ফিরে_আসা২ ২৩ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
497

#ফিরে_আসা২
২৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

স্ক্রিপ্টের দিকে চোখদুটো আটকে আছে আরশাদের। তবে মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য চিন্তা। চিন্তাগুলো কেবলই অরাকে ঘিরে। আজ ভোর বেলা অরা রওনা করেছে কালিয়াকৈরের শুটিং সেটের উদ্দেশ্যে। অরা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হতে লাগলো, বিশাল ভুল হয়ে গেছে। মেয়েটাকে একা ছেড়ে দেওয়া তার মোটেও উচিত হয়নি। ঝোঁকের মাথায় এত বড় একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে নিয়ে নিলো সে?

নিজেকে যথেষ্ট প্রাক্টিকাল মানুষ বলে মনে করে আরশাদ। আবেগের বশে বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার মতো মানুষ সে নয়। তবে কেন অরার গোমড়া মুখ দেখে গলে গিয়ে এই ভুল সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল সে?

আরশাদের পরবর্তী সিনেমার শুটিং চলছে আজ। সিনেমার নাম এখনো ঠিক হয়নি। শুটিং বেশ অনেক দূরেই এগিয়ে গেছে। প্রথম থেকেই এই সিনেমায় নিজের অভিনয় নিয়ে মনোযোগী ছিল আরশাদ। তবে আজ কিছুতেই শুটিংয়ে মন বসাতে পারছে না। প্রতি মুহূর্তে নিজের নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে অনুতাপ জাগছে তার মধ্যে।

মেয়েদেরকে আজকাল থামিয়ে রাখার উপায় নেই। যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন, তারা সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রেগন্যান্সি তাদের চলার পথে কোনো বাঁধা নয়। প্রেগন্যান্সি তো আর অস্বাভাবিকতা নয়। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার কারণে জীবনটাকে অস্বাভাবিক করে ফেলার তো কোনো অর্থ নেই।

তবে অরা অন্যদের মতো নয়। অরা তো অরাই। শুটিংয়ের প্রয়োজনে পরিচালক যদি তাকে আরও কয়েকদিন থেকে যেতে অনুরোধ করে, তবে না বলতে পারবে না সে। ওখানে একদিনের বেশি থাকার অরার ওপরে আরও বেশি ধকল যাওয়া। মেয়েটা তো একটুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে! এত ধকল সামলাবে কী করে?

আরশাদের মনের মধ্যে তীব্রভাবে খচকচ করছে। কাজে তো মন বসছেই না, অরাকে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে সে ভাবতেও পারছে না। নিজেকে নিজেই বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে আরশাদ। একটা মানুষ যখন নিজেকে বুঝতে পারে না, তার থেকে বেশি অসহায় তখন আর কেউই হতে পারে না। আচ্ছা? আরশাদ কি শুধু শুধুই অরাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে? কিন্তু কেন? শুধু শুধু তো কেউ আর দুশ্চিন্তা করতে পারে না।

হঠাৎ আরশাদের মনে পড়ে গেল গত মাসের একটা ঘটনা। বহু বছর পর আরশাদ গিয়েছিল তার স্কুলের পুনর্মিলনীতে। তার স্কুল প্রতি বছরই এই উৎসবটা পালন করে থাকে। এসএসসি পাশ করার পর আরশাদ মাত্র দুবার গিয়েছিল ওই অনুষ্ঠানে। তাও আবার সুপারস্টারে পরিণত হওয়ার আগে।

এবার কেন যেন তার ইচ্ছে হলো, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আবারও দেখা করতে। আরশাদ আসছে বলে এবারের পুনর্মিলনী আরও জাকজমকভাবে আয়োজন করা হয়। পুরনো অনেক বন্ধুদের সঙ্গেই দেখা হয় সেখানে।

সেসব পুরনো বন্ধুদের মধ্যে একজন রাশেদ। আরশাদের সঙ্গে তার সেই ক্লাস ওয়ান থেকে বন্ধুত্ব। নওশীনের সঙ্গে আরশাদের ডিভোর্সের সময় রাশেদ তার পাশে ছিল। যে কয় বার আরশাদকে কোর্টে যেতে হয়েছে প্রত্যেকবারই রাশেদ গিয়েছিল তার সঙ্গে।

