ফিরে_আসা২ ৩২+৩৩ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
598

#ফিরে_আসা২
৩২+৩৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

গেস্টরুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চোখে কাজল পড়ছে অরা। গত কয়েক রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়ার কারণে চোখদুটো অস্বাভাবিকভাবে রুগ্ন লাগছে। কাল রাতেও যথেষ্ট ঘুম হলো না। আজ মিটিংয়ে বেশ কয়েকটা প্রজেক্ট প্রেজেন্ট করা হবে। সবগুলো প্রজেক্টই কে ফিল্মসের ভবিষ্যতকে ঘিরে। রাত একটা পর্যন্ত ল্যাপটপে সেই প্রজেক্টগুলো দেখছে অরা। কোনো ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে সাথে সাথে জানিয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট টিমকে। আজ মিটিং শুরু হবে দুপুর দুইটায়। তার আগে আগে নিশ্চয়ই ভুল-ভ্রান্তিগুলো শুধরে ফেলবে তারা।

প্রজেক্ট রিভিউ শেষে ক্লান্ত হয়ে কথার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে অরা। তবুও ঘুম নেমে আসে না দুটো চোখে। শারীরিক ক্লান্তিতে মানুষ ঘুমাতে পারে, কিন্তু মানসিক ক্লান্তিতে পারে না।

মনের কালো মেঘগুলো একটু একটু করে কাটতে শুরু করেছে। চিন্তা-ভাবনাগুলো আরও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সারা রাত জেগে অরা ভাবলো, তার সঙ্গে যা ঘটেছে তাতে তার দোষটা কোথায়? সে তো তার কাজ করতেই গিয়েছিল ঢাকার বাইরে। সন্দেহ করলো আরশাদ, তার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখলো আরশাদ, তাকে ওই বিশ্রী কথাগুলো বলল আরশাদ।

অরার জায়গায় অরা তো ঠিকই আছে। আরশাদ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের কথা সে কল্পনাতেও আনতে পারে না এবং এটাই সত্যি। তার সত্যি একমাত্র সে ছাড়া কারও জানা কথা নয়। কাউকে জানতেও হবে না। অরা নিজে জানে এটাই অনেক। আরশাদ তাকে সন্দেহ করছে, এতে তার তো কোনো দোষ নেই। এমনকি সন্দেহ করার মতো কোনো কাজও সে করেনি।

অরা দৃঢ়ভাবে ঠিক করেছে, সে আর কষ্ট পাবে না। আরশাদের বলা ওই কথাগুলোর জন্যে নিজেকে দোষারোপ করবে না, নিজেকে ঘৃণা করবে না। আরশাদ তাকে অবহেলা করছে বলে কষ্টে ভেঙেও পড়বে না। আজকের দুনিয়ায় একটা মেয়ের আত্মসম্মান না থাকলে, কঠিন বাস্তবতার সামনে টিকে থাকতে পারে সে। অরা নিজেকে সম্মান করবে। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানে হলো আরশাদের ওই বাজে কথাগুলোকে স্বীকার করে নেওয়া। কিন্তু না, অরা স্বীকার করবে কেন? সে তো কোনো দোষই করেনি।

অফিসের জন্যে তৈরি হয়ে গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে এলো অরা। কথা ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে।

অরা মেয়ের কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বলল, “তাড়াতাড়ি শেষ কর সোনা! স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”

কথা দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “তুমি ব্রেকফাস্ট করবে না অরা?”

গর্বের হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। মেয়েটা ছোট হলে কী হবে, বড়দের নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই।

অরা কথার গাল টিপে দিয়ে বলল, “আমি অফিসে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো। কথা শোন, আজ কিন্তু আমি তোকে স্কুল থেকে পিক করতে যাবো না। পায়েল আন্টি যাবে। লক্ষ্মী মেয়ের মতো তার সাথে চলে আসবি।”

কথা হতাশ গলায় বলল, “তুমি যাবে না কেন?”

“আমার যে আজ অফিসে একটু জরুরি কাজ আছে সোনা। কাল থেকে আবারও পিক করতে যাবো, প্রমিজ!”

কথা হুমকির ভঙ্গিতে বলল, “মনে থাকে যেন!”

