#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
**অঘোষিত পর্ব**
রাতের খাবারটা আজ বেশ দেরীতেই খেতে বসেছে সবাই। বরাবরের মত তোড়া অনুপস্থিত। অনুকে বসানো হয়েছে মেহেরজানের ঘরটায়। নাতবউকে দেখে দুষ্টুমির ছলে তিনি বললেন -“শরম পাও কেন? এ বাড়ি তো তোমার চেনা, আগে কত আইছো।”
পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটল রুবাবা। শাশুড়িকে বলল -“আপনিও না মা, তখন ছিল মেহমান আর এখন বাড়ির বউ। লজ্জা পেতে হয়না এমনি জেঁকে বসে।”
অনুর পাশে বসে রুবাবা হাসল। মিষ্টি করে বলল -“খাবারটা নিয়ে আসবে ভাবী, সুন্দর করে খেয়ে নিবে। চিন্তা করো না কিছু নিয়ে। বড়দের উপর ছেড়ে দাও, সম্বরণ তারাই করবে।”
অনু মাথা তুলে আশপাশটা দেখে নিল। কান্নার দরুন রক্তিম হয়ে ওঠা নয়নজোড়া আরেকবার মুছে নিল সন্তর্পণে। মুখটা একদম রুবাবার কানের কাছে নিয়ে নিচু আওয়াজে শুধালো -“তোড়া কোথায় আন্টি? ও সেই যে গেল আর এলোনা।”
অনুর কথা শুনে মৃদু হাসল রুবাবা। জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি টেনে বলল -“ও এসবে থাকে না মা, আসলে ইন্ট্রোভার্ট তো।”
তাদের কথোপকথনের মাঝেই থালা হাতে ঘরে এলো অনিমা। রুবাবাকে দায়িত্ব দিল অনুকে খাওয়ানোর। মেহেরজানের খাবারটাও ঘরে পৌঁছে দিয়ে অনিমা বলল -“তোড়াকে আজ ডেকে আন রুবা। তোর ভাসুর বলেছে ডাকতে।”
মাথা নিচু করেই খাবার প্লেটটা অনুর হাতে দিয়ে রুবাবা নীরব হয়ে গেল। অনিমা কিছু আঁচ করতে পেরে প্রস্থান করল। অনিমা যেতেই খানিক বাদে রুবাবার কানে এলো ভাসুরের জোরালো আদেশ -“রেহনুমা, নিচে এসো।”
অহনের হাতজোড়া থেমে গেল প্লেটেই। নিজাম মজুমদারও একবার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাখল। যেই কাজটা তার করার ছিল সেই কাজটা অন্য কেউ করায় রীতিমতো মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই মুহূর্তে তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করছেন মেয়ের করা সমস্ত আরোপিত অভিযোগ যথার্থ। নাঈম মজুমদার ফের হাঁক ছাড়লেন -“রেহনুমা, নিচে এসো।”
জ্যেঠার আজ্ঞাপ্তি উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা নেই তোড়ার। সিঁড়ির ধাপগুলো পেরোতে সর্বনিম্ন সময়টুকু নিয়েছে সে। তার পদধ্বনিতে বিস্মিত সকলে। মৃদু আওয়াজে ঘুরে তাকাল সকলে -“বড় বাবা, ডেকেছিলে?”
ছোট থেকে অহন আর অয়নের সাথে সে-ও বাবা ডাকত নাঈম মজুমদারকে। নিজাম মজুমদার ব্যস্ত থাকতেন ছেলেদের খেয়ালে। পিতৃস্নেহে ভাইয়ের মেয়েকে আগলে রেখেছেন নাঈম মজুমদারও। কিন্তু বহতা সময়ের ধারায় সে বুলি পরিবর্তিত হয়েছে ‘বড় বাবায়’। নাঈম মজুমদারের সম্বোধন বদলায়নি এতদিনেও। বড় আদর করে রেহনুমা ডাকেন তিনি। ভাতিজীর ছোট্ট স্বরে শুধানো উক্তির জবাবে তিনি ঈষৎ হেসে বললেন -“খেতে বসো, এসো আমার পাশে।”
মুহূর্তেই চোখজোড়া জ্বলে উঠল তোড়ার। মাথা নুইয়ে শীতল স্বরে বলল -“আমার উপর কোন ভার চাপিও না বড় বাবা, অসহনীয় ভারী বস্তুর তুলনায় অসহনীয় ভারী আদেশ অত্যধিক নিষ্ঠুর।”
চোয়াল শক্ত হয়ে এল অহনের। ইচ্ছে করছে পাশে বসা লোকটাকে জিজ্ঞেস করতে কেমন শান্তি অনুভূত হচ্ছে! কি দরকার ছিল দুটো কোমল হৃদয়কে ভগ্নাংশের একক বানাতে! রক্তচক্ষু নিয়ে মেজ চাচার পানে তাকাল সে। লোকটা লজ্জা আর ভয়ে ততক্ষণে আড়ষ্ট।
অয়ন উঠে এল, তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল -“আজ বাবা খাবার আনিয়েছে, শুধুমাত্র তোর জন্য। যাতে তোর মনে না হয় তুই অনুগ্রহ পাচ্ছিস। তবুও কি বলবি এটা অসহনীয় ভার?”