ডিভোর্সের সময়ে যেহেতু আরশাদের খুব কাছাকাছি সে ছিল, ডিভোর্সের কারণটাও তাই তার অজানা নয়। ওই ঘটনার পর বহুদিন রাশেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। মাঝে কেটে গেল কতগুলো বছর। ভেঙে চুরমার হয়ে পড়া জীবনটাকে নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছে আরশাদ।

বহুদিন পর দেখা করে আড্ডায় মেতে ওঠে দুই বন্ধু। আড্ডার এক পর্যায়ে রাশেদ গম্ভীর মুখে বলে ওঠে, “বিয়ে করে ভালোই করেছিস। তবে আবারও মেয়েমানুষকে বিশ্বাস করতে পারবি তো?”

কথাটাকে একেবারেই গায়ে মাখে না আরশাদ, কৌশলে এড়িয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যেই ওই কথাটা ভাবিয়ে তোলে তাকে। অরাকে অবিশ্বাস করার চিন্তা কোনোদিনও তার মাথায় আসেনি। সব মেয়ে তো আর নওশীন নয়।

নওশীন তার বিশ্বাস ভাঙার পর পৃথিবীর সব মেয়েদেরকে একই রকম মনে হতো আরশাদের কাছে। যাদের কাছে ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে যারা সব করতে পারে। সেই আরশাদের চিন্তাধারা এত দ্রুত বদলে গেল কী করে? কী করে অরার ওপরে জন্মালো এতটা অগাধ বিশ্বাস।

অরার শুটিং সেটে যাওয়া তাকে এত ভাবাচ্ছে কেন? সে কি কোনো কারণে অরাকে অবিশ্বাস করছে?

“স্যার! শট রেডি।”

এলোমেলো ভাবনাগুলো থেকে বেরিয়ে এলো আরশাদ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরেরকে ইশারায় “আসছি” বলতেই বেরিয়ে গেল সে।

লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো আরশাদ। শুধু শুধু এতক্ষণ দুশ্চিন্তা করছিল সে। নিজেকে বুঝতে না পারার কারণেই এমনটা হচ্ছে। অরাকে সে অবিশ্বাস করতে যাবে কেন? যে মানুষটাকে নিজের থেকেও সে বেশি ভালোবাসে, তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তার মধ্যে যা কাজ করছে, তা কেবলই উদ্বেগ। মেয়েটার প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই তাকে নিয়ে একটু বেশি উদ্বিগ্ন থাকে আরশাদ। দুশ্চিন্তাকে দূরে সরে সেটের দিকে পা বাড়ালো সে।

তিন ঘন্টা যাবত গাড়ি চলছে রাজপথের বুকে। গাড়ি কেবল গাজীপুর পাড় হলো। এখনো বেশ অনেকটা সময় লাগবে। সব দোষ রাস্তার অসহনীয় যানজটের। যানজট না থাকলে তিন ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় কালিয়াকৈরে।

পেছনের সিটে বন্ধ জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আলস্যের ভঙ্গিতে বসে আছে অরা। কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভাঙলো তার। আরশাদকে দেওয়া কথা অনুযায়ী পুরোটা পথ সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। তাই তেমন একটা ক্লান্তি বোধ হচ্ছে না।

অরার পাশের সিটেই উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বসে আছেন ডক্টর নাসরিন। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে, অথবা শুটিং সেটের ক্লান্তিময় পরিস্থিতিতে অরা যদি অসুস্থ হয়ে পড়তেই পারে। তাই সতর্কতা হিসেবে আরশাদ তার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে ডক্টর নাসরিন। নাসরিন ব্যস্ত মানুষ, দিনে হাজারটা রোগী সামলাতে হয় তাকে। অরা ভেবেছিল হয়তো সে সময় করে উঠতে পারবে না। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল, শুটিং সেটে আসা নিয়ে তার আগ্রহই সবথেকে বেশি।

