এলোকেশী_সে #মাহমুদা_লিজা পর্বসংখ্যাঃ৭

0
221

#এলোকেশী_সে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বসংখ্যাঃ৭

অসময়ে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো বাড়ির ভেতরের লোকজন। রুবাবা দৌড়ে এসে দরজা খুলতেই প্রথম নজর পড়ল তোড়ার শ্বেত পোশাকটায় শুকিয়ে যাওয়া লোহিতের পানে। সেকেন্ডের ব্যবধানে সেই নজর থমকালো অহনের চোখের উপরে থাকা সাদা পট্টিটার উপর। অয়নের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখেই রুবাবা নিজেও দু’পা এগিয়ে তার বাকি ভরটুকু নিজের উপর নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে ঘরে এলো।

রান্নাঘর পেরিয়ে বসার ঘরে এসে আর্তনাদ করে চিৎকার করে উঠলো অনিমা। সকাল থেকেই বারবার রুবাবাকে বলেছিলেন তাঁর কাছে কেমন অস্হির অস্হির লাগছে। বুকটা হঠাৎ হঠাৎ কেন যেন হাহাকার জানান দিচ্ছে। এজন্যই বুঝি বলে মায়ের মন বাতাসের আগে দৌড়ায়!
অনিমা দৌড়ে এসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বিলাপ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। অয়ন খানিক নাক মুখ কুঁচকে বিরক্তির আভাস আদলে ফুটিয়ে মাকে বলল -” আহা, আম্মা! এমনিতেই ও স্ট্রেসড, তার উপর আপনার হাউমাউ কান্নায় প্যানিক করা শুরু করবে। হালকা গরম পানি করুন, ওকে শরীর মুছিয়ে দিতে হবে।”
ছেলের কথা শুনেও অনিমা থামলেন না। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদেই চলেছেন। অহন মাকে শান্ত করার জন্য একগাল হাসল। মাথায় আসা দুষ্টু প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার জন্য মন হাস ফাঁস করছে। নিজের মনটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে এবার ধুম করে বলেই বসল -“আম্মা তুমি তোমার বিয়ের দিনও এভাবে কান্না করেছিলে? না মানে, বলতে চাচ্ছিলাম এত জোরে কেঁদেছিলে? আমার হার্টবিট ধুপধাপ করছে, না জানি ওখানকার মানুষগুলোর কি অবস্থা হয়েছে!”
কথাটা বলে নিজে নিজেই কাঁধ উঁচিয়ে ভ্রু নাচিয়ে অয়নের জবাব চাইল। অয়ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে বসল -” তুই এমনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাস কেন? এমনভাবে তাকাইলি যেন তখন আমি ছিলাম।”
দুই ভাইয়ের আজগুবি অহেতুক তর্কাতর্কিতে বিষাদময় পরিস্থিতিতেও সবাই হেসে কুটিকুটি কিন্তু অনিমা বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি মনে মনে ভাবছেন নাঈম মজুমদারের ছেলে তো তাঁর মতই হবে। হাত তুলে ছেলেকে মারতে গিয়েও থেমে গেলেন।
সবার ম্লান মুখে হাসি দেখে অহনও হাসল, তার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে তাহলে। আশেপাশে নজর ঘুরালো, নিজের এলোকেশীকে কোথাও দেখতে পেলো না। নিজের গায়ের দিকে তাকাল একবার। এলোকেশীর দেয়া ওড়নাটা তখনো তার পুরো গা ঢেকে রেখেছে। বুকের বা’পাশের ওড়নাতে আলতো হাত রেখে ঝট করে উঠে দাঁড়াল। ব্যাথাতুর কন্ঠে অয়নকে বলল তার ঘরে পৌঁছে দিতে।

অয়নের কাঁধে ভর দিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরল অহন। অনিমা তখনো চোখের জল মুছে নিচ্ছে শাড়ির আঁচলে। চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখলেন তোড়া তখনো রক্তমাখা কলেজের পোশাকে চুলার ধারে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে। গলাটা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করলেন চুলায় জ্বাল দেয়া পাতিলটাতে কি দিয়েছে মেয়েটা। বেখেয়ালি মেয়েটার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে সেই হুঁশ নেই। চুলার উপর থেকে পাতিলটা নামিয়ে পেছনে ঘুরতেই জ্যেঠীকে দেখে চমকে উঠল তোড়া। পাতিলটা জ্যেঠীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল – “ডাক্তার বলেছে হালকা গরম পানি দিয়ে ভাইয়ার শরীরটা মুছে দিতে হবে আর সেলাইর জায়গাটা দু’বার করে ড্রেসিং করতে হবে পাঁচ দিন। সেলাইর আর ব্যান্ডেজ লাগানো জায়গাটা পানিতে ভেজানো নিষেধ।”

