শুধু_তোমাকেই_চাই #শারমিন_হোসেন #পর্ব১০

0
326

#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১০

“চারিদিকে বিভিন্ন টিপটপ জোনাকি বাতি জ্বলছে।মাঝে মাঝে হলুদ,লাল নীল সহ বিভিন্ন রঙের আলো জ্বলছে নিভছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বেশ জাঁকজমকপূর্ণ একটা রেস্টুরেন্টে আসে স্নাক এর জন্য। নিরিবিলি ফাঁকা একটা গোলাকার টেবিলে গিয়ে ওরা সবাই বসে পড়ে।আলিফ মেন্যু কার্ডটা দেখিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে,,”যার যার পছন্দ মতো খাবার অর্ডার দাও।সবাই সবার পছন্দ মত বললো।আলিফ ওয়েটার কে ডেকে খাবার অর্ডার করলো। পাঁচ মিনিটের আগেই সব খাবার টেবিলে চলে আসে।

খাবার শেষে আলিফ তুষার কে উদ্দেশ্য করে বলে,,”তুষার তুমি ওদের সাথে গাড়িতে গিয়ে বসো।আমি কাউন্টার থেকে ফর্মালিটিজ পূরণ করে আসছি।”

আলিফ রেস্টুরেন্টের বিল পে করে বাইরে আসে।ওরা সবাই গাড়িতে না উঠে দাঁড়িয়ে আছে, সবার হাতে আইসক্রিম। রাহবার লিয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে,,
“এই আপু তুই আমার আইসক্রিমটা নে আর তোর টা আমাকে দে।আমার টা বেশি গলা মনে হচ্ছে।আর তোরও তো বেশি ঠান্ডাতে এলার্জি আছে।তাই বলছি আমারটা কম ঠান্ডা তাই তোর নিজের ভালোর জন্য হলেও বদলা প্লিজ।”

লিয়া রাহবার এর কথা শুনে চোখ রাঙিয়ে মৃদু রা’গ দেখিয়ে বলে,,”বে’য়াদব একটা তোর ঐ চেটে খাওয়া আইসক্রিম এর সাথে আমার আইসক্রিম পাল্টাবো,নেভার।আর আমার এলার্জি নিয়ে তোকে এত মাথা ঘামাতে হবে না।”

তাসনিম ওর হাতের আইসক্রিম টা রাহবারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,,”রাহবার তুমি আমার টা ধরো।এমনিতেও আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“থেংকিউ আপু।বলে তাসনিম এর হাত থেকে আইসক্রিম টা নেয়।আর ওর হাতের আইসক্রিম টা তাসনিম এর দিকে দিতেই

তাসনিম স্মিথ হেসে নরম কন্ঠে বলে,,”দুইটাই তুমি খাও।”

তাসনিম এর কথা শুনে রাহবার ঘাড় ঘুরিয়ে লিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,,
“দেখ আপু বড় আপুর কাছ থেকে কিছু শিখে রাখ।কিভাবে ছোট ভাই বোনদের জন্য স্যাক্রিফাইস করতে হয়।আর তুই তো আমার বড় বোন হয়েও মাঝে মাঝে আমার থেকেও ছোট হয়ে যাস।বিশেষ করে আম্মুর কাছে।আমি বুঝিনা আম্মু তোর সব কথা এতো শোনে কেনো?তোর কোনো কথাতেই আম্মু না করে না। আব্বু রাজি না থাকলেও আম্মু নিজে আব্বু কে কনডেন্স করে তোর সব আবদার পূরণ করে।”

লিয়া ভাব নিয়ে বলে,,”আই নো।সেইজন্য তো সবার থেকে আমি আমার আম্মু কে বেশি লাভ করি।”

আলিফ এসে হালকা কেশে ফোনে সময় দেখে নিয়ে বলে,,”রাত হয়ে যাচ্ছে তো গাড়িতে বসো।বাসায় ফিরতে হবে।বাড়ির সবাই তো টেনশন করবে।”

