#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩২||
৬৩।
হেমন্তের অমত্ত সমীরণ বাতায়ন গলে ঘরে প্রবেশ করছে। ঘরের পর্দাগুলো সেই সমীরণের তালে দুলছে। মনে হচ্ছে ঘরে উপস্থিত মানুষটির অনুভূতির ঢেউ এদের নাড়িয়ে দিচ্ছে৷ উজ্জ্বল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি টেবিলের উপর রাখা স্থির চিত্রটির দিকে। ঠোঁটে তার মৃদু হাসি। চিত্রটির একটা নামকরণ প্রয়োজন। উজ্জ্বল তার চোখ দু’টি বন্ধ করে মনে মনে দু’টো শব্দ আওড়ালো। এরপর চোখ খুলে চিত্রটির দিকে ঝুঁকে বলল,
“হিয়ার পীড়ন।”
উজ্জ্বলের বন্ধু রইস সেই মুহূর্তে তার ঘরে এসে বলল,
“কি রে উজি, তোকে যখনই ফ্রি দেখি তোর সামনে এই ছবিটা থাকবেই। কি আছে এই ছবিতে?”
উজ্জ্বল মুচকি হেসে বলল,
“একটা মেয়ের অনভূতি। বেশ চমৎকার এই অনুভূতিটা! এমনই একজন মেয়েকে কে না চায়!”
“কি আবোল-তাবোল বকছিস? তোর মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে৷ তুই তো আমাকেই পাগল করে দিচ্ছিস।”
উজ্জ্বল আবার হাসলো। রইস উজ্জ্বলের পাশে বসে বলল,
“কি হয়েছে বলবি?”
উজ্জ্বল ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“পুষ্পের ফ্রেন্ড আহি, মনে আছে?”
“হুম।”
“এই ছবিটা সে এঁকেছিল।”
“তো!”
উজ্জ্বল ছবিটির দিকে ঝুঁকে বসে বলল,
“মেয়েটার মনে অনেক কষ্ট। আমি তাকে ছবি আঁকতে বলেছিলাম। আর সে এটাই এঁকেছে। কালো রঙ ব্যবহার করে এই ছবি এঁকেছে। বুঝা যাচ্ছে, তার মন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। ছবির মেয়েটির চোখ দু’টি কেমন ঘোলাটে, দেখ। মনে হচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে চোখ শুকিয়ে গেছে। সেই চোখে এখন খরা। নৌকাটি দেখ, কেমন দুলছে। অথচ নদীতে তরঙ্গ, ঢেউ কিছুই নেই। আমি এর একটা অর্থ দাঁড় করিয়েছি।”
“কি অর্থ?”
“মেয়েটার জীবনে সবকিছুই ভাসা ভাসা। কোনোকিছুতেই সে স্থির হতে পারছে না। এরপর দেখ, তীরে দাঁড়ানো একটা অবয়ব। ভালোভাবে দেখলে বোঝা যাবে, এটা একটা ছেলের অবয়ব। এর অর্থ, আহির জীবনে একটা ছেলের বেশ প্রভাব আছে। এই ছবিতে ছেলেটি নদীর তীরে ভেসে থাকা একটা ফুল তুলছে।”
“এর অর্থ কি!”
“উহুম, বুঝতে পারছি না। হয়তো সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। আহিকে না।”
রইস ভাবলেশহীন সুরে বলল, “তো!”
উজ্জ্বল হতাশ কন্ঠে বলল,
“মেয়েটা ভীষণ কষ্টে আছে।”
“এখন তুই করতে চাচ্ছিস?”
“আহির সাথে আবার দেখা করতে ইচ্ছে করছে। তাই এবারের ছুটিতে আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি না। চট্টগ্রাম যাবো ভাবছি।”
রইস চমকে উঠে বলল,
“সিরিয়াসলি! আমরা সব বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করে ফেলেছি।”
“তোরা যা। এই মুহূর্তে আমার মন যেখানে আটকে আছে, আমার তো তারই সমাধান করতে হবে।”
“প্রেমে পড়ে যাস নি তো আবার!”
উজ্জ্বল হেসে বলল,
“আপতত তো না। তবে আরেকটু বেশি জেনে গেলে হয়তো সম্ভাবনা আছে।”
“এবার কিন্তু সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিবি। নয়তো আগের বারের মতো প্রেম করতে করতে প্রেমিকা বিয়ে করে শ্বশুড় বাড়ি চলে যাবে।”
উজ্জ্বল মুচকি হাসলো। বলল,
“আফসোস থাকবে না। এমন প্রেমিকা হারিয়ে গেলেও ভালো লাগে।”
“কীভাবে?”
