#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৯||
৫৭।
জানালার পর্দা টেনে দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখছে আহি। তার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তার। যদিও পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। পায়ের ব্যথা মোটামুটি কমেছে তার।
আহি এবার ব্যাগ থেকে তার পছন্দের সোনালি রঙের টপসটা বের করলো। ঘন্টাখানেক আয়নার সামনে বসে নিজেকে সাজালো সে। কতো বছর পর নিজেকে সময় দিচ্ছে! রুম থেকে বের হতেই পুষ্পের সাথে দেখা। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“চল, একসাথে নামি। ব্যথা কমেছে তোর?”
আহি মৃদু হেসে বলল, “কাল থেকে কিছুটা কমেছে।”
আহি নিচে নামতেই পদ্ম আর আফিফকে দেখতে পেলো। পুষ্প আর আহি তাদের টেবিলে বসতেই পদ্ম আহিকে বলল,
“আহি, তোর তো হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।”
আহি বলল,
“কাল থেকে অনেক ভালোই হাঁটতে পারছি। কাল তো পা’টা সোজাসুজি ভাবে বসাতেই পারি নি।”
নাস্তা সাজাতে সাজাতে রাদ আর লাবীবও এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। রাদ আহির দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে বলল, “ভালো আছিস?”
আহি হেসে বলল, “হুম।”
আহির ঠোঁটে আজ অন্য ধরণের হাসি দেখছে রাদ। এমন ভাবে হাসতে আহিকে আগে কখনোই দেখে নি সে। আহি কি তাহলে সেই ট্রমা থেকে নিজেকে বের করে নিয়েছে?
সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তখনই লাবীব বলে উঠলো,
“এভাবে চুপচাপ বোরিং লাগছে। চল, আমরা একটা গেইমস খেলি।”
পুষ্প বলল, “কি গেইমস!”
“একটা শব্দ বলবো, যেমন ধরো আমি বললাম রোগী। রোগী শব্দটা শুনেই প্রথম যেই শব্দ মাথায় আসবে ওইটাই হবে পরের শব্দ। সেই শব্দে শুনে যেটা মাথায় আসবে ওটা হবে তৃতীয় শব্দ।”
“বাহ, বেশ তো। চলো শুরু করি।”
লাবীব আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাইয়া, আপনিও কিন্তু খেলছেন।”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“চলুন না।”
আফিফ মাথা নাড়তেই লাবীব শুরু করলো,
“প্রথম শব্দ নাস্তা।”
রাদ বলল, “ডিম।”
আফিফ বলল, “কুসুম।”
পদ্ম বলল, “ফুল।”
পুষ্প বলল, “গোলাপ।”
আহি বলল, “লাল।”
লাবীব বলল, “রক্ত।”
রাদ বলল, “খুন।”
আফিফ বলল, “আপা।”
আফিফের কথা শুনে সবাই তার দিকে তাকালো। পদ্ম কথাটা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, “চয়ন।”
পুষ্প কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “নাম।”
আহি বলল, “আহি।”
লাবীব বলল, “রোগী।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে লাবীবের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“হাসপাতাল।”
আফিফ বলল, “ব্যান্ডেজ।”
পদ্ম বলল, “আহি।”
আহি হেসে বলল,
“সবসময় আমার নামটা কেন আসে, ভাই? এটা হবে না। একটা শব্দ দ্বিতীয় বার ব্যবহার করা যায় না।”
পদ্ম বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। ওয়াসিকা কবির।”
পুষ্প এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওয়াসিকা ইজ ইকুয়াল টু বান্ধবী।”
আহি বলল, “লিনাশা!”
আহি কথাটি বলেই থেমে গেলো। পদ্ম আর পুষ্প আহির দিকে তাকালো। লাবীব বলল,
“লিনাশা দিয়ে কি বলবো? আচ্ছা, স্কুল।”
রাদ বলল, “স্মৃতি।”
আফিফ বলল, “ছবি।”
পদ্ম বলল, “সিনেমা।”
পুষ্প বলল, “ভিলেন।”
আহি বলল, “তাজওয়ার খান।”
আহির কথা শুনে সবাই এবার তার দিকে তাকালো। আহি হেসে বলল,
“ফরগেট ইট। চল এসব খেলা বাদ দে এখন।”
রাদও কথাটা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করলো। সবাই রাদের কথায় মনোযোগ দিলেও আফিফ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহির দিকে। তাজওয়ার খান নামটা বেশ চেনা চেনা লাগছে তার। কোথায় শুনেছে এই নাম?