গাড়ি অবশেষে এসে থামলো ‘রজনী’র পেছনে। যে হোটেলে এই সিনেমার অভিনয়শিল্পী, পরিচালক এবং কলাকুশলীরা অবস্থান করছে, তার নামই রজনী। রজনী থেকে মিনিট কয়েক দূরেই ওই গ্রামের সেট বানানো হয়েছিল। ওই সেট এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নয়। তবে মূল শুটিং হবে সেই ধ্বংসস্তূপের মাঝেই। শুটিং আটকে আছে অনশনরত মানুষগুলোর কারণে। যাদের বাড়িঘর পুড়ে গেছে তারা রজনীর মূল দরজার সামনেই চাদর বিছিয়ে অনশনে বসেছে।

অরার গাড়ির পেছনে আরও দুটো গাড়ি থামলো। কে ফিল্মসের প্রোডাকশন টিম এবং ম্যানেজমেন্ট টিমের বিভিন্ন সদস্যরাও এসেছে তার সঙ্গে। গাড়ির বাইরে সিনেমার পরিচালকসহ অন্যান্য সকলে এসে ভীড় করেছে। শুটিং সেটে বরাবরই প্রযোজকদের একটু বাড়তি খাতির করা হয়। আর সেখানে যদি, প্রযোজক নিজেই শুটিং সেটের কোনো একটা সমস্যার সমাধান করতে আসে তাহলে তো কথাই নেই।

গাড়ির দরজা খুলে বাইরে পা রাখতেই সকলে “ম্যাম! ম্যাম!” করে অতিষ্ট করে তুলল তাকে।

অরা এই সিনেমার পরিচালক সাইদ সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “কী অবস্থা সাইদ ভাই?”

সাইদ সাহেব শুকনো গলায় বললেন, “খুবই ডেঞ্জারাস অবস্থা আপু। এরা যা শুরু করেছে, আমরা রীতিমত আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।”

“কেন? কী করেছে?”

সাইদ সাহেব আতঙ্কিত স্বরে বললেন, “রাত-বিরেতে হোটেলের জানালায় ঢিল ছুঁড়ে মারছে। ভয়ে থাকি কখন গায়ে ঢিল এসে পড়ে। এই পর্যন্ত সাতটা জানালার কাঁচ ভেঙেছে ওরা।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আপনি কথা বলেছেন ওদের সঙ্গে?”

“চেষ্টা করেছি আপু, কোনো কথাই তো শুনতে চাচ্ছে না। এদের একটাই দাবি, নতুন ঘর তুলে দিতে হবে। না হলে অনশন বন্ধ করবে না। এদিকে আবার আর্টিস্টরাও প্রচন্ড জ্বালাচ্ছে। তারা না-কি আর থাকতে পারবে না, অন্য জায়গায় ডেট দেওয়া আছে।”

অরা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আর্টিস্টদের সমস্যাটা তো এখন মুখ্য নয়। আগে এই সমস্যার সমাধান করি।”

অনশনরত মানুষগুলো হোটেল থেকে কাউকে বের হতে দিচ্ছে না। কেউ বের হওয়ার চেষ্টা করলেই তাদের আক্রমণ করা হয়। এমনকি পেছনের দরজা দিয়ে কেউ বের হলেও ছুটে আসছে তারা। আপাতত অরার বডিগার্ডরা তাদের সামলাচ্ছে। তাই হোটেলের সবাই বের হবার সাহস করে উঠতে পেরেছে।

অরা বলল, “কোথায় ওরা?”

সাইদ সাহেব বললেন, “সামনের দিকে আপু।”

“চলুন যাই তাদের কাছে।”

সাইদ সাহেব ইতস্তত করে বললেন, “আপনি আপু আগে একটু রেস্ট নিয়ে নিলে ভালো হতো না? এতটা পথ জার্নি করে এসেছেন।”

অরা ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “যে কাজটা করতে এসেছি, সেটা আগে করি। রেস্ট তো পরেও নেওয়া যাবে।”

হোটেলের সামনে দিকে এগিয়ে যায় অরা। তার পিছু নিলো পরিচালক, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, প্রোডাকশনের লোকজনসহ তার সঙ্গে আসা টিমের মেম্বাররা।