“কারণ এদের ঘৃণা করা যায় না। এদের ভেবে ভেবেই চমৎকার মুহূর্ত কাটানো যায়। এরা বাস্তবেও সুন্দর। কল্পনাতেও।”
রইস উজ্জ্বলের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
“বেশ ভালোভাবেই আহির মায়ায় ডুবেছিস, বুঝা যাচ্ছে।”
(***)
সাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে আসছে পুষ্প। লাবীব সেই মুহূর্তে ক্যাম্পাসের গেটের সামনে তার মোটরসাইকেল থামালো। হেলমেট খুলে ভ্রূ কুঁচকে সে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পও সামনে তাকাতে লাবীবকে দেখে তার দিকে তাকালো। লাবীবের চাহনি দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। লাবীব তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। পুষ্পের সম্পূর্ণ মনোযোগ লাবীবের দিকে তাকায়, সে খেয়াল করে নি তার সাইকেলের সামনের চাকাটি আঁকাবাঁকা ইটের রাস্তার গর্তে আটকে গেছে। আর মুহূর্তেই পুষ্প ভারসাম্য হারিয়ে উলটে পড়লো রাস্তায়। লাবীব তা দেখে অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। আহি গেটের কাছেই দাঁড়ানো ছিল। পুষ্পের এই অবস্থা দেখে সে দৌঁড়ে তার কাছে এলো। এদিকে লাবীব হাসতে হাসতে পুষ্পের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“যে কাজ পারো না, সেটা করো কেন?”
পুষ্প মুখ ফুলিয়ে লাবীবের দিকে তাকালো। আহি বিরক্তির সুরে বলল,
“দেখছিস না ও ব্যথা পেয়েছে?”
আহির হাত ধরে পুষ্প উঠে দাঁড়ালো। এরপর সে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। কয়েকজন এখনো ঘুরে ঘুরে তাকে দেখছে। লজ্জায় পুষ্পের চোখ ছলছল করে উঠলো। আহি তার সাইকেল উঠিয়ে বলল,
“কি রে, মন খারাপ করছিস কেন? এটা জাস্ট এক্সিডেন্ট।”
পুষ্প চুপ করে রইলো। লাবীব পুষ্পের কাছে এসে নরম সুরে বলল,
“কাঁদছো কেন?”
পুষ্প মুখ ভ্যাংচে বললো, “কাঁদছি না আমি।”
লাবীব পুষ্পের হাত ধরতেই পুষ্প চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আর পুষ্পের ভেজা চোখ দু’টি সাথে সাথেই লাবীবের বুকখানা দগ্ধ করে দিয়ে গেলো। লাবীব বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহি পুষ্পের সাইকেল একপাশে রেখে তালা লাগিয়ে চাবিটা পুষ্পের হাতে দিয়ে বলল,
“ব্যথা পেয়েছিস তুই। চল, তোকে মেডিকেল রুমে নিয়ে যাই।”
লাবীব বলল,
“আহি তুই ক্লাসে যা। আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
আহি ‘ঠিক আছে’ বলে চলে গেলো। এরপর লাবীব পুষ্পকে মেডিকেল রুমে নিয়ে গেলো। পুষ্পের কনুইয়ে নিজ হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“হেসেছো, আবার মলম লাগাচ্ছো!”
“সরি।”
পুষ্প জোরে শ্বাস ছাড়লো। লাবীব পুষ্পের দিকে ঝুঁকে বলল,
“আমি তো বলেছিই, আমার বাইক পার্টনার হও। রোজ তোমাকে নামিয়ে দেবো, নিয়ে আসবো।”
“প্রতিদিন এই দায়িত্ব নেওয়ার মতো কি তোমার অধিকার আছে?”
“যদি দাও, নিয়ে নেবো।”
“কিন্তু তুমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসো।”
লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ভালোবাসলেই কি শুধু অধিকার দিতে হয়।”
পুষ্প অভিমানী সুরে বলল,
“লাগবে না আমার এসব আদিখ্যেতা।”
লাবীব পুষ্পের হাত ধরে বলল,
“মেয়েটা যদি তুমি হও, তাহলে কি এই আদিখ্যেতা তোমার ভালো লাগবে?”
