শুধু_তোমাকেই_চাই #শারমিন_হোসেন #পর্ব০২

0
473

#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব০২

দেয়ালে টাঙ্গানো একটা পোস্টারের দিকে দৃষ্টি যায় লিয়ার।যেখানে কোচিং থেকে ক্যাডেটে চান্স পাওয়া স্টুডেন্টদের সাথে কোচিং এর টিচারদের ছবি আছে।টিচাররা কৃতকার্য স্টুডেন্টদের হাতে গিফট তুলে দিচ্ছে।সেই পোস্টারের একপাশে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে জারিফ।জারিফের ছবিটা দেখে লিয়া চোখে মুখে উৎসুকতা নিয়ে পোস্টারটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
একটা মহিলা হাতে কিছু পেপারস নিয়ে করিডোর দিয়ে যাচ্ছিল।লিয়া মহিলাটিকে দেখে বুঝতে পারে অফিস সহকারী হবে হয়তো।

লিয়া হালকা কেশে সালাম দিয়ে বিনয়ের সাথে সামনের মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,,” আন্টি কিছু না মনে করলে একটা প্রশ্ন করতাম আরকি?”

মহিলাটি কপাল কুঁচকে লিয়ার দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলে,,” সমস্যা নাই বলো।”

পোস্টারের দিকে জারিফের ছবিটাকে দেখিয়ে বলে,,উনি কি এই কোচিং এ ক্লাস নেন।না মানে আমার ভাইয়ের জন্য একজন টিউটর দরকার ছিলো তো তাই বলছি আরকি।শেষের কথাটা জড়তা নিয়েই বলে লিয়া।”

“জারিফ এর কথা বলছো।ও তো অনেক ভালো স্টুডেন্ট। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ থেকে পড়াশোনা করছে। আমাদের কোচিং এ আজ দুইবছর হলো ক্লাস নেয়।তবে আমি যতটুকু জানি আমাদের এইখানকার অনেক গার্জিয়ানরাই ওকে তাদের ছেলেমেয়েদের কে পড়ানোর জন্য বলে। তবে ও রাজি হয়না কারো বাসায় যেতে। শুধু আমাদের কোচিং এই ক্লাস নেয়। সপ্তাহে তিনদিন আসে।ভালো ছাত্র তো নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে শুনেছি।আর খুব পলাইট।”

লিয়া মহিলার কথা শুনে মনে মনে অনেক খুশি হয়।যাক অল্প কথায়ই ছেলেটির সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।লিয়া মহিলাটিকে ধন্যবাদ জানায় ইনফর্মেশন গুলো দেওয়ার জন্য।

লিয়া রাহবার কে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরছে আর ভাবছে, তারমানে আজকে না আসার কারন হলো সপ্তাহে ওনার তিনদিন ক্লাস থাকে।লিয়ার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে।ভাবে আম্মু কে বলে ঐ কোচিং এর টিচারকে যদি আমার টিউটর বানানো যায়,তাহলে কেমন হবে।গুড আইডিয়া,আমার নিজেরও তো একজন টিউটর দরকার।আর উনি হলে আমি আমার ভালোলাগা টা ধীরে ধীরে বলার স্কোপ পাবো।আর ইমপ্রেস করারও একটা গ্রান্ড চান্স পাওয়া যাবে।

লিয়া ওর আম্মুর রুমে গিয়ে দেখে ওর আম্মু গল্পের বই পড়ছে।লিয়া ওর আম্মুর গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে,, “আম্মু বলছিলাম যে?”

রাজিয়া সুলতানা ঘাড় ঘুরিয়ে লিয়ার দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলে,,”এতো আদুরে গলায় বলছিস কোনো আবদার আছে নিশ্চয়?”