তাসনিম গাড়িতে উঠতে যাবে,তখন তুলি হুড়মুড় করে এসে বলে,,”এবার আমি জানালার পাশে বসবো।মাঝে বসবো না।”

তাসনিম কপাল কুঁচকে তুলির দিকে তাকিয়ে আবার ওর জামার দিকে দেখিয়ে বলে,,”এই দেখতো কি করলি আইসক্রিম মেখে দিলি তো আমার জামায়।ধীর সুস্থে এসে এটা বলা যেতো না।সব সময় হুড়মুড় না করলেই তোর হয়না।”

তুলি ভাবলেশহীন ভাবে বলে,,”সরি অন্ধকারে খেয়াল করিনি তো।আর বাসায় গিয়ে পরিষ্কার করে নিস কেমন।”

আলিফ পকেট থেকে টিস্যু বের করে তাসনিম এর দিকে দিয়ে বলে,,”আপাতত মুঝে নাও।”

তাসনিম টিস্যু নিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”থ্যাংকস।”

বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ওদের রাত আটটা বেজে যায়।রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে লিয়া বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ে।কিছু সময় পড়ে রাজিয়া সুলতানা এসে লিয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে,,

“লিয়া নিচে চল।তোর আব্বু তোদের সবার জন্য গিফট এনেছে।”

লিয়া আলস্যতা কে’টে উঠে বসে বলে,,”আমার তো এখন নিচে নামতেই ইচ্ছে করছে না।রাজ্যের ঘুম চেপে বসেছে আমার দুই চোখে।”

রাজিয়া সুলতানা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নরম কন্ঠে শুধায়,,”খাবার খাবি না?”

“ইচ্ছে করছে না খাবার খেতে, রেস্টুরেন্ট থেকে তখন খেয়ে এসেছি তো।আপু,তুলি ওরা কই?”

“ওরা সবাই নিচে আছে।তুইও আয় হালকা কিছু খাবি।”বলে রাজিয়া সুলতানা রুম থেকে প্রস্থান করেন।

অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিয়াকে নিচে যেতে হয়।লিয়া সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখে তাসনিম তুলি সহ বাড়ির বড়রা ড্রয়িং রুমে আছে।লিয়া কে দেখে তহমিনা বেগম সোফার উপর থেকে একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে লিয়া দিয়ে বলে,,”লিয়া এইটা তোর।দেখতো পছন্দ হয় কিনা।”

লিয়া প্যাকেট টা খুলে দেখে একটা থ্রি পিচ।লিয়া মিষ্টি হেসে বলে,,”বড়মা খুব সুন্দর হয়েছে।কে পছন্দ করেছে বড় আব্বু নিজেই?”

তহমিনা বেগম ঘাড় নাড়িয়ে বলে,,”নাহ্।তোরা বিকেলে বাইরে যাওয়ার পর আমি তোর বড় আব্বুর সাথে মার্কেটে গিয়েছিলাম।”

তুলি আনন্দিত কন্ঠে বলে,,”এই লিয়া আমার ড্রেসের কালার টা দেখতো কিরকম হয়েছে।”

আলিফ ডিনার করার জন্য রুম থেকে বের হয়ে নিচে আসছিলো।উপর থেকে নিচে তাকাতেই দৃষ্টি যায় সোফায় বসা তাসনিম,লিয়া আর তুলি ওদের দিকে।আলিফ সিড়ির রেলিং উপর দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তাসনিম কে দেখতে থাকে।

হঠাৎ কেউ একজন এসে আলিফের কাঁধের উপর হাত রাখে।আলিফ চমকিয়ে যায় সাথে সাথেই পিছন ফিরে দেখে স্মিত হেসে বলে,,”ওহ্! আম্মু।?