(***)
পদ্ম, পুষ্প আর আহি নাস্তা শেষে একসাথে বসে হাসাহাসি করছে। রাদ দূরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহির মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আর আজকের এই পরিবর্তনের জন্য একটা মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি। আর সে হলো নায়ীব তামজিদ। রাদ নায়ীবকে ফোন করে বলল,
“আপনাকে ধন্যবাদ দিলেও কম হবে। আপনি আমাকে কি ফিরিয়ে দিয়েছেন, আপনি জানেন না।”
নায়ীব মুচকি হেসে বলল, “এটা আমার দায়িত্ব।”
এদিকে বিকেলে সবাই বসে গল্প করছিলো। তখন আহি তার ফোনটা রেখে ওয়াশরুমে গেলো। আর সেই মুহূর্তে ফোনে এলো মিসেস লাবণির কল। ফোনের স্ক্রিনে লাবণির ছবি দেখে পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আরেহ, এটা তো লিনাশার আপু! আহি না বললো, ওর সাথে লিনাশার কোনো যোগাযোগ নেই? তাহলে আপুর কল ওর ফোনে কেন আসছে?”
রাদ ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা লাবণির ছবি দেখে বলল,
“আরেহ উনি লিনাশার আপু না। উনি আহির মা।”
পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহির মা? উনাকে আমরা চিনি।”
লাবীব বলল,
“আরেহ, এটা ওর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী!”
পুষ্প আর পদ্ম চোখ বড় বড় করে লাবীবের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“এটা লিনাশার আপু। আমরা উনাকে সামনা-সামনি দেখেছি।”
মুহূর্তেই সবার মাঝে নীরবতা ছেয়ে গেলো। আহি এসে দেখলো তার ফোন পুষ্পের হাতে। পুষ্প ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
“তোর ফোন এসেছে।”
“কার কল!”
“লিনাশার আপু।”
আহি তড়িৎ গতিতে ফোনটা হাতে নিয়ে নিলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেলো আহি। পদ্ম বলল,
“লিনাশার সাথে তোর তো যোগাযোগ নেই।”
আহি থমথমে কন্ঠে বললো,
“আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না।”
আহি দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আহি চলে যেতেই পুষ্প বলল,
“আজ বুঝলাম, লিনু আর আহির এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে কেন ফাঁটল ধরেছে। ওদের জীবনে এতো বড় ঘটনা ঘটে আছে, আর ওরা দু’জনেই এই ব্যাপারে কাউকে জানায় নি?”
রাদ বলল,
“আমার মনে হয় যেটা ওরা জানাতে চায় না, এই বিষয়ে প্রশ্ন করে ওদের বিরক্ত না করা উচিত। আমি তোমাদের দু’জনকে রিকুয়েষ্ট করছি, আহিকে এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না, প্লিজ। ও এমনিতেই অনেক চাপে আছে। এতোদিন আমরা যেভাবে হাসিখুশি স্বাভাবিক ছিলাম, এখনো ওরকমই যাতে থাকি।”
পদ্ম বলল,
“হুম, আমরা কিছু বলবো না। কিন্তু ওদের ভুল বুঝাবুঝি দূর করা তো আমাদের দায়িত্ব।”
রাদ বলল,
“আমরা তো জানি না কি হয়েছে। আহি কখনো এই ব্যাপারে কিছু বলে নি। আমার মনে হয় এসবে আমাদের না জড়ানো উচিত। প্লিজ, আমি আহিকে মানসিক ভাবে দুর্বল দেখতে চাই না। ওর মন ভালো করার জন্য এখানে এনেছি। ওকে অন্তত এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করে আবার ওর মন ভেঙে দিও না।”
আফিফ রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদের আকুতিভরা কন্ঠ শুনে অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাদ আহিকে ভালোবাসে না। ভীষণ ভালোবাসে সে আহিকে। তাই তো আহির জন্য এতোটা উদ্বিগ্ন। আফিফ রাদকে আশ্বস্ত করে বলল,
“তুমি ওর কাছে যাও। পদ্ম এ ব্যাপারে আহিকে কোনো প্রশ্ন করবে না।”
পদ্ম আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ তার হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল,
“কারো দুর্বলতা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করা ভালো।”
রাদ আফিফের কথা শুনে মৃদু হাসলো। মানুষটা বুঝদার। তার এক কথায় পদ্ম আর পুষ্প তাদের উৎসাহ কমিয়ে ফেলেছে। নয়তো মেয়েদের এই এক স্বভাব। পরিস্থিতি যতোই জটিল হোক, উত্তর না পাওয়া অব্ধি শান্ত হবে না। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়ে পদ্ম আর পুষ্প চুপচাপ বসে থাকার মতো মেয়ে নয়। এখানে রাদের অনুরোধও ভিত্তিহীন তাদের কাছে। অথচ আফিফের এক বাক্যে দু’জনই আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। তারা যে এবার আর আহিকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না এ ব্যাপারে রাদ নিশ্চিত।
(***)
আহি রুমে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাদ আহির রুমে ঢুকেই দেখলো আহি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সে ব্যস্ত হয়ে আহির কাছে বসে বলল,
“কাঁদছিস কেন?”
