উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৩০(১ম ভাগ)||

0
296

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩০(১ম ভাগ)||

৬০।
চট্টগ্রামে ফিরেই রাদ আর আহি নায়ীবের সাথে দেখা করতে গেলো। নায়ীব তাদের দেখেই সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। আহি মুচকি হেসে বলল,
“আপনাকে ধন্যবাদ দিলেও কম হবে।”

নায়ীব আহির দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে প্রেসক্রিপশনে কিছু লিখতে লাগলো। রাদ আহির হাত ধরে নায়ীবের উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছে। নায়ীব রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মিস ওয়াসিকা কবির যার সাথে বেশি ভালো থাকে, তার সাথেই সময় কাটাবে।”

নায়ীব এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি বলেছেন বাবা আপনাকে মায়ের সাথে দেখা করতে দেয় না। অথচ আপনি আমার থেরাপি ছাড়াই যতোদিন মায়ের সাথে ছিলেন, ভালো ছিলেন। আসল সমস্যা আপনার বাসায়। আমি আপনাকে শুরুতে জানায় নি, কারণ আপনি যদি এটা মস্তিষ্কে গেঁথে ফেলতেন, তাহলে এই এক্সপেরিমেন্টে কোনো কাজ হতো না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “বাসায় সমস্যা বলতে?”

“আপনি নিশ্চয় সেই স্থানে ভালো নেই। এই মুহূর্তে আপনার জন্য আপনার মায়ের সাথে থাকা জরুরি। যখনই মনে হবে আপনি প্যানিক হচ্ছেন, ভালো লাগছে না। আমি সাজেস্ট করবো মিস্টার রাদ অথবা আপনার মা যাতে আপনার পাশে থাকে। কারণ এই দু’জনই আপনাকে ম্যান্টালি সাপোর্ট করে।”

নায়ীব প্রেসক্রিপশনটি আহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার টিপস ফলো করবেন।”

আহি প্রেসক্রিপশন দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মেডিসিন তো নেই!”

“আপনার মেডিসিন আপনি নিজেই। আর এই টিপসগুলো। সকালে উঠেই প্রয়োজনীয় কাজ সেরে মেডিটেশন করবেন। এটা প্রতিদিনই যাতে দিনলিপিতে যুক্ত হয়। নাস্তা খাওয়ার আগে বাইরে হেঁটে আসবেন। একদমই অলসতা দেখাবেন না। যদি ক্লাস থাকে, সেদিন আরো আগে উঠবেন। তাও এই দুইটা কাজ অবশ্যই করবেন। এরপর বাকি আপনার জরুরি কাজ থাকলে করবেন। কাজের ফাঁকে বাগানে সময় তো দিবেনই। সেই মুহূর্তে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে পারেন বা আপনার প্রিয় গায়ক বা গায়িকার গান। তবে এই জায়গায় আপনি কোরআন তিলাওয়াত শুনতে পারেন। এটা আপনার মনকেও শান্ত করবে, সাথে সওয়াবও পাবেন। আপনার ইচ্ছা, আপনি যেটা করতে ইচ্ছুক। আর অবসরে ভালো কিছু মুভি দেখতে পারেন। প্রেম সম্পর্কিত মুভি না দেখায় আপতত আপনার জন্য ভালো হবে। আর অবশ্যই আপনার শখকে প্রাধান্য দিবেন। যেহেতু আপনি ছবি আঁকেন, তাহলে সেখানেই বেশি ফোকাস করবেন। যেই ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে আপনি মানসিক শান্তি পান, তার সাথে প্রতিদিন কথা বলবেন। আর সে যদি মিস্টার রাদ হয়ে থাকে, তাহলে বলবো, প্রতিদিন একসাথে কোনো এক বেলা খাওয়া-দাওয়া করবেন। সুযোগ না হলে এক কাপ চা একসাথে খাবেন। ট্রাস্ট মি, এর চেয়ে চমৎকার মুহূর্ত আপনি আর পাবেন না। এরপর আসি ভয়ংকর সময়ে, রাত দশটার পর প্রায়ই মানুষ ডিপ্রেশনে চলে যায়। বা গভীর রাত জাগার অভ্যাস থাকলে আপনা-আপনি মন খারাপ হয়ে যায়। সাজেস্ট করবো, সেই সময় প্যারানরমাল বা থ্রিলার মুভি দেখবেন। অথবা কমিকস পড়বেন। আর যাই করবেন রাতে আপনি গান শুনবেন না, ছবিও আঁকবেন না। সেই মুহূর্তটা আপনাকে আরো বেশি ইমোশনাল করে ফেলবে। কারণ ছবি আঁকার সাথে আপনার অতীতের সম্পর্ক আছে। আর গান শুনলে স্বাভাবিক মনটা আরো ভারী হয়ে আসে। কিন্তু দিনের বেলায় এই কাজ করলে আপনার তেমন অনুভূত হবে না। কারণ আলোর প্রভাব। এবার আসি পরিবেশে। প্রথম কাজ দেয়ালের রং পরিবর্তন করবেন। মনের মতো ঘর সাজাবেন। জানালা খোলা রাখবেন। পর্দা চেঞ্জ করবেন। রাতে বেশি আলো জ্বালাবেন। যেমন দুইটা বাতি জ্বালিয়ে রাখবেন। রঙ-বেরঙের বাতি জ্বালিয়ে রাখতে পারেন। তবে নয়টার পর আলো কমিয়ে দেবেন। অনেকে সাজেস্ট করে বিড়াল পোষার জন্য বা পাখি কিনে আনার জন্য। আমি করবো না। আমার নিজের একটা বিড়াল আছে। ও অসুস্থ হলে, আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই এই মুহূর্তে নিজেকে সময় দিবেন। অন্য কিছুতে না।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ। আমি ফলো করবো এই টিপসগুলো।”