আতিকা বেগম ছেলের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার নিচে দৃষ্টি দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,,”এখানে দাঁড়িয়ে আসছিস যে,নিচে চল খাবার খাবি। ওহ্ আরেকটা কথা তো তোকে বলতে ভুলেই গিয়েছি।তোর নানিমনি ‌তোর বিয়ের জন্য ঘটককে বলেছিলো।ঘটক বিকেলে এসে কয়েকটা মেয়ের ছবি দিয়ে গিয়েছে।আমি অবশ্য মাকে বলেছিলাম এখনই এসব বাদ দাও।আগে আলিফ এর থেকে শুনে নেই।আর মাত্রই ওর চাকরিটা হয়েছে একটু ভালো করে সেটেল হয়ে নিক তারপর না হয় মেয়ে দেখা যাবে।”

আলিফ নিরেট চোখে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,,” বাইরে মেয়ে দেখার কি দরকার,ঘরেই যখন আছে।”

ছেলের কথা শুনে আতিকা বেগম চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে অবাক গলায় শুধালো,,”ঘরেই আছে মানে,কার কথা বলছিস তুই?”

আলিফ ইশারায় বলে,,”নিচে তাকিয়ে দেখো,তাহলেই বুঝতে পারবে।”

আতিকা বেগম নিচে তাকিয়ে আগে ওনার দৃষ্টি যায় সোফায় বসা লিয়ার দিকে।তারপর ডায়নিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে তাসনিম খাবার ডিশ গুলো সাজাচ্ছে আর তুলি চেয়ার টেনে বসছে।আতিকা বেগম এর মনে হয় ছেলে নিশ্চয় লিয়ার কথা বলবে।কারন ওদের দুজনের থেকে লিয়া বেশি সুন্দরী।তাই সবারই ফাস্ট চয়েজ লিয়া হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরক্ষনেই আতিকা বেগমের চিন্তা হয় বড় বোন থাকতে তো এখনই লিয়ার সাথে আলিফ এর বিয়ের কথা বলা যায় কিভাবে?যতই হোক বড় দুইটা মেয়ে রেখে তার ভাইরা কখনো ছোট মেয়েকে বিয়ে দেবে না।আর একজন বিবেকবান জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ এরকম প্রস্তাব রাখবেই বা কি করে?এসব ভেবে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে আতিকা বেগম মৃদু কন্ঠে শুধালেন,,”লিয়া?লিয়ার কথা বলছিস তুই।”

মায়ের কথা শুনে আলিফ চরম বি’রক্ত হয় ওর ফেস দেখেই বোঝা যায়।আলিফ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে শান্ত ভাবে বলে,,”না আম্মু,লিয়া নয়।আমি এ বাড়ির বড় মেয়ের কথা বলছি। তাসনিম এর কথা বলছি।”

ছেলের কথা শুনে আতিকা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ।উনি মনে মনে খুব খুশী হয়।চোখে মুখে একরাশ আনন্দ নিয়ে বলে,,”ভালো তো। তাসনিম কে পুত্র বধূ হিসেবে পেলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবে না। আচ্ছা এই ব্যাপারে তোর মামার সাথে আমি কথা বলবো।”
এটা বলার কিয়ৎক্ষন পরেই আতিকা বেগম মনে মনে ভাবে,,”তাসনিম এর মতামত নেওয়া টাও তো জরুরী।এত বড় ভার্সিটি পড়ুয়া একটা মেয়ে। তার তো নিজস্ব কোনো ভালো লাগা থাকতে পারে।তাই আমাকে আগে তাসনিম এর মনের অবস্থা বুঝতে হবে। তাসনিম এর ভাবসাব বুঝে তারপর না হয় প্রস্তাব টা রাখবো।মনের কথাগুলো মনে রেখে আতিকা বেগম শান্ত গলায় বলেন,,
“আলিফ তুই আমাকে বললি।আমি বিষয়টা নলেজে রাখবো।আর আমি নিজেও চাই তোর সাথে তাসনিম কে দেখতে।তাই টেনশন করিস না।তবে আমার মনে হয় তুই তোর ক্যারিয়ারটা আরেকটু গঠন করে নে,আর এদিকে তাসনিম ও ওর পড়াটা কমপ্লিট করে নিক।তারপর উপযুক্ত সময় দেখে আমি তোদের দুজনের বিয়ের প্রস্তাব রাখবো।”