আহি কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুই কি ওদের বলেছিস উনি আমার বাবার স্ত্রী হোন?”
রাদ মাথা নিচু করে বলল,
“হুম, আমি আসলে বুঝতেই পারি নি। হঠাৎ হয়ে গেলো সব। আর এটা কোনো বিষয় হলো? তুই কেন কাঁদছিস?”
“এবার ওরাও আমাকে ভুল বুঝবে।”
“কেন ভুল বুঝবে? কেউ তোকে ভুল বুঝে নি। বিশ্বাস কর, ওরা এসব মাথায়ও রাখে নি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, সবাই আবার নিজেদের মতো গল্প করছে।”
আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই বিশ্বাস কর, আমি জানতাম না এসব। বাবা হুট করে এমন কান্ড ঘটিয়েছিল। এমন সময়ে আমি এই ধাক্কাটা খেয়েছি, যখন আমি নিজেই মানসিকভাবে সুস্থ ছিলাম না। আমি সব হারিয়ে ফেলেছিলাম সেই বছর। কিন্তু আমি এখন মন থেকে ভালো থাকতে চাই। প্লিজ, আমাকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিস না আর।”
রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুই। তোর অতীত না। তোর মতো মিষ্টি মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করার জন্য এই অতীতটা খুবই দুর্বল। তাই এমন ভিত্তিহীন চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেল যে, আমরা কেউ তোকে ভুল বুঝবো।”
৫৮।
রাতে ডায়েরীর পাতা উল্টালো আহি। এরপর কলম হাতে নিয়ে লিখলো,
“এআর, তুমি হয়তো কখনোই আমার কল্পনায় আসবে না। তারা হয়ে গেলে যে। আজ থেকে আবার আমার অনুভূতিগুলো এই ডায়েরীতে স্থান পাবে। শোনো এআর, তোমার জায়গাটা আমি কাউকে দিতে পারবো না। হয়তো এজন্য আমার তোমাকে নিয়ে দেখা অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু আমি তো আহি। স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করবো না, তা তো হয় না। তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো পূরণ হবে, এআর। আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করবো আজই। একটা স্বপ্ন ছিল আমার। সাগর পাড়ে তোমার সাথে সমুদ্র বিলাস করবো। এক রাতের জন্য একটা ছোট্ট সাজানো ঘর বাঁধবো সমুদ্র পাড়ে। আজ এই স্বপ্ন পূরণ হবে। আমার কল্পনায় দেখা তুমিটা এবার বাস্তবে হাসবে। তোমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে তুমি সমুদ্র দেখবে। শুনবে সাগরের আর্তনাদ। তোমার চোখে আটকে থাকবে তোমার ভালোবাসার মানুষটির মিষ্টি হাসি। তোমার বুকে ঝাপটে পড়বে সে। সেই মানুষটা আসবে আজ। তোমার মনের মানুষ আজ তোমার মনের মতো করে সাজবে।”
আহি ডায়েরীটা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আজ তুমি চোখ সরাতে পারবে না। আজ তুমি প্রেমে পড়তে বাধ্য, আফিফ। আর আমি তোমাকে প্রেমে পড়তে দেখবো, এর চেয়ে চমৎকার মুহূর্ত আর কি হতে পারে, বলো?”
