এলোকেশী_সে #মাহমুদা_লিজা **বোনাস পার্ট**

0
507

#এলোকেশী_সে

#মাহমুদা_লিজা

**বোনাস পার্ট**

হাতে থাকা রুটির টুকরোটা প্লেটে রেখে অহন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল -“আমি বিয়ের জন্য তৈরী নয় আম্মা। আর মৃদুলকে আমার পছন্দ নয়, শি ডিজার্ভস বেটার দ্যান মি।”
অনিমা কপালে ভাজ ফেলে যথেষ্ট জোরালো স্বরে বলল -“সেদিন কি বলেছিস? ”
সামনের গ্লাসে থাকা পানিটুকু এক চুমুকে শেষ করে অহন তীর্যক চাহনি নিয়ে বেশ অস্হির হয়ে বলল -” সেদিন মনে হয়েছিল বিয়ে করতে হবে কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বিয়ে কয়দিন পরে করলেও চলবে। তাছাড়া আগে নিজে কতটুকু মানুষ হয়েছি সেটা বুঝতে হবে। যাকে বিয়ে করব তাকে কতটুকু ভালো রাখতে পারব সেটুকু কনফিডেন্স আসুক।”

ছেলের কথা শুনে নাঈম সাহেব গলা ঝাড়লেন কিন্তু কিছু বললেন না। তিনি জানেন এখন কিছু বলা মানেই বেফাঁস কথা শোনা। কিন্তু অনিমা থামলেন না। মেজাজ শৃঙ্গে তুলে তিনি শুধালেন -“বুড়ো হলে বিয়ে করিস, ছেলেমেয়ে নানা ডাকবে। মৃদুলাকে পছন্দ নয় বলছিস কিন্তু নিজেও তো একটা পছন্দ করে রাখিস নি।”
স্ত্রীর কথা শুনে নাঈম মজুমদার ঈষৎ তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন -“তোমার গভর্নর ছেলেদের সাথে প্রেম করবে কোন মেয়ে? কথাবার্তার যেই ছিরি, তার উপর যেই মেজাজ কোনো মেয়ে এক মিনিটের বেশি দুই মিনিট থাকবে না। ওদের বিয়ে নিয়ে ভেবো না তুমি, একজনও দুদিনের বেশি সংসার করার মত পাবলিক না। ওদের ধমকের চোটে বউ তল্পিতল্পা গুটিয়ে সটকে যাবে।”
ডাইনিং টেবিলে হাসির রোল পড়ল। অয়ন নিজের হাসিমুখটায় অমাবস্যা টেনে বলল -“না জেনে বলছো বাবা, তুমি জানো না আমি প্রতিদিন কতগুলো লাভ লেটার পাই। ক্লাস করানোর সময় মেয়েগুলো কত মনোযোগ নিয়ে আমায় দেখে। ভাগ্যিস মাধ্যমিকের স্টুডেন্টদের ক্লাস নেই, নইলে দেখতে মেয়েরা আমায় তুলে নিয়ে বিয়ে করত।”
ছেলের কথা শুনে ভিরমি খেল নাঈম মজুমদার। কাশতে শুরু করলেন হাঁপানি রোগীদের মত। অনিমা তাড়াতাড়ি পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন স্বামীর দিকে।
এক চুমুকে পানি শেষ করে তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খানিক ফিসফিস করে শুধোলেন -“আমার ছেলেরা এভাবে কথা বলে কেন? কোন রাখঢাক নেই। আচ্ছা হাসপাতালে অদলবদল হয়ে গেছিলো নাকি?”
সবাই ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর বেকার চেষ্টা করছে। ততক্ষণে তোড়া তৈরী হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যাওয়ার আগে প্রতিদিন মাকে জানিয়ে গেলেও আজ জ্যেঠীকে জানিয়ে বের হয়ে গেল। হেঁটে যেতে তার বেশ সময় লাগে কিন্তু আজ দেরী হয়ে গেছে। তার উপর মনের অবস্থা বেশ নাজুক।

