#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ৫
শাফিন প্রীতির হাত ধরে ফেলে বললো এখন কোথায় পালাচ্ছিস? তখন না দাঁত কেলিয়ে হাসছিলি এখন সেই হাসি গেলো কোথায়?
প্রীতি এভাবে ফেঁসে যাবে বুঝতে পারে নি। কিভাবে এখন এখান থেকে ছাড়া পাবে তাই ভাবতে লাগলো। পরে শাফিনের দিকে তাকিয়ে বোকা হেসে বললো আসলে হয়েছে কি আজ সকালে সুন্দর করে দাঁত ব্রাশ করে দাঁত একদম সাদা করে ফেলেছি তাই দাঁত দেখাচ্ছিলাম, সত্যি আমি হাসছিলাম না।
ওহ তাই নাকি তাহলে তোর সেই সাদা দাঁত এখন একটা একটা করে উপরে ফেললে কেমন হয়? এ বলে প্রীতির একদম কাছে এগিয়ে গেলো।
শাফিনের এভাবে কাছে আসাতে প্রীতি ভয় পেয়ে গেলো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো আ..আমি কিন্তু আ..আন্টিকে ড..ডাক দিবো।
দে আমি কি তোকে আঁটকে রেখেছি নাকি?
শাফিনের এমন ভাবলেসহীন জবাব দেখে প্রীতি ভরকে গেলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কিভাবে এখান থেকে পালাবে।
শাফিন এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললো তোর সাহস হলো কি করে মায়ের কাছে আমার নামে বিচার দেওয়ার? আজতো তোকে আমি….
আর কিছু বলার আগে প্রীতি শাফিনের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো। আকস্মিক আক্রমণে শাফিন হাত ছেড়ে দেওয়াতে প্রীতি দৌড়ে পালিয়ে গেলো।
শাফিন প্রীতির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বেকুব বনে গেলো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো দাঁতের দাগ পড়ে গেছে। রাক্ষসের মতো কামরে দিয়ে পালিয়ে গেলো একে তো পরে দেখে নিবো আমি এ বলে দাঁতে দাঁত চেপে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে দেখলো প্রীতি শাহানা বেগমকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
শাফিনকে দেখে শাহানা বেগম বললো বোস আমি নাস্তা দেই।
লেট হয়ে যাচ্ছে আম্মু বাহিরে খেয়ে নিবো এখন যাই এ বলে প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললো তারাতাড়ি আয়।
শাহানা বেগম শাফিনকে বললো আমার মেয়েকে সাবধানে পৌঁছে দিবি যদি কোনো বকাঝকা করিস তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।
মায়ের কথায় শাফিন ঠোঁট উল্টে বললো এমন ভাবে বলো যেনো এই শাঁকচুন্নি তোমার আসল মেয়ে আর আমাকে কুড়িয়ে এনেছো।
শাফিনের এমন করে কথা বলাতে শাহানা বেগম আর প্রীতি হেঁসে ফেললো।
শাহানা বেগম প্রীতিকে একটু বেশি এই ভালোবাসেন। তার মেয়ে আর প্রীতি এক বয়সী। তার মেয়েটাকে জন্মের পর এই হারিয়ে ফেলেছে। মেয়ের শোকে পাগল প্রায় অবস্থা তার তখন। শরীফ শিকদার (শাফিনের বাবা) আর পাভেল চৌধুরী ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। তাদের শত্রুপক্ষরাই শরীফ শিকদারের মেয়ের জন্মের একদিন পর অপহরণ করে নিয়ে যায়। মেয়ের শোকে শাহানা বেগম পাগলের মতো করতো। প্রীতির বয়স তখন এক