অরা মিষ্টি একটা হাসি তার দিকে নিক্ষেপ করে বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে ডাকলো, “পায়েল?”

কথার গভর্নেন্স পায়েল বসার ঘর থেকে ছুটে এসে বলল, “জি ম্যাম?”

“কথাকে সাবধানে নিয়ে আসবে। ড্রাইভারকে বলা আছে, ঠিক সময়মতো বাড়িতে চলে আসবে।”

পায়েল তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ম্যাম।”

পায়েল চলে যেতেই আনমনে অরা তাকালো দোতলায় আরশাদের ঘরের দিকে। যে ঘরটা কিছুদিন আগেও তাদের দুজনের ছিল, আজ সেটা আরশাদের একার। ঘরের দরজা বন্ধ, হয়তো এখনো ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশাদের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল অরা। ভাববে না সে আরশাদকে নিয়ে। রাগ আরশাদ হক একাই করতে পারে না। এবার সে দেখবে অরার রাগ কতটা প্রখর হতে পারে।

কথাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল অরা। আরশাদ এখনো ঘুমাচ্ছে না, এখনো জেগে রয়েছে। সারা রাত সে ঘুমায়নি। গত রাত থেকে যে কতগুলো সিগারেট খেয়েছে তার কোনোই হিসাব নেই। আরশাদের হাতে এখনো জ্বলন্ত সিগারেট। সে বসে আছে ঘরের পূর্ব দিকে থাকা বিশাল সাদা সোফাটার ওপরে। ঘরের বাতিগুলো সব নেভানো। ভারী পর্দাগুলোও টেনে রাখা। পর্দার ফাঁক-ফোকর দিয়ে আলো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ঘরে। আলোর স্বল্পতাই তো স্বাভাবিক, ঘরটা যে ভরে গেছে অরার সঙ্গে তার করা দুর্ব্যবহারের ছায়ায়।

আবারও সিগারেটে লম্বা একটা টান দিলো আরশাদ। ধোঁয়া ছাড়তেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ধোঁয়াগুলো যেন আরশাদের চিন্তা-ভাবনার প্রতিচ্ছবি। অস্পষ্ট, ঘোলাটে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে বুকের ওপরে কেউ ভারী পাথর চেপে ধরে রেখেছে। পাথর নয় অবশ্য। তার সন্দেহ, অরার প্রতি করা অন্যায়ের ভার এটি। আরশাদ এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না, এত বড় একটা ভুল সে করে ফেলেছে। সে তো সন্দেহ করতে চায়নি অরাকে। অতীতে বিশ্বাসঘাতকতা থেকে পাওয়া ট্রমা তার তার এই অহেতুক সন্দেহের আগুনে যেন ঘি ঢালার কাজ করেছে।

অরার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে আরশাদের। সেদিন তার বলা প্রতিটা শব্দই যেন একটু একটু করে ভেঙে ফেলে মেয়েটাকে। অরার চোখদুটোতে পরিষ্কার ফুটে উঠছিল তার ভেতরকার ব্যথা। জীবনে কোনদিন এতটা বিধ্বস্ত হতে দেখেনি সে মেয়েটাকে। অরাকে কিনা তার কারণেই শেষমেশ বিধ্বস্ত হতে হলো?

আরশাদ আঘাত করতে চায়নি অরাকে, কখনোই না। অতীতের মতো আবারও যন্ত্রণা পাবার আশঙ্কায় ডুবে গিয়েছিল সে। নিজেকে যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর ব্যাকুল চেষ্টায় কষ্ট দিয়ে ফেলল তার সবথেকে কাছের মানুষটাকে।

ঘরটার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে চোখ বুলালো আরশাদ। এই ঘরটাতেই তো অরার সঙ্গে তার কত সুখস্মৃতি। অরার জ্বর হলে তাকে বুকের মাঝে আগলে রাখা, দুজনে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে টিভিতে সিনেমা দেখা, নীরবতার মাঝে বৃষ্টির শব্দ শোনা – সবগুলো স্মৃতিই যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠলো চোখের সামনে। যে ঘরটাতে এক সময়ে স্বর্গসুখ খুঁজে পেত আরশাদ, সেই একই ঘরকে আজ মনে হচ্ছে একটি খাঁচা। যে খাঁচায় আরশাদ এবং তার যন্ত্রণাগুলো বন্দী। নিজের ভেতরকার অনুতাপে নিজেই একটু একটু করে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সে।