এদিকে অহন মায়ের উদ্দেশ্যে শীতল চাহনি নিয়ে সাফ জানাল -“সময় হলে আমিই জানাব বিয়ের কথা। আপাতত এসব ভাবছি না। এসব নিয়ে আমাকে আর কখনো কিছু বলো না আম্মা। তোমাদের জন্য আমার সাজানো তরী যাতে না ডুবে, এতটুকু সুযোগ আমায় দিও আম্মা।”
কথাটা বলেই টেবিল ছাড়ল অহন। সদর দরজা পার হওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল-“আমার আসতে লেট হবে।”
বাইকের চাবি আর হেলমেট নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো সে। কব্জিতে থাকা ঘড়িটাতে সময় দেখে নিল। তড়িঘড়ি করে বাইক স্টার্ট দিয়েই হেলমেটটা মাথায় দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। সে জানে মিনিট দুয়েক এই গতিতে থাকলেই এলোকেশীর নাগাল পেয়ে যাবে। কথাটা ভাবতেই ভাবতেই দৃষ্টিসীমায় চলে এলো তার একান্ত প্রিয়জন। বাইকের গতি আরেকটু বাড়িয়ে প্রায় ছুঁইছুঁই হয়ে গেছে মেয়েটার। সে এতটাই বেখেয়ালি ছিলো যে আশেপাশের বাস, গাড়ি নিয়ে তার কোন ধ্যানই ছিলো না। তার মন তখন পড়ে আছে ঐ একটা মানুষের মাঝে। পেছন থেকে নিজের নাম শুনল তোড়া, ঠিক সেই মুহূর্তেই শুনলো কারো আর্তচিৎকার। দ্রুতগামী গাড়িটার সাথে সংঘর্ষ হলো অহনের বাইকের। বাইক নিয়ে ছিটকে পড়লো খানিক দূরে। পিচঢালা কালো রাস্তায় পড়ে হেলমেট খুলে গেল মাথা থেকে। গাড়িটা ততক্ষণে গতি আরো বাড়িয়ে পগারপার।
বাইকটা ছিটকে গেল আরো দু’হাত দূরে। লুকিং গ্লাস, হেডলাইট ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়। আশেপাশের মানুষজন দৌড়ে এসে ঘিরে ধরল অহনকে। এতক্ষণে সম্বিত ফিরল তোড়ার। আচমকা অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সে খানিক ভড়কে গেছে। খেয়াল ফিরতেই সবার ভিড় ঠেলে অহনের পাশে এসে বসল মেয়েটা। অহনের রক্তাক্ত হাতটার দিকে দৃষ্টি রেখে নিজের কোলে টেনে তুলল তার মাথাটা। দু’গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে শুধালো -“ভাইয়া, ভাইয়া, শুনতে পাচ্ছেন?”
নিভু নিভু দৃষ্টিতে অহন দেখল তোড়ার অস্হিরতা, আধো আধো শুনতে পেল মেয়েটার ছটফটানি।
চোখজোড়া বন্ধ হয়ে এলো অহনের। তার শরীর থেকে গড়িয়ে আসা লোহিত উষ্ণ তরলে রঞ্জিত হলো এলোকেশীর শুভ্র পোশাক। তোড়া ততক্ষণে আশেপাশের মানুষদের বারবার চিৎকার করে বলছে সাহায্যের জন্য।