চোখ তুলে তাকাল তোড়া। অয়নের কথায় বিস্ময়ের শৃঙ্গে চড়ল সে। তার কথা ভেবে মানুষটা এই কান্ড ঘটাবে তা তার অজানা। নাহ, মানুষটার কাছে সে কৃতজ্ঞ নয়, খুব স্নেহের, খুব আদরের। নয়ত এমনটা কেউ করে নাকি!
ধীর কদমে জ্যেঠার পাশে থাকা খালি চেয়ারটায় এসে বসল তোড়া। মিষ্টি হাসিটা উপহার দিল তার বড় বাবাকে তাতেই যেন বিষফোঁড়ায় হুল ফুটলো কাননের। গজগজ করতে করতে বলল -“ঢং, এমন ভাব যেন নিজে কামাই করে খায়। রং দেখে বাঁচি না। ভাগ্যিস জমিদারি প্রথা উঠে গেছে, নয়ত এই বিদ্যে নিয়ে বাঈজির নাচ নাচা ছাড়া আর কোন উপায় থাকত নাকি! অবশ্য তাতে ভালোই কামাই রোজগার হতো।”
কথাটা কানে যেতেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল তোড়া। অহন আর অয়ন দুজনও পা দিয়ে লাথি মেরে চেয়ার সরালো। টেবিলে থমথমে স্তব্ধতা, ঘূর্ণিঝড়ের বিপদসংকুল পূর্বাভাস। কোথা থেকে হাওয়ার বেগে ছুটে এসে কাননকে টেনে ঘুরিয়ে সপাটে চড় বসাল রুবাবা। চেয়ারটা পেছনে ঠেলে সন্তর্পণে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। পুরো শরীরটা থরথর করে কাঁপছে তার। অন্যদিকে সাপের ন্যায় ক্রোধে ফুঁসছে রুবাবা। ঘনঘন নিশ্বাস পড়ছে তার। অনিমা আর কলি থমকে গেছে রুবাবার রণচন্ডী রূপ দেখে। তার নয়ন ঠিকরে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আসছে। তার কোমল কন্ঠের সকল সুনাম ঠেলে ফেলে চিৎকার করে বলল -“জিভ কেটে নেব ভবিষ্যতে আমার মেয়েকে এরকম কথা বললে। আজকে চড়িয়ে সাবধান করে দিলাম। রং রূপ বেঁচে কে চলে তা পুরো দুনিয়া জানে।”
পাল্টা জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল কানন তার আগেই অহনের হুংকার -“শুধুমাত্র গুরুজনের তকমা থাকায় আপনি বেঁচে গেলেন এই যাত্রায়। নয়ত একজন নারীর প্রতি নোংরা অশ্লীল অপবাদ আরোপের দায়ে জিভ কেটে নিতাম। ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দিয়ে বিশাল সাইনবোর্ডে লিখতাম এদের কোন স্হান নেই পরিবারে। জাস্ট বের করে দেয়া উচিত।”
সবার রোষানলের মুখে কুমিরের কান্না শুরু করল কানন। স্বামীর পাশে গিয়ে বলে -“তোমার সামনে সবাই আমায় অপমান করছে।”
তার কথা শেষ করার আগেই ফুলস্টপ বসাতে হলো তোড়ার স্টার্টিংয়ে -“উনি কিছু বলবেন না। এখন তো ওনার কিছু বলাও উচিত নয়। আপনার হয়ে কিছু বলতে হলে আগে আমার হয়ে লড়তে হতো কিন্তু উনি তা করেন নি। এখন আপনার হয়ে জবাব এলে আমি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত রেখে দেব। সোজা পুলিশ ডাকিয়ে তাদের হাতে তুলে দিতে এক বিন্দু ভাবব না। অভিযোগ থাকবে সন্তান জন্ম দিয়ে তার দায়িত্ব না নেয়া, বিয়ে করেও স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করা। এমন শতটা অভিযোগ এবং সত্য অভিযোগ আছে।”
আর থামল না তোড়া। মায়ের হাত ধরে চলে গেল দাদীর ঘরে। মা’কে সেখানে রেখে দ্রুত পদে ত্যাগ করল খাবার ঘরটা। তোড়ার প্রস্হানে সর্বোচ্চ ক্ষিপ্ত হওয়া তার বড় বাবা খাবার প্লেটটা ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। ঝনঝন শব্দে চুরমার হলো সেটা। টুকরো টুকরো হয়ে এপাশ ওপাশে ছড়িয়ে গেল। গগনবিদারী শব্দে ছিটকে পড়ল অহন আর অয়নের চেয়ারটা। মুহূর্তের ব্যবধানে প্রায় রিক্ত হলো খাবার ঘরটা। দাদী শাশুড়ির ঘরের দরজাটা আগলে অনু সব দেখছিলো।ভয়ে থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। অয়নের এই রাগ তার অজানা।
_______
থমথমে ঐ ঘরটাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তোড়া আবার নেমে এলো। জোর গলায় জ্যেঠীকে জিজ্ঞেস করল -“ভাবীকে কোন ঘরে নিব জ্যেঠীমা? সে কি দাঁড়িয়ে থাকবে?”