“এবার আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন। আমি মিস্টার রাদের সাথে কিছু কথা বলবো।”

আহি বাইরে যেতেই নায়ীব রাদকে বলল,
“মিস ওয়াসিকা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হোন নি। এমনকি আপনাকে দেখেও মনে হচ্ছে, মানসিক চাপে আছেন। চাপটা যে মিস ওয়াসিকাকে নিয়ে তা আমি বুঝতে পেরেছি। এবার দুইটা কথা বলবো, যতো শীঘ্রই সম্ভব তাকে তার বাবার বাসা থেকে নিয়ে আসা উচিত। মিস ওয়াসিকা সেই ছেলেটাকে এতো সহজে ভুলতে পারবে না। সে শুধু বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। সহজে কাউকে ভুলে যাওয়া যায় না। একজন সুস্থ মানুষ সবকিছুর ভীড়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু প্রাক্তনকে দিনের একটা সময় তার মনে পড়বেই। এটা একদম ন্যাচেরাল। আর সেখানে মিস ওয়াসিকার অনুভূতি অন্য পর্যায়ে চলে গেছে। সেটা এখন আধ্যাত্মিক অনুভূতি। এখান থেকে সহজে বের হওয়া যায় না। যদি একই অনুভূতি সে অন্য কারো জন্য অনুভব করে, তবেই এটা সম্ভব। কিন্তু ন্যাচেরালি মিস ওয়াসিকা অনেক লয়েল। এই দিক থেকে মেয়েটা লয়েল থাকবে৷ এখন বিয়ে বা নতুন কোনো সম্পর্ক এই দুইটা চাপ আপতত তার ঘাড়ে না চাপালেই হলো।”

রাদ নায়ীবের সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক বড় উপকার করেছেন। আমি অবশ্যই আহির খেয়াল রাখবো।”

নায়ীব মৃদু হাসলো। রাদ চেম্বার থেকে বের হয়েই আহির দিকে তাকালো। মনটা ভারী ভারী লাগছে তার। মনে মনে ভাবছে,
“সত্যিই কি আহি আমার প্রেমে পড়বে না? আমি কি এইটুকু স্বপ্ন দেখতে পারবো না? এখন তো বলতেও পারবো না, আমি ওকে ভালোবাসি। যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়? যদি ও আবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে?”

৬১।

ভাদ্র বিদায় হলো চোখের পলকে। প্রকৃতি ছেয়ে গেলো উষ্ণ আবহাওয়ায়। আহি ঘেমে নেয়ে ক্যাম্পাস থেকে সবে মাত্র বাসায় ঢুকলো। তখনই চুনি এসে বলল,
“আফা দেহেন গিয়া কে আইছে।”

আহি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
“কে আর আসবে? অতিথি মানেই তো বাবা আর মিসেস লাবণির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার আপন কেউই এই বাসায় আসে না।”

চুনি মুখ চেপে হেসে বলল,
“আপনের আপন মানুষ আইছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মা এসেছে!”

“আরেহ না।”

“তাহলে কে?”