সপ্তাহ। শাহানা বেগমের করুণ অবস্থা শুনে পিয়াসা বেগম মেয়েকে নিয়ে ছুটে আসলো। প্রীতিকে পেয়ে তিনি একটু শান্ত হলেন। প্রিতির মাঝে নিজের মেয়েকে খুঁজে পেতেন। প্রীতিকে নিয়ে গেলেই পাগলামো করতেন শেষে কোনো উপায় না পেয়ে শরীফ শিকদার বন্ধু পাভেল চৌধুরীর বাসার পাশে বাড়ি উঠালেন। তারপর থেকেই তারা দুই পরিবার এক সাথে থাকে। শাহানা বেগম ও প্রীতিকে কাছে পেয়ে মেয়ের শোক একটু ভুলে থাকতেন। এভাবে কেটে গেলো ১৭ টি বছর।
—————————–
প্রীতি ভয়ে ভয়ে গাড়িতে যেয়ে উঠলো। ভাবলো শফিন কিছু বলবে কিন্তু প্রীতিকে অবাক করে দিয়ে শাফিন কিছু না বলে চুপচাপ ড্রাইভ করতে লাগলো।
হঠাৎ প্রীতির চোখ গেলো শাফিনের হাতের দিকে। ফর্সা হাতে লালচে দাগ পড়ে গেছে দাঁতের ছাপ। তা দেখে প্রীতির মায়া লাগলো এতো জোরে কামর না দিলেও পারতো। কিন্তু কিছু বললো না। কলেজের সামনে গাড়ি আসাতে শাফিন প্রীতিকে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেলো। অফিসে পৌঁছে চলে গেলো পারফির কেবিনে।
পারফির সাথে কথা বলে যে যার কাজে লেগে গেলো।
দুপুরে পারফি পৌঁছে গেলো প্রিতির কলেজের সামনে। পারফি যাওয়ার কিছুক্ষণ পর প্রীতি আসলো। প্রীতিকে গাড়িতে উঠতে না দেখে পারফি জিজ্ঞেস করলো কি হলো গাড়িতে উঠছিস না কেনো?
প্রীতি আমতা আমতা করে বললে আসলে ভাইয়া একটা কথা বলার ছিলো।
প্রীতিকে এমন আমতা আমতা করতে দেখে পারফি ভ্রু কুঁচকে বললো কি?
আসলে চাইছিলাম ইয়ানাকে একটু দেখতে যাবো, নিয়ে যাবে?
পারফি কিছুক্ষণ ভেবে সংক্ষেপে জবাব দিলো ওঠ।
প্রীতি খুশি বললো সত্যি নিয়ে যাবে? থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া।
পারফি কিছু বললো না গাড়ি ঘুড়িয়ে ইয়ানাদের বাসার সামনে এসে থামলো।
প্রীতি গাড়ি থেকে নেমে বললো তুমিও চলো ভিতরে।
না তুই যা, আমি আছি এখানে দেখা করে আয়।
প্রীতি আর জোর করলো না কারণ জানে পারফি উপরে যাবে না তাই একাই চলে গেলো।
প্রীতি যেতে পারফি তাকালো দোতলার বারান্দায় দিকে। কেনো যেনো সেই স্নিগ্ধ মুখটা একটাবার দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। এখন আফসোস হলো তখন কেনো প্রীতির সাথে গেলো না। গেলে অন্তত স্নিগ্ধ ফুলের মুখটা একটাবার দেখতে পেতো।
আচ্ছা এমন নিস্পাপ স্নিগ্ধ ফুলকে কিভাবে মানুষ আঘাত করে? আমার কাছে এমন একটা স্নিগ্ধ ফুল থাকলে যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিতাম।
নিজের আজগুবি ভাবনায় পারফি নিজেই হেঁসে ফেললো। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। স্নিগ্ধ ফুল আসলেই খুব ভয়ানক এক দিনেই আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে।
পারফি ফের দোতালার বেলকনির দিকে তাকালো যদি একটা বার আসে বেলকনিতে সেই আশায়। কিন্তু পারফিকে হতাশ করে বেলকনির দরজা একটা বারের জন্য ও কেউ খুললো না তা দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপ নিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে বেলকনির দিকে তাকিয়ে রইলো।