আলিফ আতিকা বেগমের কথায় সম্মতি দিয়ে নিচে নেমে যায়।

রাত বারোটা পার। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। খান বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ঘুম নেই লিয়া, তাসনিম আর তুলির চোখে। রুমে হালকা হলুদ নিয়ন আলো জ্বলছে।তিনবোন মিলে রাজ্যের গল্প করতে বিজি আছে।

তুলি মুখটা মলিন করে বলে,,”লিয়া তোরা কালকেই চলে যাবি?আর কয়েকদিন থাকতে পারতি।তোর ছুটি তো এখনো আছেই তাই বলছি আর কয়েকদিন থেকে যা না।বড় ফুপ্পি রাও চলে যাবে আবার তোরাও।একদিনে সবাই গেলে তো আমার ভীষণ মন খা’রাপ করবে।”

তুলির কথা শুনে লিয়ার মনটা একটু খারাপ হয়।এর থেকেও মন টা বেশি ছটফট করছিলো জারিফকে দেখার জন্য।আজ তিন হতে চললো মাস্টার মশাইয়ের সাথে দেখা হয়না।লিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,,”এর পরের বার আসলে বেশি দিন থাকবো কেমন।আর আমার প্রাইভেট মিস যাচ্ছে তো, সেইজন্য কালকে যেতেই হবে।লিয়া তাসনিম কে উদ্দেশ্য করে বলে,,আপু তুমিও কি কালকে আমাদের সাথেই ফিরছো?”

তাসনিম শান্ত গলায় জবাব দেয়,,”আমি এই সপ্তাহ টা থেকে যেতে চাচ্ছি।তোরা যা, সমস্যা নেই আমি ছোটো চাচ্চুর সাথে সামনের সপ্তাহে হলে চলে যাবো।”

লিয়া হঠাৎ নির্বিকার ভঙ্গিতে তাসনিম কে শুধায়,,”আপু তোমার কাউকে ভালো লাগে না?না মানে ইয়ে বলছি তোমার কি কোনো স্পেশাল পার্সন আছে।”

লিয়ার কথা শুনার সাথে সাথেই তাসনিম এর মন মস্তিষ্কে জারিফের কথা স্মরণ হয়। কিয়ৎক্ষন ভেবে নিয়ে তাসনিম দৃষ্টি সরু করে ধীর স্থির গলায় বলে,,”আসলে লিয়া তুই তো মনে হয় জানিসই আমাদের ফ্যামেলি থেকে এই বিষয়টা নিষেধ আছে।বিশেষ করে ছোট ফুপ্পির কারন থেকে।ছোট ফুপ্পির মৃ’ত্যুর পর দাদি সহ বাবা আর মেজো চাচ্চু আমাদের তিনবোন কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো আমরা যেনো কখনো ছোট ফুপ্পির মতো ভুল না করি।রিলেশন করে বিয়ে করা তো আমাদের জন্য মানা আছে।তাই সব সময় এই বিষয়টা আমার মাথায় থাকে, সেইজন্য ওরকমটা ভেবে দেখিনি।”

লিয়া গমগমে কন্ঠে বলে,,”আজ থেকে আট বছর আগে কি হয়েছে না হয়েছে সেটা ধরে রাখলে হবে।আর সব ছেলেই যে ছোট ফুপ্পির বরের মতো হবে এমন তো নয় যে,লাভ ম্যারেজ করে বিয়ে করে অথচ শ্বশুর বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য বারবার পেশার দিবে আর মেয়েটা বাবার বাড়ি থেকে বারবার টাকা চেয়ে নেওয়ার লজ্জার কারনে সুইসাইড করবে।এমন তো নয়।”

লিয়ার কথা শুনে তাসনিম ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সম্মতি দিয়ে বলে,,”সেটা তুই ঠিক বলেছিস।সবাই যে ছোট ফুপ্পির বরের মতো লোভী হবে এমন নয়। কিন্তু আমার বাবা চাচার মনে যে ভয় টা একবার ঢুকেছে তাদের অতি আদরের ছোট বোন কে হারিয়ে সেই ভয় কি আর এতো সহজে যাবে নাকি?”