আহি হোটেল ম্যানেজারকে বলে সমুদ্রের পাশে একটা বড় তাবু বাঁধালো। সেই তাবুর ভেতর উঁচু একটা বেড বিছিয়ে দিলো। তাবুর সাথে লাগিয়ে দিলো ছোট ছোট মরিচ বাতি। ভেতরে ছোট একটা টেবিল রাখলো। আর তার উপর ছোট ছোট মোম সাজিয়ে সেগুলোতে নিজ হাতে আলো জ্বালাতে লাগলো। গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে বিছানায় ছড়িয়ে দিলো। ম্যানেজার এক গুচ্ছ অলকানন্দা ফুল নিয়ে আসতেই টেবিলের উপর রেখে দিলো আহি। এরপর সব গুছিয়ে চলে এলো হোটেলে। ঢুকলো হোটেলের ড্রেসিংরুমে। আহির হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেট থেকে একটা সাদা শাড়ি বের করলো সে। সাথে লাল রঙের স্লিভলেস ব্লাউজ। যত্নের সাথে শাড়িটা গায়ে জড়ালো। একটা লাল টিপ কপালের মাঝখানে বসালো। হাতে পরার জন্য এক গুচ্ছ চুড়ি নিলো। কানে বড় বড় ঝুমকো ঝুলিয়ে দিলো। কড়া পারফিউম গায়ে লাগালো। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক লাগানোর পর, খোঁপায় বেঁধে দিলো অলকানন্দা ফুলের মালা। আয়নায় দেখে বলল,
“আজ আফিফ প্রেমে পড়বেই।”
কথাটি বলেই আহি মুচকি হাসলো। ম্যানেজারকে শিখিয়ে দিয়েছে আফিফকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আফিফ আগে থেকেই তাবু বেঁধে রাখা জায়গাটিতে চলে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে সে খুব অবাক হলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“কে করেছে এসব!”
তখনই আহি আফিফের সামনে এসে বলল,
“সারপ্রাইজ।”
আহি সরে দাঁড়াতেই আফিফের সামনে দৃশ্যমান হলো পদ্ম। মেয়েটা লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়েছে। প্রথম স্লিভলেস ব্লাউজ পরায় চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না। বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত ঢেকে দিচ্ছে। রঙ-বেরঙের আলোর ভীড়ে সাদা শাড়ি পরা পদ্মফুলটিকে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। আফিফ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। আহি আফিফের চাহনি দেখে হাসলো। এই হাসিটা সুখের নাকি কষ্টের, বোঝায় যাচ্ছে না। আহি এবার পদ্মের পাশে দাঁড়িয়ে পদ্মকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এবার তোর বরের সাথে সমুদ্রবিলাস কর। এদিকে কেউ আসবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তবে ঘুমানোর আগে তাবুর চেইনটা টেনে দিয়ে ঘুমাবেন।”
পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আফিফ এমন ড্রেস পছন্দ করে না। উনি কি রাগ করবেন?”
“উনার সামনেই তো তোকে এনেছি। আর কেউ তো নেই এখানে। শাল গায়ে জড়িয়ে এসেছিস। সমস্যা হলে গায়ে জড়িয়ে রাখ।”
আহি এবার আফিফকে বলল,
“এটা আমার পক্ষ থেকে স্পেশাল হানিমুন গিফট। গুড নাইট কাপল।”
আহি চলে এলো। আফিফ এবার ধীর পায়ে হেঁটে পদ্মের কাছে এলো। পদ্ম চোখ-মুখ খিঁচে বলল,
“আপনি কি রাগ করেছেন?”
আফিফ মুচকি হেসে বলল, “কেন রাগ করবো?”