তোড়ার অনুভূতিহীন বুলি আওড়ানো অনর্গল শুনে গেল অনিমা। মেয়েটার পুরো কাপড়ে ছোপ ছোপ রক্ত দেখা মাত্রই তিনি আঁতকে উঠলেন -“এগুলো সব আমার অহনের রক্ত, তোড়া!”
জ্যেঠী মায়ের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে যেন। মৃদু হেসে তোড়া বলল -“রাস্তার ধূলোবালিও আছে। ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে শীঘ্রই, চিন্তা করোনা জ্যেঠীমা।”
কথাটুকু বলেই স্হান ত্যাগ করল তোড়া। ঐ মানুষটার পান্ডুর মুখটা সে দেখেছে কতটা কাছ থেকে, ঐ মানুষটার ব্যাথায় আর্তনাদের প্রতিটা শব্দ সে শুনেছে। সে চায় না মনের ছোট্ট কুঠুরিতে অনুভূতির জন্ম দিতে কিন্তু অনুভব বড্ড বেহায়া। বারবার ঐ মানুষটার পাংশুটে আদলটা হৃদয়টাকে চুরমার করে দিচ্ছে। এলোমেলো পায়ে রান্নাঘর ছেড়ে সিঁড়ির কোণায় আসতেই মায়ের ডাকে থমকালো তার পা। মায়ের বাজের মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুঝতে তোড়ার খুব একটা কষ্ট হলোনা। সে বুঝতে পারল কোন কঠিন জেরার মুখে সে পড়তে যাচ্ছে।
রুবাবা মেয়েকে হাত ধরে টেনে সিঁড়ি পেরিয়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করল। ঘাড় ঘুরিয়ে কোন ভণিতা ছাড়া জিজ্ঞেস করল – “অহনের এক্সিডেন্ট হয়েছে তুই কিভাবে জানলি? আমার সন্দেহ যদি ভুল না হয় তাহলে তোর কলেজের পোশাকভর্তি ওর রক্ত লেগে আছে, তাইনা!”

তোড়া শীতল দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে চাইল। তার মনে প্রথম এলো তার মা কি তাকে অবিশ্বাসের চূড়ায় বসালো? এমন পাষাণ, নির্দয়, কঠিন প্রশ্নটা কি করে করল মানুষটা! তার ব্যক্তিত্বকে কি মা নামক মানুষটা প্রশ্নবিদ্ধ করছে! সব ভাবনা উপেক্ষা করে তোড়া মুখস্থ বুলির মত জানাল -“রাস্তায় ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছে, কাকতালীয়ভাবে আমি তখন সেই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। পরিবারের একজন সদস্য কেটে ছিড়ে রাস্তায় পড়ে থাকবে আর আমি কি তখন সেটা দেখেও চলে যাব?”
মেয়ের কথা শুনে বুকের ভেতরের দমবন্ধ ভাবটা কমল রুবাবার। মেয়ের সামনে এসে দুহাতের তালুতে মেয়ের কোমল আদলখানা আবদ্ধ করে কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু খেল রুবাবা। চোখের কোণের জলটা মুছে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তিনি বলতে থাকলেন -“তোর উপর আমার ভরসা আছে, বিশ্বাস আছে। এমন কোন ভুল জীবনে করিস না যার জন্য তোকে ভুগতে হয়। আমি চাইনা তোর জীবনটা আমার মত হোক। বিয়েটাকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে না ভেবে নিজের দায়িত্ব নেয়ার মত প্রত্যয় রাখিস মা। যাতে কোন পুরুষের উপেক্ষা তোকে মচকে না দেয়। অনুভূতির স্হান মনে দিস না মা। কিছু মিথ্যে অনুভূতি জীবনের অন্তিমদশা দেখায় মা। আমি বেঁচে মরার মত হয়ে আছি, তোর জীবনটাকে সাজিয়ে নে, বাঁচার মত বাঁচতে হবে।”

মায়ের প্রতিটি কথায় তোড়া স্পষ্ট টের পেয়েছে অহনের প্রতি জন্মানো অনুভূতি পিষে ফেলার আদেশ এসেছে। মায়ের চোখটা ফাঁকি সে দিতে পারেনি, সে ধরা পড়েছে মায়ের স্নেহের ছোঁয়ায়। চোখের কোণের জলটুকু নীরবে আড়াল করে নিল। পুরুষদের প্রতি আকাশসম ঘৃণাও অহনের প্রতি জমানো অনুভূতিকে ম্লান করতে পারেনি। তাহলে মানুষটা সত্যি স্পেশাল তার জীবনে। মায়ের কথায় বুক ফেটে কান্না কেন আসছে! সে বাঁচতে চায়, নিজের দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতাও অর্জন করতে চায় কিন্তু ঐ মানুষটার জন্য জন্মানো অনুভূতি সে পিষে ফেলতে চেয়েও কেন আবার পিছু হটে! মায়ের কথায় ভুল নেই কিন্তু সে হায়া হারাতে চায়না।