তোড়ার মনে পড়ল তারা বাড়ি থেকে অল্প দূরত্বে আছে। সাত পাঁচ না ভেবে সে ডায়াল করল অয়নের নাম্বারে। হেলেদুলে অয়ন সবে বের হচ্ছিল, মোবাইলের রিংটোনের শব্দ শুনে ঠোঁট দিয়ে ‘চ’ শব্দ করে পকেট থেকে ফোন বের করতেই তোড়ার নাম দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করল। ওপাশ থেকে তোড়ার অস্হির কন্ঠটা শুনে নিজের বাইকের চাবি পকেটে ঢুকিয়ে ত্রস্ত পায়ে ছুটলো তোড়ার দেয়া ঠিকানা বরাবর। দৌড়াতে দৌড়াতে কয়েক মিনিট বাদেই পৌঁছাল সেখানে। ততক্ষণে আশেপাশের মানুষের সাহায্যে অহনকে রাস্তার একপাশে সরিয়ে এনে নীরবে কাঁদছে তোড়া। যেই মানুষটার জন্য মনের কোণে প্রথম অন্যরকম অনুভূতি জন্মেছে সেই মানুষটা অচেতন হয়ে পড়ে আছে তার কোলে মাথা রেখে। বারবার অহনের নাকের কাছে নিজের হাত এনে শ্বাস চলছে কিনা তা চেক করছে তোড়া। শার্টের টপ বাটন দুটো নিজ হাতে খুলে দিয়ে চোখে মুখে কয়েকবার পানিও ছিটিয়েছে।

অয়নকে দেখেই হু হু করে কেঁদে উঠল কিশোরী মেয়েটা। অয়ন দ্রুত সিএনজি ডেকে ভাইকে নিয়ে উঠে বসল সিএনজিতে। তোড়াকে জিজ্ঞেস করল -“যাবি?”
জবাব না দিয়ে হুড়মুড় করে সেও উঠে বসে পড়ল অয়নের পাশে। অচেতন মানুষটার হাতের তালুতে বারবার নিজের হাত ঘষে চেতন ফেরানোর কঠিন চেষ্টা করছে মেয়েটা। নিজের ব্যাগে থাকা রুমালটা পানিতে ভিজিয়ে হাত, মুখে লেগে থাকা লাল তরলগুলো মুছে দিচ্ছে বারবার। বোতলের পানি শেষ হওয়ার পর সিএনজি থামিয়ে আবারও পানি নিয়েছে সে। তোড়ার অস্হিরতা আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করছে অয়ন। কিন্তু মেয়েটার মনের খবর জানতে সেও ব্যর্থ হলো।

কাছের হাসপাতালটার সামনে এসে সিএনজি থামতেই তোড়া নেমে ছুট লাগালো হাসপাতালের ভেতরে। রিসিপশনে গিয়ে জানালো একটা স্ট্রেচার দরকার, বাইক এক্সিডেন্টে অচেতন পেশেন্টকে ইমার্জেন্সি ডাক্তার দেখাতে হবে।
হাসপাতালের রিসিপশন থেকে ডাক পেয়ে দুজন কর্মী স্ট্রেচার নিয়ে ছুটল তোড়ার পিছু পিছু। অয়ন সবে ভাড়া মিটিয়েছে, ততক্ষণে তোড়া স্ট্রেচার নিয়ে হাজির।