“এমন ব্লাউজ…”
“আমার বউ, আমি ছাড়া তো কেউ নেই।”
আফিফ পদ্মকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো। পদ্মও আফিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ বলল,
“তোমাকে একদম আমার স্বপ্নের রানীর মতো লাগছে। তুমি ঠিক সেভাবেই সেজেছো, যেভাবে আমি তোমাকে দেখতে চাই।”
পদ্ম লাজুক হেসে বলল, “আহি সাজিয়ে দিয়েছে।”
আফিফ পদ্মকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তোমাকে আহি সাজিয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পদ্মের হাত ধরে তাকে তাবুর ভেতরে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়েই দেখলো টেবিলের উপর অলকানন্দা ফুল। আফিফ সেখান থেকে একটি ফুল নিয়ে পদ্মের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, পদ্মফুল।”
পদ্ম ফুলটি নিয়ে আফিফের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি, আফিফ।”
আফিফ পদ্মের কাছে এসে বসলো। আলতো করে পদ্মের হাত ছুঁয়ে দিয়ে পদ্মের দিকে তাকালো।
আজকের এই রাতটি আফিফ আর পদ্মের জীবনে আসা চমৎকার একটি রাত। সমুদ্র জলে পা ডুবিয়ে হাতে হাত রেখে রাতের আকাশ দেখা, সমুদ্রের গর্জন শুনে ভালোবাসার অধ্যার রচনা করা, আফিফের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকা, তার চোখের আলোতে আটকা পড়ে থাকা পদ্মের লাজুক মুখখানি, তার বুকে পদ্মের মাথা রাখা, আফিফের তার পদ্মফুলকে নিজের মতো করে ভালোবাসা, আজ সত্যিই আহির স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আহির কল্পনা বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে। সে নিজ হাতেই তার ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হৃদয়ে ডুবিয়ে দিয়ে এসেছে।
এরপর আহি নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের খুশিতে ইচ্ছেমতো খাওয়া-দাওয়া করলো। খাওয়া শেষে নিজের পছন্দের শাড়ি বের করলো আহি। ফ্যাকাশে বেগুনি বর্ণের জরজেট শাড়ি। কপালে কালো টিপ পরলো। চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক লাগালো। ব্যাগ থেকে হিল জোড়া বের পরে নিলো। পায়ের ব্যথা এখন আর নেই। তাই ঠিকমতো হাঁটতে পারছে আহি। এবার সে কানে এয়ার বাড গুঁজে ফোনে গান চালিয়ে ছাদে এলো। রাদ, পুষ্প আর লাবীব আগে থেকেই ছাদে ছিল। আহিকে দেখে তিন জনই হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। আহি রাদের কানে অন্য পাশের এয়ার বাডটি গুঁজে দিয়ে বলল,
“লেটস ডান্স।”
(***)
রাদ আর আহি গান শুনে শুনে নাচছে। আর রাদ আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আহি রাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কি দেখছিস এভাবে?”
রাদ আহির হাতটি ঘুরিয়ে এনে তাকে পেছন দিক থেকে হালকা জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
“তোকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে।”
আহি হেসে বলল,
“আমার পছন্দ এতোটাও খারাপ না।”
রাদ এবার আহিকে সামনে থেকে ঘুরিয়ে এনে তাকে নিজের দিকে ফিরালো আর বলল,
“তোর পছন্দ আমার পছন্দের চেয়ে বেশি সুন্দর না।”
আহি মুচকি হেসে রাদের কাঁধে হাত রেখে রাদের পেছন দিক থেকে একবার ঘুরে তার সামনে এসে এক পা তুলে রাদের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোর পছন্দ কি?”
রাদ মুচকি হেসে আহির ফোন নিয়ে গান পরিবর্তন করে দিয়ে বলল,
“চল গলা ছেড়ে গাই।”
মিউজিক চালু হতেই আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ইশারায় বলল, “এই গানটা কেন?”
রাদ বলল, “শুনলে সমস্যা তো নেই।”
আহি আর রাদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে কাঁধ হেলিয়ে তুড়ি বাজিয়ে নাচতে লাগলো। রাদ গাইতে লাগলো,
“হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”
আহি রাদের দিকে তাকিয়ে কাঁধ বাঁকিয়ে গাইলো,
“হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”
রাদ আহির হাত ধরে গলা ছেড়ে গাইলো,
“আয়ে নাজার চেহেরে হাজার…
হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।
হোনা তা পিয়ার…..”
এদিকে পুষ্প আর লাবীব মনোযোগ দিয়ে রাদ আর আহির দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তারা দু’জনেই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। রাদ এবার আহির হাত ধরে তাকে ছাদের এক কোণায় বসিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সুরের সাথে গাইলো,
“তেরে দিল’কে শেহের মে,
ঘার মেরা হো গেয়া,
হো গেয়া….”