“গিয়া না হয় দেখি আসেন।”

আহি লিভিং রুমে উঁকি দিতেই দেখলো, তাজওয়ার, তার মা রেহানা খান, আর দোয়েল বসে আছে। আহি তাদের দেখে পেছন ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে চুনির দিকে তাকালো। দোয়েল আহিকে দেখেই বলে উঠল,
“আহি চলে এসেছে।”

দোয়েলের ডাকে আহি চোখ-মুখ কুঁচকে লিভিং রুমে ঢুকলো। সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে রেহানা খানকে সালাম দিলো। রেহানা খান আহির কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“রিজওয়ান ভাই, আপনার মেয়েটা বেশি লক্ষ্মী।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে বলল,
“তাই তো তোমার শয়তান ছেলের জন্য আমাকে নিয়ে যেতে চাইছো!”

রেহানা খান আহিকে টেনে নিজের পাশে বসালেন। তাজওয়ার হুট করে রিজওয়ান কবিরের পাশ থেকে উঠে আহির গা ঘেঁষে বসে পড়লো। আহি চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আহির তাকানো দেখে তাজওয়ার মুচকি হাসি ফেরত দিলো। আহি এবার রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। রিজওয়ান কবির ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছেন। আহির রাগ উঠলো। এ কেমন বাবা তার? একটা ছেলে তার গা ঘেঁষে বসে আছে, আর তার বাবার কোনো প্রতিক্রিয়ায় নেই! আহি এবার বিরক্ত মুখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“বিন্দুমাত্র ভদ্রতা নেই এই ছেলের।”

এদিকে রেহানা খান হঠাৎ আহির হাতে একটি সোনার বালা পড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“আগামী মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার তাজওয়ার আর আহির এনগেজমেন্টটা হলে ভালো হয়।”

আহি রেহানার কথা শুনে ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। লাবণি আহির চাহনি দেখে বলল,
“আহি এখন থেকেই ড্রেস সিলেক্ট করে ফেলো। তাজওয়ারকে নিয়ে যা যা লাগবে কিনে ফেলো। এনগেজমেন্ট আমেরিকায় হবে। সিরাজ ভাইয়া তো দেশে আসতে পারবেন না তাই।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“দেশে আসবে কিভাবে? আসলেই তো তার ঠিকানা সোজা জেলখানায়।”

আহির কথা শুনে রিজওয়ান কবির রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালেন। তাজওয়ার পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলল,
“আহি, আসলেই তুমি অনেক ফানি। তোমার হবু শ্বশুড় কিন্তু এমন মজা অনেক পছন্দ করেন। তুমি এক কাজ করো, আমেরিকায় গিয়ে বাবাকে এরেস্ট করে নিয়ে এসো।”

“যদি ক্ষমতা থাকতো ক্রসফায়ারে দিয়ে দিতাম। এরেস্ট করে সময় নষ্ট করতাম না।”

রিজওয়ান কবির ধমকের সুরে বললেন,
“আহি, এসব কেমন বেয়াদবি?”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি অন্তত এমন অসভ্য লোকের সাথে আমাকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করে, আমার কাছ থেকে সভ্য ব্যবহার আশা করবে না। এখন থেকে আমি এভাবেই কথা বলবো।”

রিজওয়ান কবির উঠে দাঁড়িয়ে আহিকে চড় মারতে যাবেন তার আগেই তাজওয়ার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“প্লিজ আংকেল। রিল্যাক্স। আপনি তো এখন আহির দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। ওকে শাসনটাও না হয় আমিই করি।”

আহি রাগী স্বরে বলল,
“তুমি আমাকে শাসন করার কে?”

তাজওয়ার সবার সামনে আহিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর আহিকে নিয়ে ছাদে চলে গেলো। ছাদে এসেই আহিকে রেলিঙের উপর বসিয়ে আহিকে আবদ্ধ করে রেলিঙের দুই পাশে হাত রেখে তাজওয়ার বলল,
“তুমি জানো, আমি কতোটা হিংস্র। কিন্তু তবুও আমি বড়দের সামনে ভদ্র আচরণ করি। আর তুমি আমার মায়ের সামনে এভাবে কথা বলছো! মা কি মনে করবে?”