লিয়া মৃদু আওয়াজে বলতে থাকে,, “রাহবারের কোচিং থেকে শুনলাম একজন টিচার আছে খুব ভালো সায়েন্সের স্টুডেন্ট।ফিজিক্সে খুব ভালো তাই যদি তাকে বলে আমাকে পড়ানোর ব্যবস্থা করে দাও আরকি।”

“তোর আব্বু তো খুঁজছে নিউ টিউটর।”

“অলরেডি দুইদিন শেষ হয়ে গিয়েছে আমার ছুটির, এখনো যদি খুঁজে না পাও তাহলে কি করে হবে বলোতো?সেই জন্য আমি একজন টিচারের খোঁজ দিলাম বাকিটা তুমি ম্যানেজ করবে, প্লীজ আম্মু।”

রাজিয়া সুলতানা হাতের বইটা বিছানার উপর নামিয়ে রেখে বলে,,” আচ্ছা ঠিক আছে।নাম কি টিচারের যোগ্যতা কি বল।আমি তোর আব্বু কে বলে তাকে রাজি করাবো ইনশাআল্লাহ।”

লিয়া জারিফ সম্পর্কে যতটুকু জানে সবটুকু রাজিয়া সুলতানা কে বলে।

কলিং বেলের শব্দ হওয়ায় লিয়া দরজা খুলে ওর কাজিন তুষার কে দেখে অবাক হয়ে বলে,,”ভাইয়া আপনি?”

তুষার হালকা হেসে বলে,,”এই সময় আমাকে এক্সপেক্ট করোনি বুঝি?(তুষার লিয়ার বড় চাচার ছেলে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে)”

“নাহ্ মানে”

তুষার পিছনে ইশারা করে জান্নাত বেগম (লিয়ার দাদি) কে দেখিয়ে বলে,,”দাদিমনির সাথে আসতে হলো। আব্বুর হঠাৎ জরুরী কাজ পড়ায় আসতে পাড়লো না,তাই আমাকে বললো দাদিমনি কে পৌঁছে দিতে।”

লিয়া ওর দাদি কে সালাম দিয়ে বলে,,”কেমন আছো দাদিমনি?”

জান্নাত বেগম কপাল কুঁচকে লিয়ার দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলে,,”ভালো আছি।তুই কবে বাসায় আসছিস?”

এর মধ্যে সেখানে রাজিয়া সুলতানা এসে সালাম দিয়ে বলে,,”আম্মা আসতে আপনার কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

জান্নাত বেগম ধপধপ হেটে সোফায় গিয়ে বসে বলে,,”এই বয়সে গাড়িতে উঠলে তো অসুবিধা হয়ই।তারপর তুষার সাথে ছিলো সেইজন্য বেশি সমস্যা হয়নি।”

রাজিয়া সুলতানা ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,”আর বাবা তুষার তোমার কি খবর?তুমি তো এখন আসোই না।”

তুষার মাথা চুলকিয়ে স্মিত হেসে বলে,, “আসলে মেজো আম্মু পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়তো। সেইজন্য,সময় হয়ে উঠে না আসার।

“লিয়া তুষার কে এক গ্লাস পানি দেতো।গাড়িতে থাকতেই তুষার বলছিলো ওর নাকি পানি পিপাসা লাগছে।” জান্নাত বেগম বলেন

রাজিয়া সুলতানা কিচেনে চলে যায়।লিয়া ডায়নিং থেকে পানি এনে তুষারের দিকে বাড়িয়ে দেয়।তুষার আড়চোখে লিয়ার দিকে তাকিয়ে পানির গ্লাস টা নিয়ে বলে,,”থ্যাংকস।”

লিয়া সৌজন্যমূলক হেসে ওখান থেকে চলে আসতে নিলে তুষার লিয়াকে ডেকে বলে,,”লিয়া”

লিয়া থেমে গিয়ে পিছন ফিরে তাকায়।তখন তুষার বলে,,”আসলে আসার সময় তুলি তোমার কথা অনেক করে বলেছে।বলেছে তুমি গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে আসলে বাড়িতে যেয়ে যেনো এবার বেশিদিন থাকো।”

“ওকে, ট্রাই করবো।আসলে বাসায় থাকাকালীনও আমার প্রাইভেট থাকে তো সেইজন্য বেশিদিন গিয়ে থাকতে পারিনা।”

জান্নাত বেগম বলেন,,”মেয়ে মানুষ সব সময় এতো পড়া পড়া করে কেনো আমি বুঝিনা।সেই তো বিয়ে হইলে সংসার করা লাগবে।তাইলে এত্ত পইড়া কি হবে শুনি।ছুটিতে আসছিস এখন বাড়িতে গিয়ে ভাইবোনের সাথে আনন্দ করে কাটাবি।”

তুষার ওর দাদির কথা শুনে আড়ালে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।আর লিয়া মনে মনে বিরক্ত হয়।