সিগারেট শেষ হয়ে গেছে তবুও শেষাংশটুকু দুই আঙ্গুলের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরলো আরশাদ। যে মানুষটার চোখদুটো সবসময় স্টারডমের চাকচিক্যে জ্বলজ্বল করে, তার চোখদুটো আজ ম্লান হয়ে আছে। যে অন্ধকার তাকে ভয়াবহভাবে ঘ্রাস করে রেখেছে, সেই অন্ধকার যেন ফুটে উঠছে ওই চোখদুটোর মাঝে।

তর্জনী কপালে চেপে ধরলো আরশাদ। যে জানে তার ডিপ্রেশন আছে। বহুদিন ধরেই আছে। আজকাল ডিপ্রেশন শব্দটা বড্ড সস্তা হয়ে গেছে। পান থেকে চুন খসলেই ব্যবহৃত হয় শব্দটি। যারা সত্যিকার অর্থে ডিপ্রেশনের শিকার হয়, শুধুমাত্র তারাই জানে এ ব্যাধি কতটা ভয়াবহ।

ডিপ্রেশন থেকে কখনো বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেনি আরশাদ। কারো কাছে সাহায্যও চায়নি। ভাবতো তার সমস্যা একান্তই তার। এই সমস্যাগুলোর সমাধান করার সাধ্য পৃথিবীতে আর কারো নেই। আসলে তো, আরশাদকে ডিপ্রেশন থেকে উদ্ধারের সাধ্য তার নিজেরও ছিল না। নিজের অজান্তেই এই ভয়াবহতা থেকে তাকে বাঁচিয়েছে অরা।অতীতে ডিপ্রেশন থেকে পাওয়া ট্রমার কারণে সেই অরার সঙ্গেই এতটা খারাপ আচরণ করে ফেলল আরশাদ?

ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। বিরক্ত ভঙ্গিতে সোফার সামনে থাকা টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা হাতে নিলো আরশাদ। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে তার ম্যানেজার অয়নের। কারও সঙ্গে কথা বলার মানসিকতায় আরশাদ নেই। কলটা তাই কেটে আবারও নতুন একটা সিগারেট ধরালো।

খানিকক্ষণ বাদে নোটিফিকেশনের শব্দ কানে ভেসে এলো। আরশাদের একবার ইচ্ছা হলো ফোনটাকে আছাড় মেরে ফেলে দিতে। পৃথিবীর সবগুলো মানুষকে কেন আজই তাকে বিরক্ত করতে হবে।

বিরক্ত হলেও কী যেন মনে করে ফোনটা হাতে নিলো আরশাদ। অয়ন ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, “স্যার আজকের মিটিং দুপুর দুইটায় শুরু হবে।”

সঙ্গে সঙ্গে আরশাদের মনে পড়ে গেল আজকের অ্যানুয়াল মিটিংয়ের কথা। মনের মাঝে বয়ে চলা এই জোরালো ঝড়ের ধাক্কায় সে তো ভুলেই গিয়েছিল আজ অফিসে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে। এই মিটিংয়ে তার সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আজ সে কতটুকু মনোযোগ দিতে পারবে তা নিয়ে অবশ্য অগাধ সংশয় রয়েছে।

অসুস্থতার অজুহাতে মিটিংটা ক্যান্সেল করতে ইচ্ছা করছে। সে যে একেবারে সুস্থ তা তো নয়। মানসিক অসুস্থতাও এক ধরনের অসুখ। মিটিংয়ে না যাওয়ার ইচ্ছাটাই তার মাঝে বেশি। মিটিংয়ে গেলেই তো অরার মুখোমুখি হতে হবে। অরার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর কোনপ্রকার সাহস কিংবা মনের জোর আরশাদের নেই।

তার তো উচিত এই মুহূর্তে অরার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া। সে চাইছেও তাই। তবে মন থেকে কোনপ্রকার জোর পাচ্ছে না। অরা কি পারবে কোনোদিন তাকে ক্ষমা করতে দিতে? নির্ঘাত পারবে না। হৃদয়টা অদ্ভুতভাবে মোচড় দিয়ে উঠলো। আচ্ছা তার প্রতি অরার সকল ভালোবাসা কি উধাও হয়ে গেছে? আরশাদ নিজেই দোষেই কি হারিয়ে ফেলল তার সবথেকে মূল্যবান জিনিসটা?