“যা ইচ্ছে মনে করুক। যা ভাবার ভেবে এই বিয়েটা ভেঙে দিক।”

তাজওয়ার হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার বলল,
“তুমি এতোটা বোকা হবে, তা আমি জানতাম না। বিয়েটা আমার ইচ্ছাতেই হচ্ছে। আমার ইচ্ছার উপর কথা বলার সাহস কারো নেই। কেউ মেনে নিক, না নিক। আমি তোমাকে যে-কোনো মূল্যে নিজের করেই ছাড়বো। কারো ক্ষমতা নেই আমাকে আটকানোর।”

আহি বুঁকে হাত গুঁজে বলল,
“ক্ষমতা আছে। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন। এই কথা তো জানোই। আল্লাহ যদি আমার সাথে থাকে, তুমি আমাকে স্পর্শও কর‍তে পারবে না।”

তাজওয়ার আহির কোমর আঁকড়ে ধরে আহির গালে জোর করে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
“করলাম স্পর্শ। পেরেছো নিজেকে মুক্ত করতে?”

“তোমার মতো শয়তানরা একবার সফল হয়েই নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে। একবার আমাকে সফল হতে দাও। ওয়াদা করছি, তোমাকে তোমার জায়গা দেখিয়ে দিবো।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“এমন গালগল্প না শুনলে রাতে ঘুম আসে না। এমন গাজাখুরি গল্প শোনার জন্য হলেও আমার তোমাকে চাই।”

(***)

ফোনের স্ক্রিনে আহির নাম ভেসে উঠতেই রাদ তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে আহির কান্না ভেজা কন্ঠ শুনে মুহূর্তেই রাদের বুকটা ভারী হয়ে হলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, কাঁদছিস কেন?”

“ভাই আমার লাইফটাই অভিশপ্ত। যন্ত্রণা শব্দটা থেকে আমি এক সেকেন্ডের জন্যও মুক্তি পাই না।”

“হয়েছে কি বলবি?”

“আগামী মাসে তাজওয়ার আর আমার এনগেজমেন্ট।”

কথাটি শুনেই মুহূর্তের জন্য রাদের মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। পরক্ষণেই সে বলল,
“আরেহ ধুর, আগেও তো এনগেজমেন্ট ফিক্সড হবে বলেছিল, ওটা তো হয় নি।”

“আগের বার বাবা ওদের দাওয়াত দিয়েছিল। এবার ওরাই এসেছে।”

রাদ থমথমে কন্ঠে বলল, “কি করবি এখন?”

“চেয়েছিলাম মাস্টার্স শেষ করেই ইউকে তে শিফট হয়ে যাবো। ওখানে গেলে তাজওয়ার আমার কোনো ক্ষতি করতে পারতো না৷ এখন তো বাবা আমাকে ইচ্ছে করে দেশে এনেছে, যাতে আমি পালাতে না পারি। জানিস, আমার পাসপোর্টটাও আমার কাছে নেই।”

রাদ মলিন মুখে বললো,
“কি সাজেশন দিবো তোকে। আমার নিজেরই তো মাথা ঘোরাচ্ছে।”

“সিনেমাতে কতো দেখি বিয়ের দিন বর-কনে পালটে ফেলা যায়। যদি ওরকম সুযোগ থাকতো!”

“হুহ, তোকে উড়না গায়ে ঝুলাতে দেয় না, আর লম্বা ঘোমটা টেনে বিয়ে কর‍তে বসাবে? আর কবুল বলার সময় নামটা কি সাইলেন্টলি পড়বে না-কি?”

“সিনেমায় যে কীভাবে হয়! এখন কোনো আইডিয়া দে না। ওই অজগরের কাছ থেকে কীভাবে মুক্ত হবো আমি?”

“আমাকে একটু সময় দে ভাবার। তুই চিন্তা করিস না। একদম লাস্ট কোনো অপশন না থাকলে তোকে আমিই বিয়ে করে ফেলবো। মেয়েদের তো আর দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়া যাবে না। তখন তাজওয়ার তোকে আর বিয়েই কর‍তে পারবে না।”

“হ্যাঁ, কতো সাহস তোর! তোকে ওই অজগর গিলে ফেলবে। তারপর আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।”

“আমাকে বাঁচাতে তুইও ওই অজগরের মুখে ঢুকে যাবি আর কি। তারপর আমরা দু’জন ওই অজগরের পেটে ঢুকে তার পেট ফুঁটো করে বেরিয়ে আসবো।”

“বাহ কোন পুরাণকাহিনি বলছিস। এটা একবিংশ শতাব্দী।”