আহি প্রতিত্তোরে রাদের কাঁধে তার দুই হাত রেখে বলল,
“স্বাপ্না দেখা যো তুম’নে
ওয়ো মেরা হো গেয়া,
হো গেয়া…”
“ডুবে তো ইউ,
জেসে হো পাড়…
হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার…
হোনা তা পিয়ার।”
রাদ এবার আহির হাত ধরে তাকে সুইমিংপুলের পাশে নিয়ে এলো। আহিকে উপরে উঠিয়ে ঘোরাতেই আহি চোখ বন্ধ করে দুই হাত প্রসারিত করে রাখলো। রাদ আহিকে নামিয়ে আহির হাত নিজের বুকের কাছে এনে সুরের সাথে গাইলো,
“থামে দিলো কি বা’হে,
হাম আ’তে সালো মে,
সালো মে…”
আহি রাদের হাত ছেড়ে দিয়ে দুই হাত পেছনে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইলো,
“পায়ে জাবাব হাম নে,
তেরে সাওয়ালো মে,
সাওয়ালো মে….”
এবার রাদ আহির হাত ধরে গাইলো,
“খোয়াবও কি ডোর…”
“খোয়াবও কি ডোর..”
“টুটে না ইয়ার,
হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”
“হোনা তা পিয়ার,
হুয়া মেরে ইয়ার।”
গান শেষ হতেই রাদ আর আহি দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। আহি বলল,
“সব হারিয়ে ফেলার পরও আজ আমি অনেক খুশি। থ্যাংক ইউ রাদ। তুই আমার পাশে না থাকলে আমি বাঁচতাম না রে।”
রাদ আহিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোর কিছু হলে আমি কি বাঁচতাম বল?”
“রিয়েলি? তোর কি হতো?”
“আমার একমাত্র মেয়ে বান্ধবী তুই। তুই ছাড়া কে আছে আমার?”
“বাহ, আমাকে পটানোর চেষ্টা করিস না।”
“আমি তো চেষ্টা করি না। আমার যেটা ভালো লাগে, আমি সেটাই করি। তোর যদি মনে হয় আমার উপর পটে গেছিস, তাহলে ডায়েরী লিখে প্রকাশ করিস না আবার। সোজাসুজি বলে দিস। আমি আবার চিঠি পড়ে নিজের বেহাল দশা বানাতে চাই না। হবে তো হবে। প্রেম হলে একবিংশ শতাব্দীর প্রেম হবে। নব্বই দশকের প্রেমিকের মতো চিঠির পেছনে দৌঁড়াতে পারবো না।”
“নব্বই দশকের প্রেম তো আমাকে বোল্ড আউট করে দিয়েছে। এবার যদি প্রেম করি, ছক্কা মেরে দিবো। আউট করলে তাজওয়ার খানকে আউট করবো।”
“আমাকে রান নিতে দিস। আউট করিস না।”
“তুই তো দেখছি আমার প্রেমিক হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিস!”
“তোর মতো করে কেউ ভালোবাসলে, আমি ধন্য হয়ে যেতাম। তাই তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি। আমার প্রেমে পড়ে উদ্ধার করিস আমাকে।”
“আগে তাজওয়ারকে আউট করি, তারপর ভেবে দেখা যাবে।”
আহির কথা শুনে রাদ হাসলো। আহিও শব্দ করে হাসলো। হাসি থামিয়ে রাদ বলল,
“তোকে শাড়িতে কোনো রাজ্যের সম্রাজ্ঞীর মতো মনে হয়।”
“তাহলে সম্রাটটা কে হবে শুনি?”
“আগে রাজ্য জয় করি, তারপর আমার রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবি।”
আহি হেসে বলল, “ঘুরেফিরে তুইই!”
“যাব তাক হে ইস শারীর মে জান,
মে রাহুঙ্গি তোমহারা সম্রাট শাহজাহান।”
আহি আঙ্গুলের ইশারা করতে করতে বললো,
“মুজে নেহি বান্না তোমহারি মামতাজ বেগাম,
পিয়ার নে মুজে ধো ঢালা,
আব চা’লা গেয়া মেরা সুখ, চ্যান ওর গাম।”
চলবে-
(একটু ভিন্নতা রেখে গল্পটা ব্যাখ্যা করেছি। প্রথম কোনো ডান্স স্টেপ ব্যাখ্যা করলাম। আমি যেভাবে কল্পনা করে লিখেছি, আপনারা ওভাবে অনুভব করেছেন কি-না জানি না। তবে গানটা শুনে শুনে পর্বের ওই অংশটুকু পড়লে হয়তো ভালোই লাগবে। এই পর্বটা রাদপ্রেমীদের জন্য। আর একজনের অনুরোধে লেখা, যে রাদের সাথে আহির ডান্স দেখতে চেয়েছিল।)