পুষ্প লাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল, “হুম।”
লাবীব বলল,
“তাহলে ভালো সময় আসুক। আমার আবার সবকিছু একটু ঝাঁকানাঁকা হতে হয়।”
“কখন ঝাঁকানাঁকা হবে?”
“বলে দিলে তো ঝাঁকুনি খেতে পারবে না।”
পুষ্প লাজুক হাসলো। লাবীব পুষ্পের চশমা নিয়ে নিজের শার্টের কোণায় তা মুছে পুষ্পের চোখে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“চলো চশমিশ। ক্লাস শেষে আবার দেখা হবে।”
এদিকে পুষ্পের ফোনে উজ্জ্বলের কল এলো। সে রিসিভ করতেই উজ্জ্বল বলল,
“ছুটিতে তোদের বাসায় আসছি।”
পুষ্প উৎসুক কন্ঠে বলল, “ওয়াও, সত্যি!”
“মিথ্যা গল্প বলার জন্য তোকে কখনও ফোন দিয়েছিলাম?”
“হুম, যাক, ভালোই হবে। তোর অপেক্ষায় থাকলাম।”
“শোন, তোর ওই ফ্রেন্ডটার কি অবস্থা!”
“কার কথা বলছিস?”
“আহি!”
পুষ্প হেসে বলল,
“তুই তো আমার বান্ধবীকে বেশ ভালোভাবেই মনে রেখে দিয়েছিস।”
“এতো ন্যাকামি করছিস কেন? সোজাসুজি বল না।”
“আরেহ আছে তো ও। ভালো আছে।”
উজ্জ্বল হেসে বলল,
“আচ্ছা, রাখছি। ট্রেনে উঠবো রাতে।”
“আচ্ছা।”
(***)
সন্ধ্যায় ছবি আঁকা শেষ করলো আহি। এখন প্রায় প্রতিদিনই সে সন্ধ্যায় ছবি আঁকতে বসে। এক ঘন্টা এঁকে উঠে যায়। আজ এঁকেছে একটা বাড়ির করিডরের চিত্র। পুরো করিডোরটি বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে আলোকিত করেছে। দেয়ালে মিষ্টি গোলাপী রঙ। মেঝের টাইলসটি সেঞ্চুরি পাতার। মাঝখানে একটি গোলাপী বর্ণের লাগেজ রাখা। ছবি আঁকা শেষে ক্যানভাসের নিচে একটা চিরকুট আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলো আহি। সেটিতে লেখা,
“লাগেজে ভরা স্বপ্নগুলো কি এই চাকচিক্যময় আবদ্ধ ক্ষেত্রফলেই আঁটকে থাকবে?”
এরপর আহি ক্যানভাসটি ইজেল থেকে নামিয়ে একপাশে রেখে দিলো। এরপর হাত ধুয়ে এসে ডায়েরির পাতা উল্টালো। লিখলো,
“সেদিনের পর কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। ভীষণ জেদ উঠেছে আমার। ঘৃণা শব্দটা নিতে পারি নি আমি। তাই পদ্মকে ফোন করে জানা হলো না, কেমন আছো। কিন্তু দেখো, এতোকিছুর পরও প্রতিদিন তোমার স্মরণে ডায়েরীর পাতায় কিছু না কিছু লিখি। কি করবো, আমি যে তোমাকে ভুলতে পারি না। তুমি মানুষটা সূত্রের মতো মস্তিষ্কে গেঁথে গেছো। এই ব্রহ্মাণ্ডে একেক জনের ভালোবাসা একেক রকম। আর আমার কাছে ভালোবাসার অর্থ ভুলে যাওয়া নয়। ভালোবাসা মানে আরো নতুনভাবে ভালোবাসতে পারে। প্রকাশ্যে না হোক, আড়ালে কেন লুকিয়ে থাকবে আমার অনুভূতি? প্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ভালোবাসাতে পারার আসক্তিটা কখনোই ছাড়া যায় না। যে আসক্তি ছাড়তে পারে, যে ভালোবাসাকে গ্রহণ করেছে নিজের স্বার্থের জন্য। আর আমি তো নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি। আমার জীবনে যেই আসুক। আমি তো নিয়তিকে আটকাতে পারবো না। কিন্তু তুমি আমার জীবনে আজীবন প্রদীপের মতো জ্বলবে। এই প্রদীপের তেজ এতো বেশি যে মৃত্যুর পর এই আলোয় আমি তোমাকে খুঁজে নেবো। তখন নিয়তির খেলা শেষ হবে। আমি হয়তো সেদিন তোমাকে আমার করে পাবো।”
৬৪।
আজ ক্যাম্পাসে চলছে কার্তিক উৎসব। এই উৎসবে পুরো ক্যাম্পাসের সব ডিপার্টমেন্ট মিলে মেলার আয়োজন করে। আজ আহি ক্যাম্পাসে এসেছে কমলা রঙের শাড়ি পরে। গলায় ঝুলিয়েছে কাঠের তৈরী মালা। খোঁপায় গেঁথে দিয়েছে ছোট ছোট কাঠগোলাপ। হাতে একগুচ্ছ হলুদ কাচের চুড়ি পরেছে, কপালে লাগিয়েছে হলুদ টিপ। আজ বেশ মানানসই লাগছে আহিকে।
এদিকে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই রাদ আর আহির দেখা হলো। রাদ আহিকে দেখে সেকেন্ড খানিকের জন্য থমকে গিয়েছিল। এরপর আহি রাদের কাছে আসতেই রাদ নিজের বুকে হাত রেখে বলল,
“মেরে ফেলবি না-কি আমাকে!”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমি আবার কি করলাম!”