তুষার গলা ঝেড়ে জান্নাত বেগম কে উদ্দেশ্য করে বলে,,”আরে সুইটহার্ট এখন সময় চেন্জ হয়েছে।একটা কথা আছে না যে রাঁধতে জানে সে চুলও বাঁধতে জানে।সো সংসার করার জন্য মেয়েদেরকেও শিক্ষিত হওয়া মাস্ট।কারন একজন শিক্ষিত মা-ই পাড়ে একটা শিক্ষিত জাতি দিতে।আমার কথা নয় বিখ্যাত নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উক্তি এটা।”

এরমধ্যে রাজিয়া সুলতানা লিয়াকে ডাকতে থাকায়, লিয়া ওর আম্মুর কাছে কিচেনে চলে যায়।

দুপুরে ডায়নিং এ বসে লাঞ্চ করছে।লিয়া, রাহবার,লিয়ার বাবা এনামুল খাঁন।আর লিয়ার দাদিমনি।তুষার দুই ঘন্টা থেকে চলে গিয়েছে।ওর নাকি কি কাজ আছে তাই আর আজ থাকতে রাজি হয়নি।তবে বলেছে কয়েকদিন পর আবার এসে তখন থাকবে।
রাজিয়া সুলতানা খাবার সার্ভ করছে।

নীরবতা ভেঙ্গে রাজিয়া সুলতানা এনামুল খানের উদ্দেশ্যে বলেন,, “লিয়ার জন্য নিউ টিচার দরকার।তাই বলছি রাহাবারের কোচিং এ একটা ভালো টিচার আছে।তাকে যদি লিয়াকে পড়ানোর জন্য ঠিক করা হতো।”

এনামুল খাঁন মুখে খাবার নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলে,, “আচ্ছা সেই টিচারের নাম বলো ,আমি হারুন কে পাঠিয়ে বলার ব্যবস্থা করবো।”

“কোচিং এ গিয়ে জারিফ নাম বললে সবাই চিনবে। বাকৃবিতে ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।শুনেছি ফিজিক্স এ খুব ভালো।আর লিয়ার তো যত প্রবলেম ফিজিক্স নিয়েই।”

জারিফ নাম শুনে জান্নাত বেগম কপাল কুঁচকে রাজিয়া সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলে,, এত্ত বড় মেয়েরে বে’ডা ছোল মানুষ দিয়ে পড়াবা।মেয়ে মাস্টারনীর কি অভাব পড়ছে নাকি?তাও এত বড় মেয়ে একা একা চ্যাংড়া পোলার কাছে পড়বে।আমি মানতে পারলাম না।”

লিয়া মনে মনে বিরক্ত হয়ে আড়ালে দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে বিড়বিড় করে বলে,, “ওহ্ মাই আল্লাহ! আম্মু টাও না দাদিমনির সামনেই আব্বু কে বলতে হলো। আব্বু যদিও রাজি ছিলো ।এখন দাদিমনির কথা শুনে পাল্টি না খেয়ে বসে।দাদিমনির নাম কে যে জান্নাত রেখেছিলো। দাদিমনির নাম হ্যাভেন না হয়ে হেল হলে একদম পারফেক্ট হতো।এখন দাদিমনির কথা শুনে আব্বু রাজি না হলে,আমার মনটা ভে’ঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।”

লিয়া কে অবাক করে দিয়ে এনামুল খাঁন বলেন,, আহ্!মা।এরকম কেনো বলছো।লিয়া ওখানে একা থেকে পড়ছে না। ওখানে মেইল টিচার নেই,,এই চিন্তা পুষে থাকলে তো আর লেখাপড়া করানো যায় না।গার্ডিয়ান হিসেবে আমরা আমাদের সন্তানদের কে নৈতিকতা,ইটিকেট শিক্ষা দেবো।আর সব সময় ভালো থাকার জন্য সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।আর রইল মেইল টিচারের কথা নিশ্চয় আমি সেই টিচারের সম্পর্কে জেনেই তাকে বাসায় আসার জন্য এলাউ করবো।”

এনামুল খানের কথা শুনে লিয়ার মনে খুশিতে লাড্ডু ফোটে। লিয়ার মনে হচ্ছে খুশিতে নাগিন ডান্স দিবে।লিয়ার বাবা চাচারা সব সময়ই জান্নাত বেগমের কথা কে প্রায়োরিটি দেয়। বিত্তবান প্রভাবশালীর কন্যা ছিলেন জান্নাত বেগম। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠলেও কথা বার্তায় এখনো আগের মতোই দাপট নিয়ে বেড়ান। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবার সব সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন তিনি।যে সব সম্পত্তি এখনো নিজের নামেই আছে।