হাজারো দোনমনো শেষে অফিসে যাবে বলে ঠিক করলো আরশাদ। রূপকথার মতো এই জীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি যেহেতু সেই করেছে, তাই সবটা আগের মতো তাকেই করে তুলতে হবে। অরার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থেকে তা তো আর সম্ভব নয়।

হট শাওয়ার নিয়ে এসে অফিসের জন্যে তৈরি হলো আরশাদ। সাদা শার্ট, কালো জিন্স, কালো স্যুটে তাকে বরাবরের মতোই হ্যান্ডসাম লাগছে। নিখুঁত অভিনেতা বটে আরশাদ। নিজের ভেতরে ফুটতে থাকা আগ্নেয়গিরির লাভা সুকৌশলে গোপন করে রাখছে। তাকে দেখে যেন বোঝার উপায় নেই তার ভেতরে সব তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।

আরশাদ অফিসে পা রাখতেই একপ্রকার হইচই পড়ে গেল। অফিসের বস এসেছে বলে কথা। মেইন গেট থেকে লিফট পর্যন্ত বিভিন্ন টিমের স্টাফরা দাঁড়িয়ে আছে তাকে স্বাগত জানাবে বলে। বিরক্ত না হয়ে পারলো না আরশাদ। সে কি এই অফিসে প্রথমবারের মতো আসছে না-কি? যেই আরশাদের সামনে পড়ছে, সেই বিনীত ভঙ্গিতে বলছে, “Good Afternoon Sir.”

তারকারা চাইলেই সকলের চোখের আড়ালে চলে যেতে পারে না। সারা বছরই তাদের থাকতে হয় সাধারণ দর্শকের আগ্রহের কেন্দ্রে। মানুষের অ্যাটেনশন পেয়ে অভ্যস্ত আরশাদ। তবুও আজ সকলের অহেতুক এই অ্যাটেনশন অসহ্যকর লাগছে। ইচ্ছা করছে অদৃশ্য হয়ে যেতে।

ফাইন্যান্স টিমের প্রধান রিয়াজসহ অন্যান্য টিমের প্রধানরা এসেছে আরশাদকে রিসিভ করে নিতে। এও এক বিরক্তি। আরশাদ এই অফিসে কম আসে বলে কী অফিসটা তার কাছে অজানা? সে খুব ভালো করেই জানে মিটিং হল কোথায়। তাকে আবার রিসিভ করে নিয়ে যেতে হবে কেন?

পাঁচতলায় অফিসের বিশাল মিটিং রুম। কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ মিটিংগুলো এখানেই হয়ে থাকে। ঘরটির একটি দেয়ালজুড়ে প্রকান্ড চৌষট্টি ইঞ্চির টিভি। মিটিংয়ের প্রজেক্টগুলো এই টিভিতেই প্রদর্শন করা হয়। ঘরের পুরোটা জুড়েই বিশাল টেবিল এবং আঠারোটি চেয়ার একের পর এক সাজানো। ঘরের ওপরের দেয়ালে চমৎকার আলোকসজ্জা।

ঘরের ভেতরে পা রাখতেই শীতল হাওয়া বয়ে গেল আরশাদের গা বেয়ে। টিভির সবথেকে কাছাকাছি চেয়ারটায় বসে আছে অরা। বরাবরই মতোই অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। এই শাড়িতে একরকম ভালো লাগে আবাদ এখন সাদা শার্ট, হালকা মেরুন স্যুট আর কালো লেগিংসে আরেক রকম ভালো লাগছে। তবে অরা যেন অদৃশ্য এক চাদরে নিজেকে আড়াল করে রেখেছ। তার চোখদুটো আটকে সমানে থাকা ল্যাপটপে দিকে। আরশাদের উপস্থিতি কি সে টের পাচ্ছে না? পাচ্ছে তো বটেই। মিটিং রুমে উপস্থিত সকলেই তাকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অথচ কারও সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, কারোর প্রশ্নেরই জবাব দিতে ইচ্ছা করছে না। আরশাদ চাইছে, শুধুমাত্র একবার, এক মুহূর্তের জন্যে অরা চোখ তুলে তাকাক তার দিকে। কিন্তু অরা তাকালো না। আগের মতোই দৃষ্টি আটকে রাখলে ল্যাপটপে।