ঘরটায় অনুর পাশে বসে থাকা রুবাবা, অনিমা, কলি আর মেহেরজান সবাই তোড়াকে দেখে অবাক হয়েছে। সবাই ধরেই নিয়েছিল তোড়া আজ আর ঘর থেকে বের হবেনা। তাইতো অনুকে জায়গামত পৌঁছে দেয়ার দায় বর্তেছিল কলির ঘাড়ে। তোড়াকে দেখে রীতিমতো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল কলি। তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল -“উদ্ধার করেছিস মা, নয়ত অনুকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে তারা দাঁত কেলাচ্ছে।”
তোড়া হাসল ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি রাখল মায়ের মলিন বদনে। মায়ের মলিন মুখে হাসি ফুটানোর ভার আজ নিলো না। উপযুক্ত সময়ে সুদ সমেত হাসি ফেরাবে মায়ের অধরে। সবার সামনে দিয়ে অনুকে নিজের সাথে আনার সময় তোড়া গলা খাদে নামিয়ে বলল -“উপরমহল থেকে আদেশ এসেছে আপনাকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে। তা আপনাকে ভাবী ডেকে আপনি করে বলব নাকি নাম ধরে সম্বোধন করে তুই করে বলব! কি দোটানায় রেখেছে আপনার বর! একটু সময়ও দিলোনা আপনাকে ভাবী ডাকার চর্চা করার।”
অনু এবার লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিল। ইচ্ছে হচ্ছে পালিয়ে যেতে। প্রিয় বান্ধবীকে এতদিন মনের সব কথা বললেও আজ কেমন লজ্জারা অদৃশ্য বেষ্টনী দিয়ে ঘিরেছে তাকে। কথার জালে জড়িয়ে অনুকে নিজের ঘরে এনে দোর দিল তোড়া। বড় বড় চোখ নিয়ে তাকাতেই অনুর পানে চেয়ে ফিক করে হেসে দিল তোড়া। মেরুন রঙের জামদানী শাড়িটা তার সামনে এনে বলল -“আজ্ঞাবহ এই ললনাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সুন্দর করে সাজিয়ে পাঠানোর জন্য। সুচারু এই শাড়িখানা আপনার ভাসুর মহাশয় আনিয়ে দিয়েছেন। আপনি আপনার মর্জিমাফিক সাজুন। সব রাখা আছে। আমি বড়ই অপটু।”
নিজের সমস্ত আবেগ ঢেলে অনুকে সাজাল তোড়া। মোহনীয় হাসিটায় কি অমায়িক লাগছে মেয়েটাকে। অয়নের ঘরের দরজাটা ঠেলে তাকে বিছানায় বসিয়ে মৃদু হাসল তোড়া। ছোট্ট করে বলল -“আসি।”
তোড়ার ডাকে অহনের ঘর ছেড়ে নিজের ঘরের সামনে আসতেই তোড়াকে দরজার সামনে মেঝেতে বসা দেখে চমকাল অয়ন। তোড়া মিটমিট করে হেসে বলল -“বউ দেখতে হলে খরচা করতে হবে।”
অয়ন ভ্রু কুঁচকে বলল -“ইস, বললেই হলো, কত ঝক্কি সামলে বউ বানালাম, তোকে টাকা দেব কেন? চাঁদাবাজি বন্ধ করে মানেমানে কেটে পড়।”
এবার পা মেলে বসে রইল তোড়া। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে বলতে শুরু করল -“তাহলে পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি এখানে বউ পাহারা দেই।”
তোড়া আর অয়নের উচ্চ আওয়াজে বের হয়ে এলো অহন। অয়নের ঘরের সামনে ব্যারিকেড হয়ে বসে থাকা তোড়াকে দেখে বলল -“বিয়ে করলে এমন কাউকে করতে হবে যাতে পকেট কাটা যাওয়ার ভয় না থাকে।”
কথাটা বলে ফের ঘরে গেল অহন। অয়ন অসহায় দৃষ্টিতে পকেট হাতড়ে দু’টাকা বের করে বলল -“এটাই সম্বল, নিয়ে সুখে থাক।”
তোড়া হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। নিজের হাতে থাকা এক টাকার কয়েনটা অয়নের হাতে দিয়ে বলল -“দুজনে চকলেট কিনে ভাগ করে খাবেন। আমার দয়ার শরীর, বিয়ে উপলক্ষে আমার তরফ থেকে উপহার।”
বোকাবনে গেল অয়ন। নিজেকে গুটিয়ে রাখা মেয়েটা আজ এতটা স্বাভাবিক কেন? পেছন থেকে ডাকল অয়ন -“তোর কি মন খারাপ তোড়া? তোর এইরূপ তো আমি দেখিনি কখনো?”
ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিল -“নিন্দুকের জ্বলবে, আমার তাতেই চলবে।”
চলবে………..