পড়ন্ত বিকেল সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে। কিছুক্ষণ পরেই গোলাকার সূর্য টা আকাশের বুকে ঢলে পড়বে।এক হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগে মাঝে মাঝে ঠোঁট ছোঁয়াচে লিয়া।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে খোলা দিগন্তে সূর্য অস্তের অপরুপ দৃশ্য দেখছে।এরমধ্যে সেখানে রাজিয়া সুলতানা আসেন।

“লিয়া তোর ড্রাইভার আঙ্কেল কে পাঠিয়ে ছিলো তোর আব্বু। কোচিং থেকে জারিফের ঠিকানা নিয়ে হারুন গিয়েছিল।তো জারিফ রাজি হয়নি পড়াতে।”

রাজি হয়নি এই কথাটা শুনে লিয়ার
মুখটা মলিন হয়ে যায়।

“রাজিয়া সুলতানা ভরাট গলায় বলেন,,”তবে আমি চাচ্ছি কালকে আমি নিজে গিয়ে একবার বলে দেখব।এতেও যদি রাজি না হয়।তাহলে আমার কিছুই করার নেই। কোচিং এ ফোন দিয়ে শুনেছি কালকে জারিফের ক্লাস আছে,তাই কালকে আমি নিজেই গিয়ে দেখা করব।”

লিয়ার আম্মু নিজে থেকে একবার ট্রাই করবে এটা শুনে লিয়া কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে ওর আম্মুর দিকে তাকায়।লিয়া বিশ্বাস করে ওর আম্মু ঠিক জারিফ কে রাজি করাতে পারবে হয়তো।লিয়া মনে মনে ভাবে ওর উচিত ওর অনুভূতির কথাটা আম্মুর কাছে শেয়ার করা।পরক্ষণে আবার ভাবে,একটু সময়ের দরকার।আমার অনুভূতিটা শুধুই কিশোরী বয়সের আবেগ নয়তো?আর শুধুই ওয়ান সাইড হবে নাতো??এসব কিছু ক্লিয়ার হওয়ার জন্য নিজেকে আমার আরো সময় দেওয়া দরকার। আর বিষয়টা পরেই আম্মুর কাছে শেয়ার করবো কোনো উপযুক্ত মোমেন্টে।”

পরের দিন,,,,
রাজিয়া সুলতানা কোচিং সেন্টারে বসে ওয়েট করছে জারিফের সাথে কথা বলার জন্য।

জারিফ ক্লাস নিয়ে বের হচ্ছে তখন ওখানকার একজন সহকারী রাজিয়া সুলতানা কে দেখিয়ে জারিফ কে বলে,,”ঐ ম্যাম আপনার সাথে দেখা করতে আসছে।”

জারিফ রাজিয়া সুলতানার দিকে এগিয়ে গিয়ে অবাক হয়।পরনে জলপাই কালারের শাড়ি,বেশ স্মার্ট।দেখে বয়স নির্ধারণ করা বেশ মুশকিল। ত্রিশ বললেও ভুল হবে না আবার আটত্রিশ এর উপরেও যাবে না এমন।জারিফ বুঝতে পারছেনা এই মহিলা কে? আর আমার কাছেই বা কী দরকার আছে?জারিফ বিনয়ের সহিত সালাম দেয়।

“রাজিয়া সুলতানা সালামের উত্তর দিয়ে,উঠে দাঁড়িয়ে।গলা ঝেড়ে বলতে থাকে,,”ইউ আয়মান হোসেন জারিফ,আ’ম আই রাইট?”
“ইয়াহ।”
“তো তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম?আর তুমি করেই বললাম।ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড?তুমি কি আমার মেয়েকে বাসায় গিয়ে পড়াবে।”

জারিফ কিছুটা জড়তা নিয়ে বলে,,”একচুয়েলি,আমার নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তো, সেইজন্য পর্যাপ্ত সময় আমার হাতে নেই।”