আরশাদ গিয়ে বসলো অরার মুখোমুখি থাকা চেয়ারে। এমন না যে সে ইচ্ছা করে, অরার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে করলো এমনটা। অফিসে যেকোনো মিটিংয়ে অরার মুখোমুখি বসাটাই তার অভ্যাস। মানুষ কি চাইলেই তার অভ্যাস ছেড়ে দিতে পারে?

অরা ঠিকই তার অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছে। যে অরা কদিন আগেও আরশাদের থেকে চোখ সরাতে পারতো না, সেই অরাই আজ এক পলকের জন্যে দেখতে চাইছে না তাকে। রূপকথার মতো জীবনটাকে নিজ হাতে ভেঙে চুরমার করে ফেলল আরশাদ। যে অসহনীয় কষ্ট সে অরাকে দিয়েছে, সেই একই কষ্টে নিজেকে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে আরশাদের। আচ্ছা, অরা কি তাকে ঘৃণা করে?

মিটিং শুরু হলো। প্রথম এক ঘন্টা কাটলো ফাইল-পত্র ঘেঁটে। ফাইন্যান্স হেড রিয়াজ টিভিতে তার তৈরি করা প্রজেক্টের মাধ্যমে এ বছরের ফাইনাল রিপোর্টটা বিশ্লেষণ করছে। আরশাদ বারবার চেষ্টা করছে তার কথাগুলোতে মন দিতে। কিছুতেই পারছে না। তার চোখদুটো বারবার ফিরে যাচ্ছে অরার দিকে। এখনো তার দিকে একটাবার তাকায়নি অরা, আড়চোখেও না। অরা মন দিয়ে প্রজেক্ট দেখছে। তার চোখদুটোর মাঝে বিচিত্র এক কঠোরতা। যে কঠোরতা অন্য কারো চোখে না পড়লেও, এড়িয়ে যায়নি আরশাদের চোখ।

অরাকে দেখার মাঝে এতটাই ডুবে ছিল সে প্রজেক্টের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশে সে মনযোগ দিতে পারেনি।

রিয়াজের প্রেজেন্টেশনের মাঝে আরশাদ হঠাৎ বাঁধা সৃষ্টি করে বলল, “Sorry, can you repeat that?”

আরশাদ বেশ টের পাচ্ছে এই মিটিং হলে থাকা সবগুলো চোখ কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও তার দিকে পড়েছে। সেসব চোখের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই তার। তার ভেতরটায় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে অরাও তার দিকে তাকালো। কতক্ষণের জন্যে হবে? এক সেকেন্ডের জন্যে? কিংবা হয়তো তার থেকেও সময়ের জন্যে।

অরার আকস্মিক দৃষ্টিপাতে একেবারেই খুশি হতে পারলো না আরশাদ। কারণ এই দৃষ্টি বিরক্তি এবং ঘৃণায় পরিপূর্ণ। অস্বাভাবিকভাবে
ধরফর করে আরশাদের হৃদয়টা। রিয়াজ বলা কথাগুলো এবারও তার মনোযোগ এড়িয়ে গেল।

আরশাদ প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলে, স্বাভাবিক রেখে মিটিংয়ে মনোযোগ দিতে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। তার সকল মনোযোগ আটকে আছে তার বিপরীতে বসে থাকা মানুষটার দিকে। অরার অবহেলা একেবারেই অসহনীয় বলে মনে হচ্ছে তার কাছে।