হোটেলের সামনে দুটো বড় বড় রঙ চটা চাদর বিছিয়ে রাখা। তার ওপরে বসে আছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। মাঝ-বয়সী নারী-পুরুষ, ছোট ছোট বাচ্চা, বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধা। গ্রামের দিকে এই সময়েই শীতের আগমন ঘটে। তীব্র শীতে এরা দুদিন ধরে বাইরে দিনযাপন করছে। আর্দ্রতার অভাবে শুষ্ক হয়ে তাদের চেহারা তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। কারো কারো সঙ্গে দুয়েকটা পোটলা রয়েছে। সেই পোটলা জড়িয়ে ধরে শীত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত তারা।

অরা সেদিকে এগিয়ে যেতেই একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালো সকলে। উঠতে পারলেন না কেবল বয়সের ভারে ন্যুব্জ সেই বৃদ্ধা। সকলের চোখমুখে প্রবল বিস্ময়। আরশাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই অ্যাওয়ার্ড শো কিংবা ইন্টারভিউতে যেতে হয় অরা। সেই বদৌলতে তার পরিচিতিও নেহায়েত কম নয়। যে কারোর কাছেই তাকে এক পলক দেখায় চেনা চেনা লাগে।

অরা সেই বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তার দিকে ঝুঁকে হাসিমুখে বলল, “নানি, শীতের মধ্যে মাটিতে বসে আছেন কেন?”

নিতান্তই স্বাভাবিক প্রশ্ন। তবুও থতমত খেয়ে গেলেন বৃদ্ধা। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছেন। অরা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধার হাতদুটো নিঃসংকোচে তার হাতের মুঠোয় নিলো। হিমবাহের মতো শীতল বৃদ্ধার হাতদুটো।

অরার এমন কান্ডে অনশনরত মানুষগুলোর পাশাপাশি অবাক হলো সেটের সকলের। বড়লোকেরা তো গরীব মানুষের আশেপাশেই ঘেঁষতে চায় না। আর সেখানে অরা নির্দ্বিধায় এই দরিদ্র বৃদ্ধার হাত ধরছে?

বৃদ্ধা ভাঙা ভাঙা গলায় বিস্ময়ে সুরে বললেন,
“তোমারে যেন কই দেখছি মা?”

পেছনে অনশনরত দলের দুজনের ফিসফিস কথা শোনা গেল, “আরশাদ হকের বউ না?”

“হ সেইরকমই তো দেখায়!”

বৃদ্ধা পেছনে ঘুরে তাদের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে বললেন, “নায়ক আরশাদ?”

অনশনরত লোকটা জোর দিয়ে বলল, “হ, হ!”

অরা মনে মনে কথা গোছাচ্ছে। তাকে দেখেই হয়তো অনশনরতদের মন গলতে শুরু করেছে। তবুও নরম স্বরে কথা বলে পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।

অরার সঙ্গে আসা ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান রবিন সাহেব সকলের উদ্দেশ্যে থমথমে গলায় বললেন, “উনি আরশাদ স্যারের ওয়াইফ, আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”

অনশনে থাকা সকলের চোখেমুখে বিস্ময় স্থায়ী জায়গা করে নিলো। সঙ্গে হয়তো কিছুটা ভয়ও কাজ করছে। গরীব মানুষেরা স্বভাবতই শক্তিশালী কারোর মুখোমুখি হতে ভয় পায়।

তবুও বৃদ্ধা সাহস করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ম্যাডাম? এই শুটিংয়ের মানুষগুলা আফনের লোক?”

অরা আবারও হাসিমুখে বলল, “আমাকে ম্যাডাম ডাকতে হবে না নানি। আমার নাম অরা।”

আরেকদফা বিস্ময়ের প্রবল হাওয়া বয়ে গেল সকলের ওপর দিয়ে। এই মেয়েটা কি আদৌ আরশাদ হকের স্ত্রী? যে মেয়ে আরশাদ হকের মতো একজন সুপারস্টারের স্ত্রী, তার তো অহংকারে মাটিতে পাই পড়ার কথা নয়। আর সেই মেয়ে কিনা বলছে, “আমাকে ম্যাডাম ডাকতে হবে না।”

অরা বৃদ্ধাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনিও অনশন করছেন নানি?”