“এক মাস যদি একটু ম্যানেজ করতে পারো তবে আমাদের আই মিন আমার মেয়ের জন্য ভালো হতো। আমার মেয়ে ক্যাডেট এ একাদশ শ্রেণীতে পড়ে।বাসায় যখন ছুটিতে আসে সেই সময় হোম টিউটরের কাছে পড়ে,বিশেষ করে ফিজিক্স।পুরানো টিচার টা আর আসতে পারবে না।এখন ইমার্জেন্সি নিউ একজন টিচার দরকার।আর শুনেছি ফিজিক্সে তুমি খুব ভালো ছিলে,সেই জন্য তোমার কাছে আসা।অন রিকুয়েস্ট, আই হেভ হাই হোপ টু ইউ।”

জারিফ দৃষ্টি নিচু করে রাজিয়া সুলতানার কথা গুলো শ্রবণ করতে থাকে।আর নিশ্চুপ হয়ে থাকে। জারিফ মৃদু আওয়াজে বলে,,
“ওকে।ঠিকানা টা বলে যান।আমি ট্রাই করবো।”

রাজিয়া সুলতানা স্মিত হেসে বলে,”থ্যাংকস আ লট। তারপর ঠিকানা বলে।আর বলে আজ থেকেই যেনো যায়।”

“আমি তো বিকেলে ফ্রি থাকি তাহলে বিকেলের দিকে হলে কি কোনো প্রবলেম আছে?”
“নাহ্।কোনো সমস্যা নেই। তুমি বিকেলের দিকেই আসো।আর গেইটে তোমার কথা বলে দেওয়া হবে। প্রথম দিন তো তাই তুমি লিয়ার আব্বুর নাম বললেই তোমাকে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে যেতে দেবে,নেক্সট আর জিগ্গেস করবে না।আর তুমি তো রাহবার কে চেনো নিশ্চয়?”

জারিফ ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,” রাহবার”

“আমি রাহবার এর আম্মু।”
“ওহহহ হ্যা চিনিতো রাহবার কে,খুব ভালো স্টুডেন্ট রাহবার।”

নাম ঠিকানা বলে হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে রাজিয়া সুলতানা বলেন,, “আচ্ছা এবার আসি তাহলে।”

জারিফ রিকশা করে সোজা বাসায় চলে যায়।জারিফরা তিন ভাইবোন।জারিফ বড় আর ছোট দুই টা বোন।জেরিন একাদশ শ্রেণীতে পড়ে আর ছোট বোন জারা নবম শ্রেণীতে পড়ে।জারিফের বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে জারিফ।জারিফের ইচ্ছে লেখাপড়া করে বাবার স্বপ্ন পূরন করা বিসিএস ক্যাডারের চাকরি করা। একতলা বাড়ি। বাসার আসবাবপত্র খুব এক্সপেনসিভ না হলেও বেশ সাজানো গুছানো ছিমছাম বাসাটা,বলা বাহুল্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সব কিছুতেই নির্মলতা বিরাজ করছে।

বিকেল হতেই লিয়া অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জারিফের আসার। রাজিয়া সুলতানা যখন এসে লিয়াকে বলেছে,, জারিফ রাজি হয়েছে।এই কথাটি শুনে লিয়ার চোখ মুখ জুড়ে খুশি যেনো উপচে পড়ছে।তারপর থেকেই সারাদিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে,কখন বিকেল হবে। অপেক্ষার সময় যেনো কাটতে চায়না।লিয়া বারবার বেলকনিতে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে, অবশেষে বিরক্ত হয়ে রুমে এসে বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করতে থাকে।তখনই কলিং বেলের শব্দ শুনতে পায়।

রাজিয়া সুলতানা ড্রয়িংরুমে ছিলেন সাথে নুরজাহান বেগমও সোফায় বসে ছিলেন। কলিং বেলের শব্দ শুনে রাজিয়া সুলতানা গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

জারিফ মৃদু আওয়াজে বলে,,”আসসালামুয়ালাইকুম”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম”রাজিয়া সুলতানা স্মিত হেসে বলে,,বাসা খুঁজে পেতে তোমার কোনো অসুবিধা হয়নি তো।”

জারিফ এক কথায় বলে,,নাহ্।

“ভেতরে এসো।তারপর ড্রয়িংরুমের পাশেই স্টাডিরুম দেখিয়ে বলে তুমি ভেতরে গিয়ে বসো,আমি লিয়াকে ডেকে দিচ্ছি।”