রিয়াজের প্রেজেন্টেশন শেষ হতেই শুরু হলো ক্রিয়েটিভ টিমের প্রেজেন্টেশন। ক্রিয়েটিভ টিমের হেড যুথী তার প্রজেক্টের মাধ্যমে নতুন বছরে কোম্পানির যে ধরনের সিনেমায় বিনিয়োগ করা উচিত, তার প্রস্তাবনা দিচ্ছে।

সোশ্যাল ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে সিনেমা আমাদের দেশে নির্মাণ করা হয় না বললেই চলে। সোশ্যাল ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে যে সিনেমাগুলো তৈরি করা হয় তার সবগুলোর মধ্যেই সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এসব সিনেমায় অনেকগুলো চরিত্র থাকে, সমাজকে বদলে দেওয়ার মতো একটা চিত্রনাট্য থাকে এবং সিনেমার শেষে প্রভাবশালী একটি বার্তা থাকে। কে ফিল্ম নতুন বছরে এ ধরনের সিনেমায় বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। প্রাথমিক একটা বাজেটও পেশ করা হলো।

যুথী বাজেটটা অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ম্যাম, আপনি স্যারকে বাজেটটা বুঝিয়ে বলুন প্লিজ।”

অরার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে কথা বলতে হবে বলে সে ভীষণ বিরক্ত। আরশাদকে উদ্দেশ্য করে কোনো কথা বলার আগ্রহই তার নেই। অরার এই প্রতিক্রিয়া আরশাদের হৃদয়ে জ্বলতে থাকা আগুনকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দিলো।

অরা বাজেটের কাগজটায় একবার চোখ বুলিয়ে শীতল গলায় বলল, “আমরা লম্বা সময়ের জন্যে এই প্রজেক্টটা শুরু করতে চাচ্ছি। আগামী দুই থেকে তিন বছরে কে ফিল্মস পাঁচটা সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে নির্মিত সিনেমা রিলিজ করবে। এই পাঁচটা সিনেমারই শুটিং নতুন বছরের বিভিন্ন সময়ে শুরু হবে। প্রাইমারি বাজেট হিসেবে আমরা ধরেছি আট কোটি টাকা। প্রজেক্টটা পাশ হলে আমাদের প্রোডাকশন টিম আরও বিস্তারিতভাবে বাজেট তৈরি করবে।”

যন্ত্রের মতো কথাগুলো বলে গেল অরা। একফোঁটাও অনুভূতি নেই তার কণ্ঠস্বরে। চোখদুটোতেও একরাশ যান্ত্রিকতা। তবুও ভেতরে ভেতরে যে আগুন আরশাদকে জ্বালিয়ে ছারখার করছিল, অরার কণ্ঠের শীতলতা সেই আগুনকে রুখতে সফল হলো।

আচমকাই স্বস্তি অনুভব হচ্ছে আরশাদের মাঝে। কারণ সেও এখন অরাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে পারবে, অরাও বিরক্তি নিয়ে হলেও তার কথাগুলো শুনবে।

আরশাদ কম্পিত স্বরে বলল, “পাঁচটা সিনেমার জন্য আট কোটি?”

অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, প্রত্যেকটা সিনেমার জন্যে প্রায় দেড় কোটি বাজেট ধরা হয়েছে।”

সোশ্যাল ইস্যুর সিনেমাগুলোতে খুব একটা খরচ হয় না। তাই বাজেটও মোটামুটি কম থাকে।

আরশাদ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আমার মনে হয় এই প্রজেক্টটা খুবই রিস্কি। সোশ্যাল ইস্যুর সিনেমা নিয়ে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দর্শক কীভাবে এ ধরনের সিনেমাগুলো গ্রহণ করবে সেটাও আমরা জানি না। শুরুতেই পাঁচটা সিনেমায় এত বড় একটা অ্যামাউন্ট ইনভেস্ট করা কতটা যৌক্তিক হবে?”