লিয়া হুট করে বলে ফেলে,,”তবে আমার দ্বারা মনে হয় পরিবারের দেওয়া এই কথাটা রাখা সম্ভব নাও হতে পারে।”

তাসনিম কপাল কুঞ্চিত করে অবাক গলায় বলে,,”যদি তুই কাউকে পছন্দ করিস বলতে পারবি মেজো চাচ্চুর সামনে।আর মেজো চাচ্চু কি রাজি হবে।আমার মনে হয় না সহজেই রাজি হবে।”

লিয়া স্মিত হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভেবে বলে,,”আমার আম্মু আছে না।আমার আম্মু সবটা ম্যানেজ করবে।আর সাথে তো ছোট চাচ্চু আছেই।এরা দুজনে মিলে আব্বু কে ঠিক কনডেন্স করতে পারবে।আমার আকাশ সমান বিশ্বাস আছে আমার আম্মুর উপর। আমার আম্মু সব সময় আমাকে সাপোর্ট করবে।”

লিয়ার নিজের উপর এতো আত্মবিশ্বাস দেখে তাসনিম এর খুব ভালো লাগে। তাসনিম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবে,,আজ যদি আমি লিয়ার মতো হতাম।সহজেই যদি নিচের চাওয়া পাওয়া গুলো প্রকাশ করতে পারতাম,তাহলে এতোদিনে হয়তো জারিফ কে ভালোবাসার কথাটা বলতে পারতাম।

পরেরদিন,,,,

লিয়া,রাজিয়া সুলতানা আর রাহবার গাড়িতে পিছনে বসে আছে।আর লিয়ার বাবা এনামুল খাঁন সামনে বসে আছেন।লিয়ার খুব আনন্দ হচ্ছে।মনের মধ্যে এক রাশ ভালো লাগা কাজ করছে।লিয়া কিছু একটা ভেবে রাজিয়া সুলতানা কে উদ্দেশ্য করে বলে,,”আম্মু তোমার ফোনটা দাও তো একটু।”

রাজিয়া সুলতানা ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে লিয়ার হাতে দিতে দিতে বলে,,”কি করবি?”

লিয়া ফোনটা নিয়ে ওপেন করতে করতে বলে,,”দরকার আছে একটু।”

লিয়ার কথা শুনে রাজিয়া সুলতানা আর দ্বিতীয় বার কোনো প্রশ্ন করে না।লিয়া ফোনটা নিয়ে জারিফ এর কাছে টেক্সট করে।লিয়া ভাবে সেদিন ফোনে জারিফ কে ওভাবে মিস করার কথাটা বলার কারনে জারিফ যদি মাইন্ড করে বসে।আর যদি রা’গ টাগ করে না আসে পড়াতে। সেইজন্য লিয়া রাজিয়া সুলতানার ফোন দিয়ে মেসেজ দেয়।মেসেজ টা এরকম ছিলো,,”জারিফ আমরা বাসায় চলে আসছি।তাই তুমি বিকেলে লিয়া কে পড়াতে এসো।”লিয়া ভাবে,মেসেজ টা দেখে স্যার নিশ্চয় ভাববে যে, আম্মু মেসেজ করেছে।

বাসায় গিয়ে লম্বা করে একটা শাওয়ার নেয় লিয়া। লাঞ্চ করার সময় হালকা কিছু খেয়ে লিয়া প্লেটে খাবার রেখেই হাত ধুয়ে নেয়।রাজিয়া সুলতানা এটা দেখে চিন্তিত হয়ে অবাক গলায় শুধালেন,,
“লিয়া খাবার রেখেই হাত ধুয়ে নিলি যে।শরীর খারাপ লাগছে কি?”