সেই সময় জান্নাত বেগম এসে,,জারিফের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে। নুরজাহান বেগমের এভাবে তাকানোতে জারিফ অস্বস্তি ফিল করে।

জান্নাত বেগম তারপর এক আঙ্গুল দিয়ে চোখে থাকা চশমাটা একটু নিচে নামিয়ে আবার ঠিক করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,,
“তা বাপু তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”

জারিফ বিনয়ের সহিত বলে,,”বাবা,মা আর দুইবোন আছে।”

লিয়া দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে।রাজিয়া সুলতানা চিন্তায় আছেন,কারন ওনার শ্বাশুড়ির আবার মানুষের মুখের উপর যেকোনো কথা বলার ব্যাড হেবিট আছে।

নুরজাহান বেগম গম্ভীর গলায় বলেন,,”বউ বাচ্চা নেই।”

জারিফ জান্নাত বেগমের কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলে আর মনে মনে বলে,,বিয়েই করলাম না আর বউয়ের সাথে বাচ্চার কথাও জিগ্গেস করছে,স্ট্রেইন্জ। জারিফ কিছু বলতে যাবে তার আগে রাজিয়া সুলতানা বলেন,,
“আহ্! আম্মা ও তো স্টুডেন্ট।এখনো পড়াশুনা শেষ করেনি”

জান্নাত বেগম এক হাত উচু করে বলেন,,”বউমা তুমি থামো। আমি যাকে প্রশ্ন করেছি সেই উত্তর দিবে।”

জারিফ ভদ্রবে বলে,,” জ্বী না।আসলে বিয়ে করি নাই।”

রাজিয়া সুলতানা তাড়া দিয়ে বলে,,তুমি ভেতরে যাও।কারন উনি জানেন ওনার শ্বাশুড়ির কাজই অদ্ভুত কথা বার্তা বলে মানুষ কে অস্বস্তিতে ফেলা।

এই যে রাজিয়া সুলতানা জান্নাত বেগমের কথার মাঝেই জারিফকে ভেতরে যেতে বললেন,এতে করে জান্নাত বেগম মনে মনে চরম ক্ষিপ্ত হন নিজের বউমার উপর।ওনার মোটেও পছন্দ হয়না ওনার উপর দিয়ে কেউ কথা বলুক।বড় বউমা কে নাম ধরে ডাকলে এখনো শ্বাশুড়ির ভ’য়ে তরতর করে কাঁপতে থাকে।নাতি নাতনিরাও খুব ভ’য় করে চলে ওনাকে।উনি শুধু মন মতো পেরে উঠেন না এই মেঝো ছেলের বউয়ের সাথে আর তার মেয়ের সাথে।মা মেয়ে সমান মাঝে মঝেই ভেটো প্রয়োগ করে ওনার কথায়।

জারিফ স্টাডি রুমে গিয়ে একটা টেবিলের দুইপাশে দুইটা চেয়ার দেখতে পায়,একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে।

লিয়া গিয়ে জড়তা নিয়ে বলে,,আ আসসালামুয়ালাইকুম,স্যার।

“সালামের উত্তর দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লিয়া কে দেখে জারিফ চারশো আশি ভোল্টেজের শকড খায়।সেদিন কোচিং এর কথা মনে উঠতেই এক গাদা অস্বস্তি ঝেকে বসে জারিফের মাঝে। জারিফ বিড়বিড় করে বলে,, ওহ্ গড!এখানে এসে তো একের পর এক সারপ্রাইজড হয়ে যাচ্ছি আমি। প্রথমে বৃদ্ধ মহিলা এখন আবার সেই মেয়ে।”

লিয়া হালকা হেসে চেয়ার টেনে জারিফের সামনে বসে বলে,,”স্যার আমার দাদিমনির কথায় কিছু মনে করেননি তো?”

জারিফ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলে,,”এই মেয়েও যে ওর দাদির মতো তা ওর প্রশ্ন শুনেই বুঝতে পারছি।”

“স্যার আপনি মন খা’রাপ করবেন না।আর আপনি চাইলেই খুব দ্রুতই সব কিছু হবে।”

“জারিফ কপাল কুঁচকে বলে,হোয়াট?স সব কিছু মানে?”