বৃদ্ধা এমনভাবে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন, যেন ছোট্ট বাচ্চা কোনো অপরাধ করতে গিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়েছে।

অরা কোমল স্বরে বলল, “এই বয়সে শীতের দিনে রাস্তায় বসে অনশন করাটা কি ঠিক নানি? আপনার অসুখ-বিসুখ বাঁধতে পারে না?”

বৃদ্ধা চুপ করে রইলো।

অরা পেছনে ঘুরে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “পানি দাও।”

সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে উঁচু স্বরে বলল, “এই প্রোডাকশন! পানি!”

মুহূর্তের মধ্যেই একজন প্রোডাকশন বয় পানির বোতল নিয়ে হাজির হলো। অরা যত্ন নিয়ে সেই পানির বোতল তুলে দিলো বৃদ্ধার মুখে। যাক, অনশনটা তো ভাঙা গেল!

অরা এবার অনশনরত অন্যান্য মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলল, “বলুন, আপনাদের সমস্যাটা আমাকে বলুন।”

ভীড়ের মধ্যে থেকে এক লোক কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “ম্যাডাম, শুটিংয়ের লোকজন আমাগো ঘরে আগুন দিসে। আমাগো বিছানা-পত্তর, হাঁড়ি-পাতিল সব পুইড়া গেছে। আমরা এহন কই যামু?”

আরেকজন লোক সাহস পেয়ে ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে বলল, “আমরা ম্যাডাম গরীব মানুষ। দিন আনি, দিন খাই। মাথার ওপর যদি ছাদটুকুন না থাকে, তাইলে যাই কই?”

অরা ভদ্রভাবে বলল, “একটা ভুল হয়ে গেছে। এজন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমরা কখনোই ইচ্ছা করে আপনাদের ঘরে আগুন দিতে চাইনি। ভুলে আগুন লেগে গেছে। আমার লোকজন তো আপনাদের ক্ষতিপূরণও দিতে চেয়েছে।”

লোকটা দুঃখিত গলায় বলে উঠলো, “আফনের লোকজনের ব্যবহার ভালো না ম্যাডাম। এমনভাবে ট্যাকা দিতে গেছে, যেন ভিক্ষা দিতেছে। আমরা কি ভিক্ষা চাইতে আসছি। আমাদের হকের টাকা এইডা।”

অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে অনুতাপমাখা স্বরে বলল, “তার জন্যেও আমি দুঃখিত। যারা আপনাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে, তাদের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।”

সকলে ব্যস্ত হয়ে বলল, “না, না ম্যাডাম। আফনের ক্ষমা চাওন লাগবো না।”

অরা মিষ্টি গলায় বলল, “আপনারা তো টাকা নেবেন না। আপনাদের দাবি আমরা যেন আপনাদের জন্যে নতুন ঘর বানিয়ে দিই? তাই তো?”

“জে ম্যাডাম। আমাগো ট্যাকা লাগবো না। আমাগো ঘর গেছে, আমরা ঘর চাই।”

“ঠিক আছে, আমি কথা দিচ্ছি আপনাদের ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে। আজ থেকে ঘর তৈরির কাজ শুরু হবে।”

সকলে আবারও একসঙ্গে বিস্মিত হয়ে উঠলো। যে ঘরের জন্যে এতকিছু, সেই ঘরটাই শেষমেশ পাচ্ছে তারা? আনন্দের প্রবল হাওয়া বয়ে গেল তাদের মাঝে।

অরা হাসিমুখে বলল, “আমার একটাই অনুরোধ, আমাদের শুটিং করতে দিন। ঘর বানাতে একটু তো সময় লাগবেই। ততটা দিন আপনারা এই হোটেলেই থাকবেন। কোনো সমস্যা হবে না আপনাদের। কিন্তু এতগুলো দিন শুটিং বন্ধ থাকলে সত্যিই আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।”

প্রস্তাবটা খারাপ নয়। চোখের সামনে নতুন করে তাদের বাড়ি তৈরি হবে। বাড়ি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তারা এই হোটেলেই থাকতে পারবে। কেবল শুটিং ইউনিটকে শুটিং করতে দিতে হবে। তাদের মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো না কোনো আপত্তি আছে।

তবুও অরা নিশ্চিত হয়ে নেওয়ার জন্যে বলল,
“রাজি আপনারা?”

“জে ম্যাডাম! আমরা রাজি!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here