লিয়া স্থির চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে,,”না তেমন কিছু নয়।হেডেক করছে।”
“পেইন কিলার খেয়ে নে কেমন।”
“মেডিসিন নেওয়া লাগবে না।একটু ঘুম দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।আসলে আজ কয়দিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম হয়নি।তার পরে জার্নি করেছি সেই জন্য পেইন টা হচ্ছে মে বি।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।”

ঘড়ির কাঁটা বিকেল পাঁচটার ঘর ছুঁই ছুঁই। কলিং বেলের শব্দ হওয়ায় রাজিয়া সুলতানা গিয়ে দরজা খুলে দেন।জারিফ মৃদু আওয়াজে সালাম দেয়।রাজিয়া সুলতানা সালামের উত্তর দিয়ে বলে,,”কেমন আছো?”

জারিফ দুই কথায় বলে,,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

“তুমি ভিতরে গিয়ে বসো।আমি লিয়াকে ডেকে দিচ্ছি।”

রাজিয়া সুলতানা লিয়ার রুমে গিয়ে দেখে লিয়া ঘুমাচ্ছে।সেই দুপুর দুইটার সময় ঘুম আসছে আর এখন বিকেল পাঁচটা বাজে।মনে মনে ভাবেন,লিয়ার তো হেডেক হচ্ছিলো এখন ডাকবে কি ডাকবে না। না জারিফ কে আজ চলে যেতে বলবে। দ্বিধায় থাকেন ।অবশেষে ভেবে নেন লিয়ার থেকেই একবার শুনে নেই যে আছ পড়বে কি পড়বে না?রাজিয়া সুলতানা লিয়ার পাশে বসে,লিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”লিয়া উঠ বিকেল হয়েছে তো।”

মায়ের ডাকে লিয়া একটু নড়েচড়ে এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে চোখ বন্ধ করেই বলে,,”আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।একটু পর উঠি।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।তুই ঘুমা আমি বরং জারিফ কে বলি আজকে চলে যেতে,যে তুই অসুস্থ আছিস তাই।”

জারিফ এর নাম শুনে লিয়া চোখের পাতা টেনে তুলে উঠে বসে চঞ্চল কন্ঠে বলে,,”নাহ্! আম্মু আমি ঠিক আছি তো।এখন হেডেক নেই।ঘুম দিয়ে এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে।তাই শুধু শুধু পড়া মিস দেওয়ার কোনো দরকার নেই।”

রাজিয়া সুলতানা লিয়ার ফেসের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলে,,”আচ্ছা ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে নে।”

লিয়া দ্রুত বিছানা থেকে নেমে। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়। বিছানার উপর থেকে ওড়না টা নিয়ে ওরকমই স্টাডি রুমে যায়। প্রতিদিন এর মতো পরিপাটি নয় আজকে একটু এলোমেলো ভাবেই লিয়া পড়তে চলে যায়।লিয়া গিয়ে হালকা হেসে সালাম দিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।

জারিফ একনজর লিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে।লিয়ার চোখ মুখ গোলা একটু ফোলা ফোলা।বেশি ঘুম পাড়ার কারনে হয়তো এরকম হয়েছে।মুখের উপর জায়গায় জায়গায় ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের উপর এসে পড়েছে। প্রতিদিন খুব সুন্দর পরিপাটি ভাবে থাকলেও আজ বেশ অগোছালো লাগছে লিয়া কে তবে এই লুকে লিয়াকে একদম ইন্নোসেন্ট বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।জারিফ কিয়ৎক্ষন পরেই লিয়ার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

শুক্রবার এর দিন বিকেলে ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো লিয়া।লিয়ার আবার মুড সুয়িং এর অভ্যেস আছে।এই ভালো লাগছে তো হুট করেই কারন ছাড়া মন খা’রাপ ঝেকে বসে।লিয়া সোফাতে বসে রিমোট হাতে শুধু চ্যানেল চেঞ্জ করে যাচ্ছিলো।রাজিয়া সুলতানা এটা দেখে লিয়াকে উদেশ্য করে বলে,,”কি ব্যাপার লিয়া?ভালো লাগছে না না-কি? শুধু উঠবিস উঠবিস করছো যে।”