“আপনার তো দেখছি খুব ভুলো মন।এই ভুলে যাওয়া মন নিয়ে আমাকে পড়াবেন কি করে? আচ্ছা সমস্যা নেই আমি ক্লিয়ার করে বলছি,আমার দাদিমনি আপনার বউ বাচ্চার কথা বললো না।এখন নেই তো কি হয়েছে। ভবিষ্যতে হবে তো।”

জারিফ ফোঁস নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,” এমনিতেই অনেক টাইম ওয়েস্ট হয়েছে,সো ফাস্ট আপনি বই বের করুন।”

লিয়া মনে মনে আওড়ায়,,কি মানুষরে বাবা প্রথম দিন কোথায় একটু নাম পরিচয়,কিছু আলাপ করে পড়া শুরু করবে তা না করেই প্রথম ওয়ার্ডই বই বের করুন। ওহ্হ!আবার আপনি করে বলছে স্টুডেন্ট কে কেও আপনি করে বলে নাকি?লিয়া তোর তো কপাল খারাপ রে।তুই মনে হয় ভুল মানুষের উপর ক্রাশড হয়েছিস।পুরাই মনে হয় ইরিটেটিং পার্সন হবে মে বি।

জারিফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,,”শুনতে পাননি কি বললাম, ওপেন দ্যা বুক।”

লিয়া লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে বলে,,”স্যার আপনি আমাকে আপনি করে না বলে তুমি করে বলতে পারেন।”

“আমি আপনি করে সম্মোধন করাতেই কমফোর্টেবল ফিল করছি।”

জারিফ প্রথম দিন ভেক্টর দিয়েই শুরু করেছে।ভেক্টর অংক করছিলো আর লিয়াকে বুঝাচ্ছে।লিয়া একদৃষ্টে জারিফের দিকে তাকিয়ে আছে।জারিফ গ্রামীণ চেকের শার্ট পড়েছে, শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। ব্লু জিন্স পড়েছে।লিয়ার কাছে মনে হচ্ছে,পুরাই যেনো কিউটের ডিব্বা তার সামনে বসে আছে।লিয়া নিজেকে স্বাভাবিক রেখে অবশেষে পড়ায় ফোকাস করে।

প্রায় ফোর্টি ফাইভ মিনিটস পর রাজিয়া সুলতানা নাস্তা নিয়ে আসেন।হাতের ট্রে টা টেবিলের একপাশে রেখে লিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,পড়ানো শেষ হলে নাস্তাটা জারিফ কে দিও।তারপর উনি রুম থেকে বের হয়ে যায়।

পড়ানো শেষে জারিফ চেয়ার থেকে উঠতে নিলে লিয়া বলে,,”স্যার নাস্তা করে যান।”

“এখন সময় নেই অন্যদিন করবো।”

লিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”আপনি না খেয়ে গেলে আম্মু আমাকে ব’কবে।বলবে আমি হয়তো কোনো বে’য়াদবি করেছি তাই আপনি রা’গ করে খাননি।”

জারিফ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নড়েচড়ে বসে।লিয়া ট্রে থেকে একটা পায়েসের বাটি জারিফের দিকে বাড়িয়ে দেয়।আর একটা বাটি নিজে নিয়ে খেতে থাকে।আর আড়চোখে জারিফ কে দেখতে থাকে।লিয়ার সামনে খেতে জারিফের খুব অস্বস্তি ফিল হয়।কয়েক চামুচ মুখে দিয়ে তারপর ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে যেতে থাকে।

“লিয়া ওর হাতের বাটিটা টেবিলের উপর নামিয়ে মৃদু আওয়াজে গাইতে থাকে,,হতাম যদি তোর শার্টের ঐ বোতাম,,মনের কোণে দুষ্টু উঁকি দিতাম।তোর ঠোঁটের টাস, সুইট ভেরি মাচ।পা’গল আমি অলরেডি।

“জারিফ দরজা পর্যন্ত গিয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে তাকায়।লিয়া ভাবতে পারিনি জারিফের কান পর্যন্ত পৌছেবে।

লিয়া দাঁত কেলিয়ে মাথা চুলকিয়ে বলে,,”গানটা আমার খুব ভালো লাগে তো,তাই হঠাৎ করেই গেয়ে ফেলি।”

জারিফ লম্বা শ্বাস নিয়ে টানা পা ফেলে বের হয়ে যায় আর মনে মনে বলে,,একদম রং যায়গায় আসা হয়েছে, নো ডাউট…

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, রেসপন্স করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here