অরা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই প্রোডাকশন টিমের হেড সাদিক সাহেব বললেন, “অন্যান্য প্রোডাকশন হাউজ তো এ ধরনের সিনেমা করে অনেক লাভবান হচ্ছে স্যার।”

বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল আরশাদের। তার আর অরার কথোপকথনের মাঝে অন্য কেউ ব্যাঘাত ঘটাবে কেন? ওই সেই কথোপকথন যান্ত্রিক, প্রাণহীন – তবুও অরার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ তো হলো। যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি আরশাদ করেছে, তারপর রোজ রোজ এই সুযোগ আর পেয়ে ওঠা হবে না।

কণ্ঠে বিরক্তির রেশ রেখেই আরশাদ বলল, “অন্যান্য প্রোডাকশন হাউজের সঙ্গে আমরা নিজেদের তুলনা করবো কেন? তাছাড়া আমাদের আলাদা একটা অডিয়েন্স আছে, তাদের এ ধরনের সিনেমা যে পছন্দ হবে তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

অরা হয়তো মনে মনে একমত হলো আরশাদের সঙ্গে। কী যেন ভেবে সে বলল, “তাহলে আপাতত এই প্রজেক্টটা হোল্ডে রাখি। আমরা যেহেতু দর্শকদের জন্যে নতুন ধরনের সিনেমা তৈরি করতে চাচ্ছি, তাই আপাতত সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে একটা সিনেমা তৈরি করি। যদি ভালোভাবে দর্শকের সাড়া পাই, সিনেমাটা ব্যবসাসফল হয় তবেই এই প্রজেক্টটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা যাবে।”

অরার দিকে তাকিয়ে থেকে আরশাদ বলল, “হুঁ।”

মুখে “হুঁ।” বললেও মনে মনে অরার সঙ্গে আরও বেশি কথা বলতে চাইছে আরশাদ। অরাকে বোঝাতে চাইছে তার ভেতর দিয়ে কতটা প্রবল ঝর বয়ে যাচ্ছে। কতটা যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে তার। কতটা অসহায় লাগছে নিজেকে। আরশাদ সেসবের কিছুই বলতে পারলো না। অরার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা তার কাছে নেই। সে কি আসলেই ক্ষমার যোগ্য?

আরও কয়েক ঘন্টা চলল মিটিং। পুরোটা সময়ই কাজের বাইরে একটাও কথা বলেনি করা। কণ্ঠে সেই একই যান্ত্রিকতা ধরে রেখে কাজের কথা বলে গেল। মিটিং শেষ হলো অবশেষে। এ বছরের ফাইনাল রিপোর্ট বিশ্লেষণ ও পরবর্তী বছরের গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সোশ্যাল ইস্যুর প্রজেক্ট পাস না করলেও, অন্যান্য অনেকগুলো প্রজেক্টে সাইন করলো আরশাদ।

এক মুহুর্তও মিটিং হলে রইলো না অরা। সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ালো নিজের কেবিনের উদ্দেশ্যে। অরার এই অবহেলা আর এক সেকেন্ডের জন্যেও সহ্য হচ্ছে না। তার অবহেলা অরাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে, ঠিক ততটাই কষ্ট অরার অবহেলা তাকে দিচ্ছে। হয়তো এই কষ্টটাই তার প্রাপ্য।

কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে ফাইন্যান্স টিমের সঙ্গে প্রতি দুমাসে একবার মিটিং করে আরশাদ। সেই মিটিংয়ের জন্যেও আজকেই সময় দিয়েছে আরশাদ। অ্যানুয়াল মিটিং শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো সেই মিটিং। শেষ হতে হতে বেজে গেল সন্ধ্যা সাতটা।

আরশাদ আর অরা একসঙ্গে অফিসে এলে ফিরেও যায় একই সঙ্গে। এটা তাদের বহুদিনের পুরনো অলিখিত নিয়ম। আরশাদের অবচেতন মনের ছোট্ট এক অংশ আশা করেছিল, অরা হয়তো তার জন্যে অপেক্ষা করবে। একসঙ্গে ফিরে যাবে তারা। কিন্তু না, সে তো ভুলেই গিয়েছিল পরিস্থিতি আর আগে মতো নেই। আরশাদের কারণেই নেই।

মিটিং শেষে আরশাদ জানতে পারলো অরা বহু আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। আরেকদফা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল তার হৃদয়টা। আরশাদের ধারণাই ঠিক, অরা তাকে ঘৃণা করে। প্রবলভাবে, ঘৃণা করে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here