লিয়া কিছুক্ষণ স্থির ভাবে বসে থেকে শান্ত গলায় বলে,,”আম্মু কেমন জানি বোর লাগছে।তাই বলছি কি অরিনের বাসায় যাই কেমন। অরিনের সাথে গল্প করে মুড টা ঠিক করে আসি।আর তুমি তো জানোই অরিনের সাথে থাকলে যে কারোরই মন ভালো হতে বাধ্য।”

রাজিয়া সুলতানা নিরেট চোখে তাকিয়ে ভরাট গলায় বলে,,”এখন অরিনের বাসায় যাবি।তোর আব্বু শুনলে তো রা’গ করতে পারে।”

মায়ের কথা শুনে লিয়া মুখটা আরো মলিন করে ফেলে।রাজিয়া সুলতানা লিয়ার ফেসের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,,”আচ্ছা যা ঠিক আছে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই চলে আসবি। তোর আব্বু কিন্তু সন্ধ্যার দিকেই আজ বাসায় থাকতে পারে।তাই বলছি তোর আব্বুর ফিরার আগেই তুই চলে আসিস।”

রাজিয়া সুলতানার কথা শুনে লিয়া মিষ্টি হেসে রাজিয়া সুলতানা কে জড়িয়ে ধরে বলে,,” থেংকিউ আম্মু।”

রাজিয়া সুলতানা লিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,,”হয়েছে হয়েছে এবার তাড়াতাড়ি যা আর তাড়াতাড়ি ই চলে আসিস কেমন।”

লিয়া রুমে গিয়ে দ্রুত রেডি হয়ে নেয়। স্কাই কালারের হালকা কাজ করা একটা থ্রি পিচ পড়ে নেয়। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে নেয়। ঠোঁটে হালকা পিংক কালারের চ্যাপিসটিক দেয়,ব্যাস এনাফ।মেকআপ টেকআপ ব্যাবহারে লিয়ার এলার্জি । হালকা সাজেই লিয়া কমফোর্টেবল ফিল করে।লিয়া রাজিয়া সুলতানা কে আসছি বলে চলে যায়।রাজিয়া সুলতানা দরজা লাগিয়ে দেয়। আর ভাবে কেনো জানি লিয়ার কোনো আবদারই ফেলতে পারেন না,হোক সেটা ছোট কিংবা বড়।

রিক্সা থেকে নেমে লিয়া লিফটে করে পাঁচতলায় যায়। পাঁচতলার একটা ফ্ল্যাটে অরিনরা থাকে।অরিনদের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে তালা ঝুলানো দেখে লিয়া অবাক হয়।তারপর ফোন অপেন করে অরিনের নম্বরে কল করে, অরিন ফোন রিসিভ করতেই লিয়া গমগমে কন্ঠে বলে,,”এই অরিন তুই কোথায়?তোদের বাসায় তালা ঝুলছে কেনো?”

লিয়ার কথা শুনে অরিন আশ্চর্য হয়ে অবাক গলায় বলে,,”এই তুই কিভাবে জানলি আমি বাসায় নেই?আবার তালা দেওয়া,তারমানে তুই আসছিস নাকি?”

লিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”হ্যা।তোকে সারপ্রাইজ দিতে এসে আমি নিজেই তো বড় সারপ্রাইজড হয়ে গিয়েছি।”

“আমরা সবাই এখন হসপিটালে আছি।”

হসপিটাল কথাটি শুনে লিয়া চিন্তিত হয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,,”হসপিটালে কিন্তু কেনো? আন্টি আঙ্কেল ওনারা ঠিক আছেন?কে অসুস্থ?”