“বেশি সুন্দর লাগছে তোকে।”
আহি শাড়ি আঁচল নাড়িয়ে বলল,
“আমি তো সুন্দরী, সুন্দর তো লাগবেই।”
(***)
আজ আহি ব্যাগ ভর্তি টাকা এনেছে শুধু খাওয়া-দাওয়া করার জন্য। জিনিসপত্রের তুলনায় মেলায় খাবারের চড়া দাম। কারণ ক্যাম্পাসে বাইরেও অতিথি আসে। আর সবার আগ্রহ খাবারের প্রতিই বেশি। এদিকে আহি পিঠার স্টলে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের প্লেট নিয়ে সেখানে দুইটা ভাপা পিঠা, একটা পাটিসাপটা, একটা পাকন পিঠা, তিনটা নারকেল নাড়ু, দুইটা সুজির চমচম, চারটা গাজরের হালুয়া নিয়ে পেছন ফিরতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ একনজর আহির প্লেটের দিকে তাকিয়ে, আবার আহির দিকে তাকালো। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“বাতাসা আর শনপাপড়ি বাদ যাচ্ছে।”
আহি আফিফের কথা শুনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো, ঠিকই তো, সে তো এই দুইটা নিলোই না। এবার আহি চারটা বাতাসা আর সাতটা শন পাপড়ি নিয়ে নিলো প্লেটে।
আফিফ একটা বক্সে শন পাপড়ি নিতে নিতে বলল,
“এতোগুলো মিষ্টি তুমি একা খাবে?”
আহি সেকেন্ড খানিক আফিফের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”
অনেকদিন পর আফিফের সাথে দেখা হয়েছে তার। তাই কিছুটা ইতস্ততবোধ করছিলো আহি।
এরপর আহি স্টল থেকে বের হয়ে একপাশে বসে ইচ্ছেমতো পিঠা খেতে লাগলো। আফিফ দূরে বসে আহিকে খেতে দেখে নিজের খাওয়া ভুলে গেলো। পদ্মের কাছে শুনেছিল, আহি না-কি মিষ্টি পিঠা বেশ পছন্দ করে। কিন্তু তার পছন্দ এমন ভয়ংকর, তা আফিফ জানতোই না। মেয়েটা কি হজম করতে পারবে এতোগুলো পিঠা? এই আগ্রহ নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে আহির খাওয়া দেখছে আফিফ। আহি খেতে খেতে তার আফিফের দিকে চোখ পড়লো। আফিফকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে খাওয়া বন্ধ করে দিলো আহি। আফিফ বুঝতে পেরে উলটো দিকে ঘুরে বসলো। আহি চোখ-মুখ ছোট করে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাশাল্লাহ বল তো, রাদ।”
রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”
“যদি পেট কামড়ায়।”
“তোকে রাক্ষসীর মতো খেতে দেখলো কারো লোভ জন্মাবে না। উলটো খাওয়ার শখই মিটে যাবে।”
আহি রাদের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“যাক অন্তত আজ সব মিষ্টি পিঠা আমার জন্যই বেঁচে যাক।”
লাবীব এসে বলল,
“আরেহ মিষ্টি দই তো নিলিই না। ওটা খাবি না? এক কাজ করি, তোকে ডুবিয়ে দেই দইয়ের হাঁড়িতে। সাঁতরে সাঁতরে খাবি।”
আহি চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকালো। এরপর মুখ ফুলিয়ে মুখে শন পাপড়ি পুরে দিলো। যে যাই বলুক, আজ সে খাবেই খাবে।
(***)
মেলার একপাশে ভীড় জমিয়েছে মেহেদি আর্টিস্টরা। আহি আর পুষ্প দুই হাতে মেহেদি লাগিয়ে ধেই ধেই করে রাদ আর লাবীবের কাছে গেলো। রাদ আহির হাতে মেহেদি দেখে বলল,