রাদ আহিকে আশ্বস্ত করে বলল,
“দেখ আহি, আমাকে একটু ভাবতে দে। আমি তোকে মুক্ত করবো। এটা আমার প্রমিজ।”

আহির সাথে কথা বলা শেষে রাদ বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আজ আর তার ঘুম হবে না। আহি ঠিকই বলেছে, কাউকে ভালোবাসার মতো যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি দ্বিতীয়টা নেই। আহি আফিফকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে, আর রাদ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। রাদের ভালোবাসা প্রকাশ করার মতো ভালো সময়, ঝঞ্জাটহীন পরিবেশ এখন আহির জীবনে নেই। আহি ব্যস্ত নিজেকে তাজওয়ার নামক বিষাক্ত মানুষটির কাছ থেকে মুক্ত করতে। আফিফকে ভালোবেসে আহি কম আঘাত পায় নি। এর মধ্যে রাদ তার ভালোবাসার কথা জানানোর সাহস পাচ্ছে না। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। ভাগ্য তাকে কোন পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে! রাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি, আমি না তোকে ভীষণ ভাবে চাই। আশ্বিনের শীতল হাওয়ায়, তোকে খুঁজে পেতে চাই। কুয়াশার ভীড়ে তোর হাতটা ধরতে চাই। বসন্তের ফুল তোকে বিলাতে চাই। জ্যোষ্ঠের রোদ থেকে তোকে বাঁচাতে তোর ঢাল হতে চাই। শ্রাবণ বেলায় তোর সাথে ভিজতে চাই। যতোই দূরত্বের পথ হোক, আমার মনের গন্তব্য তুই। আহি তুই কখন আমার হবি? কখন বাদলা দিনে তোর সিক্ত মুখখানা ছুঁয়ে দিবো? কখন তোকে বলতে পারবো, ভালোবাসি?”

(***)

সকালে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বের হলো পুষ্প। গাড়ির জন্য ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে রইলো সে। হঠাৎ একটা মোটরসাইকেল তার সামনে থেমে তার হাত থেকে তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে নিলো। জোরে টান পড়ায় পুষ্প ভারসাম্য হারিয়ে ফুটপাত থেকে ছিঁটকে পড়লো রাস্তায়। ভাগ্যিস রাস্তায় গাড়ি কম ছিল। নয়তো পুষ্পের জন্য এই দিনটায় শেষ দিন হতো। পুষ্প রাস্তার উপর শুয়ে চেঁচাতে লাগলো। সেই মুহূর্তেই লাবীব তার মোটরসাইকেল নিয়ে সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। পুষ্পকে দেখে সে মোটরসাইকেল থেকে নেমে তাকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“বাসায় কি ঘুমানোর জন্য বিছানা ছিল না?”

পুষ্প লাবীবের কথা শুনে তাকে ধাক্কা দিয়ে তার হাতে ঘুষি মেরে বলল,
“ওই অন্ধ খাটাশ, কেউ শখ করে রাস্তায় শুয়ে থাকে না-কি! আমাকে কি পাগল মনে হয়?”

লাবীব মিনমিনিয়ে বলল, “নয়তো কি!”

পুষ্প হুংকার দিয়ে বলল, “কি?”

“আরেহ, তো রাস্তায় কি মরতে এসেছিলে?”

“তোমার সম্প্রদায় আমার ব্যাগ নিয়ে পালিয়েছে।”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমার সম্প্রদায় মানে?”

“একটা বাইকওয়ালা।”

“বাইকাওয়ালা আমার সম্প্রদায় কীভাবে হলো?”

“তোমারও তো বাইক আছে। তোমার সম্প্রদায় নয়তো কি!”

লাবীব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা বলো, ব্যাগে কি ছিল?”

“বই-খাতা আর একটা ক্যালকুলেটর।”

“ফোন কোথায়?”

“পকেটে। টাকাও ফোনের কাভারের পেছনে রেখেছি।”

“তো তুমি বই খাতা আর ক্যালকুলেটরের জন্য রাস্তায় শুয়ে চেঁচাচ্ছিলে?”

পুষ্প রাগী দৃষ্টিতে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বেচারা বাইকার, লস প্রজেক্ট ধরেছিল।”

পুষ্প চোখ-মুখ কুঁচকে সামনে হাঁটা ধরতেই লাবীব তার হাত ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো? চলো তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দেই।”

“বাসায় যাবো না আমি। ক্লাস টেস্ট আছে।”

“খাতা-কলম ছাড়া টেস্ট দিতে যাবে?”