“আরে রিলেক্স!হাইপার হওয়ার কিছু নেই।বাবা- মা ঠিক আছে।আমার চাচাতো বোন প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে পটল তুলতে গিয়ে পটল তুলতে পারেনি।এখন হসপিটালের বেডে ব্যাকা হয়ে পরে আছে।”

অরিনের কথা শুনে লিয়া হাসবে নাকি কাঁদবে?বুঝতে পারছে না।ওর কাজিন অসুস্থ হয়েছে তাও সুইসাইড করতে গিয়েছিলি। সেই বিষয়টা নিয়েও কি সুন্দর ভাবে মশকারা করে যাচ্ছে।এই পৃথিবীতে এটা অরিন এছাড়া কারো পক্ষেই এমন সিরিয়াস সময়ে ফান করা পসিবেল নয়।লিয়া গলা ঝেড়ে বলতে থাকে,,”তা কোন পদ্ধতিতে পটল তুলতে গিয়েছিলো।না মানে গলায় দড়ি দিয়ে না হাত কে’টে না বি>ষ টিষ খেয়ে।”

“সস্তার তিন অবস্থা। ট্রয়লেট ক্লিনার হারপুন আছে না।ও সেই হারপুন খেয়ে ম’রতে গিয়েছিলো।বাট কাজ হয়নি।আমাকে বললে আমি এক নম্বর ব্যান্ডের নাইনটি নাইন পার্সেন্ট জীবাণু ধ্বংসকারী হারপিক এনে দিতাম,হারপিক খেলে তাও একটু কাজ হতো।নাইনটি নাইন পার্সেন্ট জীবাণু যেভাবে বিনাশ হয় আমার কাজিনও তেমন বিনাশ হতো।”

অরিনের কথা শুনে লিয়া ফিক করে হেসে ফেলে।মৃদু কন্ঠে বলে,,”তোর কাজিন হয়না এই মুহূর্তে এরকম কি করে বলছিস। আচ্ছা আমি রাখছি।বাসায় চলে যাই।”

“তুই একটু ওয়েট কর নাহয়।আমি এখনি আসছি।”

“নাহ্।থাক আসতে হবে না।আমি বাসায় চলে যাই।রাতে ভিডিও চ্যাটিং এ আসিস।”

লিয়া রাস্তায় এসে দাঁড়ায় রিকশার জন্য। রিকশার যেনো দুর্ভিক্ষ পড়েছে আজ। উজ্জ্বল আকাশটা হঠাৎ করেই অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছিলো। গ্রীষ্ম ঋতুর এই একটা দোষ সারাদিন রোদ ঝলমলে থাকলেও হুটহাট করে বিকেল হলেই ঝড় বৃষ্টির আগমন হয়।লিয়ার নিজের উপর নিজের রাগের পারদ টা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।একে তো আকাশ কালো হয়ে গিয়েছে আবার রিকশার দেখা নেয়।লিয়া দাঁড়িয়ে না থেকে দু এক পা এগিয়ে যেতে থাকে।বিপদের উপর বিপদ বৃষ্টির ফোঁটা আকাশ থেকে পড়তে শুরু করলো।লিয়া আশেপাশে তাকিয়ে ভাবলো কোনো দোকানের ছাউনির নিচে দাড়াবে কিনা বৃষ্টি থামা বা রিকশা না পাওয়া অব্দি।আবার পরক্ষণেই মনটা কু ডেকে উঠলো এই বৃষ্টির সময় কোনো যায়গায় একলা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কেউ হয়তো বাজে ভাবে টিজ করতে পারে। তাই, লিয়া না দাঁড়িয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো ।আর ওদিকে বৃষ্টিও তার গতি বাড়িয়ে দিলো, টিপটিপ থেকে এখন আরো জোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। হঠাৎ লিয়া বুঝতে পারলো পিছন থেকে ওর মাথার উপর কেউ ছাতা ধরেছে।লিয়া সেই ছাতা ধরা মানুষ টা কে দেখবে বলে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখতে পায়…

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here