প্রীতিকে পেয়ে ইয়ানা সে কি খুশি। প্রীতি ইয়ানার খোঁজ খবর নিতে লাগলো এখন কেমন লাগছে, জ্বর কমেছে কিনা, হাতে ব্যথা কমেছে কিনা, খুব বেশি কি ব্যথা করছে আরো কত কি।
প্রীতিকে এতো ব্যাকুল হতে দেখে ইয়ানা প্রীতিকে একপাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো আমি ঠিক আছি ইয়ার। বাবা, ইমা আপু এসেছে এখন ঠিক না হয়ে পারি?বাবা আর ইমা আপু এক দিনেই আমাকে সুস্থ করে দিয়েছে। যতটুকু অসুস্থ ছিলাম তা তোকে দেখে এখন সব সেরে গেছে।
হয়েছে কত সুস্থ হয়েছেন তাতো দেখতেই পারছি একদম বেড থেকে নামবি না। সারাদিন রেস্ট করবি তারাতাড়ি সুস্থ হবি তোকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না জানু।
কলেজে একা একা নিজেকে এতিম এতিম লাগে।
প্রীতির কথা বলার ধরন দেখে হেঁসে ফেললো ইয়ানা। তখন কিছু নাস্তা নিয়ে রুমে প্রবেশ করতে করতে ইমা বলে উঠলো এতো হাসাহাসি হচ্ছে কি নিয়ে শুনি একটু।
না তোমাকে বলা যাবে না তুমি তো বিয়ে করে আমাদের ভুলেই গেছো আপু বললো প্রীতি।
ভুলি নি রে খুব মিস করি তোদের।
আমরাও তোমাকে খুব খুব মিস করি আপু এ বলে ইয়ানা আর প্রীতি ইমাকে জড়িয়ে ধরলো।
ইমা বললো হয়েছে হয়েছে এবার কিছু খেয়ে নে আর প্রীতি ওটাকে কিছু বলে যা কিছু খেতে চায় না জোর করে খাওয়ানো লাগে।
ইমার এ কথা শুনে প্রীতি ইয়ানার দিকে দাঁত কটমট করে চাইলো না দেখে ইয়ানা বোকা হেঁসে বললো হেহে আপু মজা করছে আমি খাই সারা দিন খাই ইসস।
হয়েছে আপনি যে কতো খান তা আমার জানা আছে এ বলে প্রীতি ইয়ানাকে কিছু ফল খাইয়ে দিলো আর বকাঝকা করতে লাগলো ঠিক মতো না খাওয়ার জন্য ।
ইয়ানা ঠোঁট উল্টে বকা খেতে লাগলো। এভাবে তিনজনের আড্ডার মাঝে অনেক সময় কেটে গেলো।
প্রীতি এবার ইয়ানাকে বললো দোস্ত এবার আমার যেতে হবে। আবার আসবো সময় করে নিজের খেয়াল রাখিস ভালো করে।
প্রীতির চলে যাওয়ার কথা শুনে ইয়ানার মন খারাপ হয়ে গেলো৷ মন খারাপ নিয়ে বললো মাত্রই তো আসলি এখনি চলে যাবি? আরেকটু থাক না…
থাকতাম কিন্তু ভাইয়া নিচে দাঁড়িয়ে আছে আবার আসবো সময় করে দেখে যাবো মন খারাপ করিস না কলিজা আমার।
পারফি নিচে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আর জোর করলো না। ইয়ানা মন খারাপ নিয়ে বললো তাহলে নিচ পর্যন্ত তোকে দিয়ে আসি।
মার চিনিস? নাকি আমি চিনিয়ে দিবো? এখন চুপচাপ ঘুমাবি।
ইয়ানা ঠোঁট উল্টে বললো আচ্ছা।
ইয়ানার ঠোঁট উল্টানো দেখে প্রীতি হেঁসে ফেললো।হেঁসে ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরলো তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখা হলো ইসহাক আহমেদের সাথে। তাকে দেখে প্রিতি সালাম দিলো।
ইসহাক আহমেদ সালামের জবাব দিয়ে বললো কেমন আছো মামনী?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আঙ্কেল আপনি কেমন আছেন?
