমিও সৃষ্টিকর্তার নিকট একই দোয়া রাখব।”

হাই তুলে তোড়া এবার শুয়ে পড়ল। অহন ভ্রু কুঁচকাল, মেয়েটা সত্যি রহস্যময়ী।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here