“কলম কারো কাছ থেকে ধার নিলেও চলবে। আর খাতা তো ক্যাম্পাস থেকেই দিবে। টেস্ট দিয়েই চলে আসবো।”

“আচ্ছা, চলো তোমাকে ক্যাম্পাসেই নামিয়ে দিবো। আমিও তো যাচ্ছি।”

“না, তোমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”

“কিন্তু আমার তো তোমাকেই প্রয়োজন।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব চুলে হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“অন্তত একদিনের জন্য আমার বাইকের পেছনে বসে আমাকে একটু ধন্য করো।”

“এতো ধন্য হতে চাওয়ার কারণ?”

“কখনো কোনো মেয়ে আমার বাইকের পেছনে বসে নি। এই শহরে খালি বাইক নিয়ে ঘুরে শান্তি পাই না। তুমি বসলে তোমারও লাভ, আমারও লাভ। আমিও একটু শান্তি পাবো। তুমিও তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসে পৌঁছে যাবে। এমনিতে রোডে লুটোপুটি খেয়ে অনেক সময় নষ্ট করেছো।”

পুষ্প চোখ ছোট করে বলল, “আবার?”

লাবীব মুখ ছোট করে তাকিয়ে থাকায় পুষ্প তার মোটরসাইকেলে উঠে বসলো। কিন্তু লাবীব ক্যাম্পাসে না গিয়ে একটা ফার্মেসির সামনে মোটরসাইকেল থামালো। এরপর পুষ্পকে কিছু বলতে না দিয়ে তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো। লাবীব বলল,
“সেই কখন থেকে ফটফট করেই যাচ্ছিলে। তোমরা মেয়েরা পারোও বটে। ব্যথা পেয়েছো, বলো নি কেন?”

পুষ্প বলল,
“রাস্তায় ছিঁটকে পড়েছি, ব্যথা তো পাবোই।”

“হুম। বেশি কাবিল তো।”

“আমি ব্যথা পেয়েছি, তুমি কীভাবে বুঝলে?”

“লুকিংগ্লাসে দেখলাম, তুমি ভ্রূ কুঁচকে রেখেছো। বার-বার হাতের দিকে তাকাচ্ছো। আমার সামনে তো বাঘিনী হয়ে থাকো। পেছনে তো বিড়াল ছানার মতো বসে ছিলে।”

লাবীব এবার পুষ্পের দিকে তাকালো। দেখলো পুষ্প হাসছে। এবার সে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমার কথা শুনে হাসছো? আমি তো ভেবেছি মুখ উঠিয়ে দেখবো টমেটোর মতো ফুলে গেছে তোমার মুখটা।”

পুষ্প হেসে বলল,
“তুমি ওতোটাও খারাপ না। অনেক কিছু খেয়াল করো।”

লাবীব উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চলো এবার। টেস্ট আছে তোমার।”

পুষ্প সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। এরপর লাবীব পুষ্পকে নিয়ে ক্যাম্পাসে নামলো। পুষ্প নামতেই লাবীব পুষ্পের হাতে দু’টো কলম ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ধার নিতে হবে না।”

পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বলল, “দান করছো?”

লাবীব হেসে বলল, “গিফট করছি।”

“আচ্ছা, আমি ক্লাস শেষে তোমাকে বার্গার খাওয়াবো।”

“ট্রিট চাই না। অন্য কিছু চাইলে দিও।”

“কি চাও?”

“আমার বাইকের পেছনে যদি প্রতিদিন বসতে।”

পুষ্প চোখ বড় বড় করে বলল,
“প্রেমিকা বানাতে চাও আমাকে?”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার মনে এসব ঘুরে? বন্ধুরা কি বসে না বাইকের পেছনে?”

পুষ্প মুখ ফুলিয়ে বলল, “ধুর।”

পুষ্প হনহনিয়ে চলে যেতে লাগলো। লাবীব উঁচু গলায় বলল,
“তুমি প্রেমিকা হতে চাইলেও কিন্তু আমার সমস্যা নেই।”

পুষ্প পেছন ফিরে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“লাগবে না তোমার বন্ধুত্ব।”

লাবীব হাসলো। মনে মনে বলল,
“তুমি তো দেখছি আমার প্রেমে পড়ে গেছো চশমিশ। শেষমেশ তবে এই বসন্তেই আমার একটু গতি হতে যাচ্ছে।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here