_________

হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগ থেকে ছাড়া পেয়েছে অহন। হাত, মাথা আর বুকে সাদা ব্যান্ডেজ লাগানো। বা’চোখের উপরও সাদা পট্টি লাগানো। অয়নের সাথে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বের হলো অহন। দৃষ্টি থমকালো লোহিত তরলে রাঙা শুভ্র বসন পরিহিতা তোড়ার দিকে। ফ্যাকাশে আদলখানায় বিমর্ষ দৃষ্টি নিয়ে ইমার্জেন্সি বিভাগের দরজাটার দিকে চেয়ে ছিল মেয়েটা। অহনকে দেখেই দৌড়ে এসে তার আরেকটা হাত আগলে নিল। নিজের কলেজ পোশাকের সাথে থাকা এপ্রোনের পকেট থেকে বাইকের চাবিটা দেখালো অহনকে। অহন মৃদু হাসল।
অহনের পুরো ভর ছিল অয়নের উপর। তবুও তোড়া অপরপাশে তার বা’হাতটা আগলে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে।
অয়ন কিছু একটা ভেবে অহনের ভরটা তোড়ার উপর ছেড়ে দিয়ে বলল – “তোরা আয়, আমি গাড়ি দেখছি।”
অহন বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। মনে মনে অয়নকে কয়েকশ চুমু দিলো। নিজের ভরটা সম্পূর্ণ নিজের এলোকেশীর উপর না ছেড়ে শুধু হাতটাই তার কাঁধে রেখে বলল -” নিজেই তো বাতাস বইলে পড়ে যাবি, আমাকে কি আগলে রাখবি?”
তোড়া ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাল অহনের দিকে কিন্তু প্রত্যোত্তর করল না। প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য তোড়া বলল -“আপনার কলেজ থেকে কল এসেছিল, আমি বলেছি আপনি রোড এক্সিডেন্টে ইনজুরড। তারা বলেছে সুস্থ হলে কল দেয়ার জন্য। ”
অহন হাঁটতে গিয়ে ব্যাথায় ককিয়ে উঠল। তার ‘আহ’ শব্দটুকুতে তোড়া ছটফট শুরু করল আবার -“কোথায় ব্যাথা পাচ্ছেন? বেশি কষ্ট হচ্ছে?”
অহন ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে বলল -“হাঁটু ছিলে গেছে, ব্যান্ডেজে টান লাগে।”
এদিক সেদিক তাকিয়ে পাশে থাকা ওয়েটিং সিটে অহনকে বসিয়ে দিল তোড়া। নিজের ব্যাগ থেকে সাদা ওড়নাটা বের করে অহনের গায়ের উপর ছড়িয়ে দিয়ে বলল -” এক্সারসাইজ গেঞ্জিতে তো আপনার কাঁটাছেড়া ঢাকা যাবে না। শার্ট ছিড়ে গেছে পুরো।”
তোড়ার নিচু করে রাখা মাথাটা আর অল্প স্বল্প কেয়ারিং অহনের মনের কোণে মৃদু ভাতি জ্বালালো যেন। তার মনে পড়ল জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্তের কথা। এলোকেশীর কান্নাজড়ানো কন্ঠটা তাকে শত ব্যাথার মাঝেও এক দন্ড প্রশান্তি দিয়েছিল। চট করে সে শুধালো -“তখন কাঁদছিলি কেন? আমার জন্য কষ্ট হয়েছিল?”
ছলছলে চোখজোড়া দৃষ্টি মিলাল ঐ মায়াবী নয়নজোড়ার পানে। কিছু বলতে সবে ঠোঁট নাড়াল সে তার আগেই অয়ন এসে বলল -“চল, চল, গাড়ি চলে আসছে।”

তোড়া হাসল মাথা নুইয়ে, অহন আহত দৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকাল। এলোকেশীর জবাবটা আজও জানা হলো না।

এরই মাঝে অয়নের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। অনু নাম দেখেই ঠোঁটের কোণে হাসি মিলল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল -“ভালবাসি, অয়ন সাহেব।”
অধরের কোণে লেগে থাকা হাসিটা আরো গাঢ় হলো। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আবারও হাসল। ফিসফিস করে বলল -“পরে কথা বলছি।”
কথাটা বলেই কল ডিসকানেকট করে অহনকে গাড়িতে বসালো। নিজে ড্রাইভারের পাশে বসে তোড়াকে ইশারা করল অহনের পাশে বসার জন্য।
খানিক দূরত্ব রেখে বসল তোড়া। মুঠোফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে অনুকে মেসেজ করল – “বিকেলে বাসায় আসিস।”
ফোনটা আবার ব্যাগে ভরে রাখল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টি রাখল জানালা গলিয়ে ঐ আকাশ পানে।

চলবে……….

[অনুভূতিটুকু জানিয়ে দিন, কেমন লাগলো বোনাস পার্ট! ঝটপট করে জানিয়ে দিন কেমন লাগছে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here