মায়ের বুক থেকে চট করে মাথা উঠিয়ে তোড়া বলল -“ক্লান্ত লাগছে আম্মা, আমি রেস্ট নিব।”
মেয়ের কথায় রুবাবা বুঝতে পারল মেয়েটা এখন একা থাকতে চায়। দেরী না করে তিনিও পা ঘুরিয়ে দরজার কাছে এসে আরেকবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন -“জামাগুলো দে, ধুয়ে দেই।”
নিজের শরীরে জড়ানো এপ্রোনটায় আলতো স্পর্শ করে তোড়ার মনে হলো মানুষটার এত নিবিড় ছোঁয়া সে ধুয়ে ফেলার মত সাহসী হয়নি। মানুষটার ব্যাথাতুর আর্তনাদ লেগে আছে এই পোশাকে। তার রক্ত না মুছে নিজের কাছে যত্ন করে রেখে দিবে, নিজের অনুভূতিটুকু না হয় অজানাই থাক ঐ মানুষটার কাছে।
মায়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে তোড়া জবাব দিল -“আমি ধুয়ে দিতে পারব।”

ছোট্ট জবাবটুকু দিয়েই পার্পল কামিজটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল তোড়া। এপ্রোনটা খুলে নিজের চোখের সামনে মেলে ধরল। নাহ, সে পারবে না রক্তগুলো সাবানজলের স্রোতে ঢেলে দিতে।

________

নিজের শরীর ঢাকা সাদা ওড়নাটা হাতে নিয়ে নিজের আলমারিতে তুলে রাখল অহন। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে এসে বিছানায় বসল। হাঁটুতে বারবার টান লেগে যন্ত্রণায় চোখমুখ কুঁচকে যাচ্ছে তার। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথাটা সহ্য করে ট্রাউজার আর টি শার্টটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। একহাত দিয়েই মুখে পানির ঝাপটা দিল। বেশ কায়দা করে ছিঁড়ে যাওয়া ফরমাল কালো প্যান্টটা আর গেঞ্জিটা ছেড়ে ধূসর রঙা ট্রাউজার আর কালো টি-শার্টটা পরে ওয়াশরুম ছেড়ে বাইরে আসতেই দেখল অয়ন বসে আছে।
ভাইকে দেখেই তাড়া দিল কিছু খেয়ে ওষুধটা খেতে। ফোনে দৃষ্টি রাখা অয়ন খানিক ভ্রু কুঁচকে বলল -“আচ্ছা তুই বাইকটাকে কি ভুলে বিমান ভাবছিলি? বিমানের ভাইব নিচ্ছিলি নাকি?”
অহন ঘাড় না ঘুরিয়েই আড়চোখে তাকাল অয়নের দিকে। অয়ন থামলো না। সে ফের বলতে শুরু করল -“লাভের লাভ কি হলো? বাইক নিয়ে উড়াল দিতে গিয়ে মাঝরাস্তায় দুই চাক্কার পাইলট বাইক ক্রাশ করে আহত হলো আর এগিয়ে এলো কে? এগিয়ে এলো মহারাণী লক্ষ্মীবাঈ।”
অয়নের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নিজের সুস্থ থাকা হাত দিয়ে তার চুল টেনে ধরল অহন। অয়ন গলা ছেড়ে চেঁচাতে লাগল – “আম্মা আপনার দুই চাক্কার পাইলট আমার চুল ছিঁড়ে ফেলল।”
ছোট ভাইয়ের পিঠে ধুম করে কিল বসাতেই ফোনের রিংটোনটা চিৎকার শুরু করেছে। ফোনটা হাতে নিতেই মিরানের নাম দেখে অহন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল -“যাহ ছেড়ে দিলাম, ফোন না বাজলে তোর চুল ছিঁড়ে টাক গজাতাম।”

অয়ন হাসতে হাসতে ভাইয়ের হাতে লাগানো ব্যান্ডেজে ছোট্ট একটা টোকা দিয়ে দৌড় লাগাল। দরজার সামনে গিয়ে অহনের অনুকরণ করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বের হলো রুম থেকে। হাতের পাশে থাকা বালিশটা ছুড়লো অহন, তার আগেই চম্পট দিল অয়ন।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here