“বাহ, মনে হচ্ছে তোর হাতে আণুবীক্ষণিক জোক কিলবিল করছে।”
আহি চোখ বড় বড় করে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাদ, বেশি কথা বললে তোর মুখে লাগিয়ে দেবো একদম।”
এদিকে পুষ্পের ফোন বাজছে, সে ঝুঁকে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আছে। লাবীব উঠে এসে পুষ্পের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
“আমি দেখছি।”
লাবীব পুষ্পের ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তার কানের কাছে ধরলো। ওপাশ থেকে কিছু কথা ভেসে এলো। লাবীব তা শুনলো না। সে শুধু শুনলো পুষ্প ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে তাদের ভার্সিটির ঠিকানা বলছে। এরপর পুষ্প কথা শেষ করে লাবীবকে বলল, কল কেটে দিতে। লাবীব কল কেটে দিয়ে বলল,
“তোমার চুল বেঁধে দেবো?”
পুষ্প লাজুক হেসে বলল, “হুম।”
লাবীব দেরী না করে খুব যত্নের সাথে পুষ্পের চুল বেঁধে দিতে লাগলো। তা দেখে রাদ আর আহি অবাক হয়ে গেলো। রাদ বলল,
“এসব কখন থেকে চলছে!”
লাবীব হেসে বলল,
“এখনও শুরু হয় নি। তবে আজ শুরু হবে।”
এরপর লাবীব কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই তাদের ক্লাসের কয়েকটা ছেলে এসে লাবীবের সামনে কয়েকটা ফুলের চারা রেখে চলে গেলো। পুষ্প হাঁ করে লাবীবের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর লাবীব মেলার পাশে দাঁড়ানো একজন চাচার কাছ থেকে তার সব বেলুন কিনে এনে ক্যাম্পাসের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। যদি গ্রহণ করো, তাহলে কাছে এসে হাতটি ধরো। তোমার মেহেদি রাঙা হাতটি না হয় আজ আমায় ছুঁয়ে দিক।”
রাদ আর আহি একে অপরের দিকে তাকালো৷ এদিকে পুষ্প লাজুক হেসে ধীর পায়ে লাবীবের দিকে এগিয়ে গেলো। লাবীব ইচ্ছে করে দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছিল। কারণ পুষ্পের সামনে এসে বসলে মেয়েটা ইতস্ততবোধ করে যদি পালিয়ে যায়, তখন দু’জনই লজ্জায় পড়বে। এখন না হয়, একজনই পড়ুক লজ্জায়। কিন্তু পুষ্প লাবীবকে লজ্জায় ফেলে নি। সে লাবীবের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবীব এবার প্রতিটি চারা থেকে একটি একটি ফুল ছিঁড়ে পুষ্পের দিকে এগিয়ে দিতে লাগলো। পুষ্প সব ক’টি নিলো। ফুলগুলো দেওয়া শেষে লাবীব বেলুনগুলো সব ছেড়ে দিলো। পুষ্প বলল,
“এতোটা চমৎকার হবে আমি আশা করি নি।”
লাবীব বলল,
“বলেছি না। আমার সবকিছুই ঝাঁকা নাঁকা। প্রেমের প্রস্তাবটা ঝাঁকানাঁকা হলো তো!”
পুষ্প হাসলো। কে বলেছে ভালোবাসা শেষ সময়ে আসে না। কিছু ভালোবাসা শেষ মুহূর্তে আসে, যখন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় বিয়ে নামক সম্পর্কে। পুষ্পের পঁচিশ বছরের জীবনে তার প্রথম প্রেম এসেছে পঁচিশ বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর, এক হেমন্ত বেলায়।
আহি তাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“এই হেমন্তের সকালটা যদি আমাদের হতো!”
চলবে-