আছি মা আলহামদুলিল্লাহ, তা চলে যাচ্ছো কেনো? থাকো না আজ…
আরেকদিন থাকবো আঙ্কেল আজ যাই ভাইয়া নিচে ওয়েট করছে।
আচ্ছা চলো তোমাকে দিয়ে আসি।
প্রীতি সম্মতি দিতে ইসহাক আহমেদ প্রিতিকে নিয়ে নিচে নামলো।
পারফি মন খারাপ নিয়ে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তখনি বেলকনির দরজা খুলে ইয়ানা বের হলো তা দেখে মুহূর্তের মাঝে পারফির ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা গেলো। তাকালো সেই স্নিগ্ধ মুখ পানে। যে মুখে নেই কোনো হাসি আছে একরাশ মন খারাপ। মন খারাপ নিয়ে কাউকে হাতের ইশারায় বাই জানাচ্ছে।
পারফি মুগ্ধ হয়ে সবটা দেখতে লাগলো। কেনো যেনো না চাইতেও এই মেয়ের মায়ায় আঁটকে যাচ্ছে পারফি। স্নিগ্ধ ফুলের মন খারাপ টা যেনো ওর নিজের ও মন খারাপ করে দিলো। ওই স্নিগ্ধ মুখে যে শুধু হাসিটাই মানায়।
ইয়ানা একরাশ মন খারাপ নিয়ে প্রীতিকে বিদায় জানিয়ে রুমে চলে যেতে নিলো তখন চোখে পড়লো দূরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পারফির দিকে। ওর দিকেই এক ধ্যানে তাকি আছে তাই ইয়ানা তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেলো। এতে ইয়ানার ভিতরে ধক করে উঠলো। নীলমনির সেই চোখ তার ধারালো চাওনি ইয়ানার বুকের ভিতর ধুকপুকানি বাড়িয়ে দিলো। ওই চোখের দিকে বেশি সময় তাকানোর সাধ্য হলো না ইয়ানার। চোখ নামিয়ে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলো।
ইয়ানার এভাবে চলে যাওয়াতে মুচকি হাসলো পারফি তখন সেখানে উপস্থিত হলো প্রীতি। প্রীতির সাথে আরেকজন ভদ্রলোককে দেখে পারফি বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো কে লোকটা।
তখন প্রীতি বলে উঠলো ভাইয়া উনি হলো ইয়ানার বাবা।
পারফি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
ওয়ালাইকুমুস সালাম বাবা, তা এখানে দাঁড়িয়ে কেনো বাসায় চলো।
পারফি মুচকি হেঁসে বললো আরেকদিন আসবো আঙ্কেল আজ যেতে হবে।
আচ্ছা এসো বাবা সময় করে প্রীতি মামনীকে নিয়ে।
ইন শা আল্লাহ আসবো আঙ্কেল।
কি বলে তোমাকে ধন্যবাদ দিবো বাবা তা বুঝতে পারছি না। আমার কলিজার টুকরো মেয়েটাকে তোমরা বাঁচিয়েছো। তোমরা না থাকলে কি হতো ভাবতেই আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে। তোমাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ রইলাম বাবা।
এভাবে বলবেন না আঙ্কেল আল্লাহ সহায় ছিলো তাই আমরা সময় মতো সেখানে ছিলাম আর বড় কোনো ক্ষতি হয় নি।
জানিনা কারা আমার কলিজার উপর এভাবে হামলা করলো। মেয়েটা আমার বড্ড সহজসরল কখন কে কি ক্ষতি করে ফেলে সেই ভয়ে থাকি সব সময় আর এখন তো ভয় টা আরো বেরে গেলো।
সব ঠিক হয়ে যাবে আঙ্কেল টেনশন করবেন না।
আচ্ছা বাবা সাবধানে যেও তাহলে। অনেক অনেক দোয়া রইলো তোমাদের জন্য। আবার এসো বাবা…
পারফি ইসহাক আহমেদের সাথে হাত হ্যান্ডশেক করে বললো যাই তাহলে ভালো থাকবেন।
তারপর বিদায় জানিয়ে প্রিতিকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পারফি ভাবতে লাগলো মা আর বাবার মধ্যে কতো পার্থক্য। বাবা মেয়ের জন্য কতোটা ব্যাকুল হয়ে আছে আর মায়ের মেয়ের দিকে কোনো খেয়াল এই নেই। এ কেমন মা?
#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